21-12-2024 16:53:27 pm
Link: https://bigyan.org.in/solar-energy
বর্তমানে প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানীর (fossil fuel) চাহিদা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার ফলে একদিকে দাম যেমন আকাশছোঁয়া, অন্যদিকে প্রয়োজন মেটাবার মত এতো শক্তিই বা কোথায়? অথচ আমাদের দৈনন্দীন জীবনে প্রতি মুহূর্তে শক্তি ছাড়া চলে না। একদিকে গৃহস্থালীর নানাবিধ আধুনিক যন্ত্রপাতি চালাবার জন্যে বিদ্যুৎ শক্তির যেমন প্রয়োজন, তেমনই অন্যদিকে শিল্প-কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও অনেকটা শক্তির দরকার। শক্তির এই বিপুল ঘাটতি কমাতে আমাদের সরকার বিরাট অর্থব্যয়ে পেট্রোলিয়াম আমদানী করে চলেছে, কিন্তু এটাই কি একমাত্র পথ? বিশেষত যখন এই গরম দেশে রোদ-হাওয়ার অভাব নেই। আমাদের মত রৌদ্রস্নাত দেশে তাই সৌরশক্তি সম্বন্ধে গবেষণা ও সেই শক্তির ঠিকমত ব্যবহার যাতে আম-জনতা করতে পারে সেটা অত্যন্ত জরুরী। এ-ব্যাপারে আমরা বাড়িতে সম্পূর্ণ নিজেদের সামর্থ্যে যা করতে পেরেছি, সেই বিষয়েই এই প্রতিবেদন।
প্রথমে, যে-সব জায়গায় সরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে, সে-সব জায়গায় কীভাবে সৌর-শক্তির সাহায্যে আলোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে বলি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সৌরপ্যানেল থেকে উৎপন্ন সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে জোরদার একটি বড়সড় মাপের ব্যাটারি চার্জ (বা আধানযুক্ত) করা হয়। কিন্তু ব্যাটারীর বিদ্যুৎ DC হওয়ার কারণে সেটা আমাদের গৃহস্থালীর 220 Volts AC বিদ্যুৎ-চালিত যন্ত্রের পক্ষে উপযুক্ত নয়। সেটা পেতে দরকার একটি ইনভার্টার (inverter) যন্ত্রের, যা 12 volts DC বিদ্যুৎ কে 220 volts AC তে রূপান্তরিত করতে পারে। কিন্তু এটা খানিক খরচ সাপেক্ষ, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত কম আর্থিক সামর্থের পরিবারের জন্য। আরও মনে রাখা দরকার যে 220 volts AC মোটেই সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়, বিশেষ করে আমাদের দেশে। রোজই কোথাও না কোথাও থেকে 220 volts AC তে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার দুর্ঘটনার খবর আসে।
এদিকে 12 volts 50 Watt (বা আরও কম শক্তিশালী) সৌরপ্যানেল থেকে সরাসরি উৎপন্ন বিদ্যুতের দরুণ তেমন কোনো দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই। এই সব কারণে হয়তো আরেকটা বিকল্প আছে যেটা নেওয়া যেতে পারে। এই বিকল্পে, সৌরপ্যানেল থেকে পাওয়া 12 volts DC বিদ্যুৎ দিয়ে সরাসরি ছোট 12 volts, 7 – 9 Ampere Hour, Lead-Acid ব্যাটারিকে আধানযুক্ত করা যেতে পারে এবং সেই আধানযুক্ত ব্যাটারি দিয়ে 12 volts DC Light Emitting Diode বা LED জ্বালানো যেতেই পারে। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি যে আলোকসজ্জায় ব্যবহৃত চীনে Warm White LEDর যে মালা বাজারে পাওয়া যায়, তা দিয়ে বড়, ধরুণ, 4×3 বর্গ মিটারের একটা ঘর অনায়াসে আলোকিত করা যায়, প্রায় একটা 40 – 60 Watt বাল্বের মত! এমন একটা আলোকিত ঘরের ছবি আমরা পরে রাখছি, একটা ধারণা দেওয়ার জন্য। ব্যাটারি ঠিকমত আধানযুক্ত হলে, যেটা কড়া রোদে 4 – 5 ঘন্টায় অনায়াসেই সম্ভব, এই ধরণের আলো রাতে প্রায় 5 – 6 ঘন্টা বেশ উজ্জ্বলভাবে জ্বলে, তারপর ধীরে ধীরে ব্যাটারীর আধান কমার সঙ্গে-সঙ্গে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। খরচার ব্যাপারে বলতে গেলে যেটা সবচেয়ে বেশী দামী, সেটা হল সৌরপ্যানেল। একটি 12 volts 50 Watt প্যানেলের দাম 2,500 – 3,000 টাকা, ভালো Lead Acid ব্যাটারির দামও অনুরূপ, চীনে LED’র মালার দাম খুব বেশী হলে 400 – 500। আমাদের হিসেব অনুযায়ী মোটামুটি হাজার ছয়েক টাকার প্রারম্ভিক খরচের পর বিনামূল্যে ঘরে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা হয়ে যায়, তা প্রায় বছর দুয়েকের জন্য তো বটেই। এই ব্যবস্থা কী আমাদের দেশের যে কোন একটি সাধারণ বাড়ীতে অন্ধকার ঘোচাবার পক্ষে যথেষ্ট নয়?
(উপরে : আলোকিত ঘর, নিচে : LED মালা ও ব্যাটারী)
আমরা DC heater element নিয়েও কিছু পরীক্ষা করেছি। একটা কালো রঙ করা ধাতুর জলাধার, তার মধ্যে দুটো তার ঢোকানো, যেগুলো 24 volt এর একটা ব্যাটারি প্যাকের (12 volt, 9 Amp/hr এর দুটো ব্যাটারি হতে পারে) সঙ্গে লাগানো। ব্যাটারি প্যাকটি আগে থেকে সৌরশক্তিতে চার্জ করে রাখা যেতে পারে। জলাধারটি 2 লিটার আয়তনের হলে শীতকালেও জল 50 – 60 ডিগ্রী সেলসিয়াস অবধি গরম করতে 20 – 30 মিনিটের বেশি লাগা উচিত নয়। যে-সব জায়গায় বিদ্যুতের ঘাটতি, সেখানে এই সস্তার জল-গরম করার যন্ত্র বিশেষ কাজে দেবে আশা করা যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে প্রায়ই যখন গরম জলের দরকার হয়, অথচ বিদ্যুতের অভাবে তা সম্ভব হয় না, এই যন্ত্র সেখানে খুবই কাজে আসতে পারে। আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার – এই যন্ত্র ব্যবহারে কোনও কারেন্ট বা শক লাগার বিপদের ভয় নেই, যা 220 volt যন্ত্রে যথেষ্ট রয়েছে।
সাধারণতঃ ব্যাটারি চার্জ করে সৌরশক্তি সঞ্চয় করা হয়। কিন্তু rechargeable ব্যাটারি হলেও সেটা খুব বেশি বার চার্জ (recharge) করা যায়না, এবং চার্জ করাটাও সময় সাপেক্ষ। এর প্রধান কারণ এই যে ব্যাটারির মধ্যে বৈদ্যুত-রাসায়নিক (electrochemical) পদ্ধতিতে বাইরের বৈদ্যুতিক কারেন্ট দিয়ে বিদ্যুৎশক্তি সঞ্চিত হয়। এই পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ, এবং বারবার ব্যাটারির শক্তি ফুরিয়ে গেলে তাকে রিচার্জ করলে ব্যাটারির ক্ষমতাও আস্তে আস্তে কমে আসে।
শুধু তাই নয়, ব্যাটারি কমজোরী হয়ে গেলে, তাকে যে-কোনও জায়গায় ফেলে দেওয়া যায়না, কারণ ব্যাটারির মধ্যে যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, তা কোনোভাবে শরীরে প্রবেশ করলে মানুষের ক্ষতি করতে পারে।
