আমরা রোজকার সাধারণ ঘটনার আড়ালে বিজ্ঞানটা কিভাবে বোঝার চেষ্টা করি? হয় বয়োজেষ্ঠ্যদের জিজ্ঞাসা করে কিম্বা বিজ্ঞানের বইপত্তর ঘেঁটে। আজ এমন একটা ঘটনা বলবো যেটা আমরা সবাই হয়ত দেখেছি কিন্তু তার কারণ খুঁজে বার করা সহজ নয়। কি কারণে সূর্যের আলো না থাকলে নর্দমা থেকে দুর্গন্ধ বের হয়।
চায়ের দোকানের টিউব ওয়েলের নিত্য ব্যবহারে যে নর্দমাটা তৈরী হয় (চিত্র-a), ভোরে বা সন্ধ্যায় সেটা থেকে পচা ডিমের মত দুর্গন্ধ বেরোতে থাকে। সূর্যের আলোতে এই দুর্গন্ধ কমে যায় আর মাঝ দুপুরে কর্পুরের মত উবে যায়। রাতের সময়ে আবার এই দুর্গন্ধের প্রকোপ বেশী হতে থাকে। বাদলা দিনে সূর্যের আলো না থাকার ফলে এই দুর্গন্ধ বন্ধ হয় না। নর্দমাতে পচনশীল জৈবিক পদার্থগুলিই কি এই দুর্গন্ধের উৎস? আর তাদের সঙ্গে দিনের আলো আর রাতের আধাঁরের সম্পর্ক কি?
আর একটা কথা – সেদিন নর্দমাটা পরিষ্কার করার সময় তার ভিতরের কালো পচা মাটি তুলে নিয়ে নর্দমাটার পাড়ে ফেলা হচ্ছিলো (চিত্র-b)। স্কুলে যাবার সময় লম্বা করে এই কালো পচা মাটির স্তুপ নর্দমাটার পাড়ে পড়ে থাকতে দেখলাম। কিন্তু পরদিন স্কুল যাবার সময় দেখলাম যে কালো মাটির একেবারে উপরের অংশটা গাঢ় বাদামী হয়ে গেছে (চিত্র-c)। অনেকটা কালো পাহাড়ের চূড়ার বরফ বিকেলের সূর্যের আলো পড়লে যেমন লাগে, সেরকম গেরুয়া মাটির মত দেখতে। দিন কয়েক পরে দেখলাম যে পাড়ে তোলা কালো মাটি আমাদের খেলার মাঠের বাদামী রঙের মাটির মতন হয়ে গেছে।
এরকম কেন হয় তা জানতে গেলে আমাদের পৃথিবীর প্রথম জীবনের উৎসের সন্ধানে যেতে হবে। খুব পেছনে না গিয়ে বলি, আজ থেকে মাত্র ৫৭-কোটি বছর আগে পৃথিবীর আবহাওয়া আজকের তুলনায় একেবারেই অন্যরকম ছিলো। পৃথিবীতে গাছপালা না থাকায় বাতাসে অক্সিজেনও ছিলো না। লাল রক্ত যুক্ত আমাদের মতো কোনো প্রাণীর অস্তিত্বও ছিল না (হ্যাঁ,নীলচে সবুজ রঙের রক্ত নিয়েও জীবন আছে)।
যেসব জীবাণু তখন তৈরী হয়েছিলো, তারা মুক্ত অক্সিজেন না পেয়ে শক্তি সংগ্রহের জন্য অকার্বনিক (non-carbonic) যৌগগুলির সাহায্যে খাবারের জারণ (oxidation) করতো। আমরা খাবার থেকে শক্তি আহরণের সময় oxidative phosphorylation প্রক্রিয়ায় তৈরী ইলেকট্রনগুলি শ্বাস-প্রশ্বাসের সাহায্যে বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত করে দিই। অক্সিজেন থেকে অক্সাইড আয়ন বানিয়ে, তারপর প্রোটনের সঙ্গে বিক্রিয়া করিয়ে তাকে জলে পরিবর্তিত করি। অক্সিজেন না থাকার ফলে আগের সেই জীবাণুগুলি খাবার থেকে শক্তি আহরণের সময় তৈরী হওয়া ইলেকট্রনগুলি সালফেট জাতীয় যৌগের ভিতরে পাচার করে দিতো।
