30-12-2024 17:01:40 pm
Link: https://bigyan.org.in/victor-hess-and-cosmic-ray
রবিঠাকুর লিখেছিলেনঃ “ আলোকের এই ঝরনা ধারায় ধুইয়ে দাও”-আলোকের ঝরনা ধারাই বটে, কিন্তু সে ঝরনা শুধু সূর্যালোকস্নাত তা নয়, সে ঝরনা-রশ্মির আগমন অনন্ত, অসীম মহাজগৎ থেকে-নাম তাই মহাজাগতিক রশ্মি (cosmic ray)। অবিরাম ধারাস্রোতের মতো তা ঝরে পড়ছে পৃথিবীপৃষ্ঠে-প্রতিমুহূর্তে কোটি কোটি কণা ভেদ করে যাচ্ছে আমাদের শরীর-প্রায় সম্পূর্ণটাই আমাদের অগোচরে। এই রশ্মির সঙ্গে বাতাসের কণাগুলির আন্তক্রিয়ায় কণাগুলির ঘটে আয়নন (ionization)। তৈরি হয় আয়নিত কণার স্রোত। প্রথম থেকেই কি জানা ছিল এই কথা ? নিশ্চয়ই নয়। বাতাসের কণার আয়ননের সাথে বিজ্ঞানীরা পরিচিত থাকলেও ১৯১১-১২ সাল পর্যন্ত তার মূল কারণ ছিল অধরা। ১৯১২ সালে বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রানজ হেস (Victor Franz Hess) পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণ করলেন-এই আয়ননের মূল কারণ মহাজগৎ থেকে আসা অজানা রশ্মিস্রোত- ২০১২ সালে তাই পালিত হয়ে গেল মহাজাগতিক রশ্মি আবিষ্কারের শতবর্ষ। অদ্ভুতভাবে দেখেছি, আমাদের মতো বিজ্ঞান শিক্ষার্থী দের কাছে হেস বড়ই অচেনা। সে প্রসঙ্গে কিছু আলোকপাত করার জন্যই এ লেখার অবতারণা।
ভিক্টর হেস (Victor Hess) জন্মেছিলেন অস্ট্রিয়ায়-২৪শে জুন, ১৮৮৩ সালে। বাবা ভিনজেন হেস ছিলেন রাজা Oettingen- Wallerstein এর এস্টেটের মুখ্য বনপাল। মা সারাফিন হেস (Sarafine Hess)। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ভিক্টর যোগ দিলেন গ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সালটা ১৯০১। ১৯০৬ সালে পিএইচডি সমাপ্ত করার পর ভিক্টর বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে post doctorate করার জন্য তখনকার বিখ্যাত পদার্থবিদ পল ড্রুড -এর কাছে আবেদন করলেন। ড্রুড সে সময় কঠিন পদার্থের ভিতর দিয়ে তাপ ও তড়িত-পরিবাহিতা নিয়ে বিখ্যাত সব কাজ করছেন। (বলে রাখা ভালো, আলোর গতিবেগের চিহ্ন হিসেবে আমরা যে সংকেত c ব্যবহার করি, তা ড্রুড-এরই দেওয়া)। সঙ্গে আলোকের বিভিন্ন ধর্ম নিয়েও গবেষণা করছেন। ভিক্টর চেয়েছিলেন ড্রুড-এর কাছে আলো নিয়ে গবেষণা করতে। কিন্তু অদৃষ্টের কী পরিহাস!-ভিক্টর বার্লিন পৌছানোর কিছু সপ্তাহ আগেই ড্রুড আত্মহত্যা করলেন। এরপর ফ্রাঞ্জ এক্সনার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে গবেষণার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সে সময় ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগৎজোড়া নাম-পদার্থবিদ্যা বিভাগে রয়েছেন –এক্সনার, বিকিরণ সংক্রান্ত গবেষণায় তাঁর খ্যাতি তখন সর্বত্র। ১৯০৭ সালে বোল্টজ্মান-এর স্থানে যোগ দিয়েছেন ফ্রেড্রিক হ্যাসেনোর্হল (Friedrich Hasenohrl) (১৮৭৪-১৯১৫)। হ্যাসেনোর্হল সে সময় গবেষণা করছেন তড়িৎ চুম্বকীয় ভর নিয়ে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, হ্যাসেনোর্হল-এর কাছে সে সময় গবেষণা করছেন এরউইন স্রোডিংগার (পরবর্তীকালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম আবিষ্কারক হিসেবে তাঁর নাম চিহ্নিত হয়ে থাকবে)। