06-11-2024 18:47:07 pm
Link: https://bigyan.org.in/superconductor-bcs-theory
আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছি সুপারকন্ডাক্টিভিটী আবিষ্কারের ইতিহাস নিয়ে। সেই সময়ে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেননি এর উৎসের কারণ। সুপারকন্ডাক্টিভিটী ব্যাখ্যা করার জন্য ইলেক্ট্রনের ধর্ম নিয়ে যে ধারণা থাকা প্রয়োজন, সেগুলো এসেছে পরের যুগে, কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার হওয়ার পরে। এসব নিয়েই আমাদের এ পর্বের আলোচনা।
সুপারকন্ডাক্টিভিটীকে সফলভাবে ব্যাখ্যা করেন তিনজন বিজ্ঞানী – জন বার্ডিন, লিওন কুপার ও জন রবার্ট শ্রীফার। তাঁদের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে এই বিখ্যাত তত্ত্বকে ডাকা হয় বি. সি. এস. তত্ত্ব নামে। তত্ত্বটি পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে। এর আগে অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মাথা ঘামিয়েছেন সুপারকন্ডাক্টিভিটীর জট ছাড়াতে। তাঁদের অবদানও এই আবিষ্কারের ইতিহাসে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমরা সেই বিস্তারিত ইতিহাসে ঢুকব না।
বি. সি. এস. তত্ত্ব অনুযায়ী সুপারকন্ডাক্টিভিটীর জন্ম হয় যখন ইলেক্ট্রনরা একে অপরকে আকর্ষণ করে। শুনে অনেকে হয়ত আশ্চর্য হচ্ছেন! আমরা চিরকাল জেনে এসেছি যে দুটো ইলেক্ট্রনের মধ্যে কুলম্বের সূত্র অনুযায়ী বিকর্ষণ বল কাজ করে। আকর্ষণ এলো কোথা থেকে? আসলে কঠিন পদার্থের ভেতর ইলেক্ট্রন ও আয়নের যোগাযোগের ফলে ইলেক্ট্রনদের মধ্যে আপাতভাবে এক আকর্ষণী বলের সৃষ্টি হয়। এই লেখায় আমরা সেই আকর্ষণের খুব সরলীকৃত একটা বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করব।
আয়নরা ইলেক্ট্রনদের তুলনায় বহুগুণ বেশি ভরশালী এবং ইলেক্ট্রনদের চেয়ে অনেক মন্থরগতিতে নড়াচড়া করে। একটা ইলেক্ট্রন যখন দ্রুতগতিতে আয়নের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়, তাদের বিপরীত আধান বা চার্জের দরুণ আয়ন ঝুঁকে পড়ে ইলেক্ট্রনের দিকে। এতে খানিক বিকৃতি সৃষ্টি হয় আয়নদের সারিতে, যার ফলে এক জায়গায় বেশিমাত্রায় ধনাত্মক আধান বা পজিটিভ চার্জের প্রভাব ঘটে। দ্বিতীয় আরেকখানা ইলেক্ট্রন, যে একই পথ দিয়ে আসছিল, সে আকৃষ্ট হয় ওই ধনাত্মক আধানের জমায়েত দেখে। তাহলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ালো যে, প্রথম ইলেক্ট্রন আকর্ষণ করল দ্বিতীয় ইলেক্ট্রনকে আয়নসারিতে বিকৃতি ঘটিয়ে। এ হেন আকর্ষণের মাধ্যমে দুটো ইলেক্ট্রন জুটি বাঁধে। এই জুটিদের ডাকা হয় কুপার জোড়া বলে।
আয়নদের মধ্যস্থতায় ইলেক্ট্রনদের ভেতর যে আকর্ষক বল তৈরি হতে পারে, এই ধারণা বি. সি. এস. তত্ত্ব আবিষ্কারের কিছু বছর আগে থেকেই পদার্থবিজ্ঞান জগতে আলোচিত হচ্ছিল। এই ধারণার জন্ম দেন হেরবার্ট ফ্র্যোলিখ। তারপর প্রশ্ন উঠেছিল – এই আকর্ষণ কি এতটাই জোরালো যে ইলেক্ট্রনদের স্বাভাবিক বিকর্ষণকে ছাপিয়ে উঠেও মোটের ওপর আকর্ষণ কার্যকরী হবে?
