কীট-পতঙ্গের মধ্যে প্রজাপতির মত সুদৃশ্য পতঙ্গ কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়। শরীরের অনুপাতে প্রজাপতির ডানা অসম্ভব বড় হয়ে থাকে এবং বিভিন্ন জাতীয় প্রজাপতির ডানা বিভিন্ন রকমের আকৃতি বিশিষ্ট। ডানার মনোরম বর্ণবৈচিত্র্যে সহজেই এদের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় । পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট-বড় বিভিন্ন জাতীয় অসংখ্য রকমারি প্রজাপতি দেখা যায় । দিবাচর ও নিশাচর হিসাবে প্রজাপতিকে মোটামুটি দু-ভাগে ভাগ করা যায় । সাধারণত দিবাচর প্রজাপতিই আমাদের বেশি নজরে পড়ে। উজ্জ্বল দিবালোকে এরা ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায় । দিনের আলো নিষ্প্রভ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তারা লতাপাতা বা ঝোপঝাড়ের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে নিশ্চলভাবে অবস্থান করে । নিশাচর প্রজাপতিরা কিন্তু সারাদিন আনাচে-কানাচে চুপ করে বসে থাকবার পর রাতের অন্ধকারে আহারান্বেষণে বহির্গত হয় । এদের ডানা গুলি দিবাচর প্রজাপতির মত হালকা নয় এবং ডানার বর্ণবৈচিত্র্যও পৃথক রকমের। বিশ্রাম করবার সময় দিবাচর প্রজাপতিরা পিঠের উপর দিকে ডানা মুড়ে বসে; কিন্তু নিশাচর প্রজাপতিরা ডানা প্রসারিত করেই বিশ্রাম করে। তাছাড়া এদের মস্তকের শুঁড় দুটি কতকটা পালকের আকৃতিবিশিষ্ট; কিন্তু দিবাচর প্রজাপতির শুঁড় দুটি মসৃণ এবং প্রান্তভাগ বর্তুলাকৃতির । নিশাচর প্রজাপতিরা মথ নামে পরিচিত। এদের বাচ্চাগুলিই রেশম-সূত্র প্রস্তুত করে থাকে।
যৌন-মিলনের পর স্ত্রী-প্রজাপতি গাছের পাতার উপর খানিকটা স্থান জুড়ে পর পর ডিম পেড়ে যায়। ডিম গুলি প্রায় গোলাকার; কোনো কোনো মথ ও প্রজাপতির ডিমের গায়ে ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাসের সাহায্যে সুদৃশ্য কারুকার্য্য দৃষ্টিগোচর হয় । অধিকাংশ প্রজাপতিই ঘনসন্নিবিষ্ট ভাবে ডিম গুলি সাজিয়ে রাখে । আবার কেউ কেউ পৃথক পৃথক পাতার উপর এক-একটি করে ডিম পাড়ে। অল্প কয়েকদিন পরেই ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। অধিকাংশ প্রজাপতির বাচ্চার গায়েই বিষাক্ত শোঁয়া থাকে। আবার অনেকের শরীর মসৃণ। এই বাচ্চাগুলিই ক্যাটারপিলার বা শোঁয়াপোকা নামে পরিচিত। ডিম থেকে বাইরে এসেই বাচ্চাগুলি পাতার সবুজাংশ কুরে কুরে খেতে শুরু করে। খাওয়া হলো বাচ্চাগুলির প্রধান কাজ। তিন-চারদিন অনবরত আহারকার্য চালাবার পর কিছুকাল নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থেকেই প্রথমবার খোলস পরিত্যাগ করে। তার কিছুকাল বাদে আবার খাওয়া শুরু করে। এইরূপে সাধারণত চারবার খোলস বদলাবার পর পরিণত