21-12-2024 16:23:42 pm
Link: https://bigyan.org.in/semiconductors-stories-01-use-in-war
রাজীবুল: আজকে আমাদের অতিথি হিসাবে আমরা পেয়েছি ইন্টেল-এর বিজ্ঞানী দেবলীনা নন্দী-কে। দেবলীনা, অনেক স্বাগত জানাই।
দেবলীনা: থ্যাংক ইউ, রাজীবুল।
দেবলীনা আর আমি একসাথে পড়াশোনা করেছি আন্ডারগ্র্যাডে। দেবলীনা, তুই যদি শুরু করিস তোর জার্নি-টা দিয়ে। ইন্টেল এখন বিশ্বের অন্যতম বড় একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যেখানে গবেষণা হয়। সেমিকন্ডাক্টর-এর পাওয়ারহাউস বলা চলে। আমরা যখন বাজারে কম্পিউটার কিনি, তাতে ইন্টেল-এর চিপ, “ইন্টেল ইনসাইড” এই কথাগুলো দেখতে পাই। এত বড় একটা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী তুই, তোর জার্নি-টা সম্বন্ধে একটু বল আমাদের।
তুই আর আমি যাদবপুরে একসাথে পড়েছি। তারপর আমি গেছিলাম IISc-তে। IISc-তে আমি প্রফেসর অজয় সুদ-এর ল্যাবে রিসার্চ করলাম। ওখানেই আমি প্রথম সেমিকন্ডাক্টর এবং সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাব (fabrication) শিখেছি।
তারপর আমি Caltech-এ এসেছিলাম। Caltech-এ আমাদের সময় ‘ইন্টিজার কোয়ান্টাম হল এফেক্ট’ (integer quantum Hall effect) ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর চেষ্টা করা হতো। সেটা একটা এক্সসাইটিং ফিল্ড ছিল। সেটাতে আমি পিএইচডি গবেষণা করলাম। তারপর আমি Harvard-এ পোস্টডক করতে গেলাম। সেইসময় ‘টোপোলজিক্যাল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং’ (topological quantum computing) খুব সরগরম ছিল। পদার্থের টোপোলজিক্যাল অবস্থার গবেষণার জন্য নোবেল প্রাইজও দেওয়া হয়েছিল। যে টিম-টাকে নোবেল প্রাইজ দিয়েছিল, সেই টিম-এর সাথে আমি যুগ্মভাবে কিছু কাজ করেছি।
কিন্তু এইসব কাজ করতে করতে বারবারই আমার মনে যে প্রশ্নটা উঠতো, সেটা হলো: এই যে দশটা বছর আমি গবেষণা করলাম, এর সরাসরি প্রয়োগটা কীভাবে হবে? সেটা তলিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি বুঝলাম, হয়তো সেখানেই শুরু করা উচিত যেখান থেকে বিশ্বের প্রথম ল্যাপটপ গেছিলো সবার কাছে। অর্থাৎ, ইন্টেল কোম্পানি। তখন আমি এই কোম্পানিতে যোগদান করি।
কোথা থেকে কম্পিউটার আসে, মূলত এই প্রশ্নটা থেকেই এই পথটা বেছে নেওয়া। ছাত্র অবস্থায় মনে এই প্রশ্নটা আসে: কীভাবে হয়, কারা করে, তাদের দলে যোগ দিলে কেমন হবে। সেই ভেবেই যোগ দিলাম ইন্টেল-এ।
খুব মজার গল্প। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে নিজেদের জীবনে সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করেই থাকি — যেমন এখন আমরা ফোনে কথা বলছি বা ল্যাপটপে কথা বলছি। এদের সবের ভিতরেই চিপ থাকে। এই যে চিপ তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যে মূলত সেমিকন্ডাক্টর বলে পদার্থটার ব্যবহার হচ্ছে। তো আমাকে একটু সহজ করে বোঝা, সেমিকন্ডাক্টর-এর এতটা গুরুত্ব কেন? ফোন, ল্যাপটপের বাইরেও কি সেমিকন্ডাক্টর-এর গুরুত্ব রয়েছে আমাদের জীবনে বা সমাজে?
এটা ভীষণ ভালো প্রশ্ন। আজকে গাড়ি, মিসাইল সিস্টেম, বা এরোপ্লেন, হেন কিছু নেই যেখানে সেমিকন্ডাক্টর চিপ লাগে না। যদিও ফোন আর ল্যাপটপ-টাই প্রথমে আমাদের মাথায় আসে, কিন্তু দেশের ডিফেন্স-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে একটা মস্ত বড় স্তম্ভ হলো সেমিকন্ডাক্টর।
ডিফেন্স বলতে কি রকেট-এর কথা বলছিস?
হ্যাঁ, গাইডেড মিসাইল (guided missile) বা ফাইটার জেট প্লেন (fighter jet plane)।
মানে যে ইলেকট্রনিক্স-এর সাহায্যে গাইডেড মিসাইল তার নিশানায় পৌঁছতে পারছে, তার কথা বলছিস?
