প্রথম পর্ব
রামধনু তোমরা হয়ত সকলেই দেখেছো! নিজের চোখে না হোক, বইয়ের পাতায় কিংবা টিভিতে তো বটেই। তাই রামধনু কেমন দেখতে হয় বা রামধনুতে কটা রং থাকে তা তোমরা নিশ্চই জানো। তোমাদের মধ্যে কেউ-কেউ হয়তো এটাও জানো রামধনু তৈরি কিভাবে হয়। আর যারা আরো একটু বিজ্ঞান চর্চা করো, তারা হয়তো বলতে পারবে রামধনু কয় প্রকারের হয়। অনেকে হয়ত ভাবছ – ‘রামধনু কয় প্রকার’ মানেই বা কি? সেই গল্পই বলি তাহলে!
বৃষ্টির পর রোদ উঠলে আকাশে সূৰ্যের বিপরীত দিকে তাকালে অৰ্ধবৃত্তাকার (আসলে বৃত্তাকার) রুপে যে সাত রঙের বৰ্ণালী দেখা যায় মাঝেমধ্যে, সেটাই হলো রামধনু। তোমরা জানো কি সেই বৰ্ণালীর একটি বিশেষ সজ্জা বা প্যাটার্ণআছে যার কখনই কোনো হেরফের হয় না? যদি লক্ষ্য করো কখনও, তাহলে দেখতে পাবে রামধনুর সাত রঙের বৰ্ণালীতে বেগুনি সবসময় নিচের প্রান্তে আর লাল উপরের প্রান্তে থাকে। মধ্যিখানে থাকে নীল, সবুজ, হলুদ ইত্যাদি রঙগুলো। রামধনুর বৰ্ণালীর সজ্জা এইরকম হলে তাকে আমরা বলি ‘প্রাথমিক রামধনু’ (Primary Rainbow)। ‘রামধনু’ বলতে আমরা সাধারণতঃ এই প্রাথমিক রামধনুকেই বুঝিয়ে থাকি।
কিন্তু তোমরা কি জানো রামধনু আরো এক রকমের হয়?
আকাশে প্রাথমিকের তুলনায় অপেক্ষাকৃত উপরের দিকে অবস্থিত এই দ্বিতীয় প্রকারের রামধনু কচ্চিৎ দেখতে পাওয়া যায়। এটিকে বলা হয় ‘মাধ্যমিক রামধনু’ (Secondary Rainbow)। এই রামধনুর বৰ্ণালীর সজ্জা হয় প্রাথমিকের সম্পূৰ্ণ বিপরীত, অৰ্থাৎ এতে বেগুনি থাকে উপরের প্রান্তে আর লাল রঙ থাকে নিচের প্রান্তে। যেহেতু এর ঔজ্জ্বল্য প্রাথমিকের তুলনায় কম, এই রামধনু সবসময় দেখা যায় না।
যখন এই দুই প্রকারের রামধনুরই দেখা মেলে, তখন সেটাকে আমরা বলি ‘জোড়া রামধনু’ বা Double Rainbow।
এ তো গেল রামধনু কয় প্রকারের হয় তার কথা। কিন্তু এছাড়াও আরো কিছু অদ্ভূত ব্যাপার-স্যাপার রামধনুর সাথে জড়িয়ে আছে যেগুলো এবার আমি তোমাদের বলব।
উৎসাহী বিজ্ঞান মনস্ক মানুষজনদের পর্যবেক্ষণে রামধনুদের ব্যাপারে আরো একটি বিশেষ প্যাটাৰ্ণের কথা জানা গেছে। লক্ষ্য করে দেখা গেছে যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক রামধনুর মধ্যকার অংশের আকাশ বাকি আকাশের তুলনায় সর্বদাই বেশি গাঢ় দেখায়। ২০০ খ্ৰীষ্টাব্দের আশেপাশে গ্রীক দাৰ্শনিক আলেকজান্ডার এটিকে প্রথম বৰ্ণনা করেন। আকাশের এই অঞ্চলটির নাম তাই রাখা হয় আলেকজান্ডারের ডার্ক ব্যান্ড (Alexander’s dark band)।
এতক্ষণে তোমরা নিশ্চয় ভাবতে বসেছো যে ব্যাপারখানা ঠিক কি! রামধনুর কথা তো জানতে, কিন্তু তার সাথে-সাথে যে এত রহস্যময় ব্যাপারও ঘটে সেগুলো তো কেউ বলেনি! এবারে তাহলে তোমাদের কৌতূহলটা আরেকটু উস্কে দিই। যদিও খালি চোখে দেখতে পাওয়া মুশকিল, তবু খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে প্রাথমিক রামধনুর ভিতরের প্রান্তের কাছে কিছু গোলাপি ও সবুজ ব্যান্ডের উপস্থিতি রয়েছে যাকে বলা হয় ‘অতিরিক্ত ধনু’ বা supernumerary arcs।
ব্যান্ডগুলি একান্তরভাবে গোলাপী ও সবুজ এবং এদের ঔজ্জ্বল্য এতই কম যে প্রায় চোখেই পড়ে না।কিন্তু হলে কি হবে, বিজ্ঞানীদের কাছে এদের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ রামধনুকে ব্যাখ্যা করে এমন কোনো তত্ত্ব কতখানি সঠিক সেটা যাচাই করা সম্ভব এটা দেখে যে তত্ত্বে এই গোলাপি-সবুজ গোষ্ঠীর ঠাঁই আছে কিনা (এবং সেই সঙ্গে আলেকজান্ডারের ডার্ক ব্যান্ডেরও)।
