21-12-2024 17:02:36 pm
Link: https://bigyan.org.in/quantum-lizard
বছর সতেরোর রুমেলি ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। যত রাজ্যের প্রশ্ন সবসময় মাথায় ঘুরঘুর করছে। প্রায় সব জিজ্ঞাসাই তার পিসেমশায়ের কাছে – সে মহাকাশই হোক বা মৌমাছি!
সেদিন বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে রুমেলি হঠাৎ হাজির পিসেমশায়ের বাড়ি, হাতে একটা প্রিন্টআউট – ‘Cosmos’ ম্যাগাজিনে ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটা রচনা। Cathal O’Connell-এর লেখা ‘How a human can climb like a gecko’ [১]। চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে পিসেমশাইকে রুমেলির প্রশ্ন: “পিসো, এও কি সম্ভব ? মানুষ কখনো টিকটিকির মত দেওয়াল বেয়ে উঠতে পারে?”
প্রশ্ন শুনে পিসো হো হো করে হেসে বলে উঠলো, “কেন, স্পাইডারম্যান তো কেমন তরতর করে বড় বড় খাড়া দেওয়াল এমনকি কাঁচ বেয়ে উঠতে পারতো! যাই হোক, লেখাটা আমিও পড়েছি। ওতে একটা লাইন মনে করে দেখো – The coolest thing about geckos is their feet, how they can adhere to almost anything। এটা gecko অর্থাৎ পার্বত্য অঞ্চলের তক্ষকদের নিয়ে বলেছে, কিন্তু সেগুলোও টিকটিকির সমগোত্রীয়। মানুষ পারে কি পারে না সেটা বোঝার আগে জানতে হবে টিকটিকি বা তক্ষকেরা কিকরে পারে। অর্থাৎ, কিকরে তারা অভিকর্ষের বিরুদ্ধে দেওয়ালে বা ছাদ আঁকড়ে ঘুরে বেড়াতে পারে বা শক্তভাবে আটকে থাকে।”
হ্যাঁ, সেইটাই তো! আমি তো কই দেয়াল বেয়ে উঠতে পারবো না! পড়ে যাবো! — প্রশ্ন রুমেলির।
পিসো শুরু করলেন — জানো, আমিও কিন্তু ছোটবেলায় অবাক হয়ে এই কথাটাই ভাবতাম। শুধু আমি না, এই প্রশ্ন কিন্তু অনেকদিনের। টিকটিকির এই দেওয়ালে আটকে ঘুরে বেড়াবার রহস্য বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী আরিস্টটলের মনেও প্রশ্ন তুলেছিল। সেই শুরু, এখনো চেষ্টা চলছে রহস্য ভেদ করার, পারলে টিকটিকির সেই ক্ষমতাকে আয়ত্ত্ব করার। একেই বলে গবেষণা, বুঝলে! শুরু হয় স্রেফ প্রকৃতির কোনো ঘটনাকে বুঝতে চাওয়া থেকে। সেই সত্যকে ধাওয়া করতে করতে গবেষকরা অবশেষে একদিন তার নাগাল পান, সম্ভব হলে তাকে কাজে লাগান। এখানে প্রথাগত, ফলিত সব জ্ঞান মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
বিষয়টা খোলসা করে বলো পিসো, আর তর সইছে না যে আমার। এই নিয়ে কি গবেষণা হয়েছে? কিছু বেরিয়েছে তার থেকে?
এই নিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করছেন জার্মান বিজ্ঞানী স্টানিস্লাভ গর্ব। ওনারা দেখলেন যে টিকটিকি ল্যাজ ব্যবহার করে ভারসাম্য রক্ষা করতে, আর পা ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে। ওদের মোট চারটে পা, প্রত্যেকটিতে আবার পাঁচটা করে আঙ্গুল।
আঙ্গুলে কিছু আছে নিশ্চই?
