অঙ্ককে যারা বিদঘুটে আর বিচ্ছিরি বলে ভাবে, তাদের জন্য এবারের ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’। ইস্কুলের অঙ্ক, যেটা কেবল নিয়ম মেনে কিছু হিসেব কষা শেখায়, সেটাতে অঙ্কের পুরো চিত্র বা মজা কোনটাই পাওয়া যায় না। সত্যি বলতে কি মজা না পেলে সেই কাজ করতে মনও চায় না। এবারের বিজ্ঞান পত্রিকাতে অঙ্কের এমনি কিছু মজাদার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
আচ্ছা গোলাপ বা সূর্যমুখী ফুল কেমন লাগে তোমাদের? কোনারকের চাকা বা মন্দির কিম্বা নিদেন পক্ষে তাজমহল? মনের মধ্যে ছবিগুলো ফুটে উঠছে তো? এগুলো যে খুব সুন্দর সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আকৃতির দিক থেকে এদের সৌন্দর্যের সাথে অঙ্কের ওতপ্রোত যোগ রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল: গোলাপ বা সূর্যমুখী ফুলে আবার অঙ্ক এলো কোথা থেকে? ভাল প্রশ্ন। খুব ভাল করে যদি দেখ তাহলে বুঝতে পারবে ওদের পাপড়ির সজ্জারীতি অনেক সময় অঙ্ক মেনে সাজানো থাকে (নিখুঁত হ’লে এগুলি ফিবোনাচ্চি সিরিজ মেনে চলে, শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রে গাছের ডাল বা পাতার সজ্জারীতিও এই সিরিজ মেনে চলে)। তেমনই কোনারক বা তাজমহলও নিপুণ অঙ্কের স্বরূপ। অঙ্কের এই রূপটাই দেখতে পান গণিতজ্ঞরা। আর এক জন দেখতে পায়। সে হল ‘পটাশগড়ের জঙ্গলে’ অ্যালফাবেট সাহেবের কুটিরে অঙ্ক কষতে থাকা ছোট্ট ভুতু!
শুধু প্রকৃতিতে সংখ্যা নয়, সংখ্যারও মজার প্রকৃতি থাকতে পারে। গণিতজ্ঞরা এবং গণিত-উৎসাহীরা হঠাৎ-ই গণিতের একটা সম্পূর্ণ নতুন দিক আবিষ্কার করেন যখন এই প্রকৃতিগুলোর সম্মুখীন হন। আজ আমরা এমন একজন মানুষকে স্মরণ করবো যিনি প্রায় দিব্যচক্ষুতে সংখ্যার বিভিন্ন প্রকৃতি দেখতে পেতেন। গণিতের ইতিহাসে অজস্র প্রতিভার মাঝে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম শ্রীনিবাস রামানুজন। ওনার জীবনকাল ছিল সর্বসাকুল্যে ৩৩ বছর: জন্ম ২২শে ডিসেম্বর ১৮৮৭ অবিভক্ত ভারতের মাদ্রাজ প্রদেশের তাঞ্জোর জেলায় এবং মৃত্যু ২৬শে এপ্রিল ১৯২০। কিন্তু তার মধ্যেই উনি সাড়া জাগিয়েছিলেন গণিতের জগতে। দুটো স্বীকৃতির কথা বললেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে (১৯১৮) মাত্র ৩১ বছর বয়সে ‘রয়্যাল সোসাইটি’-র অন্যতম কনিষ্ঠ ‘ফেলো’ (সদস্য) নির্বাচিত হয় রামানুজন নামের যুবকটি। সেই বছর ১৩ই অক্টোবর প্রথম ভারতীয় হিসাবে তাঁকে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজের ‘ফেলো’ নির্বাচিত করা হয়।
