11-10-2024 20:27:46 pm
Link: https://bigyan.org.in/thermoacoustics-part-2-cancer-treatment
সকাল সাতটা থেকে বিরামহীন চূড়ান্ত বকবকানিতে গলাটা ধরে গিয়েছিল বুঝে ঋভু ট্যাক্সিতে একটা প্রশ্নও করেনি। মাঝে সাঝে অবশ্য চুপ করে গাড়িতে বসেছিল আর ওর স্কুলের বন্ধুবান্ধবীদের গল্প করছিল। এ সব শুনতে আমার বেশ ভালই লাগে। জীবনের দৈনন্দিন চাপ আর তার সাথে পি-এইচ-ডি এ্যাডভাইসারের রগড়াণির হাত থেকে নিস্তার পেতে এ এক সহজ ও আনন্দদায়ক উপায়। তার উপর প্রায় বছর দেড়েক পর মেঘলা দিনে দক্ষিণ কলকাতার বুক চিরে ট্যাক্সি যাত্রার মজা। তাই আমি চুপ করেই ছিলাম। গাড়িটা ক্যামাক স্ট্রীটের দিকটা দিয়ে কেলিনওয়ার্থের পাশ দিয়ে ঢুকে ঠিক পিটার ক্যাটের সামনে আমাদের নামিয়ে দিল। এবার বাকিটা হাঁটা। মিনিট পাঁচেকেই পৌঁছানো গেল ফ্লুরিজে। বিরাট কাঁচের জানলাটার কাছে একটা টেবিল নিয়ে- চট করে দুটো কফি, কিছু স্যাণ্ডউইচ, আর ঋভুর জন্য ফুল ব্রিটিশ ব্রেকফাস্ট অর্ডার করে এসে ফুরফুরে মনে চেয়ারে বসতেই ঋভু বললো;
“তোমার কাজ তো মেডিকাল আল্ট্রাসাউণ্ডে? তা এটা তোমার কোন কাজে লাগে শুনি?”
আমিঃ(কফিতে চুমুক দিতে দিতে) গুড কোয়েশচেন। তবে আগে একটু খেয়ে নি নাকি?
ঋভুঃ আরে আসতে আসতে বল না। তোমায় গাড়িতে এক ফোটা জ্বালাইনি কিন্তু।
আমিঃ তা জ্বালাসনি বটে। বেশ তবে শোন।
সাধারণ আলট্রাসাউন্ড ইমেজিং-এ আমরা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের শুধুমাত্র বাইরেটা দেখতে পাই। তাহলে লিভারের ভীতরে যদি টিউমার থাকে সেটা দেখবি কি করে? কাজেই তখন আমরা ব্যবহার করি থার্মোএ্যাকাউস্টিক ইমেজিং”।
ঋভুঃ কোয়াইট ইন্টারস্টিং! এও কি বেন এ্যাণ্ড জেরী যে ভাবে থার্মোএ্যাকাউস্টিক ব্যবহার করে, একেবারে তেমনই?
আমিঃ বিজ্ঞানটা প্রায় একইরকম। তবে প্রয়োগটা আলাদা। মানে ধর, তুই শরীরের বাইরে থেকে খুব কম তীব্রতার ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক স্পন্দন, একটা নির্দিষ্ট প্রত্যঙ্গের দিকে নিক্ষেপ করলি। স্পন্দনটা রেডিওয়েভ/মাইক্রোওয়েভ হতে পারে বা লেসার রশ্মি, যে ক্ষেত্রে আমরা একে “ফোটোএ্যাকাউস্টিক ইমেজিং” বলে থাকি। এইবার, শরীরের যে অংশে তা নিক্ষিপ্ত হয়েছে, মনে কর লিভার, সেই স্পন্দনকে আত্মস্থ বা এ্যাবসর্ব করবে। তার ফলে খুব অল্পসময়ের জন্য (যতক্ষণ কম্পনটি লিভারে স্থিতিশীল থাকছে) মাইক্রোডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে তারপর তা আবার নিজের প্রাথমিক তাপীয় অবস্থায় ফিরে যাবে। বোঝা যাচ্ছে?
ঋভু; হ্যা।
আমিঃ বেশ। এইবার, লিভার টিস্যুর তাপ পরিবহন এবং অন্যান্য ধর্মের উপর ভিত্তি করে তার সংকোচন-প্রসারণ হবে ঠিক যেমন রেফ্রিজারেটারের ক্ষেত্রে বাস্প বা গ্যাসের হয়েছিল। আর তার থেকেই সৃষ্টি হবে শব্দ বা কম্পন যা আমরা শরীরের বাইরে একটা আলট্রাসাউণ্ড ট্রান্সডিউসার দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারবো।
ঋভুঃ বুঝলাম। কিন্তু তাতে লিভারের ভীতর টিউমার আছে কিনা বুঝবো কি করে?