সালফেট আয়নের মধ্যে অবস্থিত সালফারের যোজ্যতা +6। এর সাথে 8-টি ইলেকট্রন যুক্ত করে সালফারের যোজ্যতাকে -2 ( sulfide) করলে তা প্রোটনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন সালফাইড তৈরী করে। অক্সিজেনের উপস্থিতিতে শ্বাস-প্রশ্বাসে যেমন জল তৈরী হয়, ঠিক সেই ভাবেই এই জীবাণুরা অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে জলের সাথে সাথে সালফেট থেকে হাইড্রোজেন সালফাইড তৈরী করে বেঁচে থাকে।
SO42- + 10H+ + 8e– → H2S + 4H2O
কোনো ইলেকট্রিক সার্কিটকে কার্যকরী করতে সার্কিটটিকে আর্থ করা প্রয়োজন। যাতে ইলেকট্রনগুলিকে কাজের শেষে শোষণ করে নেওয়া যায়। শরীরের শক্তি তৈরীর যন্ত্রটিও কাজ করা বন্ধ করে দেয় যদি না উৎপন্ন ইলেকট্রনগুলি কাজের শেষে সরিয়ে ফেলা হয়। যে ইলেকট্রনগুলির উৎপত্তি হয় নানা কাজের মধ্যে দিয়ে, সবশেষে ঐ আর্থ করার প্রক্রিয়ায় সেগুলির শোষণ হওয়াটা অত্যন্ত জরুরী।
এই কাজটার জন্যে আমরা অক্সিজেন (aerobic respiration) ব্যবহার করে থাকি। আর যেসব জীবাণু পৃথিবীতে অক্সিজেন উৎপন্ন হবার আগেই এসেছিলো, তারা বিভিন্ন ধরণের যৌগপদার্থের ব্যবহার (anaerobic respiration) করে থাকে। তাই অক্সিজেনকে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াতে টার্মিনাল ইলেকট্রন অ্যাকসেপ্টর (terminal electron acceptor) বলা হয়। একই ভাবে সালফেট আয়নটিকে এই ধরণের জীবাণুদের টার্মিনাল ইলেকট্রন অ্যাকসেপ্টার বলা যেতে পারে। যেহেতু তা উৎপন্ন ইলেকট্রনগুলির সদগতি করতে পারে।
নর্দমাতে এই জীবাণুদের দ্বারা উৎপন্ন হাইড্রোজেন সালফাইডের দুর্গন্ধের সাথেই আমরা পরিচিত। রাত্রির অন্ধকারে যে জীবাণুরা তাদের বাঁচার প্রক্রিয়ায় দুর্গন্ধযুক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড তৈরী করে, তাদের বৈজ্ঞানিক নাম ডীসাল্ফোভিব্রিও (Desulfovibrio)। এই গোত্রের মধ্যে অনেক ধরণের জীবাণু আছে। চিত্র-d তে ব্যাকটেরিয়ার চিত্রটি Desulfovibrio desulfuricans G-20-র। এদের সালফেট রিডিউসিং ব্যাকটেরিয়া (SRB) বলেও ডাকা হয়ে থাকে। খাবার জারণের সময় এরা এই সালফার জাতীয় যৌগগুলিকে উৎপন্ন ইলেকট্রনগুলি দান করে জারণ-বিজারণের প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণ করে।
সূর্যের আলোতে এরা খাবার খায় না কেন? এই জীবাণুগুলো পৃথিবীতে অক্সিজেন উৎপন্ন হবার আগেই এসেছিলো, তাই অক্সিজেনকে এরা একদম পছন্দ করে না। অক্সিজেনের উপস্থিতি এদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
রাতের অন্ধকারে পৃথিবীতে সূর্যের আলো না পড়ার ফলে গাছ ও ঘাস সালোকসংশ্লেষ বন্ধ করে দেয়। বাতাসে নতুন করে অক্সিজেন সরবরাহ করে না। গাছপালারা তখন শুধু কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে মাটির কাছের বাতাসকে প্রায় অক্সিজেন-শূন্য করে দেয়। কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর হালকা আস্তরণে ঢেকে ফেলে। সেই সময় অক্সিজেনের ভয়ে মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা এই জীবাণুগুলি উপরে উঠে আসে নর্দমায় থাকা তাদের খাবার খেতে। সাধারণ জল সালফেট আয়নে ভর্তি, আর জীবানুগুলির খাদ্য কার্বনের যৌগগুলি তো মানুষের পরিত্যক্ত ও বর্জিত ভুক্তাবশেষ হিসেবে রয়েইছে।
