10-05-2025 18:24:00 pm

print

 
বিজ্ঞান - Bigyan-logo

বিজ্ঞান - Bigyan

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম
An online Bengali Popular Science magazine

https://bigyan.org.in

 

সুপারনোভা: তারাদের শেষজীবনের কাহিনী


%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a6%a8-%e0%a6%9a%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a7%80
সায়ন চক্রবর্তী

(Harvard University)

 
10 May 2015
 

Link: https://bigyan.org.in/supernova

%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%ad%e0%a6%be-%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b6%e0%a7%87%e0%a6%b7%e0%a6%9c%e0%a7%80

তারারা জ্বলে কেন? কি ঘটে তাদের মধ্যে? আর সেই ঘটনা কি অনন্তকাল ধরে চলতে পারে? না হলে, কোথায় গিয়ে শেষ হয়? সেই সব গল্প আমরা শুনবো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়ন চক্রবর্তীর মুখে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র ফেলো সায়ন চক্রবর্তীর গবেষণার বিষয় অ্যাস্ট্রোফিসিক্স। টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ থেকে Ph.D.। নিজের গবেষণার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে খুবই উৎসাহী। আমি (অনির্বাণ) আর রাজীবুল এই উৎসাহের সুযোগ নিয়ে সায়নের সাথে এক বিকেলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ক্লাসরুমে বসে তার গবেষণার খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করলাম। নিমেষের মধ্যে ক্লাসরুমের মধ্যে থেকে আমরা চলে গেলাম পৃথিবীর বাইরে, তারাদের দেশে। সেই ক্লাসে আমরা যা শিখলাম আপনাদের সামনে সেটা তুলে ধরছি। আজকে প্রথম ভাগ।

অনির্বাণ / রাজীবুল: তুমি তোমার কাজ সম্বন্ধে যদি একটু বলো।

সায়ন: আমার গবেষণার বিষয় অ্যাস্ট্রোফিসিক্স। বিশেষ করে সুপারনোভা নিয়ে আমার কাজ।

সুপারনোভা?

কিছু তারা, সূর্যের চেয়ে অনেক বড়, এরা একসময় মারা যায়। মারা যাওয়ার সময় একটা বিস্ফোরণ ঘটে, সেটাই সুপারনোভা। এই সুপারনোভার ফলে তারার ভিতরের জিনিস চতুর্দিকে ছিটকে যায় বিশাল গতিতে। এত গতিতে যে এক একটা কণা এক সেকন্ডে পৃথিবীর এপার থেকে ওপার ছুটে যেতে পারে যেতে পারে।

আচ্ছা, তারা মরে যাওয়া মানে কি?

ভালো প্রশ্ন। তার আগে বুঝতে হবে, তারা বেঁচে থাকা মানে কি? তারারা বেঁচে থাকে নিউক্লিয়ার ফিউসনের ফলে। তারার যে আলো দেখি, তার শক্তির উৎস বেশির ভাগ সময় হচ্ছে নিউক্লিয়ার ফিউসন।

নিউক্লিয়ার ফিউসন টা কি, সেটা কি ছোট্ট করে বলা যায়?

হ্যাঁ, নিশ্চয়। এই মহাবিশ্ব বেশিরভাগটাই হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরী। তারারাও তাই। হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস তারাদের মধ্যে এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায় আর মাঝে মাঝে একে অপরের সাথে ধাক্কা খায়। খুব তীব্র বেগে ধাক্কা খেলে এরা একে অপরের সাথে জুড়ে যেতে পারে। সংক্ষেপে, এটাই নিউক্লিয়ার ফিউসন।

এই নিউক্লিয়ার ফিউসন কি তারাদের মধ্যেই হতে হয়? ধরো, আমাদের বায়ুমন্ডলের মধ্যেও কি হতে পারে না এটা?

