21-12-2024 17:08:37 pm
Link: https://bigyan.org.in/treating-cancer
রিয়ার (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে আমার দেখা মেডিকেল কলেজে। পাঁচ বছরের ছোট্ট রিয়া যখন মায়ের হাত ধরে প্রথম আমাদের ক্লিনিকে এসে বসল, তখন বোঝার উপায় নেই যে এই সুন্দর শিশুটির শরীরে দানা বেঁধেছে এযুগের সবথেকে ভয়ঙ্কর রোগ: ক্যান্সার। সামান্য কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করতে সময় লাগলো না। রিয়ার অসুখের নাম লিউকিমিয়া, পোষাকী নাম প্রি-বি সেল একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকিমিয়া, এক ধরণের রক্তের ক্যান্সার।
মাস ছয়েকের চিকিৎসার শেষে রিয়া যখন বাড়ি ফিরছে, তখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পথে। সারাক্ষণের প্রবল দুর্বলতা, মাড়ি থেকে রক্তপাত, জ্বর, হাতে পায়ে যন্ত্রণা, যত্রতত্র কালশিটে দাগ – এসবের কোনটাই আর নেই। সাড়ে পাঁচ বছরের সেই উচ্ছল শিশুটিকে দেখে কে বলবে যে মাত্র কয়েক দশক আগেও তার রোগের একমাত্র পরিণাম ছিল মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা!
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন শহরে যখন সিডনি ফার্বার প্রথম কিমোথেরাপীর প্রবর্তন করছেন, তখন কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি অখ্যাত এই চিকিৎসকের হাত ধরে ক্যান্সার চিকিৎসার জগতে এতবড় বিপ্লব ঘটবে1। পেশায় প্যাথলজিস্ট ফার্বার সেই অর্থে ‘ক্লিনিশিয়ান’ ছিলেন না; আর হয়ত সেই কারণেই ক্যান্সার নিয়ে সমসাময়িক চিকিৎসক মহলের হতাশা বা ঔদাসীন্য তাঁকে স্পর্শ করেনি। ইতিপূর্বে রক্তের ক্যান্সার চিকিৎসায় নানারকম সরঞ্জামই ব্যবহৃত হয়েছে। রক্তাল্পতায় ব্যবহৃত একধরণের ভিটামিন ফোলিক আসিড বা ফোলেট এর মধ্যে অন্যতম। ক্যান্সার সঞ্জাত রক্তাল্পতা দূরীকরণে ফোলেটের ব্যর্থতার কথা ফার্বারের জানা ছিল। ফার্বার লক্ষ্য করেন যে রোগীর উন্নতির পরিবর্তে ফোলেট রক্তের ক্যান্সারের বিস্তার ত্বরান্বিত করে। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে রোগীকে যদি ফোলেটের বিরুদ্ধে কাজ করে এমন কোনো রাসায়নিক দিয়ে চিকিৎসা করা যায়, তবে হয়তো রোগীর অবস্থার উন্নতি হলেও হতে পারে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলে মাত্র পাঁচ জন রোগীর ওপর ফার্বারের প্রাথমিক পরীক্ষার ফল হয় যুগান্তকারী। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়া মাত্রই চিকিৎসক মহলে সাড়া পরে যায়। কারোর বুঝতে অসুবিধা হয়না যে ক্যান্সার চিকিৎসার এক অন্যতম হাতিয়ার উপস্থিত2।
বিজ্ঞানের কোনো গবেষণাই বিচ্ছিন্ন ভাবে হয়না। ফার্বারের গবেষণারও এক দীর্ঘ প্রেক্ষাপট রয়েছে। উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে, যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানে সামগ্রিক ভাবে বিপ্লব আসছে, ক্যান্সার গবেষণাও পিছিয়ে থাকেনি। অনুবীক্ষণ যন্ত্র সহ অন্যান্য আধুনিক সরঞ্জাম আবিষ্কারের পরই চিকিৎসক সমাজ রোগের উৎস বা ক্ষেত্র হিসেবে বিভিন্ন অঙ্গ বা সিস্টেমকে আলাদা করতে শেখে। ম্যালেরিয়ার উৎস যে এক ধরণের জীবাণু, কোনো দূষিত বায়ু নয়, তা জানতে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের ভূমিকা অত্যাবশকীয়! এই অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত চিকিৎসক