এদের খাবারের মাধ্যমে তৈরী হওয়া হাইড্রোজেন সালফাইড প্রথমে নর্দমার মাটির সঙ্গে যুক্ত বাদামী রঙের আয়রন (ferric; Fe(III)) অক্সাইডকে রিডিউস (reduce) করে সবুজ-কালো রঙের ফেরাস (Fe(II)) অক্সাইডে(FeO) পরিবর্তিত করে। পরে বেশী হাইড্রোজেন সালফাইডের প্রভাবে তা কালো ফেরাস সালফাইডে (FeS) রূপান্তরিত হয়।
Fe2O3 + H2S → | FeO + H2O |
বাদামী | সবুজাভ কালো |
FeO + H2S → | FeS + H2O |
সবুজাভ কালো | কালো |
বাড়তি হাইড্রোজেন সালফাইড তার পচা ডিমের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই খাওয়া-দাওয়া সালোকসংশ্লেষ-জাত অক্সিজেনের ফলে বিঘ্নিত হয়। প্রাণের ভয়ে এই জীবাণুগুলি আবার মাটির নীচে লুকিয়ে পড়ে আর পরের সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
নর্দমার মাটি কালো দেখায় ফেরাস সালফাইডের জন্যে। যখন নর্দমা থেকে সেটাকে উপরে তুলে ফেলা হয়, বাতাসের অক্সিজেনের প্রভাবে জারিত হয়ে সেটা আবার বাদামী রঙের ফেরিক অক্সাইডে (Fe2O3) পরিবর্তিত হয়।
আজকাল আমরা এদের জন্য ফাস্ট ফুডের ব্যবস্থা করে ফেলেছি: জামা-কাপড় পরিষ্কার করার ডিটারজেন্ট। টিওবওয়েলের সিমেন্ট বাঁধানো জায়গায় কাপড় কাচলে, ময়লা সহ ডিটারজেন্ট নর্দমার জীবাণুগুলির মহাভোজের খাবার হয়।
ডিটারজেন্টগুলি সাধারনত ১৩-১৪ টি অ্যালিফ্যাটিক কার্বন চেন দিয়ে তৈরী হয়। তার শেষ প্রান্তে একটা সোডিয়াম যুক্ত সালফোনেট গ্রুপ (-SO3Na) লাগানো থাকে যাতে ডিটারজেন্ট জলে গুলনশীল হয়। এটা কিন্তু এই জীবাণুগুলির রেডিমেড খাবার। কার্বনের অংশটা খাবার আর সালফোনেট গ্রুপের সালফারের অংশটা ইলেকট্রন রাখার পাত্রের মত ব্যবহৃত হতে থাকে।
উন্নত দেশগুলিতে কাঁচা নর্দমা (open drainage) দেখা যায় না। ঢাকা অবস্থায় নর্দমার জল শোধাণাগারের মাধ্যমে পরিষ্কার করে মাঠের কৃষির কাজে ব্যবহৃত হয়। এতে মশার উপদ্রবও হয় না আর রাস্তাঘাট দেখতে পরিষ্কার মনে হয়। সন্ধ্যা বেলায় হাইড্রোজেন সালফাইডের দুর্গন্ধে আবহাওয়াও খারাপ হয় না। আমরা কি আমাদের শহর সেরকম রাখতে পারি না?
তবে হাইড্রোজেন সালফাইডের সবটাই খারাপ নয়। আমাদের শরীরে এটা খুবই কম মাত্রায় তৈরী করে থাকি। এটা না থাকলে আমরা অ্যাল্জহাইমার (Alzheimer) ও পার্কিনসন (Parkinson) নামক স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত হতে পারি। এটা একেবারে অন্য একটা বিষয়, তাই পরে একদিন বলা যাবে।
ছবি:
- প্রচ্ছদ: The Hindu
- Desulfovibrio desulfuricans G-20-র ছবি:Lawrence Berkley National Laboratory