21-12-2024 17:03:48 pm
Link: https://bigyan.org.in/ultrasonography-imaging
আমি কলকাতায় এলেই প্রতি শনিবার আমার ছোটোমামার ছেলে রিভু দুপুর দুপুর হাজি্র হয়ে যায়। ও আমার থেকে বেশ খানিকটা ছোটই। সবে ক্লাস এইট পাশ করে নাইনে উঠেছে। তবে পড়াশোনা ছাড়াও আরো অনেক দিকে আগ্রহ থাকায় জমে ভাল। ওরও প্রশ্নের শেষ নেই,আর একজন গুণমুগ্ধ শ্রোতা পেয়ে আমিও আল্লাদে আটখানা।
বিকেলটা ভালই কাটলো ব্রেকিং ব্যাড-এর গোটা কয়েক এপিসোড আর গরম গরম পপকর্ন নিয়ে। নটার আশেপাশে বললাম: “কাল তো রোববার। হোমোয়ার্ক করা আছে? থেকে যা না আজ?”
খানিকটা কিন্তু কিন্তু করছিল প্রথমে, একটু জোরাজুরি করতেই রাজি হয়ে গেল। মামিকে ফোন করে জানিয়ে দিয়ে বললো: “ঠিক আছে, কিন্তু রাতে করবটা কি? ঘুমবো না নিশ্চই?”
আমি রায় সাহেবকে টেনেই বললাম:
“বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু;
আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু।”
খিল খিল করে হেসে ফেললো রিভু।
“তা তো বুঝলাম। কিন্তু রাতে যে বাদুড়রা দেখতে পায় তা কি সত্যি?”
আমি বললাম,”বটেই তো!”
রিভুঃ “সে কি করে সম্ভব? ওদের তো আর আর্মির মত নাইট ভিসান গগলস নেই?”
আমিঃ “তা নেই তবে ওরা ইকোলোকেশন পারে। অর্থাৎ শব্দের প্রতিধ্বনি থেকে পথনির্ণয় করতে পারে।”
ওর হাঁ মুখটা দেখেই বুঝেছি কিচ্ছু মাথায় ঢোকেনি। একটু শুরুর থেকেই শুরু করলাম।
“তবে শোন।
শব্দ একটা তরঙ্গ। কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় যে কোনো রকম পদার্থের মধ্যে দিয়েই শব্দ বয়ে যেতে পারে। পদার্থের কিছু মৌলিক কণা অর্থাৎ অণু-পরমাণুর কম্পনের মাধ্যমে এই শব্দ প্রবাহিত হয়। যেমন ধর একটা অণু কাঁপছে, সেই কম্পনটা পরের অণুতে প্রবর্তিত হচ্ছে, সেটা থেকে তার পরেরটায়, এইভাবে। ফিজিক্সে, আমরা শব্দকে দুটো পরিমাপ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি: এক, বেগ বা ইংরেজিতে ভেলোসিটি আর দুই, কম্পাঙ্ক বা ইংরেজিতে ফ্রিকোয়েন্সি।
যেমন ধর, হাওয়ায় শব্দের গতিবেগ সেকেণ্ডে ৩৪০ মিটার, আবার জলের তলায় তারই মান সেকেণ্ডে ১৪৮০ মিটার। আর কম্পাঙ্কের পরিমাপ হার্জ-এ হয়। যে শব্দ তুই আমি কানে শুনতে পাই তার কম্পাঙ্ক ২০ হার্জ থেকে ২০ কিলোহার্জের মধ্যে। তার নীচের সবই ইনফ্রাসাউণ্ড আর উপরে?”
চট করে রিভু বললো,”আলট্রাসাউণ্ড?”
আমিঃ “গুড। বোঝা গেছে তাহলে?”
ও মাথা নাড়লো।
আমিঃ “এইযে বাদুড়ের কথা বললাম, ১৭৯৪ সালে স্প্যালানজানি নামে এক বিজ্ঞানী এক্সপেরিমেন্ট করে বের করেন যে বাদুড় রাতের বেলা অন্ধকারে এই আলট্রাসাউন্ডের সাহায্যে দিকনির্ণয় করে [১, ২]। সে আলট্রাসাউন্ড ছাড়ে আর সেই শব্দ আশেপাশের জিনিসে ধাক্কা খেয়ে বা reflect করে ফিরে এসে তাকে বোঝায় কোনদিকে যেতে হবে। বা কোন বাধাটা এড়িয়ে চলতে হবে।”
রিভুঃ “আরে সে তো স্পার্ম ওয়েলও জলের তলায় মাথা দিয়ে টিকটিক শব্দ করে। করে না?”