রোসো বেটি রোসো! ক্রমশ প্রকাশ্য। টিকটিকির এই আঙ্গুলগুলোর গঠনে যে একটা বিশেষত্ব আছে সেটা আঁচ করেছিলেন গবেষকরা। তাঁরা টিকটিকির পা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করার কথা ভাবলেন। কিন্তু এই গঠন খুঁটিয়ে দেখা সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বহুদিন টিকটিকির রহস্য উদ্ঘাটন বিজ্ঞানীদের কাছে অধরাই থেকে গিয়েছিল।
তবে হালফিলে ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র (electron microscope) অনেক সহজলভ্য হয়েছে। গবেষকরা টিকটিকির পা আরো খুঁটিয়ে দেখার জন্য এই ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করলেন। এবং তখনই বেরোলো এক নতুন জগৎ। বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন টিকটিকির এক একটা আঙুলের চামড়ায় রয়েছে হাজার হাজার ভাঁজ।
সেই ভাঁজের মধ্যে রয়েছে কয়েক লক্ষ লোমের সমাহার। এই লোমগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম ‘সিটা’ (setae)। এগুলো আবার কেরাটিন (keratin) নামের এক ধরণের প্রাকৃতিক তন্তুময় (fibrous) প্রোটিন দিয়ে তৈরী। মজার কথা হচ্ছে যে আমাদের নখ আর চুলও এই কেরাটিন দিয়েই তৈরী।
ও! বুঝেছি। কেরাটিন হেয়ার ট্রিটমেন্ট এর নাম শুনেছি। চুলে বেশি রাসায়নিক ব্যবহার করলে বা ড্রায়ার কি স্ট্রেইটনার অত্যধিক ব্যবহারে কেরাটিন কমে যায়। তাই ঐ ট্রিটমেন্ট করতে হয়। তারপর…. তারপর…. বল পিসো, আমার আর তর সইছে না!
প্রতি ‘সিটা’ সাধারণত ৩০-১৩০ মাইক্রোমিটার পুরু, মাথাটা চ্যাপ্টা ধরনের, আর একগুচ্ছ তন্তু দিয়ে গঠিত। তাতে তন্তুর সংখ্যা শত-র ঘরে কিংবা হাজারের ঘরে। তাদের এক একটার নাম স্প্যাচুলা (spatula) [২]। এদের ন্যানোতন্তু বলা যায় কারণ এদের ব্যাস কয়েক ন্যানোমিটার (১ ন্যানোমিটার মানে ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ, বা আমাদের মাথার চুলকে আড়াআড়ি ভাবে এক লক্ষ ভাগ করলে এক ভাগ যা দাঁড়ায় তাই )।
টিকটিকির পায়ে অসংখ্য ভাঁজ, লোম, তন্তু, সে না হয় বুঝলাম পিসো। কিন্তু টিকটিকির দেওয়ালে আটকে থাকার সঙ্গে তার সম্পর্ক কি?
হ্যাঁ ঠিক! ঐটা নিয়েই তো যত ভাবনা, চিন্তা! অনেকে ভাবছিলেন টিকটিকিরা দেওয়াল বেয়ে ওঠার সময় পায়ের পাতা ও তলের মধ্যে একটা যান্ত্রিক ইন্টারলকিং (মেকানিকাল interlocking) তৈরী হয়। পরীক্ষা করে দেখা গেল আজব ব্যাপার। ওরা কিন্তু দেওয়ালে আটকে থাকার জন্য কোনো চটচটে আঠা, আঁকড়ে ধরার জন্য নখ, বা সাকশন তৈরীর জন্য অক্টোপাসের মত কোনো ভ্যাকুয়াম চোষকও ব্যবহার করে না।
তাহলে?
বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট ফুল এর নেতৃত্বে একটা গবেষক দল ২০০০ সালে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন [৩]। তাতে দেখানো হয় যে দেওয়ালের সাথে টিকটিকির আটকে থাকা আসলে দেওয়ালের সঙ্গে পায়ের ওই তন্তুগুলোর আন্তঃআণবিক বলেরই (intermolecular forces) ফল। টিকটিকিদের পায়ের পাতা ও তলের মধ্যে আণবিক স্তরে একটা আকর্ষণ বল (adhesive force) তৈরী হয়। এই বলটা আসে ভ্যান-ডার-ওয়াল আন্তস্ক্রিয়ার (Van der Waal interaction) থেকে।
কি ক্রিয়া? এই নামটা তো আগে শুনিনি। এটা আসে কোত্থেকে?
ও হ্যাঁ, এই বলটা খুব মজার! আচ্ছা বলোতো, দুটো ধনাত্মক আধান (positive charge) পরস্পরকে আকর্ষণ (attract) করে না বিকর্ষণ (repel)?