অবস্থায় উপনীত হয় । পরিণত অবস্থায় শোঁয়াপোকা আড়াই ইঞ্চি, তিন ইঞ্চি বা ততোধিক লম্বা হয়ে থাকে। এই অবস্থায় উপনীত হলেই শোঁয়াপোকা খাওয়া বন্ধ করে লতাপাতার কোনো সুবিধাজনক স্থান নির্বাচন করে সুতার সাহায্যে একটা শক্ত বোঁটা প্রস্তুত করে এবং সেই বোঁটা থেকে শরীরটাকে বঁড়শীর মতো বাঁকা করে ঝুলতে থাকে। নিশ্চলভাবে এই অবস্থায় কয়েক ঘন্টা ঝুলে থাকবার পর তার পিঠের দিকের চামড়া লম্বালম্বিভাবে খানিকটা ফেটে যায় । ভিতর থেকে লালচে আভাযুক্ত একটা লম্বাটে পদার্থ তখন মোচড় খেতে বেরিয়ে আসে। সর্বশেষে উপরের চামড়াটা এক টুকরো কালো ঝুলের মতো খসে নিচে পড়ে যায়। লালচে আভাযুক্ত পদার্থটা তখন বোঁটার সঙ্গে ঝুলতে থাকে। প্রায় ঘন্টাখানেকের মধ্যেই লালচে পদার্থটা ধীরে ধীরে একটা আস্ত চীনাবাদামের আকৃতি পরিগ্রহ করে। অল্প সময়ের মধ্যেই সেই পদার্থটা ক্রমশ শক্ত হয়ে উজ্জ্বল কাচখন্ডের মত ঝকমক করতে থাকে। এই হলো প্রজাপতির গুটি বা পুত্তলী অবস্থা। বিভিন্ন জাতীয় প্রজাপতির গুটি – সোনালী, রুপালি, লাল, নীল, সবুজ প্রভৃতি বিভিন্ন বর্ণের উজ্জ্বল কাচখন্ডের ন্যায় প্রতীয়মান হয়। এক-একটি গাছে হীরা-মাণিকের দুলের মতো এরূপ অনেক পুত্তলী ঝুলতে দেখা যায়। দশ-পনের দিন পরে এই গুটির পিঠ চিরে ভিতর থেকে প্রজাপতি বেরিয়ে আসে। পুত্তলী থেকে বের হবার পর এদের ডানাগুলি থাকে খুবই ছোট এবং পাতলা চামড়ার মত তকতকে। কিন্তু দেখতে দেখতে ডানাগুলি তরতর করে বেড়ে যায় এবং বর্ণবৈচিত্র্য আত্মপ্রকাশ করে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর ডানাগুলি শক্ত ও হালকা হলে প্রজাপতি আকাশে উড়ে যায়। এই হলো মোটামুটি দিবাচর প্রজাপতির জন্মের ইতিহাস।
মথ জাতীয় নিশাচর প্রজাপতির জন্মের ইতিহাস অনেকাংশে এক রকম হলেও কিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে। যৌন-মিলনের পর মথও একস্থানে অনেকগুলি করে ডিম পাড়ে। এদেরও শোঁয়াযুক্ত ও শোঁয়াবিহীন দুই রকমেরই ক্যাটারপিলার দেখতে পাওয়া যায়। প্রজাপতির ক্যাটারপিলারগুলি গুটি বাঁধবার সময় বোঁটা প্রস্তুত করতে অতি সামান্য সুতা বোনে, কিন্তু মথের বাচ্চাগুলি গুটি বাঁধবার সময় মুখ থেকে অজস্র রেশম-সূত্র বের করে ডিম্বাকার আবরণ প্রস্তুত করে। যাদের গায়ে শোঁয়া আছে, তারা আবার শোঁয়া গুলি ছিঁড়ে সুতার সঙ্গে মিশিয়ে তারই সাহায্যে বহিরাবরণ প্রস্তুত করে। সূত্রনির্মিত আবরণীর অভ্যন্তরে কিছুকাল নিশ্চেষ্টভাবে অবস্থান করবার পর ক্যাটারপিলার পূর্বোক্ত উপায়ে দেহের চামড়াটি পরিত্যাগ করে জলপাইয়ের আঁঠির মত আকৃতি ধারণ করে। এই অবস্থায় কেউ একমাস, কেউ দুই মাস, কেউ কেউবা নয়-দশ মাস কাটাবার পর মথের আকৃতি পরিগ্রহ করে গুটি কেটে বের হয়ে আসে। অনেক