উত্তরটা জানা গিয়েছিল ডেভিড ব্যোম, ডেভিড পাইন্স ও জন বার্ডিনের পরবর্তী কাজ থেকে। একটি ইলেক্ট্রনের পার্শ্ববর্তী অন্যান্য ইলেক্ট্রনের সমূহ কীভাবে এই অবস্থাকে প্রভাবিত করবে, সেটা হিসেবের আওতায় এনে দেখা যায় যে ইলেক্ট্রনদের মধ্যে বিকর্ষণের প্রভাব এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা যায়। এরপর ১৯৫৬ সালে লিওন কুপার প্রমাণ করে দেখান যে ইলেক্ট্রনদের মাঝে যদি আকর্ষক বল কাজ করে, তা সে যত ছোটই হোক না কেন, পরমশূন্য তাপমাত্রায় ইলেক্ট্রনসমূহের স্বাভাবিক দশা হবে জোড়ায় বাঁধা ইলেক্ট্রনদের সমষ্টি।
লিওন কুপারের এই কাজ বি. সি. এস. তত্ত্ব আবিষ্কারের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তার আগে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে ইলেক্ট্রনদের মধ্যে আকর্ষণ কাজ করলে এক নতুন অবস্থা পাওয়া যেতে পারে যা সাধারণ ধাতুর অবস্থা থেকে একেবারেই আলাদা। কিন্তু এটা জানা ছিল না যে এই নতুন দশা পেতে গেলে আকর্ষণের ন্যূনতম মাত্রা কত হওয়া প্রয়োজন। কুপার দেখালেন যে তা অপরিমেয় রূপে ক্ষুদ্র হলেও চলবে। মোটের ওপর বল আকর্ষণীয় হলেই পরমশূন্য তাপমাত্রায় নতুন দশার দেখা মিলবে।
এর এক বছর পরে, ১৯৫৭ সালে, জন বার্ডিন, লিওন কুপার ও জন রবার্ট শ্রীফার প্রকাশিত করলেন বিখ্যাত বি. সি. এস. তত্ত্ব। সবিস্তারে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও পরিসংখ্যানগত পদার্থবিদ্যার জটিল অনেক হিসেব কষে তাঁরা প্রমাণ করলেন ধাতুর মুক্ত ইলেক্ট্রনরা নিজেদের মধ্যে দুজন-দুজন করে জুটি বাঁধলে কুপার জোড়াদের সমষ্টি নিয়ে স্বল্প তাপমাত্রায় তৈরি হয় সুপারকন্ডাক্টার দশা।
এই দশায় কুপার জোড়ারা ভীষণভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ। বিভিন্ন জোড়ারা চলে একে অপরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তত্ত্বে প্রমাণিত হল এই অবস্থায় প্রতিরোধক্ষমতা হবে একদম শূন্য। জানা গেল তাপমাত্রা বাড়লে কীভাবে কুপার জোড়া তৈরি হওয়ার নানান ধাপে ছন্দপতন ঘটে। তাই পদার্থের তাপমাত্রা বাড়াতে থাকলে একসময় তা আর সুপারকন্ডাক্টার থাকে না, ফিরে যায় সাধারণ ধাতুর অবস্থায়।
ইলেক্ট্রনের একটি সহজাত (ইন্ট্রিনসিক) ধর্ম আছে যার নাম স্পিন। স্পিন হচ্ছে একটি কণার অন্তর্নিহিত কৌণিক ভরবেগ । কোয়ান্টাম তত্ত্বের উদ্ভবের আগে কণাদের স্পিন নামক ধর্ম নিয়ে বিজ্ঞানীদের কোনও ধারণা ছিল না। যদিও কোয়ান্টাম জগতের ঘটনা সঠিকভাবে বুঝতে গেলে উপযুক্ত গাণিতিক পদ্ধতি নিয়ে চর্চা করা প্রয়োজন, আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না। এইটুকু মনে রাখা যেতে পারে যে স্পিনকে কল্পনা করা যায় একটি অভিমুখ সমন্বিত রাশি হিসেবে – এর বর্ণনা করা সম্ভব একটি মান ও একটি দিকনির্দেশের মাধ্যমে। কোনও কোনও কণার স্পিনের মান হচ্ছে পূর্ণসংখ্যা (যেমন ০, ১, ২ ইত্যাদি), আর বাকিদের ক্ষেত্রে পূর্ণসংখ্যার সাথে অর্ধেকের যোগফল (যেমন ১/২, ৩/২, ৫/২ ইত্যাদি)। প্রথম প্রকারের কণাকে বলা হয় বোসন, আর দ্বিতীয়টিকে ফার্মিয়ন। প্রসঙ্গত, যে দুই বিজ্ঞানীর নামে এই দুটি নামকরণ হয়েছে, তাঁরা হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও এনরিকো ফার্মি।
কণার সমষ্টিতে একেকটি কণার স্বভাব বর্ণিত হয় বিশেষ কিছু গুণের পরিমাণ দিয়ে। সাধারণত এই গুণগুলি হল শক্তি, ভরবেগ, স্পিন ইত্যাদি। এদের কোয়ান্টাম সংখ্যা বলে ডাকা হয়ে থাকে। কণারা যদি ফার্মিয়ন হয়, তাদের সমষ্টিতে কোনও দুটি কণার সমস্ত কোয়ান্টাম সংখ্যার মান সমান হওয়া সম্ভব নয়। এই নিয়মটিকে বলে পাওলি এক্সক্লুশান প্রিন্সিপল। বোসনদের জন্য এরকম বিধিনিষেধ নেই।