বিকর্ষণ করে। বইতে তো পড়েছি। সম আধান পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, বিপরীত আধান আকর্ষণ করে।
ঠিক। এবার বল তো, দুটো পরমাণু, যারা মোটের উপর নিস্তড়িৎ (neutral), তাদেরকে খুব কাছাকাছি আনলে তারা পরস্পরকে আকর্ষণ করবে না বিকর্ষণ?
নিস্তড়িৎ মানে তো নিট আধান (net charge) শূন্য। তারা কিছুই করবে না, তাই না?
(রহস্যজনকভাবে হেসে) তাই কি? শুধু নিট আধানের কথা ভাবলেই চলবে কি? আচ্ছা, দাঁড়াও, একটা ছবি দেখাই। (মোবাইল ফোনে চট করে গুগল করে) নিচের এই ছবিটা দেখো। এই পরমাণু দুটোর নিউক্লয়াসে যতটা ধনাত্মক আধান (positive charge), ঠিক ততটাই ঋণাত্মক আধান (negative charge) নিউক্লিয়াসের চারিদিকে থাকা ইলেক্ট্রনগুলোর।
প্রথমেই দেখো পরমাণু দুটো নিস্তড়িৎ হলেও একেকটার মধ্যে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুটো আধানই আছে। তাই শুধু নিট আধানের কথা ভাবলেই চলবে না। যে ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আধান কাটাকুটি করে দিচ্ছে একে অপরকে, তারা কিভাবে ছড়িয়ে আছে, সেটাও ভাবতে হবে।
ছবিতে তো সুন্দর মাঝের নিউক্লিয়াসের মধ্যে ধনাত্মক আধান রয়েছে, আর চারিদিকে ঋণাত্মক ইলেক্ট্রন ঘিরে রয়েছে।
হ্যাঁ, একদম ঠিক। আধানগুলো সমান পরিমাণে সুষমভাবে বন্টিত আছে বলেই পরমাণুদুটো নিস্তড়িৎ (neutral) এবং অধ্রুবীয় (nonpolar)। এই আধানগুলো ঠিক কিভাবে ছড়িয়ে আছে, তার জন্য বিভিন্ন মডেল হয়। বাঁ দিকে এককালের বোর মডেলের ছবি দেখানো হয়েছে। এটা অনুযায়ী ইলেক্ট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে সূর্যের চারিদিকে গ্রহদের মতো ঘোরে। আর ডানদিকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার (quantum mechanics) তত্ত্ব অনুযায়ী নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেক্ট্রনগুলো মেঘের মত ছড়িয়ে আছে।
কিন্তু তার জন্য দুটো পরমাণুর মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ থাকবে কেন?
একদম ঠিক প্রশ্ন। এই ছবিগুলো দেখলে মনে হবে থাকা উচিত না। দুটো মোটের ওপর নিস্তড়িৎ পরমাণু, যাদের ধনাত্মক-ঋণাত্মক আধানকেন্দ্র দুটোই ঠিক পরমাণুর মধিখ্যানে, তাদের মধ্যে কীভাবে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ থাকতে পারে? কিন্তু বিজ্ঞানীরা অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখলেন যে একটা আকর্ষণ রয়েছে।
কেন রয়েছে, সেই নিয়ে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিজ্ঞানীরা অনেক ভাবলেন। অনেক মডেলও খাড়া করলেন। অবশেষে তারা বুঝতে পারলেন যে এই ঋণাত্মক আধানের বন্টন সময়ের সাপেক্ষে স্থির থাকে না, সময়ের সাথে দ্রুত বদলায় – যাকে বলে আধান ঘনত্বের কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন (quantum fluctuation) আর কী!
বাব্বা! টিকটিকিতেও কোয়ান্টাম?
(হেসে) তা বটে!
তার মানে, ওই সুন্দর ছবিটা, যেখানে ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আধানের কেন্দ্র একদম পরমাণুর ঠিক মাঝের বিন্দুতে, এইটা সবসময় খাটে না, তাই তো?