আমিঃ “ঠিক বলেছিস। একই জিনিস। ওই একই পদ্ধতি মেনে জলের তলায় সাবমেরিনের সোনার অর্থাৎ Sound Navigation and Ranging কাজ করে। ইউ ফাইভ সেভেন ওয়ান ছবিটা মনে পড়ছে আগের বার দেখিয়েছিলাম? আর এটাও জানিস কি, তুই জন্মানোর আগে মামা-মামি এই একই ভাবে তোকে মামির পেটের ভিতরে দেখতে পেয়েছিল?”
রিভুর চোখ চিক চিক করছে দেখে বেশ বুঝেছি ও মজা পেয়ে গেছে। এখন যদি থামি আমার আর রক্ষা নেই। তাও ভয়ে ভয়ে বললাম, “চল পিসি খেতে ডাকছে।”
মুখটা হাড়ির মত করে বললো, “মানে? আজ এই মাঝপথেই থেমে তুমি ঘুমিয়ে পড়বে তাইতো?”
আমিঃ “নারে বাবা।”
অগত্যা খেতে খেতেই বলে যেতে হল।
“ওই যে তোকে ইকোলোকেশান বোঝালাম, ঠিক সেভাবেই আলট্রাসাউণ্ড দিয়ে মানুষের শরীরের ভিতরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি তোলেন রেডিওলজিস্টরা। ধরে নে তোর পেটের ভেতরকার একটা “শব্দ-ছবি”! ডাক্তারখানায় বা হসপিটালে এই আলট্রাসোনোগ্রাফি বা ইউ এস জি (USG) প্রযুক্তির নাম শুনে থাকবি নিশ্চই। ১৯৪২ সালে, নিউরোলজিস্ট কার্ল ডুসিকের আবিষ্কার [৩]।”
রিভু থামালো।
“দাঁড়াও দাঁড়াও। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ছবিটা তোলে কি দিয়ে? আমাদের তো আর স্পার্ম ওয়েলের মত এই এত্ত বড় একটা মাথা নেই যেখান দিয়ে আওয়াজটা বেরোবে?”
আমিঃ “খুব ভাল প্রশ্ন করেছিস। এই আল্ট্রাসাউন্ড তরঙ্গ উৎপন্ন বা ট্রান্সমিট করা হয় একরকমের যন্ত্র বা ডিভাইস দিয়ে। আমরা তাদের বলি আলট্রাসনিক ট্রান্সডিউসার। ট্রান্সডিউসার জিনিসটা, এক ধরণের শক্তি বা এনার্জিকে অন্য আরেক ধরণের এনার্জিতে রূপান্তরিত করে। আর এই আলট্রাসাউন্ড ট্রান্সডিউসার হল ইলেকট্রিক আর সাউন্ড এনার্জি রূপান্তরের যন্ত্র। হসপিটাল বা ক্লিনিকে যে ধরণের যন্ত্র ব্যবহার হয় সেগুলোকে বলে পিয়েজোইলেকট্রিক ট্রান্সডিউসার।”
রিভুঃ “পি-এজো-এলেক্ট্রিক? সে আবার কি? কখনও তো শুনি নি স্কুলে?”
আমিঃ “শুনবি। তবে, আরো দু এক বছর পর, ক্লাস ১১এ উঠলে। পিয়েজোইলেকট্রিক কথাটা গ্রীক পিএজাইন (piezein) থেকে এসেছে, যার মানে দাঁড়ায় কোনো কিছুকে চাপ বা ধাক্কা দেওয়া। কোনো পদার্থের একটা ঘনক্ষেত্র বা কিউবকে যদি শব্দ তরঙ্গের আওতায় আনা হয়, অর্থাৎ ক্রমাগত চাপ দেওয়া আর ছাড়া হয়, সে পদার্থটি পিয়েজোইলেকট্রিক হলে একটা তড়িৎ সিগন্যাল তৈরী করবে। একেই বলে পিয়েজোইলেকট্রিক এফেক্ট। এই ধরণের পদার্থের মধ্যে পড়ে জিঙ্ক অক্সাইড (ZnO), লেড জার্কোনিয়াম টাইট্যানেট (PZT) ইত্যাদি। তবে এই এফেক্ট-এর উল্টোটাও কিন্তু সত্যি। যদি এই ধরণের পদার্থের ক্রিস্টাল-কে তড়িৎ ক্ষেত্রের আওতায় আনা হয়, তার মধ্যে একটা মেকানিকাল ভাইব্রেশান বা কম্পন দেখা দেবে। একে বলে রিভার্স বা উলটো পিয়েজোইলেকট্রিসিটি, আর এর মাধ্যমে যে কম্পনের জন্ম হয়, সেটা থেকেই তৈরী হয় আলট্রাসাউন্ড। ১৮৮০ সালে, দুই ভাই, পিয়ের ও জাক কুরী প্রথমবার পিয়েজোইলেকট্রিক এফেক্টের কথা মানুষের সামনে আনেন।”
রিভুঃ “বুঝেছি, তার মানে ওই রিভার্স এফেক্ট দিয়ে আলট্রাসাউন্ড ওয়েভ ছাড়ে আর ডিরেক্ট দিয়ে রিফ্লেক্ট হওয়া শব্দ ধরে ছবিটা তৈরী করে এই তো?”
