30-12-2024 18:08:47 pm
Link: https://bigyan.org.in/thermoacoustics-part-1-green-refrigerator-ben-jerry
“অনেক ঘুমিয়ে নিয়েছ, এবার চট পট উঠে পড় দেখি। হাতে বেশি সময় নেই।”, ঋভু বললো।
আগের সপ্তাহে রাত জেগে আলট্রাসাউণ্ড নিয়ে আড্ডাটা যে জায়গায় ছেড়েছিলাম, তাতে ব্যাটাছেলে যে শনিবার সকাল সকালই হামলা করবে এই ধারণাটা আমার মোটা মুটি ছিলই। মূলত যখন সামনের বুধবারই আমার রিটার্ন ফ্লাইট। তা বলে সাড়ে ছটা?
আমিঃ রিভু ৭ টাও বাজেনি। তুই পিসির কাছে আগে কফি টফি খা। ২ ঘন্টা আগে আমায় জ্বালাবি না।
ঋভুঃ তুমি যদি এক্ষু্নি না ওঠো আমি মশারীর মধ্যে ঢুকে তোমায় জ্বালাবো। আগের শনিবার যা তা করেছ। তার উপর বুধবার আবার বছর খানেকের জন্য হাওয়া। উঠে ছাদে চল কফি খেতে খেতে গল্পটা শেষ করবে, তারপর আমরা বেরোবো।
আর কি? অগত্যা উঠতেই হল! মুখ হাত ধুয়ে ফ্রীজ থেকে আধখান ঠান্ডা স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়েছি সবে, রিভু বলল
“ফ্লুরিজ যাবো। ৯ টায় বেরোনো । বেশি পেট ভরিয়ো না।”
আমিঃ বেশ। কি খাবি?
ঋভুঃ একটা কেক আর আইস্ক্রীম।
আমিঃ এই সাত সকালে আইস্ক্রীম?
ঋভুঃ আজ্ঞে।
আমিঃ খাবি পরে, আগে বল দেখি, শব্দ দিয়ে যে আইস্ক্রীম বা খাবার ঠাণ্ডা রাখা যায়, এটা জানা আছে কি?
স্যান্ডুইচের বাকি আধখান ওকে দিয়েছিলাম। আমার কথাটা শুনে প্রায় মুখ থেকেই পড়ে যাচ্ছিল।
ঋভুঃ সকাল সকাল গুল মারছো তো?
আমিঃ মোটেই না! ছাদে চল, বলছি।
ঋভুঃ(আমার হাত ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে ছাদে এসে) চটপট বল। আগের দিনের মত মাঝ পথে থামলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবো বলে রাখলাম কিন্তু।
আমিঃ বেশ বেশ। আজ তোকে খুব মজার দুটো তিনটে ব্যাপারে বলবো। সবগুলোই শব্দ, তাপ এবং তাদের যৌথ আদান প্রদান সংক্রান্ত।
ঋভুঃ আরিব্বাস! এই দুটোয় আবার যোগ আছে নাকি? দুটো তো দুই গ্রহের প্রাণী!
আমিঃ হু হু বাবা। ওরম মনে হয়। “থার্মোএ্যাকাউস্টিকস” কথাটার নাম শুনেছিস?
ঋভুঃ না তো
একটু থেমে…
বুঝেছি। “থার্মো” এসেছে থার্মাল থেকে, থার্মোমিটারের মত, তাইতো? আর আগের-বার তো বললেই আলট্রাসাউণ্ড বা এ্যাকাউস্টিক্সের কথা।
আমিঃ সাবাস! ফাটিয়ে দিয়েছিস তো। একটু উল্টো ভেবেছিস, তবে কুছ পরোয়া নেহি! থার্মাল বা থার্মোমিটার এসেছে থার্ম থেকে। যাক এবার বোঝাতে সুবিধা হবে। কাজেই শব্দ থেকে তাপ আর তাপ থেকে শব্দের যৌথ রূপান্তরের বিজ্ঞানকে আমরা “থার্মোএ্যাকাউস্টিক্স” নাম দিয়েছি। তাপীয় প্রসারণ বা থার্মাল এক্সপ্যানশান তো জানিস, ওই যে ভাবে গরম কালে ট্রেনের লাইন বা ধাতুর তৈরি ব্রীজ আকারে বেড়ে যায়?