ঠিক তাই। নিচের ছবিটা দেখো। পরমাণু নিস্তড়িৎ হলেও তার আধানের ঘনত্ব (charge density) সর্বত্র এক থাকে না, ওঠানামা করে। এটাই ফ্লাকচুয়েশন (fluctuation)। এর ফলে মুহূর্তের জন্য ইলেক্ট্রনের আধানকেন্দ্র ও নিউক্লিয়াসের আধানকেন্দ্রের অবস্থানের মধ্যে তফাৎ তৈরী হতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে এই অধ্রুবীয় (nonpolar) পরমাণুটা একটা দ্বিমেরু (dipolar) পরমাণুতে পরিণত হতে পারে।
আচ্ছা পিসো, তাহলে যদি একটা দ্বিমেরু পরমাণু আরেকটা পরমাণুর কাছে আসে, তারা কি একে অপরকে আকর্ষণ করতে পারে ? আর এইটা ওই কি যেন ক্রিয়া বললে, সেইটার কারণ?
হ্যাঁ, কিন্তু কিকরে আকর্ষণের জন্ম হয় বলতো?
ঠিক বলতে পারছি না।
তুমি তো জানোই যে পরমাণুর নিউক্লিয়াস ইলেট্রন মেঘের সাপেক্ষে অনেক ভারী, তাই যা নড়াচড়া করার, ওই ইলেক্ট্রনের মেঘটাই করে। ধরা যাক, একটা তাৎক্ষণিকভাবে দ্বিমেরু হয়ে যাওয়া পরমাণু একটা নিস্তড়িৎ এবং অধ্রুবীয় (nonpolar) পরমাণুর খুব কাছে চলে এলো। তখন এই নিস্তড়িৎ পরমাণুর ঋণাত্মক ইলেক্ট্রন মেঘ অন্যটার ইলেক্ট্রন মেঘকে ঠেলে দূরে পাঠিয়ে দেয়। আর তার ফলে অন্য পরমাণুটিও তাৎক্ষণিক ভাবে আর একটা দ্বিমেরু পরমাণুতে পরিণত হয়। এটাকেই ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক ইনডাকশন (electrostatic induction) বলে। এর ফলে ওরা একে অন্যকে আকর্ষণ করতে পারে। নিচের ছবিটা দেখ, তাহলেই বুঝতে পারবে।
ও আচ্ছা, এবার বুঝেছি। তাহলে দুধরণের আধানের কেন্দ্র সরে গিয়ে একটা দ্বিমেরু (dipole) তৈরী হয় প্রতিটা পরমাণুর মধ্যে। আর, দুটো দ্বিমেরু পরমাণু দুটো চুম্বকের মত বিপরীত মেরুকে নিজের কাছে আকর্ষণ করতেই পারে, তাই না?
ব্রাভো, একদম ঠিক। এর ফলেই দুটো পরমাণুর মধ্যে একটা দুর্বল আকর্ষণ বল তৈরী হয়। এটাই ভ্যান-ডার-ওয়াল বল। তবে এই ফ্লাকচুয়েশনটা, যার জন্য দ্বিমেরু আর আকর্ষণ বল তৈরী হচ্ছে, সেটাও সময়ের সাথে বদলায়। উদ্ভূত আকর্ষণ বল হিসেবে যা পাওয়া যায়, তা আসলে বলের সময়-গড় (time-averaged)। তবে এই ফ্লাকচুয়েশনের মূল কারণটা ধরতে গেলে কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব লাগবে! সে নাহয় এখন থাক।
ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু ওই বিজ্ঞানীর দল টিকটিকির দেওয়ালে আটকে থাকার পিছনে কারণটা টের পেলেন কি করে?
২০০২ সালে এই গবেষক দলটা এই বল নিখুঁতভাবে মাপার [৪] চেষ্টা করেন MEMS (Micro-Electro-Mechanical System) বল সেন্সর দিয়ে। বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তারা বুঝতে পারেন যে টিকটিকিদের দেওয়ালে আটকে থাকার ক্ষেত্রে মূল অবদান হল এই ভ্যান-ডার-ওয়াল আন্তস্ক্রিয়াজনিত বল। তুমি শুনলে অবাক হবে যে প্রথম এই অসাধ্য সাধন করেছিল তোমারই মত একটা হাইস্কুলে পড়া মেয়ে। সেই গল্প শুনতে হলে প্রফেসর ফুলের এই অসাধারণ টেড টক্ ভিডিওটা দেখতে পারো [৫]।
আচ্ছা পিসো, এই ভ্যান-ডার-য়ালস বল নিয়ে আরেকটু বলো। এটা কি শুধু টিকিটিকির পা আর দেওয়ালের মধ্যেই দেখা যায়, না আর কোথাও এর কার্যকারিতা আছে?
