ভ্যাকসিন কি সত্যিই আমাদের মুক্তি দেবে Covid-১৯-এর হাত থেকে? ভ্যাকসিন নিলেই কি আমরা সুরক্ষিত?
এই বিষয়টি নিয়ে এখনও পুরোদমে গবেষণা চলছে এবং নিত্যনতুন তথ্য সামনে আসছে। প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে ২৯.১১.২০২০ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে।
করোনা ভাইরাস (SARS-CoV-2) ভ্যাকসিনের (টিকা) কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে একটা ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে ঠিক কি প্রভাব ফেলে। এর জন্য সবার আগে বোঝা দরকার কোনো সংক্রমণ হলে মানব শরীর কি ভাবে তা প্রতিরোধ করে।
যখন কোনো ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, তখন তার মূল লক্ষ্য হলো নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। জীবাণু আমাদের শরীরের বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে এই উদ্দেশ্য সফল করে এবং এর ফলেই আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। আবার মানব দেহের ইমিউন সিস্টেমও তৈরি থাকে নানান অস্ত্র নিয়ে সংক্রমণ ঠেকাবার জন্য।
ইমিউন সিস্টেম-এর নানান অস্ত্র
আমাদের শরীরে ইমিউনিটি বা অনাক্রম্যতার দুটো ধাপ দেখা যায়। প্রথম ধাপ হলো ইননেট ইমিউনিটি, যাকে বলা যেতে পারে ‘first line of defence’। কোনো জীবাণুর সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায় (কয়েক মিনিট অথবা ঘন্টার মধ্যেই)। জীবাণুর কোষে বেশ কিছু প্যাটার্ন দেখতে পাওয়া যায়, যা শুধুমাত্র জীবাণুদের ক্ষেত্রেই থাকে। ইননেট ইমিউনিটি-তে আমাদের শরীর এই প্যাটার্ন দেখেই শত্রুদের চিহ্নিত করে। শত্রুকে চিহ্নিত করার পর এক বিশেষ ধরণের কোষ মাঠে নেমে পড়ে, এদেরকে বলে ম্যাক্রোফেজ (macrophage)। এটা এক বিশেষ ধরণের শ্বেত রক্ত কণিকা, যে বিভিন্ন জীবাণু অথবা কোনো মৃত কোষকে এক কথায় গিলে ফেলতে পারে। তবে এই ইননেট ইমিউনিটি দীর্ঘমেয়াদী নয়। কিন্তু ইননেট ইমিউনিটি সজাগ হওয়ার ফলে যে ম্যাক্রোফেজগুলো সক্রিয় হয়, এরাই পরের ধাপের ইমিউন রেস্পন্সকে কাজ করতে উদ্যত করে।
দ্বিতীয় ধাপ হলো এডাপ্টিভ বা অর্জিত ইমিউনিটি, এটাই কিন্তু কোনো জীবাণুর থেকে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা দেয়। এডাপ্টিভ ইমিউনিটি ঘটাতে সাহায্য করে কিছু বিশেষ ধরণের শ্বেত রক্ত কণিকা, বি-লিম্ফোসাইট বা বি-কোষ (B-lymphocyte) এবং টি-লিম্ফোসাইট বা টি-কোষ (T-lymphocyte)। বি-কোষ প্রধানত অস্থি মজ্জা বা বোনম্যারো (bone marrow) থেকে তৈরি হয়, আর সেই কারণেই ‘B’ কোষ নামকরণ। এরা মূলত অ্যান্টিবডি (antibody) তৈরি করে যেগুলো পরবর্তী কালে জীবাণু থেকে