আমিঃ “এক্সেলেন্ট! বাপারটা অতটা সহজ না হলেও কাজের পদ্ধতিটা মোটামুটি ঠিকঠাকই ধরেছিস। বিভিন্ন দিক থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গ মাপার পর শুরু হয় ইমেজ প্রসেসিং বা ছবি তৈরির কাজ। সে কথা অন্যদিন বলবো, এখন যা বলছি শোন। কি ধরণের ছবি তোলা হবে, তার উপর নির্ভর করে এই ট্রান্সডিউসার বাছা হয়। নামজাদা অনেক কম্পানি নানান ধরন আর ফ্রিকোয়েন্সির ট্রান্সডিউসার তৈরী করে থাকে।”
রিভুঃ আরো একটু বিশদে বল।
আমিঃ ধর যদি একটাই পিয়েজো ক্রিস্টাল (বর্গক্ষেত্র, প্লেট ইত্যাদি ) ব্যাবহৃত হয়। তখন তাকে আমরা বলি সিংগেল এলিমেন্ট ট্রান্সডিউসার। তা থেকে কেবল মাত্র একটা নির্দিষ্ট দিকের গভীরতাই মাপা যায়। পুরো ছবি তুলতে গেলে ওয়ান ডি অথবা টু ডি ট্রান্সডিউসারের প্রয়োজন। এই ছবিটা দেখ (ল্যাপটপটা খোলাই ছিল)। বাঁদিকের ছবিটা দেখ, বুঝতে পারবি। একটা ব্যাপার হল, অনেক ওয়ান-ডি ট্রান্সডিউসার-এ, তড়িৎ সিগনাল কিভাবে প্রয়োগ করছিস তার উপর দেখার কোণ বা অ্যাঙ্গেল নির্ভর করে। ওয়ান ডিতে অবশ্য তুই খালি টু ডায়মেনশানাল ছবিই পাবি।
থ্রী ডায়মেনশানাল ছবির জন্য তোকে কিন্তু একটা টু ডায়ামেনশানাল ট্রান্সডিউসার ব্যাবহার করতে হবে। তাকে আমরা বলি ভলুমেট্রিক ইমেজিং।”
আবার প্রশ্ন রিভুর। “তবে তুমি বলছো যে এই সব হাসপাতালে এই যে এত-এত ইউ এস জি করে, তার সব এই পিয়েজোইলেক্ট্রিক ট্রান্সডিউসারেই হয়? এই এত বছর ধরে তাই হয়ে আসছে?”
আমি বললাম, “হ্যা তা বলতে পারিস্, তবে এই ট্রান্সডিউসারগুলোর কিছু সমস্যা আছে। তাই হালে, ২০ বছরের একটু বেশি সময় ধরে আরেকটা নতুন ধরণের ট্রান্সডিউসারের উপর বিজ্ঞানিরা প্রচুর গবেষণা চালাচ্ছেন। “
রিভুঃ “শুনি, শুনি!”
