দক্ষিণ ভারতের গ্রামাঞ্চলে সদ্য অপারেশন সোলার ফার্মইয়ার্ড (Operation Solar Farmyard) সম্পন্ন হলো। যে প্রত্যন্ত গ্রামে আমাদের পর্যবেক্ষণকেন্দ্র বসাতে চেয়েছিলাম, সেখানে বিদ্যুতের অবস্থা ভালো নয়: এই আসে, এই যায়, কখনো আবার ভোল্টেজ বেড়ে যায় ঝপ করে। স্থানীয় বিদ্যুতের উপর নির্ভর করলে আমাদের মহাকাশ দেখার ক্যামেরাগুলি বেশিদিন টিকতো না। তাই গবেষণাগারে নির্বিঘ্ন গবেষণার স্বার্থে এই অপারেশন সোলার ফার্মইয়ার্ড-এর কথা ভাবা হলো।
যে গবেষণাগারটির কথা বলছি, এরকম আরো কয়েকটি আছে, সব মিলিয়ে পাঁচ ভাইবোন। এদের গ্লোবাল জেট ওয়াচ অব্জারভেটরি (Global Jet Watch Observatory) বলা হয়। বিস্তারিত জানতে এখানে দেখুন: www.globaljetwatch.net। পাঁচটি টেলিস্কোপ পৃথিবীর দ্রাঘিমা বরাবর এমনভাবে বসানো যে দিনের যে কোনো সময়ে এর মধ্যে একটি অন্তত অন্ধকারে থাকে। অন্ধকারে থাকাটা অপটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি-র জন্য খুবই জরুরি কারণ দিনের বেলা সূর্যের চোখধাঁধানো আলোয় আর কিছুই দেখা যায় না। তাই, দিনের বেলা পর্যবেক্ষণ বন্ধ রাখতে হয়। কিন্তু পাঁচটি টেলিস্কোপকে এইভাবে বসানোর ফলে মহাকাশ দেখার একটি অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরী হয়েছে।
আমাদের ছায়াপথে থাকা ব্ল্যাক হোল (black hole) বা কৃষ্ণগহ্বরকে এখন চব্বিশ ঘন্টা চোখে চোখে রাখা যাবে। এইরকমটা করা একটি বিশেষ দ্রাঘিমায় অবস্থিত একটিমাত্র টেলিস্কোপের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বর পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে এই চব্বিশ ঘন্টা নজরদারিটা খুবই প্রয়োজন। কারণ যেসব অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে কৃষ্ণগহ্বরের আশেপাশে, তারা খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাদের আয়ু কিছু দিন বা কয়েক ঘন্টা মাত্র। তাই ওই সময়টুকু চোখের আড়াল করলে আমাদের পর্যবেক্ষণে বিস্তর ফাঁক থেকে যাবে।
আমরা দেখার চেষ্টা করছি একটি কৃষ্ণগহ্বরের চৌহদ্দিতে পদার্থের কী পরিণতি হয়। কীভাবে গহ্বরের মধ্যে পদার্থ আকৃষ্ট হয় এবং যেটি আরো চমকপ্রদ, কীভাবে আলোর গতিবেগের কাছাকাছি বেগে সেটি বহিষ্কৃত হয়। এটি করতে অস্ট্রেলিয়ান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অব্জারভেটরি-র (AAO) স্টিভেন লি একটি স্পেক্ট্রোগ্রাফ বানিয়েছেন যা অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে আলোকে তার কম্পাঙ্কে (ফ্রিকোয়েন্সি-তে) ভেঙ্গে রেকর্ড করে নিতে পারে। সেই স্পেক্ট্রোগ্রাফ-কে ০.৫ মিটার ব্যাস-এর একটি টেলিস্কোপের সাথে জোড়া হয়েছে। কোনো কৃষ্ণগহ্বরের পারিপার্শ্বিক তাণ্ডব থেকে টেলিস্কোপে আলো এলে অনায়াসে সেই আলোকে তার বিভিন্ন কম্পাঙ্কে ভেঙ্গে ফেলা যায়।