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গ্রেনেডের আঘাতে হ্যাসেনোর্হল মারা যান। যা হোক,হ্যাসেনোর্হল বা এক্সনার এর সাথে কাজ করতে এসে বিকিরণের গতি-প্রকৃতি সংক্রান্ত গবেষণায় হেসও উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। পরে অধ্যাপক ভিক্টর মেয়ার এর তত্ত্বাবধানে “ইনস্টিটিউট অফ্ রেডিয়াম রিসার্চ” -এ কাজ করতে আসেন। এখানে থাকাকালীন ভিক্টর মহাজাগতিক রশ্মি সংক্রান্ত বিখ্যাত গবেষণাগুলি করেন।
অনেকটা সময় পিছনে চলে যাওয়া যাক। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে আবিষ্কৃত হয়েছিল তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্র। ১৭৮৫ সালে পরীক্ষা করতে গিয়ে চার্লস-অগাস্টিন-দ্য- কুলম্ব (বিজ্ঞানের ছাত্ররা সবাই কুলম্বের সূত্রের সাথে পরিচিত) লক্ষ্য করেছিলেন কোন তড়িতাহিত ধাতব গোলককে বাতাসে রেখে দিলে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তড়িৎক্ষরণ হয় এবং গোলকটি নিস্তড়িত হয়ে পড়ে। তার আগে অনেকের ধারণা ছিল বাতাস তড়িতের কুপরিবাহী। কুলম্ব দেখালেন তা ঠিক নয়। তড়িৎবীক্ষণের ক্ষেত্রেও দেখা গেল একই ঘটনা। পরবর্তীকালে মাইকেল ফ্যারাডে আরো ভালোভাবে কুলম্বের ধারণার যথার্থতা প্রমাণ করলেন। যত দিন যাচ্ছিল, তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্রের প্রভূত উন্নতিসাধন হচ্ছিল। প্রথিতযশা বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন, ক্রুকস্-রা পরীক্ষা নিরীক্ষার সুবিধার্থে তড়িৎবীক্ষণের সংস্কার করছিলেন। ১৮৭৯ সালে ক্রুকস্ লক্ষ্য করলেন তড়িৎবীক্ষণের ভিতরে বাতাসের চাপ কমালে তড়িৎক্ষরণ ঘটে ধীর গতিতে। মোটামুটি ভাবে বোঝা গিয়েছিল এইসব তড়িৎক্ষরণের মূলে রয়েছে তড়িৎবীক্ষণের ভিতরের বাতাসের কণাগুলির আয়নন (যদিও পরে দেখা গেল এই ধারনাও ঠিক নয়)। কিন্তু বাতাসের কণাগুলির আয়নিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে কোন ধারণা সে সময় ছিল না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে জোরকদমে কানাডা, ইটালি, আমেরিকা এবং বিশেষতঃ অস্ট্রিয়ায় বাতাসের তড়িৎ পরিবাহিতা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা আরম্ভ হয়। আগে বলেছি এক্সনার-এর কথা। তিনিও এ বিষয়ে গবেষণা করছিলেন ছাত্র স্রোডিংগার-এর সাথে। পরবর্তী জীবনে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করলেও স্রোডিংগার সে সময়ে বাতাসের তড়িৎ পরিবাহিতা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ১৯১০ সালে তিনি ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লক্ষ্যণীয়, স্রোডিংগার-এর পি.এইচডি থিসিসের নাম ছিল “ On the conduction of electricity on the surface of insulators in moist air”( কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কোন নামগন্ধ নেই!)।