ভিয়ারখফ3 (Virchow) তার দীর্ঘ গবেষণায় সমস্ত রোগের উৎস বর্ণনা করতে সচেষ্ট হন। কোন রোগে যকৃত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর কোন রোগেই বা রোগীর হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে পরে এসবই ভিয়ারখফের গবেষণায় ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবে ধরা পরে নানাবিধ ক্যান্সারের পার্থক্যও। ক্যান্সার যে কোনো একমাত্রিক সমসত্ব রোগ নয় তা বুঝতে অসুবিধা হয়না কারোরই। কোনো বিশেষ প্রত্যঙ্গের (যেমন ধরা যাক ফুসফুসের) ক্যান্সার-ও যে কত বিচিত্র রকমের হয় এবং কত বিচিত্র উপসর্গের প্রকাশ ঘটে, তা ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হয়। সকল ক্যান্সারই এক অর্থে শরীরের কোনো না কোনো অংশের কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনের ফলে সৃষ্ট এক উপবৃদ্ধি বিশেষ। কিন্তু মানবশরীরের কোনো অংশই যেহেতু একধরণের কোষ দিয়ে সৃষ্ট নয়, তাই ক্যান্সারও সমসত্ব ব্যাধি নয়।
ক্যান্সারের জটিলতা ও বহুত্ব সম্পর্কে এভাবে গভীর ও অভূতপূর্ব জ্ঞান অর্জনের পরেও এরোগের চিকিৎসার বিশেষ উন্নতি ঘটেনি। শল্যচিকিৎসার (surgery) উন্নতির সাথে সাথে সলিড টিউমার কেটে বাদ দেওয়ার চিরাচরিত পদ্ধতিরও উন্নতি ঘটে। কিন্তু শরীরের বহিরঙ্গের ক্যান্সার না হলে সেই প্রক্রিয়ার সাফল্য ছিল অতি সামান্য। চিকিৎসা শেষে ক্যান্সার ফিরে আসার আশঙ্কাও রয়ে গেল গভীর। ১৮৯৫ সালে এক্স-রে আবিষ্কারের পর রেডিয়েশন থেরাপী শুরু হওয়ায় এক নতুন পথের সূচনা হলো ঠিকই, কিন্তু অতি সীমিত সাফল্য আর এক্স-রের নিজের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত দুশ্চিন্তার ফলে রেডিয়েশন থেরাপীও খুব বেশী জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি4।
ফার্বারের গবেষণা এক অর্থে এই সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটায়। সার্জারি বা রেডিও থেরাপীর ভূমিকা অমূলক হয়ে না গেলেও ক্যান্সার চিকিৎসায় এরা চলে যায় পিছনের সারিতে। ক্যান্সার গবেষণার মুখ্য প্রতিপাদ্য হয়ে ওঠে আরও ভালো কিমোথেরাপী এজেন্ট খুঁজে বার করা: এমন রাসায়নিক যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম বা নগণ্য, যা কেবল ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের ওপর আক্রমণ শানাতে সক্ষম, যার বিরুদ্ধে ক্যান্সার সহজে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। একবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে আমেরিকার বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে আবিষ্কৃত ‘ক্যান্সারের মারণাস্ত্র’ ইমাটিনিব (Imatinib mesylate) কে নিয়ে যে বিশ্বখ্যাত কভার স্টোরিটি ছাপা হয়, তার সূচনা এক অর্থে ফার্বারের হাত ধরেই5।
তবে কিমোথেরাপীতেই ক্যান্সার চিকিৎসা আটকে থাকেনি। বিগত পঞ্চাশ বছরে ক্যান্সার গবেষণায় দুই নজিরবিহীন বৈপ্লবিক পটপরিবর্তন ঘটেছে, আর তা ঘটেছে এমন দুই ব্যক্তির হাত ধরে যারা সেই অর্থে কেউই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ নন। তাঁদের যুগান্তকারী গবেষণার ফল স্বরূপ আজ আর ক্যান্সার থেকে আরোগ্য আর অলস কল্পনা মাত্র নয়। তবে সে আলোচনা থাক আরেকদিনের জন্য।
পরের পর্ব – ক্যান্সার থেকে আরোগ্যের পথে-২
——x——
সূত্র:
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/treating-cancer