মনে পড়ে
১.
ছোটবেলা থেকেই একমাত্র সাঁতার কাটা ছাড়া কোনরকম খেলাধূলায় আকর্ষণ অনুভব করিনি। অবসর সময়ে প্রায়ই বনে জঙ্গলে, খাল – বিল এঁদো পুকুরের ধারে কীটপতঙ্গ, পাখি এবং ছোট ছোট মাছ ও জলপোকার গতিবিধি লক্ষ করে কাটিয়ে দিতাম। গাছপালারও অনেক কিছু নজরে পড়েছিল। কিন্তু অনেক কিছুর তাৎপর্য বোঝার ক্ষমতা ছিল না। এই সব সাধারণ দেখাই পরবর্তীকালে আমার কাজে অনেকটা সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের কথা আজ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তখনকার দেখা কিছুই পুনরায় দেখতে পাই নি।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আনাড়ি হাতেই একটা টাইমপীস খুলে ব্যালান্স হুইলটার অদ্ভুত দ্রুতগতি এবং অন্যান্য (আপাত) নিষ্ক্রিয়তা দেখে অবাক হয়ে ভাবতাম এটা কেমন করে সম্ভব হচ্ছে। একদিন খেলার সময় অসতর্কতার ফলে প্রচন্ডবেগে যেন স্প্রিংটা খুলে গিয়ে ব্যারেলটা সমেত উপরে টাঙানো সরু একটা তারের ওপর ছিটকে পড়ে, ব্যালান্সড হয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দোল খেতে লাগল। অন্যান্য জিনিস দিয়ে অনুরূপভাবে ব্যালানস করার চেষ্টায় লেগে গেলাম। ইতিমধ্যে আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার আমাদের কাছে কতগুলি সায়েন্স ম্যাজিক দেখিয়ে তার কারণ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন। তার মধ্যে গোটা দুই ব্যালেন্সের খেলাও ছিল। এই সব ব্যাপার থেকেই ম্যাজিক শিখতে আগ্রহাণ্বিত হয়ে পড়ি। বেশ কয়েক বছর ম্যাজিকের চর্চা করেছিলাম। ইতিমধ্যে ঘড়ি, গ্রামাফোনের যন্ত্রাদি সম্পর্কেও কিছু পরিমাণে দক্ষতা অর্জন করেছিলাম।
এর আগেই রামায়ণ ও মহাভারত অনেকটা পড়েছিলাম। মায়ের ছিল ভয়ানক বই পড়ার ঝোঁক। অনেক রাত জেগে উপন্যাস গল্পের বই পড়তেন, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের বই পড়তাম। ক্রমশ উপন্যাস পড়ার ঝোঁক বাড়তে লাগল, অক্ষয়কুমার দত্তের চারুপাঠ এবং দু একখানা বই ছাড়া বিজ্ঞানের বই পড়ার সুযোগ পাই নি। এইসব আজেবাজে জিনিস পড়বার ফলে বেশ ক্ষতি হয়েছিল বটে, কিন্তু লাভও যে কিছু হয় নি, এমন কথা বলতে পারি না। এই সময় থেকেই ছড়া কবিতা লেখবার চেষ্টা করি, পুরনো ঘড়ি, গ্রামাফোন খুলে যান্ত্রিক কৌশল দেখবার চেষ্টা করি। কলেজে কেমিষ্ট্রি ছিল একটি পাঠ্য বিষয়। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য প্রতিবারেই একসেট যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক পদার্থ নিজের হেফাজতে রাখবার জন্য দেওয়া হতো। নিজের ইচ্ছামত পরীক্ষা করতাম, ফসফোরেটেড হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন প্রভৃতি গ্যাস তৈরি করা, রাসায়নিক পদার্থের সাহায্যে আগুন জ্বালানো এবং অন্যান্য অনেকগুলি পরীক্ষায় সাফল্যলাভ করে উৎসাহিত হয়ে উঠতাম।