না। এর জন্য তাপমাত্রা আর নিউক্লিয়াসের ঘনত্ব অনেক অনেক বেশি হতে হবে। এই যে আমি এই চেয়ারটা  ছুঁয়ে দেখছি, এই চেয়ারটা যে পরমাণু দিয়ে তৈরী, তার নিউক্লিয়াসগুলোকে কিন্তু আমি ছুঁই না। নিউক্লিয়াসের চারিদিকে যে ইলেক্ট্রনগুলো আছে, সেগুলো আমার হাতের ইলেক্ট্রনগুলোকে দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। সেই বলটাই আমি অনুভব করছি ছুঁয়ে দেখার সময়। নিউক্লিয়াসগুলো বড়ই ছোট, আর এই ইলেক্ট্রনের ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু একটা তারার মধ্যে এত তাপমাত্রা যে ইলেক্ট্রনগুলো নিউক্লিয়াস থেকে ছিঁড়ে যায়। এবং নিউক্লিয়াসরা একা একা ঘুড়ে বেড়ায়। এবং শুধু তাই নয়, তাপমাত্রা এত বেশি যে নিউক্লিয়াসরা একে অপরের সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে জুড়ে যেতে পারে। তারার মধ্যেই তাই নিউক্লিয়ার ফিউসন সম্ভব।

মানুষও এই প্রক্রিয়া পৃথিবীতে নকল করতে পেরেছে। হাইড্রোজেন বোমায়। তবে নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার ফিউসন মানুষ করতে পারেনি। নিয়ন্ত্রিত ফিউসনে যতটা শক্তি পাওয়া যায়, ততটা ঢালতে হয় না। অতএব নিট ফল হলো, শক্তি লাভ হচ্ছে। কিন্তু এখনো অব্দি শুধু শক্তি খরচা করে নিউক্লিয়ার ফিউসন করা গেছে।

তারাদের বেঁচে থাকা তার মানে …

তারাদের বেঁচে থাকা এই নিউক্লিয়ার ফিউসনের ফলেই। তারাদের কোর বা কেন্দ্রস্থল যেখানে, সেখানে এত বেশি তাপমাত্রা আর নিউক্লিয়াসের ঘনত্ব যে এই নিউক্লিয়ার ফিউসন এখানে সফলভাবে হয়। এবং এই নিউক্লিয়ার ফিউসনের ফলে যে শক্তি বের হয়, সেই শক্তিই তারাটাকে জিইয়ে রাখে।

সূর্যের ভিতরের তাপমাত্রা কয়েক কোটি কেলভিন অব্দি পৌঁছে যেতে পারে।  নিউক্লিয়ার ফিউসন সেখানেই হয়।

তাপমাত্রা ঠিক কত বেশি, সেটার একটা আইডিয়া পাওয়া যায় কি? এই ধরো, আমাদের চুল্লিগুলোর মধ্যে তাপমাত্রা কয়েক হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস। সেই তুলনায় কত?

সবচেয়ে কাছের তারা যেটা, সেটা হলো সূর্য। সূর্যের বাইরের দিকে যে তাপমাত্রা সেটা আমরা আন্দাজ করতে পারি সহজেই, সূর্যের রং দেখে। কোন জিনিসকে গরম করতে থাকলে প্রথমে সে লাল হয়ে ওঠে, তারপর ধীরে ধীরে হলুদ, এবং আরও শক্তি বাড়তে থাকলে নীলের দিকে যেতে থাকে। তো সূর্যের রং হলুদ। আবার টাংস্টেন বাল্বের থেকে যে আলো বেরোয়, তার রং-ও হলুদ। তাহলে সূর্যের বাইরের দিকের তাপমাত্রা একটা টাংস্টেন বাল্বের থেকে বিশেষ আলাদা নয়। সেই থেকে সূর্যের উপরতলার তাপমাত্রা ৫-৬ হাজার কেলভিনের কাছাকাছি বলে আমরা অনুমান করতে পারি। কিন্তু ৫-৬ হাজার কেলভিনে নিউক্লিয়ার ফিউসন হয় না। তার জন্য আরও হাজার গুন বেশি তাপমাত্রার দরকার। সূর্যের ভিতরের তাপমাত্রা কয়েক কোটি কেলভিন অব্দি পৌঁছে যেতে পারে। এই নিউক্লিয়ার ফিউসন সেখানেই হয়।

সূর্যের বাইরের সাথে ভিতরের এই তফাত কেন?