আমিঃ “দ্যাখ, শব্দ বিজ্ঞানে আমরা দুটো জিনিসকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিই। এক, চাপ বা প্রেশার আর দুই শব্দের বেগ বা ভেলোসিটি। আর এই দুটো মিলিয়ে আমরা তৈরী করেছি একটা গাণিতিক বা ম্যাথেমেটিকাল পরিমাপ যাকে বলা হয় অ্যাকাউস্টিক ইম্পিডেন্স। এর একক Kgm2-s বা Rayl, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড রেইলীর নামে। এটা খানিকটা ধর আলোর ক্ষেত্রে প্রতিসরাঙ্ক বা রিফ্র্যাক্টিভ ইন্ডেক্সের মত। এক মাধ্যম থেকে আরেক মাধ্যমে যেতে আলোক তরঙ্গ তার সোজা পথে যতটা বাধা পায়, তার পরিমাপ প্রতিসরাঙ্ক। কিছুটা সেরকমই শব্দতরঙ্গও মাধ্যম বদল করলে তার পথে বাধা সৃষ্টি হয় আর সেই বাধাকে অ্যাকাউস্টিক ইম্পিডেন্স দিয়ে মাপা হয়।
এবার, শব্দ যেখান থেকে তৈরী হচ্ছে অর্থাৎ ট্রান্সডিউসার আর যে পদার্থের মধ্যে দিয়ে সেই শব্দের প্রবাহিত হওয়ার কথা অর্থাৎ মানুষের শরীরের টিশু, তাদের ইম্পিডেন্স-এ খুব বেশি ফারাক হলে শব্দ সেই দুই পদার্থের অন্তঃরেখা বা বাউন্ডারি থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। মানুষের শরীরে ঢুকতে পারে না, সুতরাং তোর পেটের ভিতরের ছবি আর উঠলো না।”
রিভু হাসতে হাসতেই বলে উঠলো, “মানে আলো যেমন আয়নায় লেগে ফেরত আসে ওইরকম?”
আমিঃ “একদম যে সেভাবে ঘটছে তা নয়, তবে আপাতত তাই ধরে নে। ঘটনাটা যে আখেরে প্রতিফলন সেই দিক থেকে আলোতে আর শব্দে কোনো ফারাক নেই, তবে এর পিছনে কারণটা কি, তাতে ফারাক আছে। এবার, পিয়েজোর ইম্পিডেন্স আর মানুষের শরীরের ইম্পিডেন্স একেবারেই আলাদা। তাই প্রতিফলন আটকাতে আমাদের কিছু অন্যরকম পদার্থের আস্তরণ ট্রান্সডিউসারের উপর ব্যাবহার করতে হয়। তার নিজের ইম্পিডেন্স এমনি হওয়া চাই যাতে সেটা ব্যাবহার করলে ওই ইম্পিডেন্স-এর ফারাকটা কেটে যায়, বা ‘এ্যাকাউস্টিক ম্যাচিং’ ঘটানো যায়। আমরা সেই স্তরকে বলি ম্যাচিং লেয়ার। এছাড়াও পিয়েজো ট্রান্সডিউসারের আরো কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য নানান পদার্থের স্তর আলাদা করে তৈরী করতে হয় পিয়েজো কৃস্টালের সামনে এবং পেছনে। এই পুরো কার্যপ্রণালীটা বেশ সময় সাপেক্ষ এবং তাতে খানিকটা কায়িক শ্রমেরও দরকার হয় বটে।
এছাড়াও আরো একটা ব্যাপার হল এই ধরণের পদার্থ যে পরিবেশে এসিক (Application Specific Integrated Circuits বা ASIC) চিপ তৈরী হয়, সেখানে একই সাথে তৈরী করা যায়না। কাজেই ট্রান্সডিউসার ও তাকে চালনা করার মাইক্রচিপ আলাদা করে তৈরী হয় দুই জায়গায়। তারপর তাদের যান্ত্রিক উপায়ে এ্যাসেম্বেল বা সম্মিলিত করতে হয়। বুঝতেই পারছিস পুরো প্রডাক্টটা তৈরী করা ভীষণ রকম খরচ ও সময় সাপেক্ষ। হালে বেশ কিছু ‘পিক অ্যান্ড প্লেস’ যন্ত্র আবিষ্কার হলেও প্রধান কাজের বেশ খানিকটা হাতেই করতে বাধ্য হন অপারেটররা।”
রিভুঃ “তবে উপায়?”