ঋভুঃ হ্যাঁ তা তো পড়েছি।
আমিঃ বেশ। তেমনই ঠান্ডা করলে যে কোনো পদার্থ আকারে ছোট হবে? তাইতো?
ঋভুঃ একদম!
আমিঃ বেশ, তবে বল দেখি, আমি যদি একটা পদার্থকে পর পর ক্রমাগত গরম-ঠাণ্ডা গরম-ঠাণ্ডা করি তবে সে পদার্থের কি হবে?
ঋভুঃ বাড়বে কমবে, বাড়বে কমবে…তাইতো?
আমিঃ এক্সেলেন্ট! আগের গল্পটা মনে কর। কৃত্রিম শব্দ কিভাবে তৈরি করা যায়?
ঋভুঃ ওইতো আগেরদিন বলেছিলে। আমার নাম মনে থাকে না। তড়িৎ-এর মাধ্যমে কৃত্রিম কম্পন সৃষ্টি করা হয়।
আমিঃ ঠিক, যন্ত্রটার নাম “আল্ট্রাসনিক ট্রান্সডিউসার”। ট্রান্সডিউসার একপ্রকারের শক্তিকে অন্য প্রকারের শক্তিতে রূপান্তরিত করে। আলট্রাসাউণ্ড ট্রান্সডিউসার হল তড়িৎ শক্তি এবং শব্দ শক্তি আদানপ্রদানের যন্ত্র।
ঋভুঃ হ্যাঁ মনে পড়েছে। ট্রান্সডিউসার! কিন্তু এই ক্ষেত্রে তুমি যা বলছো তেমন কোনো যন্ত্র তো ব্যবহার হচ্ছে না, তাইতো? একটু বুঝিয়ে বলবে?
আমিঃ ঠিক। এও তো একরকমের কম্পনই হল নাকি? তাপ দিয়ে কম্পন। সেই কম্পন কত ফ্রিকোয়েন্সীর বা কম্পাঙ্ক-এর, তার উপর নির্ভর করছে শব্দের কম্পাঙ্ক ।
ঋভুঃ বুঝেছি। মানে তাপ কাজ করছে, তা দিয়ে পদার্থ আকারে বাড়ছে কমছে, তা থেকেই শব্দের উৎপত্তি যা কিনা আশে পাশে হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে।
আমিঃ ঠিক। প্রথমবার বাইরন হিগিন্স ওনার বিক্ষ্যাত “সিঙ্গিং ফ্লেম” এক্সপেরিমেন্টে থার্মোএ্যাকাউস্টিক্স প্রত্যক্ষ করেন। এরপর ১৮৫০এ, প্রফেসার সণ্ডহাস দেখান, একটি কাচের টিউবের(যার একদিকে তাপ প্রদান করা হচ্ছে) দৈর্ঘ্য এবং আয়তন কিভাবে শব্দের কম্পাঙ্ক ও তীব্রতা নির্ধারণ করে। এরপর ধীরে ধীরে কার্চফ, গ্রাহাম বেল ও সামার টেইন্টারের (বেল ও টেন্টার দেখান আলো কিভাবে তাপ এবং তার থেকে শব্দ সৃষ্টি করে) হাত ধরে থার্মোএ্যাকাউস্টিক্সের নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানো [১]। যা বলতে চাইছি তা আরেকটু ভাল করে বুঝতে হলে এই ছবিটা খেয়াল কর ভাল করে। তারপর থার্মোএ্যাকাউস্টিক এঞ্জিনের এই ভিডিওটা দ্যাখ। (দরকার পড়তে পারে ভেবে ফোনটা নিয়েই এসেছিলাম)।
ঋভুঃ সবই তো বুঝলাম। কিন্তু এর ব্যবহার কোথায়?