১৯১৪ থেকে ১৯১৮, গোটা ইউরোপ তখন জ্বলছে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগুনে। সেই আবহাওয়ার মধ্যে রামানুজন ট্রিনিটি কলেজের হার্ডি নামক এক গণিতজ্ঞের সাথে পাড়ি জমিয়েছেন অঙ্কের ‘অসীম’ সমুদ্রে। সে এক অন্য জগত, যেখানে সংখ্যারা রূপ নেয় সমীকরণের, সমীকরণ দেখা দেয় ছবি হয়ে আর ছবিগুলো হয়ে ওঠে জীবন্ত। তবে প্রথাগত শিক্ষা ও সঠিক সময়ে সঠিক প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় তার ‘নোটবুক’-এ অনেক সময় যা দেখা যায়, তা আসলে পূর্ব আবিষ্কৃত কোনো সূত্র, যেমন অয়লার-এর সূত্র। অনেক সময় প্রমান ছাড়া সেই সূত্রগুলি তিনি লিপিবদ্ধ করতেন তাঁর নোটবুকে। কি ভাবে একজন গণিতজ্ঞ প্রশিক্ষণ ছাড়াই এই সূত্রগুলিতে উপনীত হয়েছিলেন, তা আজও পণ্ডিতদের মনে বিস্ময় জাগায়। ট্রিনিটি কলেজের আর এক সমসাময়িক গণিতজ্ঞ লিট্লউড-এর মতে, প্রত্যেক ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যার সঙ্গে রামানুজনের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল।
রামানুজনের আবিষ্কারের মর্ম তৎকালীন ভারতের গণিতজ্ঞরা বুঝতে পারবেন না, এটা তাঁর কাছের বন্ধুরা বুঝেছিলেন। বন্ধুদের কথাতে রামানুজন চিঠি লিখলেন তখনকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ জি. এইচ. হার্ডি-কে। ‘রতনে রতন চেনে’ বলেই হার্ডি নির্ভুল ভাবে রামানুজনের সেই নয় পাতার চিঠির মধ্যে একটা স্ফুলিঙ্গের আভাস অনুভব করেছিলেন। উনি রামানুজনের দেশ, ধর্ম বা প্রথাগত শিক্ষার অভাব-কে আমল দেননি। বরং তার ইংল্যান্ড-এ আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন যাতে একসাথে গবেষণা করতে পারেন। তারপর যা হয়েছিল, সেটা ইতিহাস। দুজনের যৌথ গবেষণার ফলে নাম্বার থিওরি, ম্যাথেমেটিক্যাল অ্যানালিসিস, ইত্যাদি গণিতের বিষয়ে অনেক বড় বড় ফলাফল খুব অল্প সময়ের মধ্যে বেরিয়েছিল।
রামানুজনের ৯৮ তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ওনাকে শ্রদ্ধা জানাতে ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র একাদশ সংখ্যা অঙ্কের লেখা দিয়ে সাজানো হয়েছে। রামানুজন-এর কিছু কাজের নমুনা নিয়ে আলোচনা আছে এবারের পত্রিকাতে। যেমন: ১+২+৩+৪+… , এই সিরিজ-টার যোগফল কি? দেখানো যায় যে একভাবে যোগ করলে যোগফলটা -১/১২। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? রামানুজনের এই সমাধানের আলোচনা আছে এখানে। আছে ১৭২৯ বা ‘ট্যাক্সি ক্যাব’ সংখ্যা খুঁজে পাবার ইতিহাস। আচ্ছা, ৩-কে কত ভাবে দুটো (বা তার বেশী) ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যার যোগফল হিসাবে লেখা যেতে পারে? ১+১+১, ১+২ আর ৩, অর্থাৎ তিন রকম ভাবে। অর্থাৎ তিনটে পার্টিশান বা ভাগ আছে। সেই রকম ৭ কে লেখা যায় ১৫ রকম ভাবে। এবার যদি বলি ২০০-কে কত রকম ভাবে লেখা যায়? মোটামুটি একমাস হাতেকলমে গবেষণা করে জানা গেছে ৪ ট্রিলিয়ন (৪,০০০,০০০,০০০,০০০) ভাবে। রামানুজন আর হার্ডি একটা সমীকরণ লিখেছিলেন যেটার সাহায্যে একটা সংখ্যার কতগুলো পার্টিশান হয়, সেটা আনুমানিক বা অ্যাপ্রক্সিমেট হিসেব করা যায়। সে কথাও আছে এই দুই মলাটের মাঝে। এমন আরও অনেক মজার মজার অঙ্ক আছে এবারের ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র একাদশ সংখ্যায়।