১৮৯৫ সালে বিজ্ঞানী থমসন আবিষ্কার করলেন এক্স-রে। ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানী বেকেরেল আবিষ্কার করলেন ইউরেনিয়াম মৌলের স্বতঃস্ফূর্ত তেজস্ক্রিয়তা ধর্ম। কিছুদিন পরেই পিয়ের ও মেরী কুরী পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম মৌলেও তেজস্ক্রিয়তার সন্ধান পেলেন। তেজস্ক্রিয়তার কারণে মৌলগুলি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রশ্মি বিকিরণ করে। দেখা গেল তেজস্ক্রিয় মৌলের উপস্থিতিতে তড়িৎবীক্ষণের পাতদুটি দ্রুত তড়িৎক্ষরণ করে। সুতরাং একদল বিজ্ঞানী ধারনা করলেন, পৃথিবীর অভ্যন্তরে যে বিপুল তেজস্ক্রিয় মৌলের ভান্ডার রয়েছে, তা থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সাথে বাতাসের কণাগুলির আন্তঃক্রিয়ার ফলে ঘটছে আয়োনাইজেশন বা আয়নন। কিন্তু এলসার, গাইটেল, উইলসন প্রমুখ বিজ্ঞানীরা তাদের পরীক্ষায় যে ফল পেলেন, তার ব্যাখ্যা তেজস্ক্রিয়তা দিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে করা গেল না। প্রশ্ন উঠল, হয়তো এই আয়নন-এর কারণ তেজস্ক্রিয়তা নয়, মহাজগৎ থেকে আসা কোন রশ্মি। ১৯০১ সালে উইলসন লিখলেনঃ
বাতাসে থাকা এই আয়নের উৎস নিয়ে আমাদেরকে আরো বেশি করে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে হবে। হয়ত এই আয়নের উৎস বর্হিজগৎ থেকে আসা কোন রশ্মি , যা হয়তো ক্যাথোড রশ্মি, কিন্তু আরো বেশি ভেদন ক্ষমতা সম্পন্ন।
এমন কি, তৎকালীন বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার ও পদার্থবিদ নিকোলা টেসলা ১৯০১ সালে আমেরিকায় একটি পাওয়ার জেনারেটর-এর পেটেন্ট নিয়েছিলেন। কারণ হিসেবে তার বক্তব্য ছিলঃ
সূর্য বা অন্য কোন মহাজাগতিক বস্তু থেকে প্রতি মুহূর্তে যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা চলে আসছে সেগুলোর কারণেই ঘটছে বাতাসের কণার তড়িতাহিতকরণ।
১৯০৯ সাল পর্যন্ত যে সব পরীক্ষা হয়েছিল, তা থেকে বোঝা গিয়েছিল এই অজানা রশ্মির ভেদন ক্ষমতা (penetrating power) অত্যন্ত বেশী এবং পরীক্ষা ব্যবস্থায় যত অন্তরণই (insulation) থাকুক না কেন, এ রশ্মির প্রভাব সর্বত্র। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন এই অজানা রশ্মির স্বরূপ নির্ধারণ করতে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে উঁচুতে। কারণ উঁচুতে ওঠার সাথে পৃথিবীর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব কমে আসবে। পরীক্ষাগারের পরীক্ষায় এই রশ্মির স্বরূপ নির্ধারণ সম্ভবপর নয়।
এরপর আসা যাক জার্মান পাদরী থিয়োডোর উলফ (Theodor Wulf)-এর কথায়। উলফ ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী। ২০ বছর বয়সে তিনি পাদরী হয়ে যান। অবশ্য এতে উলফ-এর পড়াশোনা থেমে থাকেনি। গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়াল্টার নার্নস্ট (Walther Nernst)-এর কাছে পদার্থবিদ্যা পড়েছিলেন তিনি। অজানা রশ্মির স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য আরো সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করার জন্য উলফ তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্রের বেশ কিছু পরিবর্তন করলেন। সোনার পাত দুটোর স্থানে লাগালেন ধাতব কাঁচ (metalised glass)। ১৯০৯ সালে জার্মানি, হল্যান্ড ও বেলজিয়ামের বিভিন্ন স্থানে তিনি পরীক্ষা চালালেন তার যন্ত্র নিয়ে। উলফ-এরও ধারনা ছিল অজানা রশ্মির কারণ মৌলের তেজস্ক্রিয়তা। এরপর ১৯০৯ ও ১৯১০ সালে উলফ গেলেন প্যারিসে-আইফেল টাওয়ারের ( উচ্চতা ৩০০ মিটার) মাথায় উঠে পরীক্ষা করলেন। কিন্তু ৩০০ মিটার উঁচুতে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ যতটা কমার কথা ছিল পরীক্ষা থেকে তা পাওয়া গেল না। উলফ লিখলেন ঃ