আমিঃ এইযে বললাম, বেরিয়ে যে গাদা গুচ্ছের আইস্ক্রীম খাবি বলে ঠিক করেছিস, তোর আইস্ক্রীম থার্মএ্যাকাউস্টিকস দিয়েও ঠান্ডা করা যায়। আসলে সণ্ডহাস এক্সপেরিমেন্টের অপর দিকটা যদি ভাবিস, শব্দ চলাচলের জন্য তৈরি হওয়া -তার কম্পাংক ভীত্তিক- সংকোচন ও প্রসারণ তাপ বাড়াতে বা কমাতে পারে।
ঋভুঃ ফ্যাসিনেটিং। ঠাণ্ডা মাথায় গোটা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বল তো দেখি।
আমিঃ আসলে যে পদ্ধতিতে এই ঠাণ্ডা করার কাজটা করা হয় তার নাম থার্মোএ্যাকাউস্টিক রেফ্রিজারেশান [১-২]। বেন এ্যাণ্ড জেরী আইস্ক্রীম কোম্পানির জন্য পেনসিল্ভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ম্যাট পোএজ, ডঃ স্টিভেন গারেট এবং বব স্মিথের আবিষ্কার।
ঋভুঃ দূর। সে আবার কি? এইরকম দূম করে এক একটা নাম বললে বোঝা যায়? শুরু থেকেই বরং শুরু কর। কি, কেন, কিভাবে, সবকিছু!
আমিঃ বেশ শোন তবে।
যে কোনো উন্নত অথবা উন্নয়নশীল দেশেই খাদ্যশিল্প একটা অতি প্রয়োজনীয় শিল্প। কাজেই, তৈরি খাবার অথবা খাবার তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী শীতল বা অতিশীতল আবহাওয়ায় সুস্থ উপায়ে লম্বা সময়ের জন্য জমিয়ে রাখার প্রয়োজনীতা ঘীরেও গড়ে উঠেছে আরেক ধরণের বিরাট শিল্প, যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি “ইণ্ডাস্ট্রিয়াল রেফ্রিজারেশান”। তুই যদি এই শিল্পের ইতিহাস নিয়ে খানিকটা ঘাটা ঘাটি করিস তাহলে দেখতে পাবি যে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল পর্যায়ে এই কাজের শুরু ১৯৩০ সালে “ভেপার কম্প্রেশান রেফ্রিজারেশান” অথবা বাংলায় বললে “সংকুচিত বাষ্পের দ্বারা হিমায়ন”এর হাত ধরে। এইবার তোকে আমি যেটুকু চিনি তাতে তোর মনে প্রশ্ন এসেছে যে সেটা কিভাবে হয়, তাই তো?
ঋভুঃ সে আর বলতে।
আমিঃ বেশ, এই ছবিটা দ্যাখ।
আসলে “ভেপার কম্প্রেশান রেফ্রিজারেটর” এমন এক যন্ত্র যেখানে একটি তরল পদার্থের সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট জায়গার তাপ শোষণ করে আরেকটা জায়গায় সেই তাপকে বের করা হয়ে থাকে। সেই তরলকে পদার্থবিজ্ঞানে “রেফ্রিজারেন্ট” বলা হয় অর্থাৎ কিনা যে পদার্থ হিমায়নের কাজটা করছে।
ঋভুঃ বাহ! এতো দারুণ কারসাজি!
আমিঃ তা তো বটেই। এত কারসাজি করতে হচ্ছে, তার কারণ রেফ্রিজারেন্ট-কে লাগাতার ঠান্ডা রাখতে হবে। না হলে আইসক্রীম ঠান্ডা থাকবে কী করে? তাই, রেফ্রিজারেন্টকে একটা চক্রের মধ্যে ঘোরানো হচ্ছে – আইসক্রীম ঠান্ডা করতে গিয়ে সে নিজে গরম হয়ে যাচ্ছে, আবার এই চক্রের অন্য একটা জায়গায় গিয়ে সেই তাপ ছেড়ে দিচ্ছে।
আরো খানিকটা বিস্তারিত ভাবে বুঝতে হলে ছবিটার ব্লকগুলোকে খেয়াল কর। এই ধরণের যন্ত্রে সাধারণত চারটি অংশ থাকে।
ওই যে তোকে বললাম রেফ্রিজারেন্ট তরলের কথা, সেই তরল পদার্থ আসলে এই চারটি খণ্ডের মধ্যেই চক্রাকারে আবর্তিত হয়, এবং এক একটি অংশের মধ্যে একবার বাষ্প এবং একবার তরলে রুপান্তরিত হয়।
ঋভুঃ বেশ। এরপর?
