২.
ছেলেবেলার অনেক ঘটনার কথাই ভুলে গেছি, তবে কোন কোন ঘটনার অনেক কিছু স্মৃতিই রয়ে গেছে – কতক ঝাপসা, কতক পরিস্কার। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে যোগেন মাস্টারের কথা। মাঝে মাঝে যোগেন মাস্টার ছেলেদের ডেকে এনে ম্যাজিকের খেলা দেখাতেন। একটা মজার জিনিস দেখাবেন বলে একদিন তিনি ক্লাসরুমে মাস্টার, ছাত্র সবাইকে ডেকে নিয়ে এলেন। পকেট থেকে গাঢ় খয়েরী রঙের কয়েকটি বিচি বের করে মাস্টারদের হাতে দিয়ে বললেন – দেখুন তো জিনিসটা কী এবং এতে কোন ছিদ্র বা টুটা-ফাটা আছে ? দেখতে কতকটা কাঁই বিচির মতো হলেও আসলে তা নয়, কোনও একটা অজানা ফলের বিচি – মসৃণ ও গোলাকার, কোথাও কোনও টুটা-ফাটা নেই। বিচিগুলি টেবিলের ওপর রাখার কয়েক মিনিট পরেই একটা বিচি হঠাৎ প্রায় চার ইঞ্চি উঁচুতে লাফিয়ে উঠলো। তারপর এদিক ওদিক থেকে প্রায় সবগুলি বিচিই থেকে থেকে লাফাতে শুরু করে দিল। অবাক কাণ্ড। কিভাবে এটা সম্ভব হতে পারে ? আমরা তো ছেলেমানুষ, বড়রাই কিছু বুঝতে পারেন নি। অবশেষে মাস্টারমশাই ছুরি দিয়ে একটা বিচি চিরে ফেলতেই দেখা গেল, তার ভেতরে রয়েছে একটা পোকা (Larva)। টেবিলের ওপর পড়েই পোকাটা ধনুকের মতো শরীরটাকে বাঁকিয়ে দু-প্রান্ত একত্রিত করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।
এই ঘটনা থেকেই কীট-পতঙ্গ, পোকা মাকড় সম্পর্কে একটা কৌতূহল জাগতে লাগল। নতুন কোনও পোকা-মাকড় বা গাছপালার কোনও বৈশিষ্ট্য নজরে পড়লে বিষ্ময় জাগতো বটে, কিন্তু সুসংবদ্ধ জ্ঞানের অভাবে তার প্রকৃত রহস্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা ছিল না।
স্কুলের গ্রাম্যজীবনের শেষে শহরাঞ্চলের (মৈমনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ জীবনে) পালা। নতুন জীবন, নতুন পরিবেশ। গাছপালা কীটপতঙ্গের কথা একরকম ভুলেই গেলাম। একটা ঘটনায় পদার্থবিদ্যার দিকে ঝোঁক পড়লো। একটা সুযোগও এসে গেল। পদার্থবিদ্যার পরীক্ষামূলক দিকটা এতই কৌতূহলোদ্দীপক যে, তাতে আকৃষ্ট না হয়ে পারা যায় না। যা হোক কিছুকাল পরে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বাধ্য হয়ে পল্লীগ্রামে ফিরে এসে শিক্ষকতার কাজে কর্মজীবন শুরু করতে হলো।
সন্ধ্যার পর স্কুল বোর্ডিং এ কয়েকজন বসে গল্প করছি। বর্ষাকাল, অনবরত টিপ টিপ বৃষ্টি চলেছে। হঠাৎ একতা দমকা হাওয়া উঠলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল – মুষলধারে বৃষ্টি। বোর্ডিং এর কিছু দূরেই গাছপালা বর্জিত একটা বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মাঝখানে, মাটি থেকে প্রায় তিন চার হাত উঁচুতে এই বৃষ্টিধারার মধ্যেই হঠাৎ যেন একটা আগুনের গোলা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। কিছুক্ষণ পরেই এলোমেলোভাবে ছুটাছুটি করে কিছু দূর গিয়েই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।