হ্যাঁ, এখন তো সব কিছুই অটোমেটেড (automated), তাই না? ইলেকট্রনিক্স-এর ব্যবহার তো হবেই।
বুঝলাম। আচ্ছা, প্যানডেমিক-এর মাঝখানে একটা কথা শোনা যাচ্ছিল, সেমিকন্ডাক্টর-এর সাপ্লাই চেন-এ কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। যে কারণে চিপ পাওয়া যাচ্ছিল না, নতুন গাড়ি কিনতে পাওয়া যাচ্ছিল না। বা, আমরা ল্যাবরেটরি-তে যে ইলেকট্রনিক্স কিনি, তার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি-তে থেকে কি তুই সেই জিনিসটা অনুভব করেছিস?
হ্যাঁ, এটা তো হয়েছিল। এটার সাথে সাথে যে যুদ্ধগুলো চলছে, আমেরিকা বনাম চীনের বাণিজ্যে যুদ্ধ কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেনের সরাসরি যুদ্ধ, এইসব যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। যেমন, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের পর পশ্চিমী দেশগুলো থেকে রাশিয়াকে কোনো চিপ দেওয়া হয়নি।
রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কথা তো আমরা জানি। এই যুদ্ধটা অনেকদিন ধরেই চলছে। আমেরিকা আর চীনের মধ্যে যে যুদ্ধের কথা বলছিস, সেটা কি সেমিকন্ডাক্টর-কে কেন্দ্র করেই?
প্রথম যখন যুদ্ধের কথা আমরা বুঝলাম, তখন সবে কোভিড-19 পেরিয়ে এসেছি। কোভিড-19 এই দুটো দেশের মধ্যে খারাপ সম্পর্কের একটা সরাসরি কারণ। কিন্তু হ্যাঁ, এই খারাপ সম্পর্কের একটা অংশ সেমিকন্ডাক্টর সংক্রান্ত ব্যবসা নিয়ে।
আচ্ছা এই যে সেমিকন্ডাক্টরের কথা বলছি, এর এতো যে প্রয়োগ, সাধারণ পাঠকের হয়ে একটা প্রশ্ন করি। যে হয়তো ইস্কুলে ‘সেমিকন্ডাক্টর’ শব্দটা শুনেছিল, এখন হয়তো আর মনে নেই। তার জন্য একটু সহজ করে ব্যাখ্যা করা যায় কি? — সেমিকন্ডাক্টর জিনিসটা ঠিক কী এবং কেন সেমিকন্ডাক্টর এ ধরনের একটা ম্যাজিক জিনিস?
আমরা ইন্টেল-এ যে ওয়েফার (wafer) গুলো বানাই, সেগুলো সিলিকন ওয়েফার। এই সিলিকন ওয়েফার-কে তুই n-টাইপ বা p-টাইপ ডোপ (dope) করতে পারিস। এবার সেমিকন্ডাক্টর ম্যাজিক জিনিস কারণ এই ডোপ করা সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করে অন-অফ সুইচ বানানো যায়। এবং এই সুইচের সাইজটা ন্যানোমিটার স্তরে।
ভেবে দেখ, এতো ছোট একটা জিনিসকে এতো ভালো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি আমরা। এই নিয়ন্ত্রণ করাটা আমরা পঞ্চাশ বছর ধরে আস্তে আস্তে শিখেছি। অন্য কোনো জিনিসের উপর আমরা এতটা সুন্দর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারিনি।
(Note: সিলিকন-এর মতো একটা সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের মধ্যে অন্য কোনো মৌল ঢুকিয়ে দিলে বলা যায়, সেমিকন্ডাক্টর-টাকে dope করা হলো। দু-ধরনের doping হয়: n-টাইপ আর p-টাইপ। দু-ধরনের dope করা সেমিকন্ডাক্টরকে একের সাথে অন্যটা জুড়লে সেটা একটা সুইচের মত কাজ করে। একদিক দিয়ে কারেন্ট বইতে পারে, অন্য দিকে পারে না। এই নিয়ে আরো বিস্তারিত জানতে এই লেখাটা পড়ো : অর্ধপরিবাহীর দাপট)
তাহলে এটা কি বলা যায় যে সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করে পৃথিবীর সবথেকে ছোট সুইচ বানানো হচ্ছে?
হ্যাঁ, সেটা বলা যায়।
আর সুইচ জিনিসটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
যে কোনো ইলেকট্রনিক সার্কিট-ই তো সুইচ দিয়ে তৈরি, তাই না?
মানে ইলেকট্রনিক সার্কিট-এর এক আর শূন্যের কথা বলছিস। অর্থাৎ, এক আর শূন্যকে বাস্তবায়িত করতে একটা ফিজিক্যাল ডিভাইস লাগবে, সেটাই এক্ষেত্রে অন-অফ সুইচ।
হ্যাঁ, সেটাই।
আচ্ছা, এই যে ছোট সাইজের কথা বললি, কত বললি যেন – ন্যানোমিটার স্তরে?