এই নিউক্লিয়ার ফিউসনের ফলে যে শক্তি বেরোয়, সেটা প্রথমে গামা রশ্মি হিসেবে বেরোয়। কিন্ত সূর্যের বিশাল ঘনত্বের ফলে এইসব গামা রশ্মি আটকা পড়ে যায়। কম্পটন বিক্ষেপণের দ্বারা।

কম্পটন বিক্ষেপণটা কি?

খুব বেশি শক্তির একটা আলোককণা একটা ইলেক্ট্রনের সাথে ধাক্কা খেলে, মাঝেমাঝে তার শক্তিটা ইলেক্ট্রনকে দিয়ে দেয় আর নিজে অল্প শক্তির আলোককণা হয়ে বেরিয়ে যায়। এই অল্প শক্তির আলোক কণাটি কিন্তু মূল উচ্চশক্তির কণাটি যেদিকে ছুটছিল, তার বদলে অন্য কোন দিকেও বেরোতে পারে। এই যে সূর্যের ভিতরে নিউক্লিয়ার ফিউসনের ফলে গামা রশ্মির আলোককণাগুলো তৈরী হলো, তারা সেই শক্তি নিয়ে সূর্য থেকে বেরোতে পারে না। সূর্যের ভিতরে থাকা ইলেক্ট্রনরা, যারা কিনা পরমাণুর ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে, তারা এই আলোককণাগুলোকে ধরে ফেলে। এই আলোককণাগুলো নিজেদের শক্তি আস্তে আস্তে এই ইলেক্ট্রনদের চালান করতে থাকে আর নিজেরা আঁকাবাঁকা পথে বেরোতে থাকে। একটা আলোককণার এইভাবে এঁকেবেঁকে সূর্যের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে প্রায় দশ হাজার বছর লেগে যেতে পারে।

আর ইলেক্ট্রনগুলোও এই আলোক কণাদের গুঁতো খেতে খেতে গরম হয়ে যায়। আর এই গুঁতোগুঁতির ফলে সূর্যের ভিতরে একটা চাপ সৃষ্টি হয়। যেটা তারাদের দাঁড় করিয়ে রাখে তাদের মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে। এই চাপটা না থাকলে তারারা চুপসে যেত।

এই করে তারারা নাহয় বেঁচে থাকলো। এটা আজীবন কাল ধরে হয়না কেন?

হ্যাঁ, তাহলে বোঝা গেল যে সবকিছুর মূলে ওই নিউক্লিয়ার ফিউসন। ফিউসন অনন্ত কাল ধরে হতে পারে না। হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস জুড়ে জুড়ে তৈরী হয় হিলিয়াম। এবং একসময় এই হিলিয়ামের সাথে আরও কিছু জুড়ে কার্বন, অক্সিজেন ইত্যাদি তৈরী হয়। যত ফিউসন হয়, আরেকটু ভারী কোনো মৌল তৈরী হয় আর আরেকটু শক্তি নিংড়ে নেওয়া যায়। এই ফিউসন চলতে চলতে একসময় আয়রন (লোহা) তৈরী হয়। একবার আয়রন বানিয়ে ফেললে এই প্রক্রিয়াকে আর বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না।

আরো ভারী মৌল তৈরী করা যায় না কেন ?

কারণ, আয়রনের নিউক্লিয়াস সবচেয়ে স্থায়ী নিউক্লিয়াস। তার থেকে ভারী নিউক্লিয়াস বানাতে গেলে, তাকে শক্তি দিতে হয়। শক্তি বের করা যায় না।

আর যে সে তারা আয়রন বানাতে পারে না। তাকে সূর্যের চেয়ে অন্তত আট দশ গুণ বড় হতে হয়। সেইরকম তারার মধ্যে  তাপমাত্রা আর নিউক্লিয়াসের ঘনত্ব এত বেশি হয় যে সে আয়রন নিউক্লিয়াস অব্দি বানাতে পারে। আর এইভাবে তারার ভিতরে আয়রন নিউক্লিয়াসের একটা দলা তৈরী হয়।

ফিউসন চলতে চলতে একসময় আয়রন (লোহা) তৈরী হয়। আয়রনের নিউক্লিয়াস সবচেয়ে স্থায়ী নিউক্লিয়াস। যে সে তারা আয়রন বানাতে পারে না। তাকে সূর্যের চেয়ে অন্তত আট দশ গুণ বড় হতে হয়।

আচ্ছা, দাঁড়াও একটু। এই হাইড্রোজেন থেকে আয়রন অব্দি যেতে যদি খালি শক্তি পাওয়াই যায়, দিতে হয়না, তাহলে তো এটা এমনি এমনি হওয়ার কথা। তাহলে বেশি তাপমাত্রা বা সাইজের প্রয়োজন কেন?