যেকোনো গ্যাস থেকে কিছু বিশেষ কম্পাঙ্কেই আলোর নিঃসরণ হয়। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের চারিপাশ থেকে বহিষ্কৃত গ্যাসের গতিবেগ প্রায় আলোর গতিবেগের কাছাকাছি। সেই গতিবেগের ফলে নিঃসৃত আলো যখন ধরা পড়ে, তার কম্পাঙ্ক পরিচিত কম্পাঙ্ক থেকে কিছুটা সরে গেছে। কতটা সরে গেছে, তাকে বলে ডপলার শিফ্ট (Doppler shift)। এই ডপলার শিফ্ট থেকে হিসেব কষে গ্যাসের গতিবিধি নির্ণয় করা যায়। এক কথায়, কৃষ্ণগহ্বরের চারিপাশে কী চলছে, তা টেলিস্কোপ-এ ধরা আলোর সাহায্যেই বলে ফেলা যায়।
আর এখন, চব্বিশ ঘন্টা কী চলছে, সেটা বলা যায়। আমাদের বসানো পাঁচ পাঁচটি টেলিস্কোপ-এর মাধ্যমে।
তবে সেখানেই শেষ নয়…
শুধু গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন নয়, জ্ঞান বিতরণেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। এই যে পাঁচটি গ্লোবাল অব্জারভেটরি-র কথা বললাম, তার অনেকগুলিই কোনো না কোনো ইস্কুলের মধ্যে অবস্থিত। ভারতেরটিও ব্যতিক্রম নয়। একটি সরকারি বোর্ডিং স্কুলে টেলিস্কোপটি বসানো হয়েছে। সেখানে অর্ধেকের বেশি ছাত্রছাত্রী এমন পরিবার থেকে এসেছে যেখানে তাদের আগে কেউ স্কুলে যায়নি। ভারত সরকারের উদ্যোগে অল্প বয়েসেই চাষবাসে নামার পরিবর্তে তারা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। এদেরই হাতে আমরা তুলে দিয়েছি টেলিস্কোপটি। তারা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অব্দি এটি ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারে। তারপর আমরা দূরে ইন্টারনেট-এর মাধ্যমে এর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নিই।
এবার শুরুর সমস্যাতে আসা যাক। এই যে দ্বৈত সুবিধে, চব্বিশ ঘন্টা পর্যবেক্ষণ আর ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিক্ষাদান, এর কোনোটিই সম্ভব নয় যদি পাওয়ার না থাকে। কিংবা দুম করে ভোল্টেজ চড়ে গিয়ে যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যায়। এক বছরের বেশি হলো যখন এক সহানুভূতিশীল ব্যক্তি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। স্কুল বিল্ডিং-এর পর্যবেক্ষণকেন্দ্রকে সম্পূর্ণ সৌরশক্তিচালিত করার জন্য অর্থের যোগান দিলেন তিনি। প্রয়োজনীয় সৌরশক্তি উৎপাদন করতে একটি সোলার ফার্ম (solar farm) তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। সেই থেকে আমি আর অস্ট্রেলিয়ান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অব্জারভেটরি-র দুই সহকর্মী, স্টিভেন লি ও ক্রিস ম্যাককয়েজ, এই অর্থের সাহায্যে স্থানীয় বিদ্যুৎ গ্রিড এড়িয়ে সম্পূর্ণ সৌরশক্তির উপর নির্ভরশীল হওয়ার পরিকল্পনা করছি।
পর্যবেক্ষণকেন্দ্র চালাতে কোন কোন জায়গায় বৈদ্যুতিক শক্তি লাগে? প্রথমত লাগে সিসিডি ক্যামেরাকে শীতল রাখতে যাতে স্রেফ তাপমাত্রার ফলে আলোর শনাক্তকরণ ঘেঁটে না যায়। সিসিডি ক্যামেরাতে ছবির পিক্সেলগুলি একটি ক্যাপাসিটর-এর (capacitor) স্তরের মধ্যে জমা থাকে আধান বা চার্জ হিসেবে। সেই আধানের বিন্যাসকে (charge distribution) পড়ে ছবিটিকে বন্দী করা হয়। বাইরে থেকে আসা আলো সেই ক্যাপাসিটর স্তরের উপর আধানের বিন্যাসকে সৃষ্টি করে। যথেষ্ট ঠাণ্ডা না হলে আলো ছাড়াও স্রেফ তাপের জন্য কিছুটা আধান তৈরী হয়ে ছবি ঘেঁটে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, শক্তির প্রয়োজন হয় টেলিস্কোপ পরিচালনা করে যে কম্পিউটারটি সেটিকে চালু রাখতে, আর খোদ টেলিস্কোপটিকে আগুপিছু করতে বা ঘোরাতে।