আসা একটা বিশেষ উপাদান (অ্যান্টিজেন)-কে আক্রমণ করে। এই অ্যান্টিবডি যেহেতু আমাদের শরীরের ফ্লুইড বা হিউমোর (humor) থেকে সনাক্ত করা যায়, তাই এই ধরণের প্রতিক্রিয়াকে বলে হিউমোরাল ইমিউন রেসপন্স। আবার টি-কোষর উৎসও সেই অস্থি মজ্জা, কিন্তু অপরিণত অবস্থায় এরা থাইমাস (১) (thymus)-এ চলে যায় এবং সেখান থেকেই পরিণত টি-লিম্ফোসাইট তৈরি হয়। আর সেই কারণেই ‘T’ কোষ নাম। সংক্রমিত কোষদেরকে আক্রমণ করে নষ্ট করে ফেলাই এদের প্রধান কাজ।
শত্রু চিনতে শেখা
প্রথম বার কোনো কাজ করতে আমার বা আপনার যেমন কিছুটা সময় লাগে শিখতে, ঠিক তেমনই প্রথম বার কোনো সংক্রমণ ঘটলে আমাদের শরীরের বেশ খানিকটা সময় লেগে যায় শত্রুকে চিহ্নিত করে রোগ প্রতিরোধ করতে। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি আবার একই ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস-এর আক্রমণ হয় তখন কিন্তু মোটেই আমাদের ইমিউন সিস্টেম এক মুহূর্ত দেরি করেনা শত্রুকে চিনতে। একটা বিশেষ ধরণের বি এবং টি-লিম্ফোসাইট-এর জন্য এটা সম্ভব হয়, এদের বলে মেমরি কোষ বা ইমিউন সিস্টেমের স্মৃতি শক্তি। কোনো চেনা জীবাণু দেখলেই এই মেমরি কোষ বি-লিম্ফোসাইট-কে অ্যান্টিবডি তৈরির নির্দেশ দিয়ে দেয়।
এইবার আসি ভ্যাকসিনের কথায়। এই যে এতক্ষণ অচেনা শত্রুর প্রথম আক্রমণের কথা বললাম, ভ্যাকসিন ঠিক এই ঘটনাটাকেই অনুকরণ করে। এর দুটো প্রধান সুবিধা। প্রথমত, অচেনা জীবাণুর আক্রমণে আমরা যতটা অসুস্থ হতাম, এর ফলে মোটেই সেরকম অসুস্থ হতে হবেনা। কারণ, ভ্যাকসিন তৈরি করা হয় সংক্রমণে অক্ষম জীবাণু বা জীবাণুর অংশ বিশেষ (যেমন প্রোটিন, ডিএনএ অথবা আরএনএ ইত্যাদি) দিয়ে। দ্বিতীয়ত, আমাদের ইমিউন সিস্টেম-এর একটা ট্রেনিংও হয়ে গেলো, সে মেমরি টি কোষ এবং বি-কোষ তৈরি করে ফেললো, যাতে ভবিষ্যতে এই জীবাণুর আক্রমণ হ’লে তৎক্ষণাৎ তাকে পত্রপাঠ বিদায় করতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভ্যাকসিন নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। সফল ভাবে ভ্যাকসিন দেওয়ার পর আমাদের শরীর বেশ কিছুটা সময় নেয় (অন্তত ১০-১৫ দিন) রোগ প্রতিরোধকারী বি-কোষ এবং টি-কোষ তৈরি করতে। অতএব, কেউ যদি ভ্যাকসিন নেওয়ার ঠিক আগে বা পরে সংক্রমিত হয়, তাহলে কিন্তু সে অসুস্থ হবেই।