ব্যাপারটা এইভাবে ভাবো। হাইড্রোজেন একটা উঁচু জায়গায়। তার পর হিলিয়াম আরেকটু নিচু উপত্যকায়, তাই আরো স্থায়ী। সবশেষে আয়রন সবচেয়ে নিচু উপত্যকায়। কিন্তু একটা উপত্যকা থেকে আরেকটায় পড়তে হলে একটা  পাহাড় টপকে তবে পড়তে হবে। এবার খুব বেশি জোরে এসে তবেই ওই  পাহাড় টপকানো যায়। এমনিতে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ার  সুযোগ নেই। আর অত জোরে এসে  পাহাড় টপকানোর চেষ্টা একমাত্র খুব বেশি তাপমাত্রা আর নিউক্লিয়ার ঘনত্ব থাকলেই সম্ভব। কিন্তু আয়রনের পরে উপত্যকাগুলো আবার উঁচুর দিকে যেতে থাকে। তাই এরপর লম্ফঝম্প করেও শক্তি বার করার উপায় নেই। এই যে পাহাড় আর উপত্যকার উপমা দিলাম, এটাকে স্থিতি শক্তির ভূচিত্র (Potential energy landscape) বলতে পারি, যেখানে পাহাড়ের উচ্চতা বা উপত্যকার গভীরতা বিভিন্ন নিউক্লিয়াসের (ভূচিত্রে বিভিন্ন জায়গা) স্থিতি শক্তি নির্দেশ করে।

তো, আয়রনের একটা বল তৈরী হতে থাকে। আর সেই আয়রনের বলের টিকে থাকার উপায় সাধারণ তারার টিকে থাকার উপায়ের থেকে আলাদা। একটা সাধারণ তারা গ্যাসীয় অবস্থায় আছে। তাপমাত্রার ফলে তার ভিতর যে  গুঁতোগুঁতি হতে থাকে, সেই চাপটাই তারাটাকে দাঁড় করিয়ে রাখে। কিন্তু এই আয়রনের বলটা আর শক্তি তৈরী করছে না। এ মাধ্যাকর্ষণের ফলে সঙ্কুচিত হতে শুরু করে। আর একে দাঁড় করিয়ে রাখে একটা আশ্চর্য রকমের চাপ, যাকে আমরা ফার্মি প্রেসার বলি।

ফার্মি প্রেসার কি?

এই আয়রনের বল দিয়েই বোঝাই।  প্রত্যেকটা আয়রন নিউক্লিয়াসের সাথে কিছু ইলেক্ট্রন যুক্ত আছে। এই ইলেক্ট্রনরা ফার্মিয়ন। ফার্মিয়নদের বিশেষত্ব হলো, তারা এক স্টেট বা অবস্থায় থাকতে পছন্দ করে না। যেহেতু এক অবস্থায় থাকতে পছন্দ করে না, খুব বেশি কাছাকাছি চলে এলে এদের মধ্যে একটা চাপ সৃষ্টি হয়। এই চাপটাকেই বলে ফার্মি প্রেসার। এই চাপই তারার ভিতর ওই আয়রনের বলটাকে টিকিয়ে রাখে।

কিন্তু চিরকাল টিকিয়ে রাখতে পারে না। আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে, সুব্রহ্মণীয়ম চন্দ্রশেখর আবিষ্কার করেছিলেন যে এই ফার্মি প্রেসারের পক্ষে মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে আয়রনের বলটাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব, কিন্তু একটা  ভর (mass) অব্দি।

এটাই কি চন্দ্রশেখর লিমিট?

সেই ওজনটারই নাম চন্দ্রশেখর লিমিট। তারার ভিতরের আয়রনের দলা যখন বাড়তে বাড়তে ওই চন্দ্রশেখর লিমিটের কাছে পৌঁছে যায়, তখন আর তারা টিকতে পারে না।

এই চন্দ্রশেখর লিমিটটা কত?