এই সব কারণে এর বিকল্প হিসেবে বিদেশে তৈরি হয়েছে ‘সুপারক্যাপাসিটর’ (supercapacitor) – এক ধরণের ক্যাপাসিটর যার মান সাধারণ ক্যাপাসিটরের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। টিভি, অডিও-সিসটেম প্রভৃতি ইলেকট্রনিক যন্ত্রে যে-সব ক্যাপাসিটর ব্যবহার করা হয়, তাদের মানের তুলনায় এক কোটি থেকে একশো কোটি গুণ বেশি। এগুলি কোনো বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরী নয়, সাধারণত অঙ্গার (carbon) দিয়ে তৈরি, ন্যানোপ্রযুক্তির (nanotechnology) মাধ্যমে। এই প্রযুক্তিও এমন নয় যে এদেশে তৈরি করা সম্ভব নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদেশে এই ধরণের ক্যাপাসিটর পাওয়া যায়না! প্রয়োজনে আমেরিকা, জার্মানী ও চীন থেকে এগুলোকে আমদানী করতে হয়।
এই সুপারক্যাপাসিটরের বহু-বহু প্রয়োগ রয়েছে, এবং অনেকেই মনে করছেন যে ভবিষ্যতে এদের আবির্ভাবে ব্যাটারীর ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রয়োগের মধ্যে একটা হচ্ছে যানবাহনের কাজে। আমরা সুপারক্যাপাসিটরকে সৌরশক্তি সঞ্চয়ের আধার হিসেবে ব্যবহার করে prototype model ট্রাম বা ট্রেন, সাইকেল রিক্সা ও গঙ্গা পারাপার করার ferry boat বানিয়েছি। এগুলি সবই খেলনা মাপের, কিন্তু যে-ভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে পূর্ণ মাপের তৈরি করতে কোন বাধা নেই, প্রয়োজন শুধু ইচ্ছে ও খানিকটা অর্থবলের, তাও শুধু শুরুতে। তারপর প্রকৃতির দানে দৈনন্দিন শক্তিসঞ্চয় ও ব্যবহার নিখরচায়! Model খেলনার কয়েকটা নমুনা নীচে দিলাম, নীচে youtube ভিডিওতে সম্পূর্ণ বিবরণ রয়েছে। (youtube-এ solar-powered supercapacitor-driven model railcar দিয়ে খুঁজলে এই ভিডিওটা পাওয়া যাবে)।
সৌরশক্তি দিয়ে চার্জ করা সুপারক্যাপাসিটর-চালিত ব্যাটারিহীন সাইকেল-রিক্সার কথা আমরা সকলেই জানি। কলকাতা শহর থেকে একটু শহরতলির দিকে গেলেই সাইকেল-রিক্সা বা ভ্যান-রিক্সা প্রচুর সংখ্যায় চোখে পড়ে। অথচ বছরের বেশিরভাগ সময়ে গরমে সাইকেল রিক্সা চালকদের কষ্টের সীমা থেকে না। ওপরের ছবিতে আমরা যে খেলনার মডেলটা দেখছি, তার একটা পূর্ণমাপের সংস্করণ কী করা যায়না, যাতে সাইকেল রিক্সা চালানো একটু সহজ হয়? এখন আপনারা শহরতলিতে ‘টো-টো’ বলে একটা নতুন ব্যাটারি-চালিত রিক্সা দেখছেন, যেটা ভালই চলছে। কিন্তু তার যা দাম, তাতে ঐ বাহন কিনতে একজন সাধারণ সাইকেল-রিক্সা চালক ঋণের জালে জড়িয়ে যেতে পারেন। তার ওপর, ‘টো-টো’র বেশীর ভাগটা চীন থেকে আমদানী করা, তাই খারাপ হয়ে গেলে ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এর বিকল্প হিসেবে আমরা একটা সৌরশক্তি-চালিত সাইকেল রিক্সা তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি, যা সহজে দেশে পাওয়া যায়, এবং সহজে দোকানে সারানোও যায়। টো-টোর থেকে এ-ধরণের রিক্সার সুবিধে অনেক : (১) দামের দিক থেকে অনেক সস্তা, (২) দেশেই সারানো যাবে অল্প খরচে ইত্যাদি। প্রাথমিক স্তরে খরচ কম রাখার জন্যে সুপারক্যাপাসিটর ব্যবহার করা হয়ত সম্ভব হবে না, কিন্তু সৌরশক্তি দিয়ে চার্জ করা ব্যাটারি দিয়ে চালালে খারাপ হবে না বলেই আমাদের ধারণা। টো-টোর মত জোরালো 48 volt এর ব্যাটারীর বদলে 12 বা 24 volt দিয়ে চালানো যাবে।