খুব ভালো প্রশ্ন। ভ্যান-ডার-ওয়াল বলের স্বাক্ষর অসংখ্য জায়গায় পাওয়া যায়। জলের অণুর হাইড্রোজেন বন্ধনী (বন্ডিং) থেকে শুরু করে ঘর্ষণ বল, সারফেস টেনশন, কৈশিক ধর্ম (ক্যাপিলারি অ্যাকশন) থেকে পেন্সিলের শিষ পর্যন্ত।
পেন্সিলের শিষেও আবার ভ্যান–ডার–ওয়ালস কি করে এলো?
দেখো, আমরা লেখার জন্য যে পেন্সিল ব্যবহার করি, তার শিষ হচ্ছে গ্রাফাইটের তৈরী। এই গ্রাফাইট কিন্তু খুব মজার জিনিস। আমসত্বের একটা ব্লক যেমন অনেক সংখ্যক পাতলা আমসত্বের স্তর একটার উপর আরেকটা চাপিয়ে তৈরী, গ্রাফাইটের একটা ব্লকও ঠিক সেইরকম এক–পরমাণু পুরু কার্বনের অসংখ্য স্তর দিয়ে তৈরী (চিত্র ৫)। কার্বনের এই এক একটা পারমাণবিক চাদরের নামই গ্রাফিন। একটা গ্রাফিন স্তর আর একটা গ্রাফিন স্তরের সঙ্গে সেই ভ্যান-ডার-ওয়ালস বল দিয়েই আলতো ভাবে আটকে থাকে। আমরা যখন পেন্সিলটা কাগজের উপর ঘসি তখন এই গ্রাফিন স্তরগুলো খোলস ছাড়ার মত গ্রাফাইট ছেড়ে উঠে এসে কাগজের গায়ে আটকে যায়, আমরা দেখতে পাই কাগজে পেন্সিলের দাগ। ২০০৩ সালে আন্দ্রে গেইম ও নভোসেলভ একটা সাধারণ সেলোফেন টেপ (যা দিয়ে আমরা গিফট পেপার আটকাই) ব্যবহার করে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতন একটা একটা করে গ্রাফিন স্তর পৃথক করেছিলেন ও তাদের বৈশিষ্ট্য বিচার করেছিলেন। এই আবিষ্কারের জন্য তাঁরা ২০১০ সালে নোবেল প্রাইজ পান। সে গল্প আর একদিন বলা যাবে’খন।
আছে পিসো, এই ভ্যান–ডার–ওয়ালস বল কি এতোটাই শক্তিশালী যে টিকটিকিকে পড়ে যাওয়া থেকে আটকে দেয়?
ভালো প্রশ্ন। টিকটিকির পায়ের গঠনটা আরেকবার মনে করে দেখো। লক্ষ লক্ষ তন্তুর মতো স্প্যাচুলা ওদের পায়ের আঙ্গুলে। একটা একক স্প্যাচুলা এবং পৃষ্ঠতলের মধ্যে প্রায় ০.৪ মাইক্রো-নিউটন [৪] মতো আকর্ষণী ভ্যান-ডার-ওয়ালস বল সৃষ্টি হয়। সেটা এমনকিছু নয়। কিন্তু ওই লক্ষ লক্ষ স্প্যাচুলার সম্মিলিত বল প্রায় ১০ নিউটন বা প্রায় ২.২৫ পাউন্ডের সমান।
তার মানে টিকটিকির এক একটা পা সিলিঙে আটকে থাকলে সেটা থেকে ১ কেজি (৯.৮ নিউটন) ওজন ঝুলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ, এটা হলো ক্ষেত্রফল (surface area) বেশি হওয়ার মজা, কারণ গোটা ক্ষেত্রফল জুড়ে এই ভ্যান-ডার-ওয়ালস বল কাজ করে। সবকটা স্প্যাচুলাকে ধরলে টিকটিকি পায়ের ক্ষেত্রফল প্রায় ১০০ বর্গমিমির কাছাকাছি। তাই সামান্য বলও বেড়ে যায় বহুগুণ।
এরপরের গল্পটা কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতেই পারছো। বিজ্ঞানীরা ভাবতে বসলেন: এমন উপাদান কি কৃত্রিমভাবে তৈরী করা যায় যার এমন ঈর্ষণীয় আটকে থাকার দক্ষতা থাকবে?