জাতীয় স্ত্রী-মথ গুটি কেটে বের হবার পর সেই স্থানেই অবস্থান করে। ডানা থাকলেও তারা উড়তে অক্ষম। গুটি কেটে বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই পুং-মথ তার নিকট উড়ে আসে। সময় সময় পাঁচ-সাতটি পুং-মথকে স্ত্রী-মথের নিকটে অবস্থান করতে দেখা যায়। যৌন-মিলনের কিছুকাল বাদেই স্ত্রী-মথ একসঙ্গে অনেকগুলি ডিম পেড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মথ জাতীয় প্রজাপতির গুটির আবরণীর সূত্র থেকেই বিবিধ প্রকারের রেশমী বস্ত্রাদি প্রস্তুত হয়ে থাকে।
প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ কেবলমাত্র বন্য জন্তু জানোয়ারকে বশীভূত করেই ক্ষান্ত থাকেনি, তারা কীট-পতঙ্গের মধ্য থেকে মধুর জন্যে মৌমাছি এবং রেশমের জন্যে রেশম-কীট বা মথ-জাতীয় প্রজাপতির বাচ্চাগুলিকে পোষা প্রাণীতে পরিণত করেছে। প্রতিবছর এই রেশম-কীট থেকে কি বিপুল পরিমাণ রেশম উৎপাদিত হয়ে থাকে, তার সঠিক হিসেব নির্ণয় করা দুষ্কর। আমাদের দেশে বহুকাল থেকেই রেশম-কীট প্রতিপালনের রীতি প্রচলিত আছে। এই কীট প্রতিপালনের দেশীয় পদ্ধতির বিষয় কিঞ্চিৎ আলোচনা করছি।
বিভিন্ন জাতীয় রেশম-কীটের গুটি বা কোয়া থেকে সুতা সংগ্রহ করে আমাদের দেশে গরদ, তসর, এন্ডি, বাফতা প্রভৃতি কয়েক জাতীয় বস্ত্র প্রস্তুত হয়। যে জাতীয় রেশম-কীট থেকে গরদের কাপড় প্রস্তুত হয়, তারা পলু পোকা বা তুঁতপোকা নামে পরিচিত। এরা বিভিন্ন জাতীয় মথ নামক প্রজাপতির বাচ্চা বা ক্যাটারপিলার। আমাদের দেশে বড়-পলু, ছোট-পলু, নিস্তারি পলু ও চীনা পলু নামক কয়েক জাতীয় তুঁত পোকা প্রতিপালিত হয়ে থাকে। এদের মধ্যে বড়-পলু ও বিলিতী-পলুই সর্বোৎকৃষ্ট। এদের কোয়াগুলি খুব বড় হয় আর শুভ্র বর্ণের প্রচুর পরিমাণ রেশম উৎপাদন করে। আমাদের দেশে বিলিতী-পলু প্রতিপালিত হলেও তার পরিমাণ যথেষ্ট নয়। বড়-পলু ও বিলিতী-পলু প্রতিপালনের প্রধান অসুবিধা এই যে, এদের ডিম থেকে বাচ্চা বের হতে প্রায় দশ মাস সময় লাগে। বড়-পলু ও বিলিতী-পলু খুব সম্ভব একই জাতীয় পোকা; কিন্তু এদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। হয়তো বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাবে বংশানুক্রমে এই পার্থক্য আত্মপ্রকাশ করেছে । যাহোক, বড়-পলুর ডিম মাস দশেক হাঁড়ির ভিতর রাখবার পর মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমীর দিনে হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেওয়া হয় এবং কয়েকদিনের মধ্যেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। এই দশমাস ডিম সমেত হাঁড়িটাকে ঠান্ডা অন্ধকার ঘরে শিকেয় ঝুলিয়ে রাখা হয়। আলোকিত বা উষ্ণস্থানে থাকলে ডিম ভালো করে ফোটে না। খুব