আমিঃ “ধৈর্য ধর বৎস। সেই কথাতেই আসছি। ১৯৯৪ সালে এম আই হ্যালার ও বাতরাস পি খুরী ইয়াকুব নামের দুই বিজ্ঞানী স্ট্যানফোর্ডের গ্লীজস্টোন ল্যাবে এক নতুন ধরণের ট্রান্সডিউসার আবিষ্কার করেন। একে চালনা করার পদ্ধতি খানিকটা আলাদা। এর মূলে রয়েছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছোটো ছোটো ক্যাপাসিটর দিয়ে তৈরী একটা যন্ত্র যাকে আমরা বলি সিমাট (Capacitive Micromachined Ultrasonic Transducers (CMUT))।
ক্যাপাসিটর তো জানিসই। একটা ডিভাইস যাতে দুটো সমান্তরাল ইলেক্ট্রোড অর্থাৎ বিদ্যুৎ পরিবাহী প্লেট থাকে আর তার মাঝে এক বা একাধিক স্তরে অন্তরক অর্থাৎ ইলেক্ট্রিকাল ইনসুলেটার (বিদ্যুৎ অপরিবাহী) থাকে। এবার যদি এই ইন্সুলেটার হাওয়া বা ভ্যাকিউম হয় তবে এই দুই প্লেটে ডি সি ভোল্টেজ দিলে আর একটা প্লেট-কে আটকে দেওয়া হলে (ধরা যাক সেটা নিচের প্লেট), কুলম্ব আকর্ষণের জন্য উপরের প্লেটটি নিচের দিকে এগিয়ে আসবে। সেই ডি সি-র উপর যদি নির্ধারিত কম্পাঙ্কের এসি ভোল্টেজ দেওয়া যায় তবে উপরের প্লেটটা উপর নীচে দুলতে শুরু করবে। আর এই কম্পন থেকেই হবে শব্দের সৃষ্টি। ধর একটা রাবার ব্যাণ্ডকে তুই বাঁ হাতের দুই আঙ্গুলের টানে আটকে অন্য হাতের বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনী দিয়ে চিমটির মত করে ধরে একটু করে নিজের দিকে টানছিস আর ছাড়ছিস। তার ফল যা হবে এও খানিকটা তেমনই। শুধু এক্ষেত্রে তুই আঙ্গুল নয় তড়িৎ শক্তি দিয়ে টানছিস। বোঝা গেল?”
রিভুঃ “মোটামুটি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এতে লাভ কি হচ্ছে? পিয়েজোর নিজস্ব প্রবলেমগুলো কি এতে মিটছে?”
আমিঃ “ভেরী গুড তোপসে! অবশ্যই মিটছে। এ যন্ত্র শুধুই একটা ক্ষুদ্র ‘মেকানিকাল স্ট্রাকচার’। কাজেই এক, বিজ্ঞানীরা চাইলে এই ক্যাপাসিটরগুচ্ছ নিজেদের সুবিধামত এসিকের বাকি চিপ-টার সাথেই ক্লীন রুমে বানাতে পারেন। এইযে স্মার্টফোনে এত সেন্সরের কথা শুনিস, তার চিপ আর সেন্সর ডিভাইস এই একইভাবে তৈরী হয় বড় বড় কোম্পানির ক্লীন রুমে। তার নাম মোনোলিথিক ইন্টিগ্রেশান। তাই আর আলাদা করে দু জায়গায় দুটো তৈরী করে প্রোডাক্ট বানানোর খরচ আর সময় বাড়াতে হচ্ছে না। দুই, এই প্লেটগুলো খুবই পাতলা। তাই এর নিজের পদার্থিক ইম্পিডেন্স আর তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাজেই একাউস্টিক ম্যাচিং করার প্রশ্নও উঠছে না।
সিমাট বা স্মার্ট ফোনের সেন্সারগুলো খুব ছোটো, মাইক্রোমিটার বা তারও কম সাইজের। আর এই সমস্ত যন্ত্রগুলো ইলেক্ট্রিক আর মেকানিকাল এই দুই শক্তির আদান প্রদান করে বলে এগুলোকে আমরা বলি মেমস (MEMS) বা মাইকো ইলেকট্রো মেকানিকাল সিস্টেমস।”
রিভুঃ “মেমস নামটা শুনেছি স্কুলের কুইজে, তবে মোনোলিথিক ইন্টিগ্রেশান-টা আরেকটু ভালো করে বোঝাবে?”
আমিঃ “বেশ! মোনোলিথিক ইন্টিগ্রেশান হচ্ছে একধরণের কম খরচে সমন্তরাল ভাবে এসিক-মেমস তৈরির পদ্ধতি। মানে, যেমন বললাম পিয়েজোএলেকট্রিক ট্রান্সডিউসার আর আইসি দুটো আলাদা করে তৈরী করে একসাথে একটা প্রোডাক্টে যান্ত্রিক সমাবেশ ঘটাতে অনেক বেশি খরচ পড়ে। মেমসের ক্ষেত্রে বড় বড় ফাউন্ড্রি এই মোনোলিথিক টেকনিক ব্যাবহার করে অনেক কম খরচায় অনেক বেশি ডিভাইস তৈরী করে। সিমাট-এর ক্ষেত্রেও তার চেষ্টা অনেক দূর এগিয়েছে, একটা দুটো কম্পানি করেও ফেলেছে হালে।”
রিভুঃ “বুঝলাম। তা পিয়েজো ট্রান্সডিউসারের উত্তরসূরি কি একমাত্র এই সিমাট-ই?”