ব্যাপারটা নজরে পড়েছিল অনেকেরই। কাজেই স্থান কাল পাত্রানুযায়ী এসব ক্ষেত্রে যা হয়, স্বভাবতই সেই ভৌতিক কাণ্ডের আলোচনা শুরু হয়ে গেল। কয়েকজন ছিলেন ভৌতিক কাণ্ডে বিশ্বাসী। জন দুই তারস্বরে ভৌতিক ব্যাপারে তাদের অনাস্থার কথা ঘোষণা করলেন। তাঁদের কথায় মনে হলো – যুক্তির চেয়ে তাঁদের শিক্ষাভিমান আহত হবার আশঙ্কাই এই অনাস্থা প্রকাশের কারণ। ভৌতিক ব্যাপার সম্পর্কে আমার কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। কাজেই আমি বিশ্বাসীর দলেও নই, অবিশ্বাসীর দলেও নই। এই আলোচনার মধ্যে একজন বলে উঠলেন – এসব ব্যাপারের সত্যতা সম্বন্ধে তর্ক না করে রাত্রিবেলায় একদিন এই গ্রামের দক্ষিণ দিকে পাঁচীর মার ভিটাতে গেলেই হয়তো আপনার ধারণা বদলে যাবে।
অন্ধকার রাত্রিতে এই গ্রামের অনেকেই নাকি পাঁচীর মার ভিটেতে আগুন জ্বলতে দেখেছে। কৌতূহল অদম্য হয়ে উঠলো – পাঁচীর মার ভিটার ব্যাপারটা দেখতেই হবে। ভূত বিশ্বাস করি না করি সংস্কারটা পুরোপুরিই ছিল। স্থান এবং সময় বিশেষে একটা অজানা আশঙ্কায় যেন গা ছমছম করে ওঠে। যা হোক, দু একদিনের চেষ্টায় সঙ্গী হবার জন্যে দু-জনকে রাজী করানো গেল। দিন দুয়েক পর দুজন সঙ্গী নিয়ে পাঁচীর মার ভিটের দিকে রওনা হলাম। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে – অনবরত টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে ছাতা লন্ঠন ও দেশলাই নিয়েছি। ঝোপঝাড় ও জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কর্দমাক্ত পিছল রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে। এই রাস্তা ধরেই অনেক কষ্টে পাঁচীর মার ভিটের উত্তর প্রান্তে এসে পড়লাম। চারদিক ঘন জঙ্গলে ঘেরা খোলা মাঠের মত বিস্তীর্ণ জায়গা। মাঝখানে কোন বড় গাছপালা নেই-কাজেই জায়গাটা অনেক ফর্সা। কিন্তু চারদিকের বড় বড় গাছের ছায়ায় মেঘলারাতের অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে রয়েছে। দক্ষিণ দিকে কয়েকটা বড় বড় গাছ যেন জমাট অন্ধকারের বোঝা মাথায় করে নিঃসঙ্গভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণেও কতকগুলি বড় বড় গাছ। অন্ধকারটা যেন সেই দিকেই বেশি গাঢ়। আশেপাশে লোকালয় নেই। খুব দূরে দু একখানা ঘর দেখা যায় মাত্র। চতুর্দিকে ব্যাঙের ঐক্যতান আর উইচ্চিংড়ে আর ঘুঘরে পোকার একটানা রি-রি শব্দ। একলা নই, সঙ্গে আলোও আছে, তবু কেমন যেন একটা অস্বাছন্দ্য বোধ করছিলাম।
একটু একটু করে মাঠের মাঝখানটায় এসে পড়লাম। মাঝে মাঝে এক একটা লতাগুল্মের ঝোপ। এরূপ একটা ঝোপের আড়াল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের সেই জমাট-বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা অস্পষ্ট আলোর রেখা দেখা গেল। লন্ঠন আড়াল করে সেখেনে থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর আবার কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখলাম – স্পষ্ট আলো, কোন পরিবর্তন নেই। আর একটা ঝোপ ঘুরে অনেকটা কাছে যেতেই সেই ঘনসন্নিবিষ্ট গাছগুলির নীচে আলোটাকে আরো বেশী উজ্জ্বল ও পরিষ্কার দেখা গেল।