কিছু বেরোলো সেই ভাবনা থেকে?
সেই যে আন্দ্রে গেইম আর নভোসেলভ-এর কথা বললাম, গ্রাফিন-এর জন্য যারা নোবেল পেয়েছিলেন, ওনারাই ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গবেষকদের সাথে টিকটিকির পায়ের অনুকরণ করে গেকো টেপ (Gecko Tape) নামে একটা কৃত্রিম উপাদান (চিত্র ৬) তৈরী করতে সফল হন [৬]। টিকটিকির পায়ের উপাদান দিয়ে তৈরী না হলেও গেকো টেপ-এ টিকটিকির পায়ের আঙ্গুলের মতই ন্যানো কাঠামো আছে। এইরকম টেপের প্রস্তুতি প্রক্রিয়ায় অনেক অত্যাধুনিক ন্যানোপ্রযুক্তি পদ্ধতি জড়িত।
তুমি যে স্পাইডারম্যানের কথা বলছিলে, সেটা তাহলে একেবারে কাল্পনিক নয়। এই টেপ মানুষের গ্লাভসে আর জুতোয় পরানো সম্ভব হলে দেখা যাবে হয়তো জলজ্যান্ত মানুষ ঘরের দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছে!
এই তো, ব্রাভো! মাথা খুলছে দেখছি ! দারুণ বলেছো! সে সব বিজ্ঞানীরা কি আর ভাবতে বাকি রেখেছে? রোবটের পায়ে এই গেকো টেপ পরিয়ে বিজ্ঞানীরা বাড়ির ছাদে থাকা সোলার প্যানেল পরিষ্কার করা কিম্বা বড় বড় ভবনের বাইরের দেয়াল পরিষ্কার করার কথাও ভেবে বসে আছে।
এসব তো ভাবনার কথা। কিন্তু আমেরিকার নাসাতে যে পরীক্ষাটা করা হয়েছে তার কথা বলি। ২০১৪ সালে নাসার Space Technology Mission Directorate এর Flight Opportunities Program এর মাধ্যমে একটা মাইক্রোগ্র্যাভিটি ফ্লাইট পরীক্ষায়, টিকটিকির দেওয়াল আঁকড়ে ধরার (gecko-gripping) প্রযুক্তিটা ১০ কিলোগ্রাম কিউব এবং ১০০ কিলোগ্রাম ব্যক্তিকে টেনে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে পরীক্ষা করা হয়েছিল একটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। গেকো টেপ এর আঁকড়ে ধরার ক্ষমতা ৩০,০০০ এরও বেশি বার কৃত্রিমভাবে ‘অন’-‘অফ’ করে দেখা যায় চরম অবস্থা সত্ত্বেও এটার ক্ষমতা বেশ শক্তিশালী ছিল।
শুধু টিকটিকির মত আকঁড়ে ধরাই নয়, সেই ক্ষমতাটাকে আবার অন–অফ ও করা যায়?
হ্যাঁ, এর মানে হল, যে ন্যানোস্ট্রাকচার্ড সাবস্ট্রেট দেওয়ালের সাথে ভ্যান-ডার-ওয়ালস বলের দরুণ আটকে আছে, আণুবীক্ষণিক (microscopic) স্তরে তার গঠন বদলে ফেলা যায়। অনেক রকম আলাদা আলাদা গঠন হয়, যেমন, ফাইবার, মাশরুম টিপস ইত্যাদি। ফলে ন্যানোস্ট্রাকচার আর দেওয়ালের মধ্যে স্পর্শতলের পরিমাণ (surface area) পাল্টে যায়। আর স্পর্শতলের পরিমাণ বদলানো মানেই ভ্যান-ডার-ওয়ালস বলের মানও পাল্টে দেওয়া গেল। এভাবে ঐ আকর্ষণী বলের মান বাড়িয়ে-কমিয়ে আঁকড়ে ধরার ক্ষমতাটা ‘অন’-‘অফ’ করা যেতে পারে।
গবেষকরা সম্প্রতি নিজেদের হাতে তিনটে আকারের “মহাকাশচারী নোঙ্গর” (astronaut anchors) তৈরী করেছেন। একদিন হয়তো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের ভিতরে মহাকাশচারীদের এই নোঙ্গর দেওয়া হতে পারে। [৭]
সে কি বলছো পিসো! নাসা আবার এত সব পরীক্ষাও করে ফেলেছে!