স্কুলের ছাদে, অব্জারভেটরি থেকে কয়েক মিটার দূরে, দুটি ফোটোভোল্টিক প্যানেলের সেট বসানো হলো। তাদের নাম পাভো আর ভেলা, দুটো নক্ষত্রপুঞ্জের নামে। এক একটি সেট ছয় স্কোয়ার মিটার জুড়ে চারটি প্যানেলকে প্রথমে সিরিজ-এ আর তারপর প্যারালাল-এ জুড়ে বানানো, যাতে মোটা মোটা তারের প্রয়োজন না হয়। এই ফোটোভোল্টিক প্যানেল থেকে চার্জ রেগুলেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ যায় চারটি ব্যাটারী ব্যাঙ্কে। আদর করে তাদের তারার নামে নাম রাখা হয়েছে: আলডেবারান, বেলাট্রিক্স, ক্যানোপাস আর ডায়াডেম। এগুলিতে সব মিলিয়ে আছে আটচল্লিশটি দু’ভোল্টের লেড অ্যাসিড ব্যাটারী সেল, যেগুলিকে এমনভাবে জোড়া হয়েছে যাতে ২৪ ভোল্ট আর ২০০০ অ্যাম্পিয়ার আওয়ার্স বৈদ্যুতিক শক্তি পাওয়া যায়। এই শক্তির পরিমাণ আমাদের যতটা প্রয়োজন তার থেকে অনেক বেশি রাখা হয়েছে, যাতে ব্যাটারীর আয়ু চট করে ফুরিয়ে না যায়।
এছাড়াও সম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণকেন্দ্রটিকেই DC বিদ্যুতে চলার উপযুক্ত করে তুলেছি আমরা। এতে শক্তি সংরক্ষণ হবে কারণ ব্যাটারীর DC থেকে ইনভার্টার-এর মাধ্যমে AC তে পরিবর্তন, আবার সেই AC-কে ফের ম্যানুফ্যাকচারার-এর পাওয়ার প্যাক-এর মাধ্যমে DC-তে পরিবর্তনে অনেক শক্তির বৃথা ব্যয় হয়। তার থেকে সরাসরি ব্যাটারী দিয়ে যদি পুরো পর্যবেক্ষণকেন্দ্রটি DC-তে চলে, তাহলে তো ল্যাটা চুকেই গেল। সৌরশক্তি শুধু যে জ্বালানিবিহীন এবং পরিবেশের অনুকূল, তাইই নয়, এই শক্তির তারতম্য বা নয়েস (noise) অনেক কম। ক্যামেরাতে বৈদ্যুতিক শক্তির তারতম্য থাকলে সেই নয়েস-এর মধ্যে, ছায়াপথের দূরদূরান্ত থেকে আসা আলোর হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
ব্যস, এরপর বৃষ্টি বাদলার দিনেও অক্সফোর্ড-এ বসে IP সুইচের সাহায্যে যন্ত্রপাতি চালু করে ফেলা যায়। ইন্টারনেট-এর সাহায্যে পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের সবকিছুই দূরে বসে পরিচালনা করা যায়। অতএব, সোলার ফার্ম-এর কল্যাণে গভীর রাতে আমরা নিরিবিলিতে অ্যাস্ট্রোফিজিক্স গবেষণার জন্য মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করি, আর বাকি সময়টা স্কুল-এর ছাত্রছাত্রীরা টেলিস্কোপটা ব্যবহার করে নিজেদের জন্য।
শুধু তাই নয়, প্রত্যন্ত গ্রামের বোর্ডিং স্কুলে থাকা এই সব ছাত্রছাত্রীরা আর একটা সত্যিও স্বচক্ষে দেখেছে: কীভাবে আমাদের সবচেয়ে কাছের তারাটির সাহায্যে আমরা ছায়াপথের দূরদূরান্তের তারাগুলিতে অনুসন্ধান করে চলেছি। এই উপলব্ধিও আশ্চর্যের নয়কি?
(লেখাটি মূল ইংরাজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’-এর স্বেচ্ছাসেবক, অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়।)
আপনি যদি সৌরশক্তির অভিনব ব্যবহার কোথাও দেখে থাকেন বা সেই নিয়ে সমস্যার কোনো অভিনব সমাধান দেখে থাকেন, লিখুন আমাদের ঠিকানায়: [email protected]