আরও অগ্রসর হওয়া উচিত কিনা ভাবছি – ইতিমধ্যে আলোটা যেন হঠাৎ নিবে গেল, কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার দপ করে জ্বলে উঠল। কিছুক্ষণ ধরে ক্রমাগত এরূপ ব্যাপারই ঘটতে লাগলো। তারপরেই আবার একটানা স্থির আলো। সঙ্গীদের একজন আগেই চলে গিয়েছিলেন। আর একজন যিনি ছিলেন, তিনিও অনেকটা দূরে ফাঁকা জায়গাতেই দাঁড়িয়েছিলেন – এগুতে ভরসা পান নি। অবশ্য উভয়েই আমরা জোরে জোরে কথা বলছিলাম। সঙ্গীটি ফিরে আসবার জন্য তাগিদ দিচ্ছিলেন। ভয়ে আমার গা ছমছম করছিল বটে, তবুও কেন যেন মনে হচ্ছিল – ওটা ভৌতিক ব্যাপার নয় – অন্য কিছু একটা হবে। সঙ্গীর অনুরোধ উপেক্ষা করে আরও খানিকটা এগিয়েই দেখা গেল প্রায় ৪-৫ হাত দূরেই বেশ বড় একটা অগ্নিকুণ্ড। আগুনের শিখা নেই। কাঠকয়লা পুড়ে যেমন গনগনে আগুন হয়, অনেকটা সেই রকম। আলোর তীব্রতা নেই। স্নিগ্ধ নীলাভ আলোতে আশেপাশের ঘাসপাতাগুলি পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কর্তিত একটা গাছের গুড়ি থেকে আলো নির্গত হচ্ছিল। সমস্ত গুঁড়িটাই জ্বলে জ্বলে যেন একটা অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে।
এই অপরূপ দৃশ্য আর কখনো নজরে পড়ে নি। বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা রইলো না। গুঁড়িটার অনেকটাই পচে গেছে। গুঁড়িটার পাশেই, আমাদের দিকে বেশ বড় একটা কচুগাছ জন্মেছিল। তার একটা পাতা এমনভাবে হেলে পড়েছিল যে, একটু বাতাসেই উপরে নীচে ওঠা নামা করে আন্দোলিত হতো। দূর থেকে আলোটাকে একবার জ্বলতে আবার নিবতে দেখেছিলাম – এখন তার প্রকৃত কারণ বোঝা গেল। গুঁড়িটার গা থেকে আলো বিকিরণকারী কতকগুলি কাঠের কুচি সংগ্রহ করে অক্ষত দেহে পাঁচীর মার ভিটা থেকে ফিরে এলাম। প্রত্যেকটি কাঠের টুকরো সারা রাত নীলাভ আলো বিকিরণ করতো, কিন্তু দিনের বেলায় কিছুই দেখা যেত না। দিন দুই পড়ে আলো দেওয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেল। সাধারণ কাঠের টুকরো কেন আলো বিকিরণ করে, চেষ্টা করেও তখন তার কারণ বুঝতে পারি নি।
এই ঘটনার কিছুকাল পরে রাত্রিবেলায় একটা বৃহৎ জলাশয়ের পাশ দিয়ে যাবার সময় রাস্তার উভয় দিকের জঙ্গলের মধ্যে জোনাকির আলোর মতো অসংখ্য আলোকবিন্দু নজরে পড়ে গেল। কিছুটা তুলে এনে বাতির আলোয় দেখলাম – কতকগুলি লতাপাতা থেকেই এই রকম আলো নির্গত হচ্ছে। পূর্বের দেখা আলোর মতো এই আলোয় স্নিগ্ধ নীলাভ আর খুবই উজ্জ্বল। শুষ্ক দিনেও বনে জঙ্গলে পিচকিরির সাহায্যে জল ছিটিয়ে দিলে রাত্রিবেলায় এই আলো দেখা যায়।
ইচ্ছামত যখন-তখন এই আলো-দেওয়া লতাপাতা সংগ্রহ করবার সন্ধান জানবার ফলে এই বিষয়ে অনুসন্ধান চালাবার পক্ষে খুব সুবিধা হলো। সীমাবদ্ধ জ্ঞান নিয়ে যতটা করা সম্ভব, ততটা করে কিছু কিছু তথ্য জানা গেল বটে, কিন্তু আর বেশী অগ্রসর হওয়া সম্ভব হলো না। ‘প্রবাসী’তে এই গাছের আলো সম্বন্ধে কিছু বিবরণ প্রকাশিত হবার ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকে আরো অনেক রকম আলো দেওয়া জিনিসের কথা জানিয়েছিলেন। এর ফলে এ সম্বন্ধে অনুসন্ধানের উৎসাহ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগলো।