আমিঃ ধর প্রথমে বাষ্পীভূত তরলকে আমরা কম্প্রেসারে ঢোকালাম। বাষ্পের যে অবস্থায় এই কাজটা করা হয় তাকে আমরা বলি “স্যাচুরেটেড ভেপার”। স্যাচুরেটেড ভেপার হল বাষ্পের এমন অবস্থা যেখানে তার তাপ ধারণের ক্ষমতা অত্যন্ত অল্প, কিন্তু এতটাও কম নয় যে সে তরলে রুপান্তরিত হবে। কম্প্রেসারের মধ্যে সেই বাষ্পের সংকোচন হয় এবং তার সাথে সাথে তার তাপমাত্রার বৃদ্ধি হয়। এই অবস্থার বাষ্পের নাম সুপার-হিটেড বা অতি উত্তপ্ত বাষ্প। এই অবস্থার বাষ্পের চাপ এবং তাপমাত্রা এমনই থাকে যে, জল অথবা ঠাণ্ডা হাওয়ার সংস্পর্শে আসলেই সে তার তাপ সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করে এবং তরলে রুপান্তরিত হয়। এই কাজটাই করে “কনডেনসার” এবং যে তাপ বেরিয়ে এলো তা ওই ঠাণ্ডা জল বা হাওয়া (যা ঠান্ডা করছে) কণ্ডেনসারের বাইরে বয়ে নিয়ে যায়। এই যে তরলটি তৈরি হল এর নাম “স্যাচুরেটেড লিকুইড”।
ঋভুঃ বুঝেছি। অর্থাৎ ওই স্যাচুরেটেড ভেপারের ঠিক উল্টোটা, তাইতো? এমন অবস্থার তরল যার তাপ ধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি কিন্তু সে নিজে বাষ্পীভূত হচ্ছে না!
আমিঃ স্প্লেণ্ডিড মাই বয়!
ঋভুঃ (বেশ উত্তেজিত) তারপর বল বল!
আমিঃ আচ্ছা, এরপর এই তরলকে আমরা প্রসারণ ভালভের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাই এবং সেখানে তার চাপ এক ঝটকায় অনেকখানি কমিয়ে আনা হয়। এর ফলে অবশ্য খানিকটা তরল বাষ্পীভূত হয়। যেহেতু একটা নির্দিষ্ট চাপে এই বাষ্পীকরণের কাজটা হচ্ছে তাই সেই বাষ্প-তরল মিশ্রণের তাপমাত্রার বেশ খানিকটা কমে যায়। এই তাপমাত্রা সাধারণত যে চেম্বারে খাবার বা আইস্ক্রিম ঠাণ্ডা হবে তার থেকে অনেকটাই কম।
ঋভুঃ অবশ্যই! এতো বোঝাই যাচ্ছে। না হলে আর চেম্বার ঠণ্ডা হবে কিভাবে?
আমিঃ রাইট! এবার আমরা এই মিশ্রনকে নিয়ে গিয়ে ফেলি আমাদের সর্বশেষ কক্ষে যার নাম ইভাপোরেটার। একটি ইলেকট্রিক পাখা বা ফ্যানের সাহায্যে বাইরে থেকে এই কক্ষটিতে গরম হাওয়া প্রদান করা হয়। ফলে সে মিশ্রনে যে অতি-শীতল তরল রয়েছে তা তৎক্ষণাৎ অতি-ঠান্ডা বাষ্পে রূপান্তরিত হয়। সেই বাষ্পই আসলে খাবার ভরতি ঘরের নিজস্ব হাওয়া কে ঠাণ্ডা করে এবং তোর আইস্ক্রিমকেও ঠাণ্ডা রাখে।
ঋভুঃ ওহ দারুণ। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
আমিঃ বলে ফেল।
ঋভুঃ এই ঠাণ্ডা বাষ্পের তাহলে কি হবে? একেই কি আবার কম্প্রেসারে পাঠানো হবে?
আমিঃ হ্যাঁ একেবারেই তাই। এটাই সেই রেফ্রিজারেন্টের তাপ চক্র। আরেকটা মজার ব্যাপার, আজকাল দেখিস ফ্রিজে লেখা থাকে “অটো ডিফ্রস্ট”?
ঋভুঃ হ্যাঁ সে তো থাকেই। সেটা কি?