বিকিরণের তীব্রতা ৩০০ মিটার উচ্চতায় গেলেও মাটিতে পাওয়া লব্ধমানের অর্ধেক ও নয়।
যদিও উলফ –এর নেওয়া মান বহুদিন ধরে অন্যতম প্রামাণ্য পরীক্ষালব্ধ মান হিসেবে সমগ্র ইউরোপে চালু ছিল। উলফ-এর এসব পরীক্ষার অনুসন্ধান আরো জোরদার হিসেবে চালানোর জন্য বিজ্ঞানীরা আশ্রয় নিলেন বেলুন-পরীক্ষার। অজানা রশ্মির উৎস সন্ধানে ১৯০৯ সালে প্রথম বেলুনে চড়ে আকাশে গেলেন কার্ল বার্গউইট্জ (Karl Bergwitz)। এর আগে অবশ্য ফ্রাঞ্জ লিন্কে (Franz Linke)-এর কথা জানা যায় যিনি ১৯০০ থেকে ১৯০৩ বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার সময় ১২ বার বেলুনে চড়ে আকাশে উড়েছিলেন। সঙ্গে ছিল এলসার এবং গাইটেল এর তৈরি তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্র। কিন্তু আশানুরূপ কোনো ফল লিন্কে বা বার্গউইট্জ কারুর অভিযানেই পাওয়া যায় নি। বেলুনে চড়ে আকাশে গিয়ে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন অ্যালবার্ট গোকেল (Albert Gockel)। গোকেল ছিলেন ফ্রিবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বার্গউইট্জ-এর অভিযানের কয়েক মাসের মধ্যেই গোকেল বেলুনে চড়েছিলেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৫০০ মিটার পর্যন্ত উপরে উঠতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। তিন-তিনবার বেলুনে চড়ে তিনি আকাশে যান এবং ৩০০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে অজানা রশ্মির খোঁজ চালান তিনি। গোকেল লক্ষ্য করেছিলেন উচ্চতা বাড়ার সাথে আয়ননের মাত্রার কোন হ্রাস ঘটে না। ১৯১০ সালে গোকেল লিখেছিলেনঃ
অতাধিক ভেদন ক্ষমতা সম্পন্ন অজানা এই রশ্মির উৎস হয়তো পৃথিবী পৃষ্ঠের উপরিভাগে থাকা তেজস্ক্রিয় মৌল নয়।
সত্যি কথা বলতে কি, গোকেল এর কপাল ছিল মন্দ। স্রোডিংগার তাঁর পিএইচডি গবেষণায় দেখিয়েছিলেন যদি তেজস্ক্রিয়তার কিছু অংশ পৃথিবী থেকে আর কিছু অংশ মহাজগৎ থেকে আসে, তবে ৩০০০ মিটার পর্যন্ত পৃথিবী থেকে প্রাপ্ত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মহাজগৎ থেকে আসা তেজস্ক্রিয় বিকিরণকে প্রশমিত করে দেয়। গোকেল সাহেব যদি আরো কিছুটা উপরে উঠতেন, তাহলে তিনিই হয়তো মহাজাগতিক রশ্মি আবিষ্কারের পুরোধা হতে পারতেন। যা হোক, কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতলেন হেস। অনেকে মনে করেন, হেস যেহেতু স্রোডিংগারের সাথে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ করতেন, হেস স্রোডিংগারের গণনার সাথে পরিচিত ছিলেন। হেস জানতেন যে গোকেল-এর পরীক্ষায় কিছু গণ্ডগোলের কারণ ছিল গোকেল-এর যন্ত্রে উচ্চতার সাথে চাপের তারতম্য হতো বেশ। ফলে গণনায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। হেস চাপ নিরোধক ionization chamber তৈরি করলেন। গোকেল এর মতো হেসও ছিলেন পাকা বেলুন-উড়িয়ে। ১৯১১ থেকে ১৯১২- এই এক বছরে হেস বেলুনে উড়েছিলেন মোট দশবার। ১৯১১ সালে তিনবার আর ১৯১২ সালে সাতবার। ১৯১১ সালে প্রথমবার ১০৭০ মিটার পর্যন্ত উঠেছিলেন তিনি। পরীক্ষায় দেখলেন উচ্চতার সাথে আয়নন এর যে খুব একটা তারতম্য হচ্ছে তা নয়। ১৯১১ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধে হেস লিখলেনঃ