কিছুকাল পরে একটা বিশেষ কাজের জন্য তিন চার দিনের জন্যে কলকাতায় আসতে হলো। ফিরে যাবার আগের দিন একতা কাজের খবর পেয়ে সেখানেই ভর্তি হয়ে গেলাম। কাশীপুরে গঙ্গার ধারে ছোট্ট একটা অফিস বেঙ্গল চেম্বার্স অব কমার্সের। সেখানেই টেলিফোন অপারেটরের কাজ। অফিসে আমিই একমাত্র বাঙালী। কয়েকজন হিন্দুস্থানী বেয়ারা আর বাকী যাঁরা আসেন, সবই ইউরোপীয়ান ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। কারো সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে পারি না, আর অনেক কথাই বুঝি না। অবশ্য অ্যাংলো ইন্ডিয়ানিদের কথা বুঝতে খুব বেশি অসুবিধে হতো না। টেলিফোন নিয়েই হলো মুস্কিল। টেলিফোন ব্যবহার এই আমার প্রথম। সাহেবরাই বেশীরভাগ টেলিফোন করে। কতক বুঝি – অনেকই বুঝি না। বটুক অনেক দিনের পুরনো বেয়ারা, – সাহেবদের সঙ্গে সে ইংরেজীতে অনর্গল বাৎচিৎ করে। বটুকেরই শরণাপন্ন হলাম। খাস বিলাতী সাহেবেরা যখন ফোন করেন, বটুকের হাতে ফোনটা তুলে দেই। ক্রমশ মার্টিন, উইলসন, মনিয়ার, ডি ময়রা, ডি সুজা প্রভৃতি কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ জমে উঠলো। এঁরা প্রায় সবাই বয়সে প্রবীণ। অনেক ব্যাপারেই এঁরা আমাকে সাহায্য করতেন।
একদিন অফিসে ঢুকতেই দেখি, ইন্সপেক্টর কিচেন সাহেব অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনিয়ার সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন – বেয়ারা শিউবরণ গেটের সামনে আদেশর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। যথারীতি অফিসে ঢুকে নির্দিষ্ট কাজে মন দিলাম। পরের দিন অফিসে গিয়েই দেখলাম , শিউবরণ টেবিলের কাছে জড়সড় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, আর মার্টিন সাহেব তাকে ধমকাচ্ছেন। সর্বশেষ শিউবরণ বললে – আমার কোনো কসুর নেই সাব – সেলাম তো আমরা দিই, কিন্তু বাবু সেলাম নেন না। মার্টিন সাহেব কিছুই মানলেন না, বললেন – বেয়াদপির জন্য সাজা তোমায় পেতেই হবে। ব্যাপারটা ওখানেই মিটে গেল। কেন অর সাজা হবে – তার রহস্যটা আমি বুঝতে পারি নি। সবাই যার যার কাজে চলে গেলে বটুককে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম-কী হয়েছিল। বটুক যা বললে, তাতে বুঝলাম – কাল অফিসে ঢোকবার আগে লোকটি আমাকে সেলাম দেয়নি, সেটা কিচেন সাহেবের নজরে পড়েছে এবং এই বেয়াদপির জন্য তাকে ফাইন করেছে। ও বলেছে, বাবু সেলাম নেয় না, তাই সে সেলাম দেয় নি। আমি তো অবাক – সেলাম নেবার অর্থ কি ? বটুক বুঝিয়ে দিলে – সেলাম দিলে তাকে সেলাম দিতে হয়। বটুকের কথাটা মনে গেঁথে রইলো – সেলাম দিলে তাকে সেলাম দিতে হয়।
এমন অনেক বিষয় দেখা যায়, যার সব কিছু না জেনে অল্প কিছু জানার বিপদ আছে। বটুকের কাছে শিষ্টাচারের রীতি সম্বন্ধে যা শুনেছিলাম, কার্যক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে গিয়ে একটা অনর্থ ঘটিয়ে ফেললাম।