এছাড়াও আছে ‘বিজ্ঞান’ ওয়েবসাইট-এ পূর্বপ্রকাশিত অঙ্ক নিয়ে বাছাই কয়েকটি লেখা। যেমন, প্রাচীন ভারতের গণিতের ইতিহাস নিয়ে এক মনগ্রাহী আলোচনা করেছেন প্রফেসর এস জি দানি। বৈদিকযুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিভিন্ন গণিতজ্ঞদের অবদান ক্রমানুসারে লিপিবদ্ধ হয়েছে এই লেখাটিতে। বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে থেকে এই লেখা আমাদের পূর্বসুরিদের সম্পর্কে অতিরঞ্জিত গল্পগুলিকে প্রশ্ন করতে শেখায়।
অঙ্ক শিখতে গিয়ে প্রায় শুরুর দিকেই আমরা শিখি বিভাজ্যতার নিয়ম আর তার সাথেই সাথেই আসে মৌলিক সংখ্যা। পর পর কয়েকটা মৌলিক সংখ্যা বলতে বললে সহজেই পারবে: ২, ৩, ৫, ৭, ১১,…। কিন্তু এর শেষ কোথায় বা আদৌ শেষ আছে কিনা, সেটা বলা যায় কি? ‘মৌলিক সংখ্যার মৌলিকতা’ লেখাটিতে এই প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়া হয়েছে।
এরপর ধরা যাক একটা বিয়েবাড়ির কথা। কখনও ভেবে দেখেছ কমপক্ষে এমন ক’জন ব্যক্তি থাকতে পারে যাদের পরিচিতদের সংখ্যা সর্বদা সমান? দুজন, পাঁচজন, দশজন নাকি আরও বেশী? এই প্রশ্নটার একটা মজার উত্তর পাবে ‘পায়রার বাক্সে স্থান সঙ্কুলান সমস্যা’ লেখাটিতে। পরের বারে বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে এই প্রশ্ন করে একটা আসর মাত করে দিতে পারো কিন্তু।
এবার আসি একটা খেলার কথায়। ছেলেবেলায় অনেকে নুড়ি সরানোর খেলা খেলেছ হয়তো। সেই খেলাটার মধ্যেও একটা অঙ্ক লুকিয়ে আছে। যদি তুমি অঙ্কটা জেনে যাও তাহলে তক্ষুনি জেনে যাবে এই দানে কে জিতবে। খুব সহজ এই অঙ্কটা যদি শিখতে চাও তাহলে “নুড়ি সরানোর খেলা ও গোল্ডেন রেসিও” লেখাটি পড়তে হবে।
আর আছে একটা ধাঁধা। একটা ছোট্ট গল্পের (১২-১৪ লাইন) মধ্যে লুকিয়ে রাখা আছে একটা বিশাল সংখ্যার ১০১ পর্যন্ত মান। আমাদের বিশ্বাস একটু মন দিয়ে দেখলেই পেয়ে যাবে সংখ্যাটা। তাহলে আর কি, মাথাটা একটু ঘামাও। না পারলে শেষে উত্তর দেওয়া আছে, তবে চেষ্টা না করে উত্তর দেখোনা কিন্তু। কৌতূহল রাখার জন্য বলে রাখি এই উত্তরের সঙ্গে পাবে একটা মজাদার অঙ্কের ছড়া।
এবারের “জ্যামিতির গোড়ার কথা : ইউক্লিড থেকে রিমান” পর্বটা ইউক্লিড-এর বিখ্যাত পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধ নিয়ে: যার থেকে সমান্তরাল সরলরেখা বা প্যারালাল লাইন-এর ধারণাটা আসে। এটা কি সত্যিই স্বতঃসিদ্ধ, অর্থাৎ প্রমানের অপেক্ষা রাখে না? এটাও একটা ধাঁধা বৈকি!
‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র একাদশ সংখ্যা শুধু গণিত নিয়ে। সেই বিস্ময় প্রতিভা রামানুজনের প্রতি শ্রদ্ধা ও স্মরণে। ছেলেবেলায় শুনেছিলাম, তুমি যদি অঙ্ক থেকে এক পা পিছিয়ে যাও অঙ্ক তিন পা পিছিয়ে যাবে আর যদি এক পা এগিয়ে আসো তাহলে সে সাত পা এগিয়ে আসবে। হিসাব কষে দেখলাম এগিয়ে আসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তোমরাও এগিয়ে আসো, আর বাকিদেরকেও এগিয়ে আসতে উৎসাহিত কর। এই ‘বিজ্ঞান’ হ’ল ‘যারা ভালবাসে বা ভয় পায় তাদের জন্য’।
সম্পাদকমণ্ডলী, ‘বিজ্ঞান’
মে ২০১৮