প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বে সুপারকন্ডাক্টার আবিষ্কারের কাহিনী, তার অদ্ভূত সব আচরণ এবং সেই আচরণের ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আজকের কাহিনী সুপারকন্ডাক্টার-এর প্রযুক্তিগত ব্যবহার নিয়ে। কি ধরণের প্রযুক্তি বেরিয়েছে সুপারকন্ডাক্টার-এর অদ্ভূত আচরণ থেকে, এবং তাকে বাস্তবে রূপ দিতে বাধা কোথায়, আজকের আলোচনা এই বিষয়গুলি নিয়ে।
প্রযুক্তিতে সুপারকন্ডাক্টার-এর ব্যবহার
সুপারকন্ডাক্টারের প্রতিরোধক্ষমতা শূন্য হওয়ার কারণে প্রযুক্তিতে এর বহু উপযোগিতা রয়েছে। যেখানে অবিচ্ছিন্নভাবে বিরাট পরিমাণের বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা প্রয়োজন, সেখানে এর জুড়ি মেলা ভার। খালি একটাই ব্যাপার – যে সরঞ্জামের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে তাকে বেশ ঠাণ্ডা করে রাখতে হবে, কারণ আমাদের স্বাভাবিক জগতের তাপমাত্রায় (অর্থাৎ ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২৯৩ কেলভিনের আশেপাশে) থাকলে সুপারকন্ডাক্টার দশা লোপ পাবে। সুপারকন্ডাক্টিভিটীর ইতিহাসের একদম শুরুর দিন থেকেই চেষ্টা চলছে এমন বস্তু আবিষ্কার করার যা কিনা এরকম তাপমাত্রাতেও শূন্য প্রতিরোধক্ষমতায় বিদ্যুৎবহনে সক্ষম হবে। সেরকম জিনিসের এখনও দেখা মেলেনি। সেই কথায় আসছি একটু পরে।
প্রতিরোধক্ষমতা শূন্য হওয়ার কারণে সুপারকন্ডাক্টার দিয়ে তৈরি বলয়াকার তারের মধ্যে দিয়ে বিদু্ৎপ্রবাহ চলতে থাকে অবিরাম, কোনো শক্তির যোগান ছাড়াই। সুপারকন্ডাক্টারের সবথেকে প্রচলিত ব্যবহার হচ্ছে শক্তিশালী চুম্বক তৈরিতে। সুপারকন্ডাক্টার দিয়ে বানানো বলয়াকার তারের মধ্যে বিদ্যুৎ পাঠিয়ে বিরাট মাত্রার চুম্বকীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি করা যায়। বিদ্যুৎপ্রবাহ ক্ষয় না পেয়ে অবিরাম চলতে থাকে এর ভেতর। তাকে ক্রমাগত শক্তির যোগান দেওয়ার দরকার পড়ে না।
কোথায় কোথায় এর প্রয়োগ হয় দেখা যাক। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এম . আর . আই . বলে একটি যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। এম . আর . আই . আদ্যক্ষরের অর্থ হচ্ছে ম্যাগনেটিক রেসোনান্স ইমেজিং। অনেকেই এটিকে চিকিৎসাকেন্দ্রে দেখে থাকতে পারেন। শরীরের নানা বৃত্তান্ত এই যন্ত্র বাইরে থেকে দেখতে পায়, তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ ও শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে। এখানে ব্যবহৃত হয় একটি প্রকাণ্ড বলয়াকার সুপারকন্ডাক্টার।
আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে জাপানে আবিষ্কৃত এক অত্যাধুনিক ট্রেন প্রযুক্তি, যার নাম সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেটিক লেভিটেশন (প্রচ্ছদের ছবিটি দেখুন)। ট্রেনের গায়ে লাগানো থাকে সুপারকন্ডাক্টারজাত চুম্বক আর রেললাইনের সঙ্গে থাকে বিভিন্নরকম বিদ্যুতবাহী তারের সারি। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে ট্রেনের ওপর এক বলের সৃষ্টি হয় যা তাকে লাইনের একটুখানি ওপরে শূন্যে ভাসিয়ে রাখে! এতে প্রবল গতিতে ট্রেন চলাচল সম্ভব হয়। সারা পৃথিবীর মধ্যে দ্রুততম ট্রেন হওয়ার নজির গড়েছে এই প্রযুক্তি। এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে এবং আশা করা হচ্ছে শীঘ্রই একে দৈনন্দিন যাত্রী পরিষেবার কাজে লাগানো যাবে।
সুপারকন্ডাক্টার দশার তাপমাত্রা বৃদ্ধির দৌড়
পদার্থবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদরা বহুকাল ধরে নতুন নতুন পদার্থ বানিয়ে পরীক্ষা করে চলেছেন কী করে সুপারকন্ডাক্টারের দশা পরিবর্তনের তাপমাত্রা বাড়ানো যায়। একটা সময় ছিল যখন চিত্রটা হতাশাজনক হয়ে পরে। ১৯৭০ এর দশকের দিকে তাকানো যাক। Nb3Ge সূত্রের যৌগে ২৩ কেলভিনে সুপারকন্ডাক্টিভিটী দেখা যেত। সেই সময়ে এটাই ছিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় অতিপরিবাহীতার নিদর্শন। ২৩ কেলভিন সাধারণ তাপমাত্রার দশ ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম।
বি. সি. এস. তত্ত্বকে ভিত্তি করে কোনও ধাতুর সুপারকন্ডাক্টার দশা পরিবর্তনের তাপমাত্রা কত হবে, তা আন্দাজ করা সম্ভব। প্রধানত তিনটে জিনিস এই তাপমাত্রা নির্ধারণ করে – ইলেক্ট্রনদের ঘনত্ব, আয়নদের নড়াচড়ার ফলে পদার্থের অভ্যন্তরীন কম্পনের শক্তির মাত্রা (পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ‘ফোনন’) ও ইলেক্ট্রনের সঙ্গে ফোননের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা। এর প্রত্যেকটি যত বেশি হবে, তত উচ্চ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটী পাওয়ার আশা করা যেতে পারে। সমস্যা হল, যা যা ধাতব পদার্থের কথা ভাবা যাচ্ছিল, হিসেব করে দেখা যাচ্ছিল তাদের কারও সুপারকন্ডাক্টার দশার তাপমাত্রা তখন যা জানা আছে তাকে ছাড়িয়ে বেশিদূর বাড়বে না।
পরিচিত ধাতুদের বাইরে নতুন কী পদার্থ সৃষ্টি করা সম্ভব যার অভ্যন্তরীণ গঠনের ফলে ইলেক্ট্রনদের পারস্পরিক আকর্ষণ থেকে উষ্ণতর তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটী তৈরি হতে পারে? এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবছিলেন য়োহানেস বেডনোর্টস ও কার্ল আলেক্সান্ডার ম্যূলার। কিছুটা তাত্ত্বিক গণনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আর কিছুটা নিজেদের অনুমাণ কাজে লাগিয়ে তাঁরা সুপারকন্ডাক্টিভিটীর অস্তিত্ব খুঁজছিলেন ক্যূপ্রেট বলে একশ্রেণীর যৌগে।
ক্যূপ্রেটরা গঠিত হয় তামা, অক্সিজেন ও অন্যান্য মৌলিক পদার্থের অণু সহযোগে। ১৯৮৬ সালে বেডনোর্টস ও ম্যূলার দেখতে পেলেন ৩৫ কেলভিন তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটী ঘটে Ba-La-Cu-O সূত্রের ক্যূপ্রেটে, যা হল তখনকার দিনে উষ্ণতম সুপারকন্ডাক্টারের নিদর্শন।
ক্যূপ্রেট-এর চাঞ্চল্যকর আচরণ