আমিঃ এই যে ইভাপোরেটারের সাথে চেম্বারের যোগ, তার যোগ তো আবার বাইরের স্বাভাবিক বাতাসের সাথে, যাকে আমরা বলি এ্যাম্বিয়েন্ট কণ্ডিশান বা চারিপার্শ্বিক অবস্থা। এই আবহাওয়ায় থাকা আর্দ্রতার কারণে বেশ কিছু সময় পর ইভাপোরেটারে জল অথবা বরফ জমে যেতে পারে। সেই বরফ বা ঠাণ্ডা জলকে পরিষ্কার করার পদ্ধতিই হল ডি-ফ্রস্টিং। পুরনো ধরণের ফ্রিজ বা সাধারণ ফ্রিজে সেই কাজ নিজে হাতে করতে হয়। আর হালফিলের এ্যাডভানসড ফ্রিজে সেই কাজটা ফ্রিজ নিজেই একটা পাম্পের সাহায্যে করে নেয়। সেই কাজটই হল অটো- ডিফ্রস্টিং!
ঋভুঃ বাহ! কিন্তু এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে যে এই পদ্ধতিতে কাজ হলে তোমার থার্মোএ্যাকাউস্টিক্সের দরকারটা পড়ছে কেন?
আমিঃ গুড কয়েশ্চেন!
দ্যাখ। ব্যাপারটা হল, ১৯৩০ সালের সময় থেকেই ঐতিহাসিকভাবে রেফ্রিজারেন্ট হিসাবে বিভিন্ন ধরণের রাসায়ণিক তরল ব্যবহৃত হয়ে আসছে [3,4]। এবার সমস্যা হল এই ধরণের কেমিকাল যেমন ক্লোরোফ্লুরো কার্বন (সি এফ সি) বা হাইড্রো ক্লোরো ফ্লুরো কার্বন (এইচ সি এফ সি)- ব্যবহার করল, বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে যে বিষাক্ত গ্যাসগুলির সৃষ্টি হয় তা যেমন আমাদের স্বাস্থের জন্য খারাপ তার সাথে সাথে ভয়ংকর পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। যেমন ধর সি এফ সি আমাদের বায়ুমণ্ডলের উর্ধতন ওজোন স্তরের দারুণ ক্ষতি করে।
এই ধরণের বেশ কিছু অসুবিধার হাত থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে বেন এ্যাণ্ড জেরী কোম্পানি তাদের তৈরি আইসক্রীম ঠান্ডা করার জন্য এক অন্য ধরণের রেফ্রিজারেটার আবিষ্কার করার দায়িত্ব দেন ম্যাট পোএজের গ্রুপকে। এই গবেষণারই ফল থার্মোএ্যাকাউস্টিক রেফ্রিজারেটার এবং আমাদের বায়ুমণ্ডল আর আবহাওয়ার কথা ভেবে আবিষ্কৃত বলে তার নাম দেওয়া হয় “গ্রীন ফ্রিজার”।
ঋভুঃ আচ্ছা। এইবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।
আমিঃ তবে আর কি? চল আপাতত তোর ফ্লুরিজে খানিক আইস্ক্রিম সাবড়ে আসি। সেখানে গিয়েই বাকিটা হোক নাকি?
ঋভুঃ মোটেই না! অন্তত বেন এ্যাণ্ড জেরী শেষ কর। তারপর যাবো। ওখানে গিয়ে বরং মেডিকাল এ্যাপ্লিকেশানের ব্যাপারটা হবে।
আমিঃ যো হুকুম জাহাঁপনা!
এই ছবিটা ভালো করে দেখলেই বুঝতে পারবি এই রেফ্রীজারেটর কীভাবে কাজ করছে। বাঁদিকে যেখানে Driver কথাটা লেখা আছে, সেটা হল একটা লাউডস্পিকার বা ট্রান্সডিউসার। এখান থেকে শব্দ তৈরি করা হচ্ছে। টিউবে রয়েছে অদাহ্য একটি গ্যাসের মিশ্রন (হিলিয়াম, আরগন, বায়ু ইত্যাদি)। লাউডস্পিকার থেকে তৈরি হওয়া শব্দ টিউবের মধ্যে ঢুকে গ্যাসটির সম্প্রসারণ ও প্রসারণের মাধ্যমে বা তার চাপ বাড়িয়ে-কমিয়ে বামদিক থেকে ডানদিকে ছুটে যাচ্ছে। তারপর সেই শব্দ টিউবের ডানদিকের দেওয়াল থেকে, যেখানে Reflecting surface লেখা আছে সেখান থেকে, প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসছে। এবার ভেবে দ্যাখ, টিউবের মধ্যে দুটো তরঙ্গ – মূল যেটা বামদিক থেকে ডানদিকে যাচ্ছিল, আর প্রতিফলিত তরঙ্গ যেটা ডানদিক থেকে বামদিকে ফিরে আসছে – একে অপরের উপর পড়ছে অথবা তাদের ইন্টারফিয়ারেন্স হচ্ছে, ঠিক তো? এর ফলে যেটা তৈরি হয় তার নাম হল স্থির তরঙ্গ বা স্ট্যাণ্ডিং ওয়েভ, অর্থাৎ খুব সহজ ভাষায় বললে টিউবের মধ্যে বেশী চাপ(প্রসারণ) ও কম চাপের(সংকোচন) একটা স্থির বিন্যাস। এই অবধি পরিষ্কার?