নীচের ছবিতে ফেরী নৌকোর মডেলটি যেমন সৌরশক্তি-চালিত ব্যাটারি দিয়ে চলছে।
আমরা অবশ্য ইতিমধ্যেই ওটিকে সুপারক্যাপাসিটর দিয়ে ব্যাটারি ছাড়াও চালাবার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। দেশে সুপারক্যাপাসিটর যতদিন না পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন এই ম্যাজিক জিনিসটির পূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা বেশ কঠিন। অথচ দেশে এত বড় বড় ন্যানোল্যাব থাকা সত্ত্বেও কেন যে এটা সম্ভব হচ্ছে না, তার উত্তর নেই।
পরিশেষে, কয়েকটা কথা একটু মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। যাঁরা মনে করেন সুইচ টিপলে কারেন্ট না এলে সরকারের দোষ, তা সে যে-দলের সরকারই হোন না কেন, তাঁদের ধারণা দেওয়ার জন্যে বলতে হচ্ছে যে আমাদের দেশে তথাকথিত শক্তির ঘাটতির কথা বলা হয়, তার প্রতিকারের উপায় কিন্তু প্রকৃতিই করে রেখেছে। আমরা যদি তার ব্যবহার না করি তাহলে আমাদেরই বোকামি। প্রতিদিন সূর্য থেকে যে পরিমাণ শক্তি পৃথিবীর ওপর এসে পড়ে, তা সারা বছরে আমরা সমস্ত দেশ মিলে যা শক্তি খরচ করি তার থেকেও অনেক বেশি। সূর্য থেকে শক্তি সঞ্চয় করে গাছপালা দিব্যি আছে, বছরের পর বছর। আমরাই এমন সব জ্বালানীর ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যেগুলি সহজে পাওয়ার নয়, যেমন খনিজ তেল, বা অতি খরচাসাপেক্ষ ও ভয়ঙ্কর নিউক্লিয়ার শক্তি। এর বিকল্প হিসেবে সৌরশক্তির উপযোগিতা তো সকলের কাছে পরিষ্কার বলেই আমাদের মনে হয়। এখন দরকার গবেষণার যাতে সেই শক্তি সহজে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। যখন ভাবি আমাদের দেশে নিউক্লিয়ার শক্তির গবেষণার জন্যে যা খরচ হয়েছে, বিকল্প শক্তির গবেষণার জন্যে তার 1% ও হয়নি, তখন বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। আমরা ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির জাহির করে থাকি উচ্চৈস্বরে, ‘Brand India’ নামক অলীক ছাপের বড়াই করি অনবরত, অথচ সৌরশক্তি ও বিকল্প শক্তির গবেষণায় এতটাই পিছিয়ে রয়েছি যে এ-যাবৎ অন্যদেশে তৈরি সুলভ সৌরপ্যানেলের সমকক্ষ কোনও প্যানেল তৈরী করে উঠতে পারিনি! পাছে ব্যবসায় ক্ষতি হয়, সেজন্য দেশের সৌরপ্যানেল বিক্রেতারা বিদেশে তৈরী ভালো প্যানেল এ-দেশে বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারকে উপরি কর নির্ধারণ করতে আহ্বান জানিয়েছেন, এ-খবরটি যেমন হাস্যকর তেমনই দুঃখের। এত রোদ যে-দেশে, সেখানেও কেন দুঃস্থ কোনো স্কুল পড়ুয়াকে মোম বা কেরোসিনের আলোয় পড়তে হবে, তা বোঝা কঠিন। এবং, এই অভাবের প্রতিকারের উৎকৃষ্ট উপায় হাতে থাকতেও কেন আমরা তা উপেক্ষা করে চলেছি বছরের পর বছর, সেটা বোঝা সত্যিই দুষ্কর।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/solar-energy