ঠান্ডা জায়গায় না রাখলে বিলিতী-পলুর ডিম মোটেই ফোটে না। বিলিতী-পলুর ডিম বরফের মত ঠান্ডা স্থানে রাখতে হয়। ফোটবার পূর্বে দু-তিন সপ্তাহ ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট উত্তাপে রাখা দরকার। তারপর উত্তাপ ক্রমশ বৃদ্ধি করলে বাচ্চা বের হতে থাকে । ৭৪ বা ৭৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট উত্তাপে এই পলু-পোকা পুষতে হয়।
ছোট-পলু, নিস্তারি-পলু ও চীনা-পলুর ডিম গ্রীষ্মকালে আট-দশ দিনে বর্ষাকালে দশ-পনেরো দিনে এবং শীতকালে পঁচিশ-ত্রিশ দিনে ফুটে থাকে। ডিম থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শোঁয়াপোকা বা ক্যাটারপিলার বের হয়েই তুঁত পাতা খেতে আরম্ভ করে। ডালা বা কাগজের ওপর পোকাগুলি রেখে তার ওপর কচি কচি তুঁত পাতা কুচি কুচি করে ছড়িয়ে দিলেই পোকাগুলি উপরে উঠে পাতা খেতে থাকে। ভুক্তাবশিষ্ট পাতা ও নাদি পরিষ্কার করবার জন্যে তুঁত পোকাগুলির উপর এক খন্ড সরু জাল বিছিয়ে তার উপর নতুন পাতা কুচিয়ে দিতে হয়। জালের ফাঁক দিয়ে নিচের পোকাগুলি উপরের পাতায় উঠে আসে, তখন জাল সমেত পোকাগুলিকে আরেকখানি ডালায় রেখে পূর্বের ডালাটি পরিষ্কার করে ফেলতে পারা যায়। এই উপায় সর্বদাই পোকাগুলিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার। প্রথম অবস্থায় পোকাগুলিকে প্রত্যহ পাঁচ-ছয় বার তাজা পাতা দিতে হয়, চার-পাঁচদিন পরেই পোকাগুলি নিশ্চলভাবে অবস্থান করে এবং কিছুকাল বাদেই প্রথমবার খোলস পরিত্যাগ করে। এই সময় ওরা কিছু খায় না। এই সময় অন্তত একদিন পাতা দেওয়া বন্ধ রাখতে হয়। পোকাগুলি নড়াচড়া আরম্ভ করলেই পুনরায় পাতা দেওয়া দরকার। এইরূপে এরা প্রায় চারবার খোলস ছাড়ে এবং তাদের দেহের আকার ক্রমশ বেড়ে যায়। এরা গ্রীষ্মকালে তিন-চারদিন অন্তর এবং শীতকালে পাঁচ-ছয়দিন অন্তর খোলস পরিত্যাগ করে। তৃতীয় বার খোলস ছাড়বার পর পাতা আর কুঁচিয়ে দিতে হয়না – গোটা পাতা দিলেই চলে। চতুর্থবার খোলস ছাড়বার পর পোকাগুলি শনশন শব্দে অতি অল্প সময়ের মধেই পাতা খেয়ে শেষ করে। তৃতীয়বার খোলস পরিত্যাগের পরই পাতার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ এই সময় বেশী খেলে প্রায়ই তারা ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। চতুর্থবার খোলস ছাড়বার পর পোকাগুলি গ্রীষ্মকালে ছয়-সাত দিন ও শীতকালে দশ-বারো দিন আহার করবার পর খাওয়া বন্ধ করে গুটি বা কোয়া প্রস্তুত করে। কোয়া প্রস্তুত করার সময় হলেই পোকাগুলি ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় এবং মুখ থেকে অল্প অল্প রেশম বের থাকে। এরূপ অবস্থা দেখলেই সেগুলিকে বেছে নিয়ে শুকনো ডালপালা বা বাঁশের চেটাইয়ের দ্বারা প্রস্তুত এক প্রকার সচ্ছিদ্র পাত্রের মধ্যে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে দুদিনের মধ্যেই গুটি বা কোয়া প্রস্তুত করে ফেলে ।