কিন্তু একবার ভ্যাকসিন নেওয়াই কি যথেষ্ট? এটা অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে আলাদা হতে পারে। কিছু ভ্যাকসিন আছে একবার নিলেই আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে যথেষ্ট সজাগ করে দিতে পারে কিন্তু কিছু ভ্যাকসিন-এর ক্ষেত্রে একাধিক ডোজ প্রয়োজন, এটাকে বলে বুস্টার ডোজ। বিভিন্ন ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন কিছু ভ্যাকসিন হয় যা প্রাথমিক ডোজে যথেষ্ট ইমিউন রেসপন্স ঘটাতে পারেনা, তাই বুস্টার ডোজের দরকার (উদাহরণ মেনিনজাইটিস রোগের ভ্যাকসিন), আবার কিছু ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ডোজ নেওয়ার কিছু দিন পর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে যায়, তখনও বুস্টার ডোজ দিতে হয় (উদাহরণ ডিপথেরিয়া রোগের ভ্যাকসিন)।
ভ্যাকসিন তৈরির নানান ধাপ
কিন্তু ভ্যাকসিন তৈরি করা কোনো সহজ কাজ নয়। কোন রোগের ভ্যাকসিন তৈরি করতে গেলে অনেকগুলো ধাপ পেরোতে হয়।
ভ্যাকসিন তৈরির ছ’টা ধাপ আছে:
- প্রথম ধাপ: গবেষকরা অনুসন্ধান করেন এমন কোনো প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিমভাবে তৈরি অ্যান্টিজেন-এর যেটা দিয়ে শত্রুকে কাবু করা যায়।
- দ্বিতীয় ধাপ (pre-clinical stage): এই অ্যান্টিজেনকে (সম্ভাব্য ভ্যাকসিন) কোষ, কলা (টিস্যু) কিংবা মডেল প্রাণীর উপর পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার উদ্দেশ্য রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা জন্মালো কিনা, সেইটা পরখ করা। যদি সেরকম না হয় কিংবা উল্টে ক্ষতি হয়, তাহলে আর পরের ধাপে এগোনো হয়না।
- তৃতীয় ধাপ (clinical trials): এখানে তিনধাপে পরীক্ষা হয়। কোনো বেসরকারী সংস্থা সরাসরি ভলান্টিয়ারদের ওপর পরীক্ষা করে, ক্রমশ সংখ্যা বাড়িয়ে (প্রথমে ১০০-র কম, দ্বিতীয় ধাপে ১০০-র বেশি, শেষে প্রায় ১০,০০০-এর কাছাকাছি বা তারও বেশি)। যদি অ্যান্টিজেন সবরকম পরীক্ষায় পাশ করে, তবেই চতুর্থ ধাপে যায়।
- চতুর্থ ধাপ (regulatory review): এই ধাপে সংশ্লিষ্ট দেশের ড্রাগ কন্ট্রোল বোর্ড (যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে FDA, ভারতে CDSCO ইত্যাদি)-এর কাছে বায়োলজিক্যাল লাইসেন্স-এর জন্য আর্জি পাঠানো হয়। সেখান থেকে সম্মতি দিলে তবেই ব্যাপক হারে এই ভ্যাকসিন তৈরি করা যায়।
- পঞ্চম ধাপ (manufacturing): কোনো বড়ো ফার্মা কোম্পানি ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন তৈরি ও বন্টনের দায়িত্ত্ব নেয়।
- ষষ্ঠ ধাপ (quality control): FDA তথা অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ভ্যাকসিন-এর কিরকম প্রভাব হচ্ছে, সেইদিকে নজর রাখে।
এতক্ষণ ভ্যাকসিন সম্পর্কে যা যা বললাম, একটা কার্যকরী ভ্যাকসিনের থেকে ঠিক সেগুলোই প্রত্যাশা করা হয়।
Covid-১৯ এর ভ্যাকসিন কদ্দুর এগিয়েছে
Covid-১৯ সংক্রমণের প্রায় ৯ মাস অতিক্রম করার পর, সারা পৃথিবীর মানুষের এখন প্রশ্ন ভ্যাকসিন কবে আসবে? অথবা এলেও কতটা কার্যকর হবে?