সূর্যের ভরের  দেড় গুন মত। সংখ্যাটা নির্ভর করে দলাটা আয়রনের না হিলিয়ামের, কিন্তু এই লিমিটের থেকে বেশি ওজন আর ফার্মি প্রেসার দিয়ে টিকিয়ে রাখা যায়না।

ওজন না ঘনত্ব?

না, ওজন। আসলে ঘনত্ব থেকেই এই লিমিটটা বার করা হয়। তবে চন্দ্রশেখর একটা সম্পর্ক বার করেছিলেন তারার মাঝখানের ঘনত্ব আর তারার ওজনের মধ্যে। এর ফলে একটা সুবিধে হলো। একটা তারার গোটা ওজনটা বার করা খুব সোজা। তারার আশেপাশের জিনিসের উপর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব থেকে ওজন মাপা যায় নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের সূত্র ব্যবহার করে। ভিতরের ঘনত্বটাকে সরাসরি তো মাপা যায় না, তাই তারার ওজন মেপে চন্দ্রশেখর লিমিটের সাথে তুলনা করা সোজা। তাই লিমিটটাও একটা ওজন।

চন্দ্রশেখর বুঝেছিলেন যে একটা লিমিটের পর মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে আর এই আয়রনের বলটাকে ধরে রাখা যায় না।

চন্দ্রশেখর লিমিটটা কি করে বার করে একটু ছোট্ট করে বলবে?

হ্যাঁ। যেটা বললাম, ইলেক্ট্রনরা ফার্মিয়ন। ওই আয়রনের দলার মধ্যে সব ইলেক্ট্রনগুলো এক শক্তিতে থাকতে পারেনা। ইলেকট্রনগুলোর সবচেয়ে বেশী যে শক্তি হয়, সেই শক্তিটাকে ফার্মি লেভেল বলে। এই ফার্মি লেভেলের মান যদি স্থিত অবস্থায় ইলেক্ট্রনের ভরের থেকে বেশি হয়, তখন আইনস্টাইনের E=mc2 অনুযায়ী শক্তি আর ভরের মধ্যে রূপান্তর হতে পারে, ইলেক্ট্রনগুলো রিলেটিভিস্টিক ইলেক্ট্রন হয়ে যায়। তখন আপেক্ষিকতাবাদ বা রিলেটিভিটিকে সম্পূর্ণ ব্যবহার করে তাদের অবস্থাকে  বুঝতে হয়। এই রিলেটিভিস্টিক ইলেক্ট্রনগুলোকে সহজে সংকোচন করা যায় আর এখান থেকেই মোটামুটি মাধ্যাকর্ষণ ফার্মি প্রেসারকে ছাপিয়ে যায়। অতএব, মোদ্দা কথা, ওই লিমিটটা পেতে আয়রনের দলার মধ্যে ফার্মি লেভেলকে ইলেক্ট্রনের ভরের সমান করতে হয়। এই অঙ্কটাই চন্দ্রশেখর কষেছিলেন।

তো, চন্দ্রশেখর বুঝেছিলেন যে একটা লিমিটের পর মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে আর এই আয়রনের বলটাকে ধরে রাখা যায় না। এর সংকোচন শুরু হয়। কিন্তু সংকুচিত হতে হতে এই বলটার যে কি গতি হবে, সেটা চন্দ্রশেখর জানতেন না। সংকোচন হবে, ওই অব্দি তিনি বলেছিলেন।

১৯৩১-এ চন্দ্রশেখর এই অঙ্কটা কষলেন। ৩২-তে নিউট্রন আবিষ্কার হলো। ৩৪-এ ওয়াল্টার বাদে আর ফ্রিত্জ জুইকি বার করলেন যে এই বলটা সংকুচিত হতে হতে একটা নিউট্রনের বলে পরিণত হবে।

পরমাণুর বাকিরা গেল কোথায়? প্রোটন, ইলেক্ট্রন?