এই ঘটনার বেশ কিছুকাল পরে একদিন কী যেন একটা লেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ক্যালকাটা হাইড্রলিক প্রেসের একটা বেয়ারা এসে খবর দিল – আ্যগাসি সাহেব আপনাকে সেলাম দিয়েছেন। বলা নেই, কওয়া নেই – আ্যগাসি সাহেব আমাকে সেলাম দিতে গেলেন কেন – কিছু বুঝতে না পেরে ‘সেলাম দিলে সেলাম দিতে হয়’ – পন্থা অনুসরণ করাই সমীচীন বোধ করলাম। বেয়ারাকে বলে দিলাম আ্যগাসি সাহেবকেও আমার সেলাম দিয়ে দাও।
এর পর ২০। ২৫ মিনিট কেটে গেছে। আমি নিশ্চিন্ত মনে কাজ করছি, আর ভাবছি আ্যগাসি সাহেবের কথা – লোকটা পাগলাটে – কখন যে কি খেয়াল হয়, বোঝা দায়।
অকস্মাৎ ঝড়ের বেগে রুদ্রমূর্তিতে আ্যগাসি সাহেবের আবির্ভাব। টেবিলের উপর একটা প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত করে চেঁচিয়ে উঠলেন – বাবু, কেন আমাকে ডেকেছ ? তোমার সাহস তো কম নয় – আমি ডেকেছি তোমাকে, তার উত্তরে কিনা তুমিই আমাকে ডেকে পাঠালে। আমি যতই বোঝাতে চাই তোমাকে আমি ডেকে পাঠাই নি, ততই সে গলা চড়িয়ে দেয়। বেঁক তর্জন-গর্জন ও অকথ্য ভাষা প্রয়োগ করে আমার নাম উপরে রিপোর্ট করবে বলে যেমন ভাবে এসেছিল তেমন ভাবেই চলে গেল। আমি তো হতবম্ব হয়ে বসে রইলাম। একে তো একটা-না-একটা খুঁটিনাটি ঝঞ্ঝাট লেগেই আছে, তাতে আবার ঘটলো এই কাণ্ড ! নাঃ – আর নয়, একাজ ছেড়েই দেব। সেলাম পাঠিয়ে দেওয়া মানে যে ডাকা – পরে একথা জানতে পেরেও অশান্ত মনটা আর শান্ত হতে চাইলো না – ইস্তফা দেবার কথাই ভাবতে লাগলাম।
এই ঘটনার দু-তিন দিন পরে হঠাৎ একদিন পুলিনবাবু ( পুলিনবিহারী দাস )[ অনুশীলনী দলের বিপ্লবী ] এসে আমার বাসায় হাজির। বললেন তোমাকে জগদীশ বোসের কাছে যেতে হবে। তিনি তোমাকে দেখা করতে বলেছেন। তিনি আমায় ডাকবেন কেন – ইটা তো অসম্ভব ব্যাপার বলেই মনে হয়। তিনি বললেন – কাল জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখি সেখানে রামানন্দবাবু ও গিরীন্দ্রাশেখর বসু রয়েছেন। আলো-দেওয়া উদ্ভিদাদি সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছিল। ‘প্রবাসীতে’ লেখা আলো-দেওয়া গাছপালার কোথায় তোমার কথা উঠেছিল। আমি তোমাকে চিনি বলতেই জগদীশচন্দ্র বললেন – তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।
তার পর দিনই অতি শঙ্কিত মনে জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কোথায় থাক, কী কর – এরূপ দু-একটা কথার পর আলোবিকিরণকারী গাছপালা সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলেন। সব শুনে তিনি বললেন – খুবই জটিল। এ সম্বন্ধে ঐ সব দেশেও তেমন কিছু হয়নি। এ নিয়ে তুমি কিছু করতে পারবে না। যদি তুমি আমার এখানে আসতে চাও, তবে অনেক কিছু শিখতে পারবে। মনে মনে এতদিন যে কামনা পোষণ করে এসেছি একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবেই তা ঘটে গেল। তাঁর প্রস্তাবে সানন্দে সম্মতি জ্ঞাপন করলাম। তখন থেকেই বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হলো এসব হচ্ছে ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকের কথা।