পলু পোকাগুলি যাতে ঘনসন্নিবিষ্টভাবে না থাকে, তার জন্য বিশেষ সতর্ক থাকা প্রয়োজন। প্রথম অবস্থায় ডালার উপর পলুগুলিকে পাতলা ভাবে রাখতে হয়। বড় হলে একটু ঘন ভাবে রাখলেও তত ক্ষতি নেই। প্রথমাবধি অযত্ন করলে অথবা অপরিছন্ন ভাবে রাখলে বড় হলেই তারা ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পলু যে ঘরে রক্ষিত হয়, তার হাওয়া খুব গরম বা ঠান্ডা হওয়া খুবই মারাত্মক। ঘরে হাওয়া প্রবেশ করবার ব্যবস্থা করে যাতে নাতিশীতোষ্ণ অবস্থায় থাকতে পারে তাই করা উচিত। কিন্তু দেখতে হবে-যেন পলুর গায়ে টানা হাওয়া লাগতে না পারে। কারণ টানা বাতাসে পলু রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। গুমোট হলে পাখার হাওয়া করে ঘর ঠান্ডা রাখতে হয়, নচেৎ সলফা বা হাঁসা নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে পলু মৃত্যুমুখে পতিত হয়। রোগাক্রান্ত মথের ডিমে মাতৃরোগ সংক্রামিত হয়ে থাকে। তার ফলে যত্ন করলেও পলু মরে যায়। এজন্যে ডিম পাড়বার পর প্রতেকটি স্ত্রী-মথের শরীর থেকে এক ফোঁটা রস বের করে অনুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করলে যদি কারও রসে দানার মত কোনও পদার্থ দেখা যায়, তবে মথের ডিম নষ্ট করে ফেলাই বিধেয়। তাছাড়া তুঁতের জলে ঘর, ডালা এবং অন্যান্য উপকরণ ভালো করে ধুয়ে নিয়ে তাতে সুস্থ পলুপোকা প্রতিপালন করা উচিত। তুঁতের জলে ধোবার পরও ঘরের ভিতর গন্ধক পুড়িয়ে স্থানটিকে যতদুর সম্ভব দুষিত বীজাণুমুক্ত করে নেওয়া কর্তব্য। কেউ কেউ কাগজের উপর ডিম পাড়িয়ে ডিম সমেত কাগজখানিকে তুঁতের জলে ডুবিয়ে পরে ঠান্ডা জায়গায় ঝুলিয়ে শুকিয়ে নেয়। এতে ডিমগুলি বীজাণুমুক্ত হতে পারে। এতদ্ব্যতীত একরকম বড় বড় মাছি পলুর গন্ধ পেলেই তাদের পিঠের উপর ডিম পেড়ে যায়। এই ডিম ফুটে কৃমি বের হয়। তারা পলুর শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে রস-রক্ত চুষে খেয়ে সেগুলিকে মেরে ফেলে। পলুপোকা প্রতিপালন করতে হলে এই মাছি সমন্ধে সর্বদাই সতর্ক থাকা প্রয়োজন, নচেৎ পলুর মড়ক নিবারণ অসম্ভব।
পলু পোকার খাদ্য হিসেবে আমাদের দেশে তুঁত গাছের চাষ করা হয়ে থাকে। এই তুঁত গাছ সাধারণত পেয়ারা গাছের মত বড় হয়। সে জন্য জমিতে তুঁতের কলম লাগাবার পর গাছগুলি বড় হলেই ছোট করে কেটে দেওয়া হয়। বছরে এরূপ তিন-চারবার কেটে দিলে গাছগুলি বেশী বড় হতে পারেনা। উৎকৃষ্ট পাতা জন্মাবার জন্যে তুঁত চাষে বিভিন্ন ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়, অন্যথায় যে কোনও রকম তুঁত পাতা খেয়েই পলু উৎকৃষ্ট কোয়া প্রস্তুত করতে পারে না।