ঋভুঃ হ্যাঁ, ব্যাপারটা খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি। এই সংকোচন ও প্রসারণই তো তাপমাত্রা বাড়া অথবা কমার জন্য দায়ী তাই না? একটু আগেই তো বললে।
আমিঃ ঠিক ধরেছিস। মানে, এই ফ্রীজে শব্দই compression আর expansion-এর কাজটা করে দিচ্ছে। তবে কি জানিস, গ্যাসের তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা খুব বেশী নয়। তাই, এই শব্দের মাধ্যমে তৈরি ঠান্ডা জায়গাটা আইসক্রীম পর্যন্ত নিয়ে যেতে আর দুটো জিনিস ব্যবহার করা হয়। একটাকে বলে স্ট্যাক, যা আসলে একটা কঠিন পদার্থ, যে এই গ্যাসের থেকে তাপ শুষে নেয়। আর, একটা এক্সচেঞ্জার, যা এই স্ট্যাককে আইসক্রীম যেখানে রাখা থাকে তার সাথে যোগ করে।
ঋভুঃ আরেকটু খোলসা করে বলবে?
আমিঃ আসলে একটা গ্যাসের থেকে একটি কঠিন পদার্থের তাপ ধারণের ক্ষমতা বেশি। একে বলা হয় হিট ক্যাপাসিটি। একটি কম্পমান গ্যাস কে একটি কঠিন পদার্থের সান্নিধ্যে আনা হলে, গ্যাসের সঙ্কোচন বা প্রসারণের উপর ভিত্তি করে সেই নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় থাকা কঠিন পদার্থ হয় গ্যাস থেকে বাড়তি তাপ শুষে নেয় অথবা নিজের তাপ গ্যাসটিকে প্রদান করে। ফলে হয় তার তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে কিম্বা সে নিজে আরো ঠাণ্ডা হয়।
এই পোরাস স্ট্যাক এমনই একটা কঠিন পদার্থ।
ঋভুঃ কিন্তু সেটা পোরাস বা ছিদ্র যুক্ত কেন?
আমিঃ এর পিছনে দুটো কারণ আছে। প্রথমটা হল স্ট্যাকের তাপ পরিবহন শক্তি কমিয়ে আনা, এবং দ্বিতীয়ত এই স্ট্যাকের কঠিন পদার্থ ও টিউবের গ্যাসের মিথষ্ক্রিয়া (interaction) যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দেওয়া। বুঝতেই পারছিস মিথষ্ক্রিয়া (interaction) যতটা বাড়বে স্ট্যাক-গ্যাসের তাপ আদানপ্রদান ততটাই বাড়বে।
ঋভুঃ কিন্তু তাপ পরিবহণ কমানোর প্রয়োজনটা কি?
আমিঃ লস এ্যালামোস নাশানাল ল্যাবোরেটারির এই ভিডিওটাতেও তুই স্ট্যাকের ব্যাপারটা আরো ভাল করে বুঝতে পারবি।
ধর আমরা যদি “ক” ছবিটা দেখি, দেখা যাবে যে দুটো স্ট্যাক প্লেটের মাঝে একটি গ্যাস বাবল আকারে আড়াআড়ি বাড়ছে (লাল ইলিপ্স) অর্থাৎ সেখানে গ্যাসের প্রসারণ হচ্ছে। ফলত সেই বাবলটির তাপমাত্রা কমছে। আমরা জানি যে স্ট্যাক প্লেটটির নিজস্ব একটি স্থির তাপমাত্রা আছে। কাজেই তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করার উদ্দেশ্যে স্ট্যাক নিজের তাপ সেই গ্যাস বাবলকে দিয়ে নিজে শীতল হবে।
ঋভুঃ হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই তো। পাশের ছবিটায় একেবার তার উলটো ঘটনা ঘটছে তাইনা?