বিজ্ঞান মন্দিরের কাজ-কর্ম সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা করতেই বেশ কিছু দিন গেল। তারপর তাঁর দু’জন সহকর্মীর সঙ্গে কাজে লাগিয়ে দিলেন, তাঁদের সাহায্য করবার জন্য। বিজ্ঞান মন্দিরে তখন নানা রকম উদ্ভিদ নিয়েই গবেষণা হতো। গবেষনার ফল পত্রাকারে ও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হতো। এতে ছবিও থাকত প্রচুর। আগে যিনি ছবি আঁকতেন, প্রায় বছর দুই পরে তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে লাগিয়ে দিলেন, ছবি আঁকবার কাজে। তারপর পার্সপেক্টিভ ড্রয়িং শিখবার জন্য গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে স্পেশাল স্টুডেন্ট হিসেবে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানকার কাজ শেষ হবার পর নগেনবাবুর ( নগেন্দ্রনাথ দাস ) সঙ্গে ফটোগ্রাফির কাজে জুটে গেলাম।
ইতিমধ্যে একদিন জগদীশচন্দ্র আমায় দেকে বললেন – দেখ, আমার অনেক রকম বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। এগুলিকে কার্যকরী অবস্থায় রাখবার জন্য একজন ইলেকট্রিশিয়ান দরকার। তোমার যদি এবিষয়ে উত্সাহ থাকে তবে এতে ট্রেনিং নেবার ব্যবস্থা হতে পারে। খুব উত্সাহের সঙ্গেই এতে সম্মতি জানালাম। ক্লাইভ ইঞ্জিনীয়ারিং-এ ভর্তির ব্যবস্থা হলো ! মাস ছয়েক সেখানে শিক্ষালাভের পর কয়েকটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রকে কার্যকরী করে তোলা সম্ভব হলো। আবার ছবি আঁকবার কাজ বেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ব্লক তৈরি করবার সাজ-সরঞ্জামের ব্যবস্থাও করা হলো। ছবির সব কিছু ব্লক এখানেই তৈরি করতে লাগলাম। এসব কাজের প্রয়োজন সব সময়ে সমান থাকে না। অফুরন্ত অবসর। মাইক্রোস্কোপ নিয়ে কাজ শুরু করলাম। উদ্ভিদ নিয়ে শুরু করে প্রোটোজোয়ায় এসে গেলাম। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কত রকমের প্রোটোজোয়া আমাদের আশেপাশে রয়েছে, তার যেন আর ইয়ত্তা নেই ! বিচিত্র তাদের আকৃতি, বিচিত্র তাদের ব্যবহার। যারা চোখে দেখেন নি, তাঁরা বিশ্বাস করতেই চাইবেন না যে, এত বিচিত্র আকৃতির এত রকমের অদ্ভুত জীব আমাদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ইতিমধ্যে অধ্যাপক হ্যানস্ মলিশ কিছু কালের জন্য এখানে আসেন। [ ১৯২৮ সালের প্রফেসর মলিশ ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে এসেছিলেন ] জগদীশচন্দ্র তখন ইংল্যাণ্ডে ছিলেন। তিনি তখনই আমাকে জানিয়েছিলেন – প্রফেসর মলিশ ইন্সটিউটে গিয়ে কিছুকাল থাকবেন। তুমি সেই আলো-দেওয়া লতাপাতা সংগ্রহ করে রাখবে। কারণ তিনি এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। মলিশ সাহেব এখানে আসবার পর আমি তাঁর সঙ্গে কাজে লেগে গেলাম। নানা স্থানে ঘুরে ঘুরে আলো-বিকিরণকারী অনেক রকমের জিনিস সংগ্রহ করে নিয়ে এলাম। প্রায় ছয় মাস তাঁর সঙ্গে থেকে আলো-দেওয়া কীট-পতঙ্গ, লতাপাতা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা সম্ভব হলো। আলো-বিকিরণকারী জীবাণু প্রাণিদেহ থেকে পৃথক করে সেগুলিকে প্রচুর পরিমাণে বাড়িয়ে তোলবার ব্যবস্থাও খুব সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল। এরপর আবার মাইক্রোস্কোপের কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। একদিন কল্মির ডাঁটার সেকসন কেটে মায়ক্রস্কপে পরীক্ষা করছিলাম। ১০।