আমিঃ ঠিক ধরেছিস। ভেবে দ্যাখ; লিভার টিস্যুর ধর্ম আর টিউমার টিস্যুর ধর্ম কিন্তু আলাদা। কাজেই তাপমাত্রার পরিবর্তন এবং ফলস্বরূপ তৈরি শব্দের কম্পাঙ্কও আলাদা হবে তাই নয় কি?
ঋভুঃ রাইট! বেশ ইন্টারেস্টিং!
আমিঃ তা তো বটেই। কাজেই একটা থ্রি ডায়ামেনশানাল থার্মোএ্যাকাউস্টিক ইমেজ আমাদের বেশ পরিষ্কার বুঝিয়ে দেবে কোথায় টিউমারটা আছে।
থার্মোএ্যাকাউস্টিকস দিয়ে যে মেডিকাল ইমেজিং করা যায় তা প্রথমবার এ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার থিয়োডোড় বাওয়েন ১৯৮৪ সালে প্রকাশ করেন [১]। আর এইযে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ছবিটা দেখছিস (ছবি ২), এটা প্রফেসার ক্রুগারের পাবলিকেশান সিরিজের একটি।
কিন্তু এতো গেল ইমেজিং। তুমি সেই কবে থেকে বলছো আলট্রাসাউণ্ড দিয়ে নাকি নানারকমের ট্রিটমেন্ট হয়, আজ অবধি তো কোনো খোঁজ দিলে না।
আমিঃ উফফফফ! যা বকাচ্ছিস না! শব্দ দিয়ে ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট হয় জানিস?
ঋভুঃ আরিব্বাস!না না।বলো বলো। শুনি!
আমিঃ আমরা হিফু (HIFU)- বা হাই ইনটেনসিটি ফোকাসড আলট্রাসাউণ্ড বলে একটা টার্ম ব্যবহার করি। এক্ষেত্রে কিছু বিশেষ ধরণের আলট্রাসাউণ্ড ট্রান্সডিউসার দিয়ে শরীরের বিশেষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে টারগেট করে বেশ তীব্র শব্দকে ফোকাস করা হয়। কাজেই এই নাম। সাউণ্ড এ্যাবসর্পশান বা বলতে পারিস শব্দ শোষণের মাধ্যমে সেই টিস্যুর তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে এবং ধরে রাখা জল বাবল রূপে বাস্পীভূত হওয়ার চেষ্টায় বিস্ফারিত হয়।
একে আমরা বলি ক্যাভিটেশান। এই নির্দিষ্ট টার্গে্ট যদি টিউমার হয় তবে এই ক্যাভিটেশানের ফলে সেই টিউমার টিস্যু নষ্ট হবে তা বলাই বাহুল্য। আর এই গো্টা ব্যাপারটাকে আমরা বলি থার্মাল এ্যাব্লেশান।
ছবিটা খেয়াল কর (ছবি ৩)। উপরের কালো যন্ত্রটা একটা আলট্রাসাউণ্ড ট্রান্সডিউসার যা কিনা শরীরের একটা অংশে শব্দকে ফোকাস করছে। লাল অংশটা ফোকাসড সাউণ্ড বীম। ওই জায়গায় জল বাষ্পীভূত হচ্ছে বাবলের আকারে। এবারে খেয়াল কর পাশে দেখানো হয়েছে কিভাবে শব্দের কম্পন ও তাপের জন্য আসতে আসতে বাবলটা বড় হতে হতে ফেটে যাচ্ছে। এই ফেটে যাওয়ার ফলে ধ্বংস হয় আশে পাশের ক্ষতিকারক টিউমার বা অন্য অদরকারী ক্ষতিকারক টিস্যু। এটাই ক্যাভিটেশান।
ঋভুঃ বেশ ইন্টেরেস্টিং। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শব্দকে বা কম্পনকে টার্গেট কোষে পৌছতে হলে তো অন্য কোষের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে তাইনা? সেক্ষেত্রে তারাও তো সেই কম্পনকে এ্যাবসর্ব করবে, কিন্তু তাদের ক্ষতি হবে না কেন?
আমিঃ ভেরি গুড কোয়েশ্চেন! সেখানেই ফোকাসড আলট্রাসাউণ্ডের কেরামতী। পথে পড়া কোষ এ্যাবসর্ব তো করবে বটেই, কিন্তু যে শব্দকে শোষণ করছে তার ইন্টেনসিটি এতই কম যে টিস্যু বা কোষের ক্ষতি হওয়ার জন্য যে তাপের প্রয়োজন সেই পরিমাণ তাপ ফোকাস না করলে তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। তাত্ত্বিক দিক থেকে সেই তাপ কত তা বুঝতে আমরা পেন্নের বায়ো হিট ট্রান্সফার ইকুয়েশান বলে একটা পদ্ধতি ব্যবহার করি। শব্দ জনিত তাপ তৈরির ক্ষেত্রে সেই ইকুয়েশানে হিট সোর্স বা তাপ উৎস হিসেবে আমরা যে সংখ্যাটা অংক কষে বের করি তাকে দেখতে এইরকম:
এই হল সাউণ্ড এ্যাবসর্পশান কোয়েফিশিয়েন্ট, মানে কোন কোষ কত কম্পাঙ্কের কত পরিমাণ শব্দ শোষণ করতে পারে তার একটা আনুমাণিক মান। আর হল শব্দের ইন্টেনসিটি বা তীব্রতা। কাজেই বেশ বুঝতে পারছিস ফোকাসড আলট্রাসাউণ্ডের ক্ষেত্রে সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা টার্গেটে শব্দের ইন্টেন্সিটি প্রয়োজনীয় তাপ তৈরি করার জন্য আদর্শ। অন্যান্য কোষে সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ঋভুঃ তা মানুষের শরীরে আব্লেশান হওয়ার জন্য কত তাপ বা তাপমাত্রা প্রয়োজন?