এই নিষেধ না থাকার ফলে পরমশূন্য তাপমাত্রায় সমস্ত বোসন কণাকে পাওয়া যায় ন্যূনতম শক্তির অবস্থায়। ইলেক্ট্রন হচ্ছে ফার্মিয়ন, কারণ এর স্পিন হল ১/২। বি. সি. এস. তত্ত্ব অনুযায়ী একটি কুপার জোড়া যে দুটি ইলেক্ট্রনের সমন্বয়ে তৈরি হয়, তাদের স্পিন একে অপরের বিপরীত হওয়া বাধ্যতামূলক। দুই বিপরীত মেরুর স্পিন কোয়ান্টাম তত্ত্বের নিয়ম মেনে যোগ হওয়ার ফলে কুপার জোড়ার স্পিন মোটের ওপর দাঁড়ায় শূন্য। কুপার জোড়ার ধর্ম তাই অনেকাংশে বোসনের মত।
সাধারণ ধাতুর মুক্ত ইলেক্ট্রন ও দুটি ইলেক্ট্রনের মেলবন্ধনে তৈরি কুপার জোড়ার মধ্যে এটি এক বিরাট পার্থক্য। সুপারকন্ডাক্টারের কুপার জোড়ারা বোসন-জাতীয় ধর্মের কারণে তৈরি করে এক সংহত দশা (কোহেরেন্ট স্টেট), যেখানে তারা একে অপরের সাথে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ। এই সংহত দশা ঠিক কীরকম? মনে করা যাক সেনাবাহিনীর প্যারেডের দৃশ্য, যা সাধারণতন্ত্র দিবসে দূরদর্শনের পর্দায় আমরা দেখি। দলের প্রত্যেকজন চলে সমান তালে, গতি ও ছন্দ এক রেখে। সুপারকন্ডাক্টার দশার কুপার জোড়াদের সংহতি এই জাতীয়।
বি. সি. এস. তত্ত্ব থেকে জানা যায় কীভাবে এই সংহত দশা মাইসনার-অকসেনফেল্ড এফেক্টকে ব্যাখ্যা করতে পারে। যদি মনে রাখেন, মাইসনার-অকসেনফেল্ড এফেক্ট ছিল এইরকম: সুপারকন্ডাক্টারের ভেতর চৌম্বক ক্ষেত্র লোপ পায়। সুপারকন্ডাক্টারকে চুম্বকের কাছে রাখলে সে ঠিক বিপরীত এক ক্ষেত্র তৈরি করে, যাতে কেটেকুটে তার ভেতর মোট চৌম্বক ক্ষেত্র হয় শূন্য।
মাইসনার-অকসেনফেল্ড এফেক্ট গবেষণাগারে আবিষ্কার হওয়ার পরে ১৯৩৫ সালে ফ্রিৎস লনডন ও হাইনৎস লনডন দেখিয়েছিলেন যে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচৌম্বক তত্ত্ব ও সুপারকন্ডাক্টারে শূন্য প্রতিরোধক্ষমতার তথ্য ব্যবহার করে কিছু সমীকরণ নির্ধারণ করা যায়। তাদের সমাধান থেকে মাইসনার-অকসেনফেল্ড এফেক্টের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করা সম্ভব। চৌম্বক ক্ষেত্র উপস্থিত থাকলে সুপারকন্ডাক্টা্রের পৃষ্ঠে বিদ্যুৎপ্রবাহ তৈরি হয়। সেই কারণে চারপাশে নতুন এক ক্ষেত্র আবির্ভূত হয় যা বহিরাগত ক্ষেত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত, ঠিক ততটাই যাতে ভেতরে মোট ক্ষেত্র শূন্য হয়ে যায়। ফ্রিৎস ও হাইনৎস লনডনের তত্ত্ব নির্মিত হয়েছিল ক্ল্যাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানের ধাঁচে। আণুবীক্ষণীক স্তরে ইলেক্ট্রনের ধর্ম থেকে তাঁরা হিসেব শুরু করেননি। বি. সি. এস. তত্ত্ব দেখালো যে কুপার জোড়াদের সম্মিলিত দশার বর্ণনা থেকে উপরোক্ত সমীকরণগুলি স্থাপন করা সম্ভব। সম্পূর্ণ চিত্রটা পরিষ্কার হল।
সুপারকন্ডাক্টারের মধ্যে যা ঘটে চলেছে, পরীক্ষা করে গবেষণাগারে যা যা দেখতে পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা, বি. সি. এস. তত্ত্বে পাওয়া গেল তার পূর্ণ বিবরণ। এই অসাধারণ কীর্তির জন্যে বার্ডিন, কুপার ও শ্রীফার ১৯৭২ সালে নোবেল পুরষ্কারে সম্মানিত হন। এর পর সুপারকন্ডাক্টারের কাহিনীর যবণিকা পতন হয়ে গেল এমন ভাবার কিন্তু কারণ নেই। অনেক বড় এক চমক তোলা ছিল ভবিষ্যতের জন্যে।
প্রাসঙ্গিক কিছু লেখা:
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : এই লেখাটি পড়ে মতামত দিয়ে সাহায্য করার জন্যে আমি শ্রীনন্দা ঘোষের কাছে কৃতজ্ঞ।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/superconductor-bcs-theory