এই Covid-১৯ অতিমারীর আবহে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা দিন রাত এক করে ভ্যাকসিনের গবেষণা করে চলেছেন। আশানুরূপ ফলও মিলেছে বিস্তর। সারা পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত অন্তত ১৩ টা ভ্যাকসিনের phase -৩ অর্থাৎ অন্তিম পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে এবং আরো ৩০ টারও বেশি ভ্যাকসিন বিভিন্ন প্রাথমিক পর্যায়ের ট্রায়াল-এ রয়েছে (phase ১ অথবা ২)। এর মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হলো অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং AstraZeneca-এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি ChAdOx-1। করোনা ভাইরাস (SARS-CoV-2)-এর একটা বিশেষ প্রোটিন (স্পাইক প্রোটিন) প্রস্তুতকারী জিনকে সংক্রমণে অক্ষম আডেনো ভাইরাস-এর মধ্যে ঢুকিয়ে এই ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে।
প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে এই ভ্যাকসিন-টি নন-হিউমান প্রাইমেটদের মধ্যে (যেমন বাঁদর, ওরাংওটাং, গরিলা ইত্যাদি) SARS-CoV-2 সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম। Phase-১/২ ক্লিনিকাল ট্রায়াল-এ প্রাথমিক এবং বুস্টার ডোসে (২৮ দিনের তফাতে) এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল ৫৪৩ জন সেচ্ছাসেবককে। পরীক্ষায় দেখা গেছে বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবকের ক্ষেত্রেই এই ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা আশার আলো। এখন বিভিন্ন দেশে ৩০০০০ সেচ্ছাসেবককে নিয়ে phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে এই ভ্যাকসিন-এর। তবে একজন সেচ্ছাসেবক অপ্রত্যাশিত ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়াতে এই ট্রায়াল কিছু দিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে ব্রিটেনে ৫ই অক্টোবর থেকে আবার এই ট্রায়াল শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক ফলাফল থেকে দেখা গেছে যে এই ভ্যাকসিন বয়স্ক মানুষের (বয়স ৬০ – ৭০ এর মধ্যে) মধ্যে বেশ ভালো কাজ করছে। তবে চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য phase-৩ ট্রায়াল শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ভারতীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা (pharmaceutical company) সিরাম ইনস্টিটিউট AstraZeneca-র সাথে যৌথ উদ্যোগে এই ভ্যাকসিন তৈরির দায়িত্ব নিয়েছে।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং বেলজিয়ামে জনসন এন্ড জনসন-এর উদ্যোগে আরও একটা ভ্যাকসিন-এর phase-৩ ট্রায়াল চলছিল ৬০০০০ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে, কিন্তু সংস্থার তরফ থেকে কিছুদিনের জন্য তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণটা সেই অপ্রত্যাশিত অসুস্থতা।বিশেষজ্ঞদের মতে যেকোনো ভ্যাকসিন ট্রায়াল -এর ক্ষেত্রেই এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে আশার খবর এই যে, অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আবার এই ট্রায়াল শুরু হয়েছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ এবং মডার্না-র যৌথ উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকসিন-ও বেশ আশানুরূপ ফল দিয়েছে এবং এটাও phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়ালে আছে। প্রাথমিক রিপোর্টে দেখা গেছে যে এই ভ্যাকসিন SARS-CoV-2-কে ঠেকাতে প্রায় ৯৪% কার্যকর। তবে phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাকাপাকি ভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।
ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা Pfizer এবং BioNTech নামে এক জৈবপ্রযুক্তি (biotech) সংস্থা যৌথ ভাবে বেশ কিছু mRNA ভ্যাকসিন তৈরি করেছে , এবং এর মধ্যে দুটো ভ্যাকসিন (BNT162b1 এবং BNT162b2) phase ১/২ ক্লিনিকাল ট্রায়াল-এ আশানুরূপ ফলও দিয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে চলা phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল-এর প্রাথমিক তথ্য থেকে দেখা গেছে যে BNT162b2 ভ্যাকসিন-টি SARS-CoV-2-এর সংক্রমণ ঠেকাতে ৯০% সক্ষম। তবে এই phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল-এর সম্পূর্ণ ফলাফল চলতি বছরের শেষের দিকে পাওয়া যেতে পারে।