আমিঃ হ্যাঁ অবশ্যই। ওদিকে গ্যাসের সংকোচন ঘটেছে। কাজেই বাবলটি আকারে একটা নির্দিষ্ট দিকে (আড়াআড়ি) বেশ খানিকটা চ্যাপটা। তার তাপমাত্রাও বেশি। একইভাবে তাপমাত্রা ভারসাম্য রক্ষার তাগিদে স্ট্যাক সেই বাবলের তাপ শোষন করে নিজে গরম হয়ে উঠছে।
এইবার মজার ব্যাপার হল এই স্ট্যাক পদার্থের তাপ পরিবহন শক্তি খুব বেশি হলে সে তার নিজের শরীরের দুদিকের তাপমাত্রার মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে স্বক্রিয় হবে তাই না? সেক্ষেত্রে তুই আলাদা করে একটা ঠাণ্ডা দিক কি আর পাবি? আর তা না পেলে আইস্ক্রীম চেম্বার ঠাণ্ডা হবেই বা কি করে?
ঋভুঃ বুঝলাম।
আমিঃ হুম। আবার অন্য দিকে এই স্ট্যাকের দুটি প্লেটের মাঝে দুরত্ব যে অঙ্ক ঠিক করে দেয় তার নাম “থার্মাল পেনিট্রেশান ডেপথ (thermal penetration depth)”। অর্থাৎ সেই প্লেটের পৃষ্ঠ থেকে গ্যাসের মধ্যে কতদুর অবধি তাপের বিকিরণ হতে পারে তার একটা আনুমানিক মান। সেটা নির্ভর করছে গ্যাসের ঘনত্ব, তাপ প্রসারণ ক্ষমতা, তাপ ধারণ ক্ষমতা এবং অবশ্যই শব্দের কম্পাঙ্কের উপর। একটি নির্দষ্ট স্ট্যাক প্লেট ও গ্যাসের জন্য সেই দুরত্ব যদি “x” হয় তবে দুটি পাতের মধ্যে দুরত্ব কমপক্ষ্যে “2x” থেকে “4x” এর মধ্যে হতেই হবে। কাজেই বুঝতে পারছিস যে দুটো স্ট্যাক প্লেটের মধ্যে কতটা দুরত্ব থাকবে এবং স্ট্যাক কি দিয়ে তৈরি হবে তা নির্ভর করছে এই গোটা অঙ্কটার উপর। মাইলার এমন একটা পদার্থ । এবং এই মাইলার পাত দিয়ে তৈরি একটি পোরাস স্ট্যাকের আকার খানিকটা এই নীচের (ছবি ৫) ছবিটার মত। এছাড়াও আরো নানান আকারের স্ট্যাক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই ছবিটার ক্ষেত্রে, দুটো প্লেটের মধ্যে দুরত্ব বজায় রাখার জন্য ব্যবহার করা হয় মাছ ধরার ছিপের অংশ। তাছাড়া স্ট্যাক পদার্থের তাপ ধারণ ক্ষমতা (হিট ক্যাপাসিটি) গ্যাসের তাপ ধারণ ক্ষমতার থেকে বেশ খানিকটা বেশি হওয়া প্রয়োজন।
ঋভুঃ হ্যাঁ তা না হলে তাপ আদান প্রদান সম্ভবই না।
আমিঃ এগজ্যাক্টলি! এবার বুঝতে পারছিস নিশ্চই, কি কারণে শুধু মাত্র গ্যাস থাকলেই রেফ্রিজারেশান সম্ভব নয়? স্ট্যাক থাকাটা খুব জরুরী?
ঋভুঃ হ্যাঁ বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু এবার আইস্ক্রীমটা কোথায় রাখা হচ্ছে? সেট তো বুঝলাম না?
আমিঃ হ্যাঁ সে কথাতেই আসছি। এখানে প্রয়োজন পরে একটা গরম ও একটা ঠাণ্ডা “হিট এক্সচেঞ্জার”এর।
ঋভুঃ সেটা কি?
