21-12-2024 17:03:36 pm
Link: https://bigyan.org.in/socio-scientific-amalgamation-in-epidemic-control
পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিয়নের ফ্রিটাউন বন্দর-নগরীতে ২০১৪ সাল নাগাদ এক গর্ভবতী গিনি (Guinea) মহিলার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটা বড় রকমের বিতর্কের সূত্রপাত হয়। আশঙ্কা করা হয়েছিল কোনো ‘রহস্যময় রোগে’ এই মৃত্যু-বিপর্যয় ঘটেছে। সাবেকি স্থানীয় কিশি (Kissi) সংস্কৃতিতে একটি লোক-বিশ্বাস প্রচলিত আছে: ভ্রূণ সমেত কোনো নারীকে কবরে সমাহিত করলে জাগতিক ও প্রাকৃতিক কর্ম-চক্র ব্যাহত হয়। মানুষ, জীবজন্তু ও অরণ্য প্রকৃতির সৃষ্টি ও লয়ের প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়। কীরকম? যেমন, শবানুগমনকারীরা বিশ্বাস করে এর ফলে ভূমির উৎপাদিকা শক্তি হ্রাস পাবে। ফলতঃ কৃষিকার্য ব্যহত হবে এবং তাতে অন্যান্য নারীর প্রজনন ক্ষমতাও কমে যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO-র ইবোলা রোগ-প্রতিরোধী দল নির্দেশ জারি করে যে মৃত ঐ মহিলার দেহ প্লাস্টিক বডি-ব্যাগে ভরে সমাধি ক্ষেত্রে নিয়ে যেতে হবে। তার আগে মৃতদেহকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের এরকম দ্বন্দ্ব-বিরোধের ঘটনা ইবোলা আক্রান্ত পশ্চিম আফ্রিকার গিনি, সিয়েরা লিয়ন এবং লাইবেরিয়ায় প্রায়ই দেখা যায়। সেখানে এই মহামারী ইতিমধ্যে ৮০০ মানুষের প্রাণ নিয়েছে ,আক্রান্ত হয়েছে আরও ২১,০০০ মানুষ। আধুনিক কালে ইবোলা ভাইরাস ডিজিজ ( ইভিডি: EVD )-এর এটিই সম্ভাবত সবচেয়ে দীর্ঘ, ভয়াবহ এবং মারাত্মক সংক্রমণ।
WHO, রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যেটি সাধারণত জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরী অবস্থা কিংবা মহামারী মোকাবিলায় কৌশল, উদ্যোগ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, তারা ইভিডি-কে ‘জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা’ বলে ঘোষণা করেছে যা কিনা ‘আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার সংকট’ ঘটাতে পারে বলে আশংকা করা হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে যখন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এতো উন্নত হয়ে উঠেছে আর এতো ব্যয়বহুল স্বাস্থ্যবিজ্ঞান-গবেষণা বিশ্বব্যাপী সংক্রামক ব্যাধিকে প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিয়ে সজাগ, তখন কীভাবে একটি মহামারী এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে !
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন পৃথিবীকে যে আজ এত বড় ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যবিপর্যয়ের মোকাবিলার জন্য তৈরি হতে হচ্ছে তার কারণ হলো কী মানুষ, কী রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো সংস্থা, সকলেই ইভিডি-কে নিছক ‘ জনস্বাস্থ্য সমস্যা’ বলেই ভাবছে । মহামারীর মধ্যে যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক বিষয়ও জড়িয়ে থাকে তা তারা ভাবছে না। প্রশ্ন হলো স্থানীয় সংস্কৃতির স্বীকৃতি এবং মান্যতাই কি এই ধরনের মহামারীকে প্রতিরোধ করতে পারে? মহামারী প্রতিরোধ মানেই কি ‘ভেক্টর’, ‘প্যাথোজেন’, অর্থভাণ্ডার, সরকারী বাজেটের মতো কেজো ব্যাপার, নাকি এটি আস্থা বা বিশ্বাস, যোগাযোগ কিংবা সামাজিক আচার আচরণের উপর নির্ভরশীল? সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যেসব মহামারী বা সংক্রামক ব্যাধি অতর্কিতে আসে— কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই— কোনো দেশ তার যথার্থ মোকাবিলা করতে পারে শুধু বিজ্ঞান নয়, সংশ্লিষ্ট দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক আর ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ও প্রসঙ্গকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে। ইবোলা মহামারী এই পূর্বাভাসের সম্ভাব্য সত্যতার এক উদাহরণ।
ইবোলা মহামারী যখন বিস্তৃত হচ্ছিল তখন এর ব্যাপ্তির জন্য সচরাচর দায়ী করা হয়েছিল দুর্বল স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা, দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা, দুর্নীতি, দারিদ্র্য আর ভঙ্গুর রাষ্ট্রসীমারেখা বরাবর বিপুল জনসংখ্যার নিত্য যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধাকে। মহামারীর ভাইরাস পশ্চিম আফ্রিকায় বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল, হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটাচ্ছিল ( এর মৃত্যুহার ছিল ৫০%)। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের সবরকম ব্যবস্থা প্রায় ব্যর্থ। মেডিকেল এনথ্রোপোলজিস্ট , যাঁরা এ-অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনচর্চায় প্রভূত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, তাঁরা মহামারী নিবারণের জন্য পরামর্শ দিলেন এই জনগোষ্ঠীর মৃত্যু এবং সমাধি দেওয়ার প্রচলিত পদ্ধতির উপর গুরুত্ব দিতে। এঁরা লক্ষ্য করেছিলেন পারলৌকিক আধ্যাত্মিকতা এই জনগোষ্ঠীর মজ্জায় মজ্জায় প্রবাহিত। মৃতদেহকে কেন্দ্র করে চলে এদের বিপুল পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম। খালি হাতেই এরা মৃতদেহকে স্নান করায়, পরিধেয় বস্ত্রে মুড়ে দেয় আর দেয় অন্তিম বিদায় চুম্বন । এরপর মৃতদেহটিকে ঘিরে চলে এদের সমষ্টিগত আহার। এই পারলৌকিক আচার ইবোলা মহামারী ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। কেননা ইবোলা আক্রান্ত ব্যক্তি যতই মৃত্যুর কাছাকাছি হতে থাকে, ইবোলা ভাইরাসের মাত্রা তার শরীরে ততই চরম সীমা ছাড়িয়ে যায়। ফলতঃ ঐ মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তিটির বিন্দুমাত্র ঘাম, রক্ত বা থুথু যে- কেউ স্পর্শ করুক না কেন, তারই সংক্রমণের সম্ভাবনা পুরো মাত্রায় থাকে। ইবোলা এই সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীবদ্ধ পারস্পরিক মমত্ববোধের পুরোপুরি সুযোগ নেয়। কেননা এইসব সম্প্রদায়- গোষ্ঠী যতই বিপন্ন হয়ে উঠে ততই এরা বিপদ-আপদ ভাগ করে নেয়। ভাগ করে নেয় অর্থ কিংবা খাদ্য। আর এইভাবেই ইবোলা একটি ‘পারিবারিক ব্যাধি’-তে রূপান্তরিত হয়। যতই তারা এই ব্যাধির ভাইরাসকে দমন করতে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতায় আবদ্ধ হতে থাকে ততই তারা বেশি করে ইবোলার কবলে পড়ে যায়।
ইবোলা দমনে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের কর্মীরা নির্দেশ দিল সমাধিকরণ সংক্রান্ত যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান বন্ধ করার। সংস্কৃতির উপর আঘাত ভেবে ইবোলা আক্রান্ত জনসমাজের মানুষজন প্রতিরোধ করেছিল এই নিদানের। ফলতঃ ইবোলার নিয়ন্ত্রণ রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল।