তসর-কীটেরা কিন্তু রেশম-কীটের মতো তুঁত পাতা খায় না। এরা শাল, অর্জুন, মহুয়া, বাদাম প্রভৃতি গাছের পাতা খেয়ে গাছের উপরেই কোয়া প্রস্তুত করে। রেশম-কীটের মতো তসর-কীটকে আগাগোড়া ঘরের মধ্যে পালন করা যায় না। তসর-মথেরা ঘরের মধ্যেই ডিম পারে, কিন্তু ডিম ফোটবার পূর্বেই ছোট ছোট ঠোঙ্গার মধ্যে রেখে সেগুলিকে গাছের স্থানে স্থানে ঝুলিয়ে দিতে হয়। কীট বের হবার পর ইচ্ছামতো গাছের পাতা খেয়ে বড় হয় এবং গ্রীষ্মকালে একমাস এবং শীতকালে দুই মাস বা আড়াই মাস পরে গাছের ডালেই কোয়া প্রস্তুত করে। বর্ষাকালই তসর-কীট প্রতিপালনের প্রশস্ত সময়। গ্রীষ্ম বা শীতকালে হঠাৎ কোনও দিন বেশী বৃষ্টি হলেই অনেক পোকা ‘রসা’ হয়ে মরে যায়। এন্ডি-কীট পালন করা বিশেষ কষ্টসাধ্য, স্যাঁতসেঁতে বা আর্দ্র স্থানে এই কীট পালন করা দরকার। আসাম প্রদেশে অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয় বলে সব ঋতুতেই সেখানে এন্ডি পালন করা চলে। এন্ডি-কীটেরা ভেরেন্ডা পাতা খেয়ে বড় হয়ে থাকে, এবং রেশম-কীটের মতোই সেগুলিকে প্রতিপালন করতে হয়। আট-দশ দিনের মধ্যেই ডিম ফুটে এন্ডি-পোকা বহির্গত হয়।
কোয়া প্রস্তুত হয়ে গেলে সেগুলি সংগ্রহ করে গরম জলের ভাপে ভিতরের পুত্তলীগুলিকে মেরে ফেলতে হয়। পরে ক্ষারের জলে সিদ্ধ করে সুতা বের করে নিতে হয়। রেশমের কোয়ায় ভাপ দেবার পর জলে সিদ্ধ করে যেরূপ সহজে সুতা বের করতে পারা যায়, তসরের সুতা বের করা তত সহজ নয়। সোডা, পটাশ, সাজিমাটি, কলাগাছের ছাই প্রভৃতির সঙ্গে তসর-কোয়া সিদ্ধ করবার পর তার সুতা বের হয়। জলের সঙ্গে পেঁপের রস মিশিয়ে তাতে তসরের কোয়া চব্বিশ ঘন্টা কাল ভিজিয়ে রাখলেও সহজে সুতা বের হতে পারে । সেদ্ধ করবার পর কোয়াগুলি পরিষ্কার করে ঈষৎ ভিজা থাকতেই লাটাইয়ে জড়িয়ে সুতা বের করতে হয়। এন্ডি কোয়া থেকে এক খাই সুতা বের করা যায় না। এন্ডি প্রজাপতিগুলি কোয়া কেটে বের হয়ে গেলে সেই কর্তিত কোয়া থেকে কার্পাস সুতার মতো টাকু বা চরখার সাহায্যে সুতা কাটতে হয়। এই জন্যেই এন্ডির কাপড় অন্যান্য রেশমী কাপড়ের চেয়ে অধিকতর স্থায়ী ।
প্রচ্ছদের ছবি: PixaBay
(গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা এই প্রবন্ধগুলি প্রকাশ করতে পারার জন্য আমরা তাঁর পুত্রবধূ শুভা ভট্টাচার্য, দৌহিত্রী মালা চক্রবর্ত্তী, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য বিজ্ঞান প্রসার সমিতির সম্পাদক দীপক কুমার দাঁ এবং আকাশবাণী কলকাতার মানস প্রতিম দাস-র কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। মূল গ্রন্থ থেকে লেখাটি টাইপ করেছেন ‘বিজ্ঞান’-এর স্বেচ্ছাসেবক, অমৃতা ঘোষ।)