আমিঃ হিট এক্সচেঞ্জার হল ধাতুর তৈরি টিউব বা শেল, যার সাহায্যে এক জায়গার তাপ অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এছাড়াও আরো নানা ধরণের পোরাস হিট এক্সচেঞ্জার পাওয়া যায় [4]। প্রথমে স্ট্যাকের গরম দিকটায় একটা এক্সচেঞ্জার ব্যবহার করে অতিরিক্ত তাপ বের করে বাতাসের সাহায্যে সেই তাপ আবহাওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে স্ট্যাকের ঠাণ্ডা দিকের তাপমাত্রা আরো হ্রাস পায়। পরবর্তী পর্যায়ে একটি ঠাণ্ডা এক্সচেঞ্জারের সাহায্যে আইস্ক্রীম রাখার চেম্বারের আবহাওয়াকে স্ট্যাকের ঠাণ্ডা দিকের নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নামিয়ে আনা হয়। এভাবেই কোন রকম পারিপার্শ্বিক ক্ষতি সাধন ছাড়াই বেন এ্যান্ড জেরী তাদের আইস ক্রীম ঠাণ্ডা করে থাকেন। হালে অবশ্য হাইড্রো কার্বোনের সাহায্যে হিমায়নের পদ্ধতি ওনারা আবিষ্কার করেছেন যা এই থার্মোএ্যাকাউস্টি রেফ্রিজারেশানেই মতই সবুজ।
ঋভুঃ হ্যাঁ তা না হলে তাপ আদান প্রদান সম্ভবই না।
আমিঃ এগজ্যাক্টলি! এবার বুঝতে পারছিস নিশ্চই, কি কারণে শুধু মাত্র গ্যাস থাকলেই রেফ্রিজারেশান সম্ভব নয়? স্ট্যাক থাকাটা খুব জরুরী?
ঋভুঃ হ্যাঁ বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু এবার আইস্ক্রীমটা কোথায় রাখা হচ্ছে? সেট তো বুঝলাম না?
আমিঃ হ্যাঁ সে কথাতেই আসছি। এখানে প্রয়োজন পরে একটা গরম ও একটা ঠাণ্ডা “হিট এক্সচেঞ্জার”এর।
ঋভুঃ সেটা কি?
আমিঃ হিট এক্সচেঞ্জার হল ধাতুর তৈরি টিউব বা শেল, যার সাহায্যে এক জায়গার তাপ অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এছাড়াও আরো নানা ধরণের পোরাস হিট এক্সচেঞ্জার পাওয়া যায় [4]। প্রথমে স্ট্যাকের গরম দিকটায় একটা এক্সচেঞ্জার ব্যবহার করে অতিরিক্ত তাপ বের করে বাতাসের সাহায্যে সেই তাপ আবহাওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে স্ট্যাকের ঠাণ্ডা দিকের তাপমাত্রা আরো হ্রাস পায়। পরবর্তী পর্যায়ে একটি ঠাণ্ডা এক্সচেঞ্জারের সাহায্যে আইস্ক্রীম রাখার চেম্বারের আবহাওয়াকে স্ট্যাকের ঠাণ্ডা দিকের নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নামিয়ে আনা হয়। এভাবেই কোন রকম পারিপার্শ্বিক ক্ষতি সাধন ছাড়াই বেন এ্যান্ড জেরী তাদের আইস ক্রীম ঠাণ্ডা করে থাকেন। হালে অবশ্য হাইড্রো কার্বোনের সাহায্যে হিমায়নের পদ্ধতি ওনারা আবিষ্কার করেছেন যা এই থার্মোএ্যাকাউস্টি রেফ্রিজারেশানেই মতই সবুজ।
মাথায় ঢুকলো পুরোটা?
ঋভুঃ একদম পরিষ্কার। তবে এবার মেডিকাল এ্যাপ্লিকেশান টা হোক?
আমিঃ ফ্লুরিজে পৌছানোর আগে যদি আর একটা প্রশ্ন করেছিস তো আমি এ যাত্রায় তোকে আর একটা গল্পও বলবো না। এখুনি বেরোবি চল।
ঋভুঃ (হাসতে হাসতে) আচ্ছা যাচ্ছি যাচ্ছি। অত চটে যাচ্ছো কেন?
আমরা বেড়িয়ে পড়লাম।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/thermoacoustics-part-1-green-refrigerator-ben-jerry