রামধনুর বৰ্ণালী ও তার উপস্থিতির কারণের প্রথম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন বিখ্যাত গ্রীক দাৰ্শনিক ও বৈজ্ঞানিক অ্যারিস্টটল। তিনি বোঝালেন যে আকাশের মেঘে সূৰ্যের আলোর একটি বিশেষ কোণে প্রতিফলনের ফলেই এই ‘রামধনু রশ্মি’র জন্ম। যেহেতু আকাশের কয়েকটি ‘বিশেষ’ দিক থেকে আলো বিক্ষিপ্ত (scattered) হয়ে আমাদের চোখে এসে পড়ার ফলে এই রামধনু তৈরি হচ্ছে, এতে রামধনুর অর্ধবৃত্তাকার (বা বৃত্তাকার) হওয়ার ব্যাখ্যাও মিললো। ব্যাপারটা এইরকম: রামধনু রশ্মিগুলি একটি বিশেষ কোণে বিক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে তারা সবাই মিলে আকাশে একটি আলোর শঙ্কু(আসলে প্রত্যেক রঙের জন্য এক-একটি শঙ্কু) তৈরি করে যার লম্ব প্রস্থচ্ছেদ (perpendicular cross-section) একটি বৃও হয়। আমাদের দেখা রামধনু তাহলে আসলে সেই আলোকশঙ্কুর লম্ব প্রস্থচ্ছেদ!
অ্যারিস্টটলের এই ব্যাখ্যার প্রায় ১৭ শতাব্দী পর ১৩০৪ সালে এক জাৰ্মান সন্ন্যাসী Theodoric of Freiberg এই তত্ত্ব বৰ্জন করলেন ও একটি নতুন যুক্তি দিলেন।যুক্তিটি এইরকম: মেঘে উপস্থিত জলবিন্দুরাশির সম্মিলিত প্রতিফলনের দরকার নেই, একটি জলকণাই রামধনুর জন্ম দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট! শুধু তত্ত্ব খাড়া করেই থেমে থাকলেন না সন্ন্যাসী, বাস্তবে তা আদৌ খাটে কিনা দেখার জন্য কাঁচের গোলকে জল ভৰ্তি করে তাতে আলোকরশ্মির যাতায়াতের পথও চিহ্নিত করলেন তিনি ( কাঁচের গোলকে কেন বুঝলে কি? ওটা একটা বিবৰ্ধিত জলবিন্দুর কাজ করবে বলে!)। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁর এই কাজের কথা সকলের অগোচর রইল এবং প্রায় তিন শতাব্দী পর ডেকাৰ্ট (Descartes) একই পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিয়মগুলি পুনরাবিষ্কার করলেন। থিওডোরিক ও ডেকা্ৰ্ট উভয়েই দেখালেন যে জলবিন্দুর অভ্যন্তরে আলোর প্রতিফলনের জন্যই রামধনুর জন্ম হচ্ছে; একবার আভ্যন্তরীন প্রতিফলন হয়ে আলো বেরোলে প্রাথমিক রামধনু আর দু’বার আভ্যন্তরীন প্রতিফলন হয়ে এলে মাধ্যমিক রামধনু! যেহেতু প্রত্যেক প্রতিফলনের মুহূ্ৰ্তে জলবিন্দু কিছুটা আলো শোষণ (absorption) করে ফেলে, তাই মাধ্যমিকের ঔজ্জ্বল্য প্রাথমিকের তুলনায় সৰ্বদাই কম হয়। ডেকা্ৰ্ট এও দেখলেন যে রামধনুর কৌণিক পরিসীমার (angular range) মধ্যে যেকোন এক দিশা বরাবর কেবলমাত্র একটি রঙই দেখা যায়, যার থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে রামধনুর প্রত্যেকটি রঙের জন্য আলাদা আলাদা জলবিন্দুরাশির অবদান রয়েছে! ব্যাপারটা বেশ মজার, কি বলো?
রামধনু তৈরি হওয়ার পিছনে মূল নীতি অবশ্য তোমরা প্রায় সকলেই জানো: আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ (reflection and refraction of light)। কিন্তু মুশকিলটা হল,এই দুই নীতি দিয়ে আলেকজান্ডারের ডার্ক ব্যান্ড ও অতিরিক্ত ধনুর ব্যাখা করা যায় না যে!
তাহলে? সেটা আমরা দেখব এর পরের পৰ্বে।দেখবো এই রহস্যর উৎঘাটন কতখানি সম্ভব হয়।
- প্রচ্ছদের ছবিটির উৎস : https://scijinks.jpl.nasa.gov/rainbow/
- উপরের লেখাটির অনুুপ্রেরণা ও আংশিকভাবে উৎস (আগ্রহী পাঠকদের জন্য): https://www.phys.uwosh.edu/rioux/genphysII/pdf/rainbows.pdf