কেমিস্ট্রির প্রফেসর ক্লাসে অ্যামোনিয়া গ্যাসের পরীক্ষা দেখিয়েছিলেন। সেটা দেখে উপরে জল তুলবার সহজ পদ্ধতির একটা যান্ত্রিক ব্যবস্থার নকশা করে রসায়নের অধ্যাপক তারাপদ চট্টোপাধ্যায়কে দেখিয়েছিলাম, তিনি সেটাতে একটা ভুল দেখিয়ে দিয়ে বললেন – তুমি কি এটা নিজে করেছ ? আমি তাঁর ক্লাসের এক্সপেরিমেন্ট এর কথা থেকে কী করে এটা মাথায় এসেছিল – সব বললাম। তিনি আমাকে সায়েন্স নিয়ে পড়বার জন্য বিশেষ করে বললেন। রোজই তাঁর বাড়িতে যেতাম, তিনি বিজ্ঞানের কোনও কোনও বিষয় সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন। তিনি ঢাকা কলেজে পুনরায় সায়েন্স নিয়ে ভরতি হবার ব্যবস্থাদি করে আমার অভিভাবককে জানালেন। তিনি কিছুতেই রাজী হলেন না, এর ফলে শেষ পর্যন্ত আর পড়া হল না। দেশে এসে হাইস্কুলে মাস্টারিতে ঢুকলাম। স্কুল থেকেই আমার জিম্মায় একটি বাগান এবং মালী দেওয়া হয়েছিল। ছেলেদের নিয়ে সেখানে গাছপালা সম্বন্ধে সাধ্যমত পরীক্ষাদি করতাম। কৃত্রিম উপায়ে ফুলের পরাগ সঙ্গম ঘটিয়ে সঙ্কর উদ্ভিদ তৈরির চেষ্টা, কলমের সাহায্যে একই গাছে দু-তিন রকমের ফুল উৎপাদন করা ইত্যাদি ছিল পরীক্ষার বিষয়।
এর মধ্যেই শতদল নামে একটি হস্তলিখিত মাসিকপত্র প্রকাশ শুরু করেছিলাম। কয়েকুটি ছেলেকে নিয়ে একটা দুঃস্থ(দের) সংস্থাও গঠন করি।
রিলিফের কাজে ব্যাপৃত থাকবার সময় সমাজের অবস্থা এবং বিভিন্ন লোকের মতিগতি সম্বন্ধে, নিজের দেখা কয়েকটি ঘটনা নিয়ে কাব্যবিশারদ (কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ) ধরনে হস্তলিখিত পত্রিকায় কিছু ব্যঙ্গ কবিতা প্রকাশ করি। কিন্তু সেজন্য নানাভাবে নাজেহাল হতে হয়। পত্রিকাও কিছুকাল বন্ধ রাখতে হয়। তারপরেই স্থানীয় সমাজ ও বিভিন্ন লোক সম্বন্ধে ছড়া, কবিতা বা গান লিখে নতুন ধরণের একটা জারিগানের দল গড়ে তুলি। এর মধ্যে মাঝে মাঝে মাথায় খেয়াল চাপতো, কিছু ম্যাজিক ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা আরম্ভ করেছিলাম, যেগুলি কাজে লাগিয়ে মানুষকে ভয় দেখানোর এবং কৌতুক সৃষ্টির জন্য অনেক কিছু করেছিলাম।
পূজার্চনা সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে মায়ের সঙ্গে প্রায়ই বাদানুবাদ হতো। একবার ভাইয়ের (মেজ ভাই নেপালচন্দ্র) ভয়ানক অসুখ হয়। ডাক্তার ও কবরেজ যখন আশা ছাড়লেন তখন একদিন স্বপ্ন দেখার ভান করে একটা অসুধ মাকে দিলাম, ওশুধ ধারণ করার পর রোগী ধীরে ধীরে আরোগ্যলাভ করে। এই ব্যাপারটাকে উপলক্ষ (করে) পদ্যছন্দে একটি ব্রতকথা লিখে ছাপিয়ে দিলাম। নাম ‘আপদ বিনাশিনীর ব্রতকথা’ বইটি ঘরে ঘরে প্রচারিত হলো। এমন কি আজও বোধ হয় এই ব্রতকথা কোনও কোনও স্থানে প্রচলিত আছে, প্রচারের পর মাকে সমস্ত বিষয়টা যে মিথ্যা তা খুলে বলি, এগুলির আসারতার কথা বুঝিয়ে দিলাম, অন্য লোকেদেরও বললাম, কিন্তু কেউ আমার এই সত্য কথা মানতে রাজি হন নি।
তারপর কলকাতার একটি ছেলেকে পাই, বয়স ২৫ এর মত, ভাল গান গাইতে পারে। পল্লীগীতিতে ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ও ‘লালাবাবুর দীক্ষা’ নামে দুটি পালাগান লিখে তাদের গিয়ে গাইবার ব্যবস্থা করেছিলাম। বেশ বড় দল হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে বর্ষীয়সী ও বৃদ্ধাদের দিয়ে পদ্মপুরাণ, ধর্মমঙ্গল, চণ্ডীর গানের একটা আসরও গড়ে তুলেছিলাম। ১৯২০ তেই সম্ভবত ‘কাজের লোক’ (Businessman) ও পরে ‘সনাতন’ পত্রিকার ভার নিয়েছিলাম।