খুব বেশি ঘনত্বের ফলে আয়রন নিউক্লিয়াসগুলো ইলেক্ট্রনদের খুব কাছে পেয়ে যাবে। আর তাদের খেয়ে নিতে শুরু করবে। এই খেয়ে নেওয়া ল্যাবেও দেখা যায়, যাকে বলে K-ক্যাপচার প্রসেস। পরমাণুর মধ্যে ইলেক্ট্রনগুলো তো K, L, M  এইসব কক্ষে নিউক্লিয়াসের চারিদিকে ঘুরছে, K-টা সবচেয়ে কাছে। K-ক্যাপচার প্রসেসে, নিউক্লিয়াস K কক্ষের ইলেক্ট্রনগুলোকে খেয়ে নেয়। তো সেই K-ক্যাপচারের মতোই একটা প্রসেসে আয়রন নিউক্লিয়াসগুলো ইলেক্ট্রনগুলোকে খেতে শুরু করে। নিউক্লিয়াসের ভিতরে যে প্রোটনরা আছে, তারা ইলেক্ট্রনের সাথে মিলে নিউট্রনে পরিণত হয়।

এই পরিবর্তনটা ইলেকট্রো-উইক বলের মাধ্যমে হয়। এর জন্য একটা দাম দিতে হয়। সেটা হলো একটা নিউট্রিনো। এই নিউক্লিয়াসগুলো থেকে সেই নিউট্রিনোগুলো বেরোতে থাকে। তো, এইভাবে একটা নিউট্রনের গোলক তৈরী হলো। তারার কেন্দ্রস্থলটা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে যাকে বলে নিউট্রন স্টার ।

সাইজগুলো একটু দেখা যাক। চন্দ্রশেখর লিমিটে তারার মাঝখানের ওই আয়রনের গোলকের টিপিকাল সাইজ দশ হাজার কিলোমিটার। মানে পৃথিবীর সাইজের কাছাকাছি। এদিকে  চুপসে যেতে যেতে একটা নিউট্রন স্টারের ঘনত্ব এত বেশি যে ওটা এখন দশ হাজার থেকে দশ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। পৃথিবীর সাইজের একটা বল হঠাৎ কলকাতার সাইজে এসে গেল। যেহেতু আরো আটোসাঁটোভাবে বাঁধা, তাই হঠাৎ করে প্রচুর মাধ্যাকর্ষণজাত বন্ধনশক্তি বা gravitational  binding energy ছাড়া পেয়ে গেল। আর সেই শক্তি যাবে কোথায়? জিনিসপত্র গরম করতে যেতে পারে। তো, এই  নিউট্রন স্টারটা খুব গরম হয়ে যায়।

আলো হিসেবে শক্তিটা বেরোতে পারবে না। কারণ সেই কম্পটন বিক্ষেপণ। নিউট্রন স্টারের চারিদিকে ইলেক্ট্রনের চাদর, আটকে দেয় আলোককণাকে।

এই মাধ্যাকর্ষণজাত বন্ধনশক্তি, এটা বেরোচ্ছে কিভাবে নিউট্রন  স্টার থেকে?

ওই যে বললাম নিউট্রিনো বেরোয়। তারই গতিশক্তির মধ্যে দিয়ে। ওই নিউট্রন স্টার  থেকে খালি নিউট্রিনোরাই বেরিয়ে আসতে পারে। নিউট্রিনোরা সচরাচর কারোর সাথে ধাক্কাধাক্কি করে না, সবকিছু ভেদ করে চুপিসারে চলে যায়। কিন্তু এই নিউট্রন স্টারের ঘনত্ব এত বেশি যে নিউট্রিনোগুলোরও ওই দশ কিলোমিটার পেরোতে এক থেকে দশ সেকেন্ড সময় লেগে যায়।  ধাক্কা খেতে খেতে বেরোয়। ঘনত্ব কত বেশি সেটা যদি বোঝাতে হয়, ভাবো সেটা একটা নিউক্লিয়াসের সমান। নিউট্রন স্টারটা একটা প্রকান্ড সাইজের নিউক্লিয়াস।