১২ ঘন্টা পরেই সেই ডাঁটারই আবার সেকসন কেটে দেখলাম – নতুন ধরনের কতকগুলি কোষ উত্পন্ন হয়েছে। বার বার পরীক্ষা করে নতুন কোষগুলির আবির্ভাব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে জগদীশচন্দ্রকে দেখালাম। তিনি দেখে এই বিষয়ে একটি পেপার তৈরি করতে বললেন। কিন্তু পেপার তৈরি হলেও কিছু হয় নি বলে তিনি সেটা বাতিল করে দিলেন। খুবই দমে গেলাম। অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে স্থির করলাম -এমন কোন বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে, যা তিনি সরাসরি বাতিল করতে পারবেন না – কোন না কোন বিশেষজ্ঞের অভিমত নিতেই হবে। ছোটবেলা থেকেই কীট-পতঙ্গ সম্বন্ধে কিছু কিছু জানবার সুযোগ হয়েছিল – সেকথা পূর্বেই বলা হয়েছে। এটাই ঠিক – পোকা-মাকড় নিয়েই কাজ আরম্ভ করবো। মাকড়সার বিষয় অনুসন্ধান শুরু করলাম। বহু রকমের মাকড়সা সংগ্রহ করে তাদের সম্বন্ধে কে কোথায় কি কি বিবরণী লিপিবদ্ধ করেছেন, তার খোজ করে অনেক কিছু জানতে পারা গেল। মাকড়সার সন্ধানে গিয়ে একদিন বিমানঘাটির নিকট একটা জলাভূমিতে একটা মাকড়সাকে জল থেকে মাছ শিকার করতে দেখে তৎক্ষণাৎ একটা ফটো তুলে নিলাম। ফটোটা দেখেই জগদীশচন্দ্র খুবই খুশী হলেন এবং এই মাকড়সা সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করে থিসিস তৈরি করতে বললেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে কয়েক মাস চেষ্টার ফলে থিসিস রচিত হবার পর ডাঃ করমনারায়ণ বহালের নিকট পাঠানো হলো। তাঁর কাছ থেকে অনুমোদিত হয়ে আসবার পর জগদীশচন্দ্র তার প্রথম অংশ ট্রানজ্যাকসনে প্রকাশ করেন। যে উদ্দেশ্যে কাজ আরম্ভ করেছিলাম, তা সফল হলো। দ্বিগুণ উত্সাহে গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধানের ফলে ক্রমশই নতুন নতুন কীট-পতঙ্গ নজরে পড়তে লাগলো। দেশ-বিদেশের বৈজ্ঞানিক পত্রিকাদিতেও কিছু কিছু নিবন্ধও প্রকাশিত হতে লাগল। কীট-পতঙ্গের খোঁজে প্রায়ই বনে-জঙ্গলে ও স্থানে-অস্থানে কাটাতে হতো। তার ফলে কেবল বিদ্রূপ, অপমানই নয়, দৈহিক লাঞ্ছনাও কম ভোগ করতে হয় নি। উত্সাহের আতিসয্যে এমন স্থানেও গিয়ে পড়েছি বা এমন কাজ করেছি যাতে লোকের সন্দেহের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক।
একবার কলকাতার বাইরে সোনারপুরে একটা পাড়াগেঁয়ে রাস্তা দিয়ে চলেছি। চারদিক আগাছায় ভর্তি একটা মজা-দীঘির ধারে দু-দল পিঁপড়ের মধ্যে ভীষণ লড়াই বেঁধে গেছে দেখতে পেলাম। লড়াই আর থামে না, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ছবি তুলতে আরম্ভ করলাম। মাঝে মাঝে নজরে পড়েছিল – দু-একজন গৃহস্থবধূ কলসী কাঁখে জল নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এক ভদ্রলোক এসে বললেন – ও মশাই ওখানে কি হচ্ছে ? ছবি তুলছি। ইতিমধ্যে আরোও দু-চারজন এসে হাজির। তারা চেঁচিয়ে বলে উঠলো – কে তোমাকে এখানে ছবি তুলতে বলেছে ? আমি বললাম – পিঁপড়ের ছবি তুলছি – এর জন্য আর বলাবলি কি !