আঞ্চলিক জনগোষ্ঠীর মানুষজন যে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত মহামারী প্রতিরোধ ব্যবস্থা, যেমন বাসস্থান ও মৃতদেহকে পর্যাপ্ত ব্লীচিং দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা, নিরাপদ ও বিপদমুক্ত সমাধি দেওয়া ইত্যাদি বর্জন করেছিল তার পিছনে অজ্ঞতা বা কুসংস্কার তো ছিলই। সেই সাথে, নৃতত্ত্ববিদদের মতে, ‘পশ্চিমী’ বা ‘সরকারী’ ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের অবিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলি ও বিশ্বব্যাঙ্কের (World Bank) মতো আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থাগুলি কাছ থেকে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো যে বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে তার সুফল কিছু শহুরে বাবু আর স্থানীয় সর্দারেরাই ভোগ করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় আদি-নিবাসীরাই বঞ্চিত হয়েছে (Moyo, 2010; Easterly, 2007)। তাই তারা যখন দেখে যে প্রিয়জনের মৃতদেহ প্লাস্টিক ব্যাগে মুড়ে কোনো অজানা কবরস্থানের উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে, কিংবা উঁচু কাঁটাতারে ঘেরা দেওয়ালের ওপারে astronaut-এর মতো পোষাক পরা অপরিচিত বিদেশি স্বাস্থ্যকর্মীরা অবিশ্বাস্য তৎপরতায় কীসব কাজ করে চলেছে, তখন তারা ভীত হয়। তাদের মনে জাগে আশংকা আর অসন্তোষ। কেননা এসব কাজকর্ম তাদের পরিচিত সাবেকি স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো নয়, বরং জেলখানার সংগে এর তুলনা চলে। ফলতঃ ইবোলা রোধে যাবতীয় সরকারী পদক্ষেপে এদের থাকে সমবেত অসম্মতি আর সরকারি নির্দেশ এরা করে সহজেই উল্লঙ্ঘন।
পল ফারমার (Paul Farmer) নামে একজন বিখ্যাত চিকিৎসক তথা নৃতত্ত্ববিদ বহুদিন যাবৎ হাইতির গ্রামাঞ্চলে এডস (AIDS) এবং পেরুর প্রায়-নিরাময়-অযোগ্য টিউবারকিউলসিসের (TB ) বিরুদ্ধে লড়াই-এর উপর গবেষণা করেছেন। তিনি মনে করেন, ব্যাধির সংগে সংশ্লিষ্ট কষ্ট ও দুর্ভোগের এই অসমতা এড়ানোও যেতে পারত। সুগভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিতের এই অবিচারকে তিনি ‘সাংগঠনিক হিংস্রতা’ (structural violence) বলে অভিহিত করেছেন। সুতরাং এই ইবোলা সংকটকে নিছক চিকিৎসার অপ্রতুলতা কিংবা ভ্যাকসিনের অভাব বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। এর পিছনে সুগভীর বঞ্চনা ও অসাম্যের সাংস্কৃতিক অসুখ বিদ্যমান।
আসুন, যে-ঘটনাটা দিয়ে এই প্রবন্ধ শুরু করেছিলাম, সেখানে আমরা এখন ফিরে যাই: গর্ভবতী মৃত মহিলাকে সমাধিস্থ করা নিয়ে বিতর্ক। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় অধিবাসীদের বাধাদানে ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হয়ে মেডিকেল টিম একজন নৃতত্ত্ববিদকে আমন্ত্রণ জানায়। তিনি একটি উপায় বাতলে দেন। তিনি বলেন, ঐ গোষ্ঠীর প্রচলিত সামাজিক নিয়মের উল্লঙ্ঘনজনিত ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হবে যদি ক্ষতিপূরণ বা প্রায়শ্চিত্তমূলক কোনো আচার-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যায়। WHO সংস্থার কর্মীরা ঐ অনুষ্ঠান সংগঠনের জন্য অর্থ বরাদ্দ করলেন এবং মহিলার মৃতদেহ স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কবরস্থানে সমাহিত করা হলো। আর কোনো বাধাদানের ঘটনা ঘটেনি। কৃষ্টি বা সংস্কৃতির সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্মানজনক কথোপকথনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হল।
মহামারী বা কোনো রোগের সংক্রমণ মন্দভাগ্য বা অপ্রতিরোধ্য, কোনোটারই ইঙ্গিত বহন করে না। এই প্রতিরোধে এমন একটি স্বাস্থ্যপরিষেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত যা আধুনিক বিজ্ঞান ও অভিনব উদ্ভাবনাকে গ্রহণ তো করবেই। সাথে, সেই ব্যবস্থায় স্থানীয় কৃষ্টি ও মানুষের সুপ্রাচীন সামাজিক প্রথাকেও মান্যতা দেওয়া উচিত।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/socio-scientific-amalgamation-in-epidemic-control