উচ্চতার সাথে সাথে বিকিরণের তীব্রতা যেহেতু সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে আসা বিকিরণের চেয়ে খুব আলাদা নয়, সুতরাং পৃথিবীর অভ্যন্তরের তেজস্ক্রিয় মৌলের থেকে বিকিরণের সাথে নিশ্চয়ই অন্য কোন বিকিরণের ও উৎস হিসাবে কাজ করা কিছু অস্বাভাবিক নয়।
১৯১২ সালে যে সাতবার বেলুনে চড়েছিলেন হেস তার মধ্যে দুটো উড়ান ছিল খুব উল্লেখযোগ্য। অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন এই রশ্মির উৎস হয়তো সূর্য। পরীক্ষার জন্য হেস বেছে নিলেন ১৯১২ সালের ১৭ই এপ্রিল কে। ঐদিন ছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। হেস ২৭৫০ মিটার উচ্চতায় উঠলেন। সূর্যগ্রহণ সত্ত্বেও হেস দেখলেন ২০০০ মিটার উচ্চতাতেও আয়ননের তীব্রতা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বেশী। এর থেকে হেস সিদ্ধান্তে এলেন এই রশ্মির কারণ সূর্য নয়। ওই বছরই সাত নম্বর বেলুন যাত্রায় হাইড্রোজেন ভর্তি বেলুনে চেপে ৭ই আগস্ট ৫৩৫০ মিটার উচ্চতায় উঠলেন তিনি। অস্ট্রিয়ার এক শহর Aussig থেকে সকাল ৬টা ১২ মিনিটে উড়েছিল সেই বেলুন। প্রায় ৫ ঘণ্টা পর সে বেলুন দুপুরে এসে নেমেছিল জার্মানীর শহর Pieskow (বার্লিন থেকে ৫০ কিমি পূর্বে)। এ সমস্ত পরীক্ষার ফলাফল পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পর্যালোচনার পর হেস তার বিখ্যাত সিদ্ধান্তে এলেনঃ বাতাসের কণাগুলির আয়ননের মূলে রয়েছে মহাজগৎ থেকে আসা রশ্মিস্রোত। এই রশ্মির আগমন সূর্য থেকে আরো বহুদূরে থাকা অনন্ত, অসীম মহাবিশ্ব থেকে। ১৯১২ সালে Physikalische Zeitschrift পত্রিকায় হেস –এর বিখ্যাত প্রবন্ধ প্রকাশিত হলঃ “Observations in low level radiation during seven free balloon flights”. পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ব্যাখ্যা করে হেস তাঁর প্রবন্ধে লিখলেনঃ
(১) মাটি থেকে কিছুটা উপরে বিকিরণের তীব্রতা কমার পরিমাণ খুব সামান্য।
(২) ১০০০ থেকে ২০০০ মিটার উচ্চতায় বিকিরণের তীব্রতার বৃদ্ধি বেশ লক্ষ্য করার মতো।
(৩) ৩০০০ থেকে ৪০০০ মিটার উচ্চতায় বিকিরণের তীব্রতা মাটিতে পাওয়া বিকিরণের তীব্রতার চাইতে ৫০% বেশী।
(৪) ৪০০০ থেকে ৫২০০ মিটার উচ্চতায় বিকিরণের তীব্রতা মাটিতে পাওয়া বিকিরণের তীব্রতার প্রায় ১০০ গুণ।
নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত হল মহাজাগতিক রশ্মির অস্তিত্ব। হেস লিখলেনঃ
উপরের পর্যবেক্ষণ থেকে এই সিদ্ধান্তে নিশ্চিত ভাবে উপনীত হওয়া যায় যে এই অত্যধিক ভেদন ক্ষমতা সম্পন্ন রশ্মির আগমন বর্হিবিশ্ব থেকে।
হেস আরো লিখলেনঃ
যেহেতু সূর্যগ্রহণের সময়ও আমি পরীক্ষা চালিয়েও বিকিরণের তীব্রতার কোন হেরফের লক্ষ্য করিনি, সুতরাং এই অজানা রশ্মির উৎস নিশ্চয়ই সূর্য নয়।