কলকাতা থেকে এসেছ পিঁপড়ের ছবি তুলতে, চালাকির আর জায়গা পাও নি – বলেই একটা লোক লাথি মেরে ক্যামেরাটাকে ফেলে দিল। তারপর ‘এক্সপোজ’ করা প্লেটগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল। গোলমাল শুনে আরোও কিছু লোক জমেছিল। তারা কিন্তু এতেও রেহাই দিল না – শারীরিক নির্যাতন শুরু করে দিল। অতি কষ্টে হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম।
বেলেঘাটার পল্লীঅঞ্চলে [ ১৯৩৪-৩৫ সালের বেলেঘাটা অঞ্চলের কথা ] একটা পুকুরের পূব পাড়ে একবার একটা ঝোপের আড়ালে কতকগুলি অদ্ভুত প্রাণীর আনাগোনা লক্ষ্য করেছিলাম। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে পাশাপাশি কয়েকখানা বাড়ি। লোকজন মাঝে মাঝে পুকুরের ঘটে কাজ করতে আসে। ওগুলি যে মুসলমানদের বাড়ি সেটা পরে জেনেছিলাম। যা হোক, প্রায় ঘন্টাখানেকের উপর ওখানে বসে আছি। হঠাৎ পিছন দিক দিয়ে জনাতিনেক লোক এসে জামার কলারটা ধরে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ভ্যাংচানোর সুরে বলল – ওখানে হচ্ছেটা কি ? আচমকা আক্রমণে ভড়কে গিয়ে বললাম – পিঁপড়ে দেখছি।
পিঁপড়ে বুঝি কেবল এখানেই দেখা যায় – বলেই এমন জোরে গলাধাক্কা দিল যে, টাল সামলাতে না পেরে পাশের খানাটার মধ্যে পড়ে গেলাম।
আর একবার ব্যারাকপুরের একটা পল্লীঅঞ্চলের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। নজরে পড়লো বাগানের মধ্যে বেশ বড় একটা মাকড়সা জল বুনছে। বাগানে ঢুকে জল বোনা দেখছি। বাগানের গায়েই বেশ বড় একটা খড়ের চালের বাড়ি। বাগানের দিকে কয়েকটা জানলা খোলা। জালটা বোনা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বাড়ির ভিতর থেকে লম্বা-চওড়া এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন এবং বলা নেই, কওয়া নেই – হঠাৎ আমার গালে এক প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিলেন। টাল সামলে নিয়ে আমার উদ্দেশ্যের কথা বললেও বিশ্বাস করলেন না বরং চোখ রাঙিয়ে বললেন – বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও এখান থেকে। পরে তিনি অবশ্য ওখানকার এক বিশেষ পরিচিত লোকের সঙ্গে আলাপে তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন এবং আমাকে প্রচুর জলযোগে আপ্যায়িত করে এই অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্য মার্জনা চেয়েছিলেন।
ছোট বড় এরূপ আরোও অনেক ঘটনাই ঘটেছে, তাদের উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। মোটের উপর পোকা-মাকড় সংগ্রহ এবং তাদের আচারব্যবহার পর্যবেক্ষণের জন্য যে সব পল্লীঅঞ্চলে গিয়েছি, প্রায় সর্বত্রই দেখেছি – কেউ যে সব কিছু ছেড়ে দিনের পর দিন পোকা-মাকড়ের পিছনে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পারে, অধিকাংশ লোকই একথা বিশ্বাস করতে নারাজ।