এখনও পর্যন্ত যেকটা ভ্যাকসিন phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়ালে রয়েছে তার বেশিরবাগ-ই মানব দেহে উল্লেখযোগ্য ভাবে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তবে প্রায় প্রত্যেকটা ভ্যাকসিন-এর ক্ষেত্রেই প্রাথমিক ডোজ দেওয়ার পর বুস্টার ডোজ দিতে হয়েছে এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক কিছু উপসর্গ দেখা গেছে, যেমন ভ্যাকসিন দেওয়ার পর জ্বর জ্বর ভাব, গায়ে ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, গা গোলানো ইত্যাদি। তবে এই ধরণের উপসর্গ অনেক সময়ই হয়ে থাকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে। অক্সফোর্ডের গবেষকরা দেখেছেন সাধারণ প্যারাসিটামলেই এইসব উপসর্গ কমে যাচ্ছে।
এতক্ষন যেসব ভ্যাকসিনের কথা বললাম তা সবই ইন্ট্রামাস্কুলার অর্থাৎ পেশীতে ইনজেকশন দিতে হয়। সম্প্রতি ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিন-এর একদল বিজ্ঞানী ইন্ট্রা-ন্যাসাল অর্থাৎ নাকে স্প্রে করতে হয় এমন একটা ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। তাঁরা দেখেছেন পেশীতে ইনজেকশন দেওয়ার তুলনায় নাকে স্প্রে হিসেবে দিলে ভ্যাকসিনটি অনেক বেশি কার্যকরী হয়। গবেষণায় দেখা গেছে এই ভ্যাকসিনটি ইঁদুরের মধ্যে upper এবং lower respiratory tract (শ্বাস নালী)-এ SARS-CoV-2-এর সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম। ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক ভারত বায়টেক ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিন-এর সাথে যৌথ উদ্যোগে এই ভ্যাকসিনের phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করবে ভারতে।
কার্যকরী ভ্যাকসিন তৈরির পথে অন্যান্য বাধা
এত খানি আশার আলোর মধ্যেও বেশ কিছু প্রশ্ন এখনও বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো দ্বিতীয়বার করোনা সংক্রমণ। বিশ্বের বেশ কিছু জায়গা থেকে এরকম তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? আমাদের শরীর কি তবে দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারছেনা? নাকি দ্বিতীয়বার একই ভাইরাস-এর অন্য কোনো স্ট্রেন বা প্রকার আক্রমণ করার ফলে এমনটা হচ্ছে? এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। এর আগে SARS-CoV-2-এর মতো SARS-CoV-1 অথবা MERS (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) করোনা ভাইরাস সংক্রমণ-এর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পেশেন্টদের মধ্যে ২-৩ বছর পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে। ৫-৬ বছর পর কিন্তু তা কমে যায়। যেহেতু নভেল করোনা ভাইরাস বা SARS-CoV-2 একটা সম্পূর্ণ নতুন ভাইরাস, এর সংক্রমণ পরবর্তী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কে কিছুই জানা নেই। বিজ্ঞানীরাও নিত্য নতুন তথ্য থেকে পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছেন। আর সেই জন্যই ভ্যাকসিন যতই আশার আলো দেখাক না কেন, আমরা এখনো জানিনা ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি আমাদের শরীরে কতদিন স্থায়ী হবে। অথবা একই ধরণের ভ্যাকসিন কি সব বয়সের বা সব রকম ভৌগোলিক অবস্থানের মানুষের ক্ষেত্রে সমান ফল দেবে? এসবই সময় বলবে।
আরো একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সেটা হলো এই এত্ত ভ্যাকসিন স্টোর করার সমস্যা। এখনও অব্দি যত ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ হচ্ছে, তার বেশিরভাগই রাখতে হচ্ছে -২০ ডিগ্রি বা -৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস-এ, যেটা গরিব দেশের পক্ষে খুবই ব্যয় সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ভ্যাকসিন তৈরি করার পথে আরো একটা সমস্যা হলো অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহ্যান্সমেন্ট অফ ডিসিস বা সংক্ষেপে ADE। যে অ্যান্টিবডি আমাদেরকে রোগের হাত থেকে বাঁচাতে পারে, সেই অ্যান্টিবডিরই ক্ষমতা আছে অযাচিত ভাবে রোগ সংক্রমণ বাড়িয়ে তোলার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি না হয় তাহলে এমনটা হওয়ার সম্ভবনা থাকে। তবে যে সমস্ত ভাইরাস ম্যাক্রোফেজকে আক্রমণ করে তাদের ক্ষেত্রে মূলত ADE-এর আশঙ্কা থাকে। যদিও প্রি-ক্লিনিকাল ট্রায়াল-এ ADE কিছু প্রাণীর (নন-হিউমান) মধ্যে দেখা গেছে যাদের SARS-CoV-2-এর ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এটা পাকাপাকি ভাবে এখনও বলা যাচ্ছেনা যে SARS-CoV-2 ভ্যাকসিন-এর ক্ষেত্রে ADE হবেই। এর জন্য আরো অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।