আমিঃ “তা বললে খানিকটা মিথ্যে বলে হবে। এছাড়াও আরেক ধরণের ট্রান্সডিউসার এই গবেষণার দিগন্তে বেশ উজ্জ্বল। তার নাম পিমাট (Piezoelectric Micromachined Ultrasonic Transducers (PMUTs))। এদের তুই সিমাট আর সাধারণ পিয়েজোর মাঝামাঝি রাখতে পারিস। এরাও ওই প্যারালাল প্লেটই, তবে উপরের প্লেটটায় একটা বা দুটো খুব পাতলা পিয়েজো আস্তরণ থাকে। তাই আর এদের সিমাটের মত আলাদা করে ডিসি ভোল্টেজ দেওয়ার দরকার পরে না। কিন্তু এসিকের সাথে সংযোগ ঘটানোর ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা অসুবিধায় পড়তে হয় বৈকি।
তাছাড়া পিমাটকে সেন্সার হিসেবে ব্যাবহার করা হয় প্রধানত নানান ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রয়োগে, তবে দু একটা ক্ষেত্রে ডাক্তারি আল্ট্রাসাউন্ড-এও এঁদের ব্যাবহার আছে।
এছাড়াও আরো কিছু নতুন ধরণের ট্রান্সডিউসার আবিস্কৃত হয়েছে হালে, কিন্তু তার সবই এখনো কেতাবি গবেষণার পাতায়। অন্যদিকে সিমাট (আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিমাট) ভিত্তিক প্রডাক্ট বাজারে আনার প্রতিযোগিতায় বেশ কিছু মেডিকাল আল্ট্রাসাউন্ড কোম্পানি ইতিমধ্যেই যুদ্ধে নেমে পড়েছে। ভেবে দেখ একবার! এই দুই মেমস ট্রান্সডিউসার প্রোব সত্যি ডাক্তারদের হাতে এলে আরো কত নতুন নতুন ইমেজিং-থেরাপির দিগন্ত খুলে যাবে?”
ছেলের চোখে এত রাতেও এক ফোটা ঘুম নেই। বুঝতে পারেনি আমি গল্প বন্ধ করার তাল করছি। বললাম: “অনেকক্ষণ বকেছি। গলা ধরে গেছে আমার। জলের বোতোলটা নিয়ে আয় তো।”
রিভু উঠে গেছে জল আনতে আর আমি সেই সুযোগে চটপট করে মশারিটা টানিয়ে ফেলেছি। ফিরে তো ছেলের কান্নাকাটি অবস্থা! “না না প্লিজ এরকম কোরো না। ওই নতুন নতুন ইমেজিং-থেরাপি-র দিকটা শেষ করে একেবারে ঘুমাই? প্লিজ?”
আমি ওর চেচামেচির মধ্যেই লাইটটা অফ করতে করতে বললাম, “এবার ঘুমো নাহলে মার খাবি। বাকি গল্প পরেরদিন হবে।”
প্রচ্ছদের ছবি: আলট্রাসোনোগ্রাফি (সূত্র: johnhopkinsmedicine.org)
[১] বাদুড়-এর এই শব্দের মাধ্যমে দিকনির্ণয় করার ক্ষমতা নিয়ে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত এই লেখাটি পড়ুন: https://bigyan.org.in/2014/11/18/bats-jamming-bats/।
[২] D. Kane, W. Grassi, R. Sturrock, P. V. Balint; A brief history of musculoskeletal ultrasound: ‘From bats and ships to babies and hips’, Rheumatology, Volume 43, Issue 7, 1 July 2004.
[৩] Dussik, K.T. (1942) On the possibility of using ultrasound waves as a diagnostic aid. Neurol. Psychiat. 174:153-168.
[৪] M.I. Haller, and B.T. Khuri-Yakub, “A surface micromachined electrostatic ultrasonic air transducer,”in Ultrasonics Symposium, 1994. Proceedings., 1994 IEEE, 1-4 Nov 1994, vol.2, pp.1241-1244.
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/ultrasonography-imaging