হ্যাঁ, ন্যানোমিটার স্তরে এখন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সে হতে পারে 100 ন্যানোমিটার, হতে পারে 50। এটাই এখন প্রতিযোগিতার সবথেকে বড় ক্ষেত্র: কীভাবে এই সাইজটা আরো কমানো যাবে।
(Note : এক মিটারকে এক হাজার ভাগ করলে হয় এক মিলিমিটার। এক মিলিমিটারকে এক হাজার ভাগ করলে হয় এক মাইক্রোমিটার। এক ন্যানোমিটার সেই মাইক্রোমিটার-এর এক হাজার ভাগ। মানুষের চুলের ব্যাস কয়েক থেকে কয়েকশো মাইক্রোমিটার অবধি যেতে পারে। অতএব তার এক হাজার ভাগ কত ছোট হতে পারে আন্দাজ করে দেখো।)
আচ্ছা, সেমিকন্ডাক্টর সম্বন্ধে না হয় জানলাম। কিন্তু এটা বানায় কী করে? তুই এখনি একটা ওয়েফার-এর কথা বললি।
আমাদের একেকটা ব্যাচে পঁচিশটা করে ওয়েফার থাকে। সেটা বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে যায়। সেখানেও প্রায় দু-হাজারটা ধাপ থাকে। মানে, দু-হাজারটা ধাপ দিয়ে ওয়েফারটা যায়। শেষে গিয়ে তার ইলেকট্রিকাল টেস্টিং হয়: ওয়েফারটা ঠিকঠাক বানানো হলো কি না সেটা দেখা হয়।
ওয়েফারটা যায় মানে কী? এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়?
অটোমেটিক যায়। পুরো সিস্টেম-টাই অটোমেটেড।
এরকম দু-হাজারটা যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যায়, একটা সেমিকন্ডাক্টর পদার্থ থেকে শুরু করে একটা চিপ তৈরি হতে?
হ্যাঁ।
কত সময় লাগে এতে?
এখন দু-মাস লাগে।
এটা তো বিশাল একটা ল্যাব মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, এটা একটা ল্যাবরেটরি।
এই ল্যাবটা কত বড়?
একেকটা যন্ত্রই বিশাল বড়, প্রায় একটা ঘরের সমান। আমাদের সবথেকে দামি যন্ত্র যেটা, EUV tool, সেটার এক বিলিয়ন ডলার দাম, সেটা একদম একটা ঘরের সমান বড়।
এক বিলিয়ন ডলার! তার মানে হাজার কোটি টাকার বেশি দাম সেটার।
হ্যাঁ, সাত হাজার কোটি।
এরকম দু-হাজারটা যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যায়?
না, এরকম যন্ত্র বেশি নেই। এটা হচ্ছে EUV মেশিন, যেটা দিয়ে সাইজটা ছোট করা যায়।
এই যে এতো বড় একটা ফেসিলিটির কথা বলা হচ্ছে, আর আমরা এই যে বললাম, সেমিকন্ডাক্টর ডিফেন্স ইত্যাদির জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে পৃথিবীর সব দেশে, অন্তত সব বড় বড় দেশেই কি এই ধরণের ফেসিলিটি রয়েছে?
এখন মাত্র তিনটে দেশে এই ধরনের ফেসিলিটি আছে। একটা আমেরিকা, একটা তাইওয়ান, আর একটা হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া।
শুধুমাত্র তিনটে দেশে! আমাদের ভারতে কোনো সেমিকন্ডাক্টর তৈরির ফেসিলিটি নেই?
সেরকম কিছু নেই। হয়তো পুরোনো কিছু nodes আছে, যাতে সাইজটা অপেক্ষাকৃত বড় হবে, সেগুলো এখন চেষ্টা হচ্ছে।
এরকমটা কেন? এটা কি শুধুমাত্র টাকার জন্য?
হ্যাঁ, টাকাটা এর একটা বড় দিক। এই সেমিকন্ডাক্টর গবেষণায় বেশ কিছুটা টাকা ঢালতে হয়। সেটা সমস্ত দেশ করতে পারে না।
কিন্তু অপেক্ষাকৃত ধনী দেশের মধ্যে তো আরো অনেকে রয়েছে — যেমন, ইউরোপের কিছু দেশ।
হ্যাঁ, ইউরোপেও আছে ইন্টেল-এর কিছু ফ্যাক্টরি। যেমন, আয়ারল্যান্ড-এ আছে। আমাদের দেশে এখনো তেমন কোনো ফ্যাক্টরি নেই। তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করছেন এই ইকোসিস্টেমটাকে গড়ে তোলার।
খুব ভালো খবর এটা।
প্রচ্ছদের ছবি: Dall-E 3
Video:
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/semiconductors-stories-01-use-in-war