সব শেষে বলি, সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা যেভাবে ভ্যাকসিন গবেষণার জন্য কাজ করছেন তাতে হয়তো কোনো না কোনো সমাধান এই রোগের একদিন পাওয়া যাবে। কিন্তু একবার কার্যকরী ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেলেও তা প্রতিটা মানুষের কাছে পৌঁছতে অন্তত ২-৩ বছর লেগে যাবে। তাই এখন আমাদের কর্তব্য হলো মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে বার বার হাত ধোয়া এবং অযাচিত ভীড় এড়িয়ে চলা। এভাবেই আমরা নিজেদের এবং আমাদের আশেপাশের মানুষদের সুরক্ষিত রাখতে পারবো।
টীকা : থাইমাস (Thymus): এটি একধরণের গ্রন্থি, যেটা মানব দেহের দুটো ফুসফুসের মাঝে ঠিক হৃদপিণ্ডের সমান উচ্চতায় অবস্থিত। একটি মানব শিশু জন্মানোর পর এক বছর বয়স অব্দি থাইমাস দ্রুত গতিতে আকারে বাড়তে থাকে; তারপর অবশ্য খুব ধীর গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত। মূলত থাইমোসিন (thymosin) নামক হরমোন ক্ষরণ করা এই গ্রন্থির কাজ। পরিণত টি সেল তৈরি করতে উদ্দীপিত করে এই থাইমোসিন হরমোন।
তথ্যসূত্র :
- Immunological memory cells (DOI: https://doi.org/10.5114/ceji.2018.77390 ).
- Understanding How Vaccines Work (https://www.cdc.gov/vaccines/hcp/conversations/downloads/vacsafe-understand-color-office.pdf?fbclid=IwAR1n8hXXk_ZJtbiu7yfGW9sUiIiIsK68HVgASBrFQreMogRqIcyP8bVtBFY)
- https://www.khanacademy.org/science/in-in-class-12-biology-india/xc09ed98f7a9e671b:in-in-human-health-and-disease/xc09ed98f7a9e671b:in-in-types-of-immunity-and-the-immune-system/a/adaptive-immunity
- Alberts B, Johnson A, Lewis J, et al. Molecular Biology of the Cell. 4th edition. New York: Garland Science; 2002. Innate Immunity. Available from: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK26846/
- https://www.nytimes.com/2020/10/14/health/covid-clinical-trials.html
- https://onlinepublichealth.gwu.edu/resources/producing-prevention-the-complex-development-of-vaccines/
- Safety and immunogenicity of the ChAdOx1 nCoV-19 vaccine against SARS-CoV-2: a preliminary report of a phase 1/2, single-blind, randomised controlled trial. (https://doi.org/10.1016/S0140-6736(20)31604-4)
- https://www.bbc.com/news/health-54993652
- SARS-CoV-2 immunity: review and applications to phase 3 vaccine candidates. (https://doi.org/10.1016/S0140-6736(20)32137-1).
- https://www.bbc.com/news/health-54902908
- https://www.pfizer.com/news/press-release/press-release-detail/pfizer-and-biontech-announce-vaccine-candidate-against
- A Single-Dose Intranasal ChAd Vaccine Protects Upper and Lower Respiratory Tracts against SARSCoV-2 (https://doi.org/10.1016/j.cell.2020.08.026)
- https://www.thehindu.com/sci-tech/science/bharat-biotech-inks-pact-with-wus-school-of-medicine-for-covid-19-intranasal-vaccine/article32674865.ece
- A perspective on potential antibody-dependent enhancement of SARS-CoV-2 (https://www.nature.com/articles/s41586-020-2538-8).
- Immunological considerations for COVID-19 vaccine strategies (https://doi.org/10.1038/s41577-020-00434-6).
- ADE সম্পর্কে আরো জানতে এই ভিডিওটা দেখুন:
khub valo ar somoyochito lekha. agrohi thaklam emon lekhar jonyo. Ritwik