একদিকে নিউট্রিনোরা বেরিয়ে আসছে। আর অন্যদিকে তারার বাইরের স্তরগুলো যখন দেখে তারার কেন্দ্রস্থলটা চুপসে গেছে, তখন তারাও সেই ফাঁকা জায়গার দিকে ধেয়ে আসে। নিউট্রন স্টার তাতে ধাক্কা খায়। বাউন্স করে ছিটকে যায়। এই বাউন্স করার ফলে একটা শক বা অভিঘাত সৃষ্টি হয়। আর নিউট্রিনোদের সাহায্যে সেই শক পুরো তারা জুড়ে ছড়িয়ে পরে। তার ফলে কেন্দ্রস্থলের বাইরে যে স্তরগুলো ছিল, সেগুলো ছিটকে যায় একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে। এটাই সুপারনোভা।

নিউট্রিনোদের সাহায্যে সেই শক পুরো তারা জুড়ে ছড়িয়ে পরে। তার ফলে কেন্দ্রস্থলের বাইরে যে স্তরগুলো ছিল, সেগুলো ছিটকে যায় একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে। এটাই সুপারনোভা।

নিউট্রিনো শকটাকে ছড়াচ্ছে কিভাবে? তার মানে, ওই এক থেকে দশ সেকেন্ডের ধাক্কাধাক্কির মধ্যেই যেটুকু শক্তি হাতবদল করতে পারছে ?

হ্যাঁ, নিজেদের শক্তির ১% মত দেয় কেন্দ্রস্থলের বাইরের স্তরগুলোকে। তবে নিউট্রন স্টার  থেকে বেরোনোর সময় নিউট্রিনোর শক্তি ছিল ১০৫৩ আর্গ, অতএব তার  ১%-ও কম নয়। ১০৫১  আর্গ মত।

আবার বলছি, যেহেতু তারাটা এত ঘন, তাই এই ১% মত নিউট্রিনো আটকায়। একগুচ্ছ নিউট্রিনো আমাদের মধ্যে দিয়ে গেলে তার প্রায় কিছুই আটকায় না। নিউট্রিনোরা যাচ্ছেই আমাদের মধ্যে দিয়ে সারাক্ষণ। কেউই বিব্রত হয় না।

তো, সুপারনোভা বিস্ফোরণ বলতে এই ১%-কেই দেখতে পাচ্ছি?

হ্যাঁ। শুধু একটা কথা, এটা খালি গতিশক্তির কথা বলছি। তারার মালপত্র বিশাল গতিতে এদিক ওদিক ধেয়ে চলেছে। তা চলুক না, কিন্তু দূর থেকে তাদের দেখতে পাওয়া যাবে কেন? দেখতে পাওয়া যাবে, কারণ গরম হওয়ার ফলে এর থেকে আলো বেরোবে। তো, আলো বেরোলে তবেই সুপারনোভাদের দেখা যায়।

এবার মনে রাখতে হবে, এই বিস্ফোরণটা হয় মহাশূন্যে। তাই খুব তাড়াতাড়ি সবকিছু ছড়িয়ে পড়ে। ধরো, প্রথম দিন একটা সুপারনোভাকে অপটিক্যাল (দৃশ্যমান) আলোয় দেখতে পেলাম, অর্থাৎ যে আলোটা চোখে দেখা যায়। দশ দিনের মধ্যেই এই সুপারনোভা দশগুন সাইজে পৌঁছে গেল। এর ফলে, বহুগুণ ঠাণ্ডাও হয়ে যায়। তখন আর অপটিক্যাল আলো দেয় না। তখন ইনফ্রারেড আলো দেয়।

তাহলে, একটা সুপারনোভাকে আমাদের বেশিক্ষণ দেখতে পাওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমরা মাসের পর মাস একটা সুপারনোভাকে আকাশে উজ্জ্বল অবস্থায় দেখতে পাই।

মাসের পর মাস সুপারনোভা দেখা যায় কেন ?

এই যে প্রকাণ্ড বিস্ফোরণটা ঘটলো, এর মধ্যে আরো কিছু নিউক্লিয়াসের সৃষ্টি হয়। আমরা আগে বলেছিলাম নিউক্লিয়ার ফিউসনের কথা। বলেছিলাম, ফিউসনের দ্বারা আয়রন  অব্দি পৌঁছনো যায়, কারণ আয়রন  নিউক্লিয়াস সবচেয়ে স্থায়ী। সেইসব ফিউসনে খালি শক্তি পাওয়া যায়, দিতে হয় না। কিন্তু সেটা সুস্থিত অবস্থার কথা। বিস্ফোরণের সময় এমন বিক্রিয়াও হয় যারা শক্তি নিয়ে নেয়। তাই সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় আয়রনোত্তর মৌলগুলোও তৈরী হয়।

আয়রনের পরে, বিশেষ করে লেডেরও পরে যে মৌলগুলো আছে, তারা বেশিরভাগ-ই স্থায়ী নয়।

তেজস্ক্রিয়?

