অনেক চেষ্টা করেও কিছুই নির্ণয় করতে পারা গেল না। অবশেষে বিভিন্ন জাতীয় শোঁয়াপোকা কাঁচের নলের ভিতর পুরে সঙ্গে নিয়েই চলাফেরা করতে লাগলাম। লক্ষ করলাম যে কাচের নলে রাখবার পর শোঁয়াপোকাটা প্রথমে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করে অকৃতকার্য হলে শরীরটাকে গুটিয়ে চুপ করে বসে থাকে। চুপ করে বসবার পর সাধারণত তিন ঘন্টা থেকে ছ’ঘন্টার মধ্যে যে-কোন এক সময়ে মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে দেহের আকৃতি বেমালুম পরিবর্তন করে পুত্তলীর আকার ধারণ করে। কাজেই এই পাঁচ-সাত মিনিট সময় পর্যবেক্ষণ করতে পারলেই তাদের আকৃতি-পরিবর্তনের কৌশলটা দেখা যেতে পারে। কাচের নলে শোঁয়াপোকা পুরে যখন-তখন লক্ষ করে দেখতাম – হয় শোঁয়াপোকাই রয়ে গেছে, নয়তো কোন্ ফাঁকে যে দৃষ্টি এড়িয়ে পুত্তলী হয়ে বসে আছে, তা বুঝতে পারি নি। কোনও কোনও জাতের শোঁয়াপোকা রাতের শেষভাগেই সাধারণত পুত্তলির আকার ধারণ করে থাকে। অনেক চেষ্টার পর একদিন শেষ রাত্রিতে লক্ষ করলাম – নিশ্চল শোঁয়াপোকাটা যেন একটু একটু নড়ে উঠছে। ক্রমশ নড়াচড়া বৃদ্ধি পেতে লাগলো। প্রায় দু-তিন মিনিট পরে শোঁয়াপোকাটার ঘাড়ের কাছের খানিকটা অংশ চিড় খেয়ে ফেটে গেল। সেই ফাটা স্থানের ভিতর থেকে ঈষৎ লাল আভাযুক্ত একটা শাদা পিণ্ডাকার পদার্থ ক্রমশ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। আরও তিন-চার মিনিট অতিক্রান্ত হতেই নারিকেলী কুলের আঁঠির মতো সূচালো মুখবিশিষ্ট একটা অদ্ভুত প্রাণী মোচড় খেতে খেতে ঠেলে বেরিয়ে এলো। শোঁয়াপোকার সেই বিশ্রী ছালটা একপাশে পড়ে রইলো। খোলসটা পরিত্যাগ করবার পূর্বেই সে দেহের প্রান্তদেশ থেকে একটু সূতা বের করে তাতে আটকে ঝুলে থাকে।
দেখতে দেখতে সেই পুত্তলী পরিবর্তিত হয়ে একটি সুনির্দিষ্ট আকৃতি ধারণ করে এবং উপরের আবরণের উজ্জ্বল বর্ণে আত্মপ্রকাশ করে। পুত্তলীটি সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্টভাবে দুলের মতো ঝুলে থাকে। দশ-বারো দিন পরে হঠাৎ পুত্তলীর পিঠের দিক চিড় খেয়ে ফেটে যায় এবং ধীরে ধীরে সেই খোলস থেকে দু’তিন মিনিট সময়ের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি বেরিয়ে আসে। বাইরে আসবার সময় প্রজাপতিটা তার স্বাভাবিক অবস্থা থেকে আকারে অনেক ছোট থাকে। ডানাগুলিও থাকে খুবই ছোট ছোট, কিন্তু দেখতে দেখতে প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই তরতর করে ডানা বেড়ে ওঠে এবং শরীরের আকৃতি বদলে যায়। প্রায় এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি উড়ে বেড়াতে শুরু করে। আমরা অহরহ যে সকল বিচিত্র বর্ণের প্রজাপতি দেখতে পাই, তাদের জন্মবৃত্তান্ত মোটামুটি এইরূপ। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন জাতীয় অগণিত প্রজাপতির জন্মবৃত্তান্তের বৈচিত্র্যও কম নয়।
আমরা সাধারণত দিবাচর প্রজাপতিই দেখতে পাই। বিচিত্র বর্ণে চিত্রিত হালকা ডানাওয়ালা ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির দিবাচর প্রজাপতি সারাদিন ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায় এবং সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসবার বহু পুর্বেই পত্রপল্লবের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে ডানা মুড়ে বিশ্রাম গ্রহণ করে। কিন্তু নিশাচর প্রজাপতিরা সারাদিন কোনও নির্জন অন্ধকার স্থানে ডানা প্রসারিত করে বিশ্রাম করে এবং গভীর অন্ধকারে আহারান্বেষণে বহির্গত হয়। এরা সাধারণত মথ নামে পরিচিত।