যে যে পদার্থে সুপারকন্ডাক্টিভিটীর ব্যাখ্যা বি. সি. এস. তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে সাধারণ তাপমাত্রায় ধাতুর গুণ ভালো করে দেখা যায়। ক্যূপ্রেটদের মোটেই সেই গোত্রে ফেলা চলে না। এই আবিষ্কার প্রমাণ করল প্রচলিত ধারণার বাইরেও অন্যান্য বস্তু রয়েছে যাদের মধ্যে সুপারকন্ডাক্টার দশার খোঁজ করা প্রয়োজন।
এমন যুগান্তকারী কাজের জন্যে বেডনোর্টস ও ম্যূলার নোবেল পুরষ্কার পেলেন ঠিক তার পরের বছর, ১৯৮৭-তে। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানমহলে সারা পরে গেছে। নতুন সব ক্যূপ্রেটে সুপারকন্ডাক্টিভিটী খোঁজা শুরু হয়েছে। এই প্রচেষ্টা আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথেই পাওয়া গেল ৯৩ কেলভিনে সুপারকন্ডাক্টিভিটী, Y-Ba-Cu-O তে। এই বস্তুটিকে তরল নাইট্রোজেনে (যার তাপমাত্রা ৭৭ কেলভিন) রাখলেও সে সুপারকন্ডাক্টার দশায় থাকে। বাতাস নাইট্রোজেনে ভরপুর, তাই তরল নাইট্রোজেন অনেক গুণ বেশি সহজলভ্য তরল হিলিয়ামের চেয়ে। প্রযুক্তিতে কাজে লাগার জন্যে সুপারকন্ডাক্টার একটা নতুন যুগে পা দিল।
ক্যূপ্রেটে সুপারকন্ডাক্টিভিটীর আবিষ্কার বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে, প্রচারমাধ্যম তথা জনগণকে মৌলিক বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে উৎসাহী করে তোলে। ক্যূপ্রেটে সুপারকন্ডাক্টিভিটীর আবিষ্কার কিরকম চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল তা একটা ঘটনা থেকে বোঝা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান ফিজিকাল সোসাইটি মার্চ মাসে একটি বার্ষিক সম্মেলন আয়োজন করে যেটি পদার্থবিজ্ঞানের জগতে সুপ্রসিদ্ধ। নিউ ইয়র্কে ১৯৮৭ সালের এই সম্মেলনটি ছিল বিশেষভাবে স্মরণীয়। তখন ক্যূপ্রেট-সংক্রান্ত নিত্যনতুন আবিষ্কার হয়ে চলেছে আর এই নিয়ে বিজ্ঞানমহলে উত্তেজনা তুঙ্গে। সম্মেলনের আয়োজকরা উচ্চ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটী নিয়ে একদিন একটি বিশেষ অধিবেশনের ব্যবস্থা করেন। এই অধিবেশন শুরু হয় সন্ধে সাড়ে সাতটায়। একান্ন জন তাঁদের বক্তব্য রাখেন আর অধিবেশন যখন শেষ হয় তখন বাজে রাত সোয়া তিনটে! শ্রোতার সংখ্যা ছিল প্রায় দুহাজার, সম্মেলনকক্ষে সকলের জায়গাও হয়নি। যাঁরা সেদিন উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় যে সেই পরিবেশ ছিল উৎসবের মত। পদার্থবিজ্ঞানের সম্মেলনে এমন উন্মাদনা খুবই বিরল ঘটনা।
কেন অপেক্ষাকৃত উচ্চ তাপমাত্রাতেও সুপারকন্ডাক্টিভিটি সম্ভব
সাধারণ বায়ুচাপের অধীনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটীর নজির হচ্ছে ১৩৩ কেলভিন। Hg–Ba–Ca–Cu–O সূত্রের বস্তুতে তা দেখা যায়। কেন এই নতুন জিনিসগুলোতে এত উষ্ণ অবস্থাতেও এই দশা দেখা যাচ্ছে, সেই প্রশ্নটি বিজ্ঞানীদের আজও ভাবিয়ে চলেছে। আয়নের সঙ্গে ইলেক্ট্রনের আকর্ষণ থেকে ফোননকে কেন্দ্র করে ইলেক্ট্রনদের মধ্যে আকর্ষক বল সৃষ্টি হওয়ার যে কথা বি. সি. এস. তত্ত্বে আছে, এখানে সেই ব্যাখ্যা খাটে না। সম্পূর্ণ নতুন কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন। এই নিয়ে তিন দশক পরেও হয়ে চলেছে অনেক আলোচনা, অনেক বিতর্ক। এমন কোন সমাধান পাওয়া যায়নি যাকে সব দিক থেকে সঠিক ঘোষণা করে বিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেন।