হ্যাঁ, তেজস্ক্রিয়। এবং সুপারনোভা ফাটার পর কয়েক মাস ধরে এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে যে গামা রশ্মি বেরোয়, সেই গামা রশ্মিগুলো সুপারনোভার উপাদানগুলোকে গরম করতে থাকে। আর গরম হয়ে যাওয়ার ফলে এরা এমন একটা তাপমাত্রায় থাকে, যাতে অপটিক্যাল রেঞ্জের মধ্যে আলো দিতে পারে।

সাথে সাথে কিন্তু ঠাণ্ডা হওয়ার প্রক্রিয়াগুলোও চলছে। ফাঁকা মহাশূন্যে সমতাপী বা অ্যাডায়াবেটিক ভাবে সুপারনোভার প্রসার হয়, তার ফলে ঠাণ্ডাও হয়। অনেক কম দ্রুতভাবে, কিন্তু আলো বেরোনোর ফলেও ঠাণ্ডা হতে থাকে।

এইসব গরম আর ঠান্ডা হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার চলে। সেই প্রতিযোগিতার ফলে যে তাপমাত্রা বজায় থাকে, তাতে অপটিক্যাল আলো বের হয় সুপারনোভা থেকে।

সুপারনোভা থেকে বেরোয় এবং চোখে দেখা যায়, এরকম আলোর শক্তি ১০৪৯ আর্গ  মত। সেটা তার মানে সুপারনোভার গতিশক্তির ১%। তার মানে নিউট্রিনোর শক্তির ১%-এর ১% আলোর রূপে বের হয়। তবে সেটাও এত আলো যে এই সময়টায় একটা গোটা ছায়াপথের আলোকে ছাপিয়ে যেতে পারে একটা সুপারনোভা। একটা ছায়াপথে লক্ষ কোটি তারা থাকে, তাদের সম্মিলিত আলোকে ছাপিয়ে যেতে পারে একটা সুপারনোভা।

সেই আলোটা নিয়েই তোমাদের কারবার ?

সেই আলোটাকেই সনাক্ত করে অপটিক্যাল জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।

এই আলোটা কতটা উজ্জ্বল?

কতটা আলো সেটা নির্ভর করে কতটা দূরত্ম, তার উপর। বেশিরভাগ যে সুপারনোভা আমরা দেখি, সেগুলো বেশ দূরে—

মোটামুটি কত দূর হবে?

আমি যেসব সুপারনোভাদের নিয়ে গবেষণা করি, সেগুলো কয়েক মেগাপারসেক দূরে। এক পারসেক হচ্ছে তিন আলোকবর্ষের থেকে একটু বেশি। তাহলে মেগাপারসেক মানে ৩০ লক্ষ আলোকবর্ষ মত। তার মানে বহু লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে আছে সুপারনোভারা।

আর তার আলো আমরা দেখছি দুরবীন দিয়ে। শেষ চোখে দেখা সুপারনোভা ঘটেছিল কেপলারের সময়। ১৬০৪ সালে কেপলার আমাদেরই ছায়াপথে হওয়া একটি সুপারনোভা নিজের চোখে দেখেন এবং লিখে যান।

আড্ডা জমে উঠেছিলো। এর পরের অংশে দেখবো, সুপারনোভা নিয়ে গবেষণার কিছু ইতিহাস আর বর্তমানে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, সেই সম্পর্কিত কিছু আলোচনা। বিশেষ করে, মহাকাশের হাজারটা ঘটনার মধ্যে একটা সুপারনোভাকে সনাক্ত করে কি করে, সেই নিয়ে সায়নকে জেরা করা হবে।

ছবি: Wikipedia (Courtesy NASA/JPL-Caltech)

লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।

Scan the above code to read the post online.

Link: https://bigyan.org.in/supernova

print

 

© and ® by বিজ্ঞান - Bigyan, 2013-25