এরপর অবশ্য বিভিন্ন পরীক্ষায় মহাজাগতিক রশ্মির অস্তিত্ব সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ১৯২০ সালে হেস গ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯২১ সালে হেস বছর দুয়েকের জন্য আমেরিকা যান। পরবর্তীকালে ১৯৩১ সালে ইন্সব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে Hafelekar পাহাড়ের মাথায় (উচ্চতা ২৩০০ মিটার) মহাজাগতিক রশ্মি পর্যবেক্ষন এবং গবেষণার জন্য একটি গবেষণাগার তৈরি করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে হেস যখন নিজের শহর গ্রাজে ফিরলেন, তখন জার্মানীতে একচ্ছত্র অধিপতি হিটলার। ইহুদী নিধন যজ্ঞে মেতে উঠেছেন তিনি। হেস এর স্ত্রী ছিলেন জাতে ইহুদী। সুতরাং কোপ পড়লো তাদের উপরেও। হেস এর চাকরি গেল। ভাগ্য ভালো, একজন সহানুভুতিশীল গেস্টাপো অফিসারের থেকে হেস জানতে পারলেন তারা অস্ট্রিয়ায় থাকলে কিছুদিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হবেন। তাদের চালান করে দেওয়া হবে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সুতরাং গ্রেপ্তারের প্রায় এক মাস আগেই হেস ও তার পরিবার পালালেন সুইজারল্যান্ডে। ১৯৩৮ সালে আমেরিকার ফোর্ড হ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ আসে হেস এর কাছে। হেস আমেরিকা পাড়ি দিলেন। পরবর্তী জীবনটা হেস কাটিয়েছেন আমেরিকায়। ১৯৪৪ সালে তিনি আমেরিকার নাগরিক হন। চল্লিশের ও পঞ্চাশের দশকে মানব শরীরে রেডিয়ামের প্রভাব নিয়ে বহু মূল্যবান গবেষণা করেছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালের ৭ই ডিসেম্বর হেস মারা যান।
১৯৩৬ সালে মহাজাগতিক রশ্মি আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর সাথে সে বছর পদার্থবিদ্যায় পুরষ্কার পেয়েছিলেন পজিট্রন কণার আবিষ্কারক অ্যান্ডারসন। যে সমস্ত বিজ্ঞানী হেসের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিদ আর্থার কম্পটন। নোবেল কমিটি কে পাঠানো রিপোর্টে কম্পটন লিখেছিলেনঃ
আমার মনে হয় সেই সময় হয়তো এসে গেছে যখন এই অসীম মহাজগৎ থেকে আসা রশ্মিকে আমরা প্রকৃত অর্থেই মহাজাগতিক বলতে পারি এবং এই রশ্মিকে যথার্থ ব্যবহার আমাদের কাছে নতুন নতুন আবিষ্কারের দিগন্ত খুলে দিয়েছে, সুতরাং এই মহাজাগতিক রশ্মির আবিষ্কারকে আমরা একটি প্রথম শ্রেণীর আবিষ্কার হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি .. আমার মনে হয়, হেস-ই হলেন প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি উচ্চতার সাথে বিকিরণের তীব্রতার আধিক্য সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করেছেন এবং আমার মতে হেস-ই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রমাণ করেন বাতাসের কণাগুলোর আয়ননের উৎস মহাজগৎ।
হেস এর প্রতি সম্মানার্থে ২০০৪ সালে নামিবিয়ায় মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষনার জন্য তৈরি হয়েছে এক মানমন্দির (observatory)। নাম দেওয়া হয়েছে HESS: High Energy Stereoscopic System।
আরো জানতে:
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/victor-hess-and-cosmic-ray