বি. সি. এস. তত্ত্ব থেকে যে ধাতুদের ধর্ম নিয়ে হিসেব কষা যায়, তাদের মধ্যে খুঁজলে সাধারণ তাপমাত্রায় অতিপরিবাহীতা পাওয়ার আশা নেই তা বলেছি একটু আগে। একটা ব্যতিক্রম অবশ্য ভাবা গিয়েছিল – কঠিন হাইড্রোজেন। কঠিন পদার্থের অভ্যন্তরে আয়নদের বন্ধনের স্থিতিস্থাপক ধর্মের কারণে তারা স্পন্দনরত অবস্থায় থাকে। কঠিন পদার্থে এমন তরঙ্গ সহজাতভাবে উপস্থিত। বিভিন্ন প্রকারের স্পন্দনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে শক্তির কিছু নির্দিষ্ট মাত্রা, যারই নাম ফোনন।
বি. সি. এস. তত্ত্বে ফোননদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুপার জোড়াদের সৃষ্টি হওয়ার মূলে রয়েছে ইলেক্ট্রনের সাথে আয়নদের শক্তি আদানপ্রদানের প্রক্রিয়া। হিসেব করলে দেখা যায় যে সুপারকন্ডাক্টিভিটীর দশা পরিবর্তনের তাপমাত্রা নির্ভর করে ফোননের ওপর। হাইড্রোজেনের অণু মৌলিক পদার্থের মধ্যে সবচেয়ে হাল্কা – সেই কারণে কঠিন হাইড্রোজেনের অন্তর্নিহিত কম্পনের শক্তির মাত্রা বৃহৎ হওয়ার কথা। এই ঘটনার ভিত্তিতে ও অন্যান্য আরও কিছু কারণ বিবেচনা করে হিসেব করে দেখা যায় যে এই পদার্থে অতিপরিবাহীতা ঘটতে পারে অনেক উচ্চ তাপমাত্রায়।
সমস্যা হল, হাইড্রোজেনকে সাধারণ তাপমাত্রায় কঠিন ধাতুর অবস্থায় রাখতে গেলে তার ওপর বিপুল চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বাস্তব জগতে এই সুপারকন্ডাক্টারকে পাওয়া দুরূহ কাজ। সাম্প্রতিক কালে কয়েকজন গবেষক এই কাজটিকে অপেক্ষাকৃত সরল করার চেষ্টা করেছেন হাইড্রোজেনের বদলে কিছু হাইড্রোজেন-সংবলিত যৌগ নিয়ে পরীক্ষা করে, যাদের পরিবাহী ধাতুতে পরিণত করা তুলনায় সহজ। সেভাবেই জানা গেছে H2S-এর ওপর সাধারণ বায়ুচাপের থেকে ১৫ লক্ষ গুণ বেশি চাপ দিলে (যা কিনা পৃথিবীর কেন্দ্রে চাপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) তাতে সুপারকন্ডাক্টিভিটী দেখা যায় ২০৩ কেলভিনে। এখনও অবধি সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটীর নিদর্শন এটাই। সাধারণ তাপমাত্রা থেকে যার দূরত্ব আর মাত্র ৯০ কেলভিন। এই বাকি পথটুকু যেতে আর কতদিন লাগবে? সেইটা আন্দাজ করার কোন উপায় নেই। সেই দিন না আসা পর্যন্ত সাধারণ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটীর সন্ধানে পৃথিবীর নানা প্রান্তে পরীক্ষানিরীক্ষা অবিরাম চলতেই থাকবে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : এই লেখাটি পড়ে মতামত দিয়ে সাহায্য করার জন্যে আমি শ্রীনন্দা ঘোষের কাছে কৃতজ্ঞ।
darun sundor totthosomriddho lekha