আমিঃ সেটা নির্ভর করছে কোষ বা টিস্যুর উপর। সফট টিস্যু যেমন চর্বীর ক্ষেত্রে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ক্যাভিটেশান শুরু হয়।
ঋভুঃ চমৎকার! কিন্তু আমাদের জানা কেমোথেরাপী বা রেডিওথেরাপী থাকতে এই পদ্ধতি আমরা ব্যবহার করবই বা কেন?
আমিঃ তার কারণ কেমো বা রেডিওথেরাপি টিউমারের সাথে সাথে শরীরের অন্যান্য ভাল টিস্যুকেও নষ্ট করে। শব্দ শুধুমাত্র একটা যান্ত্রিক কম্পন। কাজেই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা নেই বলেলেই চলে [২]। ১৯৫০ সালে প্রথম হিফুর ক্লিনিকাল ট্রিটমেন্ট ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। তারপর বিভিন্ন প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন রকমের ট্রান্সডিউসার বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিগত ১০-১৫ বছরে সিমাট ট্রান্সডিউসারকেও [৩] একাধিকবার হিফুর জন্য ব্যবহার করতে দেখা গেছে নানান গবেষণাগারে।
ঋভুঃ তা কত তাপমাত্রার প্রয়োজন একটা টিউমারের এ্যাব্লেশানের জন্য?
আমিঃ মোটামুটি ভাবে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে হলেই যথেষ্ট। তবে কোন টিস্যু তুই কত সময়ের মধ্যে নষ্ট করতে চাইছিস তার উপরেও নির্ভর করে।
তাছাড়াও হিফুর ক্যান্সার ছাড়াও আরো নানান রকমের প্রয়োগ আছে। তার উপর নির্ভর করেও তাপমাত্রা, বা ট্রান্সডিউসারের শব্দের কম্পাঙ্ক নির্ণয় করা হয়।
ঋভু; অন্যান্য বলতে?
আমিঃ যেমন ধর গ্লুকোমার ট্রিটমেন্ট, আলজাইমারের ট্রিটমেন্ট ইত্যাদি।
ঋভুঃ ফ্যাবুলাস! তা এগুলো বাজারে আসবে কবে? মানে আমরা হাতে পাব কবে?
আমিঃ দ্যাখ এগুলো তো হালের গবেষণা। কাজেই সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং আইনি পথ পেরিয়ে সাধারণের ব্যবহারের জন্য একটু সময় তো দিতেই হবে। তবে এ্যাবলাথার্ম [৪] বলে একটা মেশিন বাজারে এসেছে কিছু বছর হল যারা হিফু দিয়ে প্রোস্টেট ক্যান্সার সারানোর চেষ্টা করছে। কোম্পানিটার নাম EDAP-TMS [৫]। ফ্রান্সের কোম্পানি। তা ছাড়া ওই যে তোকে বললাম গ্লুকোমা ট্রিটমেন্টের কথা? ফ্রান্সেরই আই-টেক-কেয়ার [৬] বলে একটা কোম্পানি তাদের প্রোডাক্ট বাজারে এনেছে। দুই দলই এথিক্স কমিটির এ্যাপ্রুভাল পেয়েছে। মানুষের উপর ক্লিনিকাল ট্রায়ালের শেষ পর্যায় অবধি কাজ এগিয়েছে। তুই চাইলে ফোকাসড আলট্রাসাউণ্ড ফাউণ্ডেশানের [৭] ওয়েবসাইটটা খুলে দেখিস, গুগল করলেই পাবি।
ঋভুঃ ওহ দারুণ!
আমিঃ হুম! কিন্তু শোন এবার তো বিল মিটিয়ে উঠতে হবে… নইলে ফ্লুরিজের মালিক দলিল নিয়ে দেখাতে আসবে এটা আমাদের বাড়ি নয় … হা হা হা হা
(ঋভুর খিলখিলে হাসির মাঝেই বিল মিটিয়ে বেড়িয়ে এলাম আমরা।)
কিছু রেফারেন্সঃ
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/thermoacoustics-part-2-cancer-treatment