তাহলে আর বলছি কি! আরো কতকি পরীক্ষা চলছে! যেমন সেই বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট ফুলের দল আর একটা সুন্দর কাজ করে ফেলেছে। এটা প্রকাশিত হয়েছে Proceedings of the Royal Society B এর ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে [১০]। সাথে চীনের Nanjing University of Aeronautics and Astronautics এর গবেষকরাও যুক্ত আছে। আগের কাজে রবার্ট ফুল দেখিয়েছিলেন যে, টিকটিকির পায়ের আঙ্গুলগুলো পৃষ্ঠের মসৃণতম অংশে লেগে থাকতে পারে। আন্তঃআণবিক বলের উপর নির্ভর করে নতুন ধরনের আকর্ষণ ক্রিয়ার সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করেন। কিন্তু আঁকড়ে ধরা নাহয় হলো, তবে চলার সময়ে পায়ের আঙ্গুলগুলো কিভাবে এগোতে সাহায্য করে, সেটা সত্যি এখনও একটা ধাঁধা [৯-১০]।
যাইহোক এই গবেষণায় দেখা গেল টিকটিকির পায়ের আঙ্গুলগুলো কেবল এক দিকে লেগে থাকে। এক দিকে যখন তারা দেওয়ালের পৃষ্ঠতল ধরে, বিপরীত দিকে দেওয়ালের দখল তারা তখন ছেড়ে দেয়। ই. সং (Yi Song) নামের একজন বিজ্ঞানী একটা উল্লম্ব প্রাচীরের একপাশ থেকে অন্য পাশ বরাবর টিকটিকিগুলিকে চালিয়ে উচ্চ গতির ভিডিও রেকর্ডিং করছিলেন। উদ্দেশ্য, তাদের পায়ের আঙ্গুলের অভিমুখিতা লক্ষ্য করা। ‘হতাশ’ অভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন (frustrated total internal reflection = FTIR ) নামে একটা কৌশল ব্যবহার করে [৮], তিনি প্রতিটা পায়ের আঙ্গুলের সাথে তলের স্পর্শজনিত ক্ষেত্রফল পরিমাপ করেছিলেন। ঐ ব্যবস্থায়, যখন তারা একটা পৃষ্ঠ স্পর্শ করছিল, পায়ের আঙ্গুলগুলো আলোকিত হচ্ছিল।
এতো ছোট ছোট বিষয় থেকে গবেষণা যে এই স্তরে পৌঁছুতে পারে, তুমি এতো কিছু খুলে না বললে জানতে পারতাম না পিসো।
তাই তো তোমাকে বলি, প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনা যত ছোট হোক না কেন, তা নিয়ে লেগে পড়ো চিন্তা ভাবনা করতে। তারপর একটু যন্ত্রপাতিতে হাত লাগিয়ে কতটা যাচাই করতে পারো দেখো। তুমি ভাবতেও পারবে না কত নতুন নতুন সত্য তোমার হাতে এসে ধরা দেবে। তখনি পাবে তুমি গবেষণার আসল মজা।
মাথায় রাখবো পিসো। একটু মজা করি এবার। টিকটিকির ঘুরে বাড়ানোর ক্ষেত্রে এমন রহস্য আছে বলে কি রহস্যপ্রিয় গোয়েন্দাদের টিকটিকি বলা হয়? যাই হোক, পড়া আছে এখন। আজ বেরোলাম। তোমরা সাবধানে থেকো।
এই বলেই রুমেলি গাত্রোত্থান করলো। বন্ধুদের সঙ্গে আজ অনেক নতুন জানা তথ্য শেয়ার করতে হবে তো!
প্রচ্ছদের ছবি: PixaBay
তথ্যসূত্র:
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/quantum-lizard