21-11-2024 08:43:56 am
Link: https://bigyan.org.in/pollution
জগন্নাথদা গত শনিবার সকালে ফোন করেছিল। তিন বছর হয়ে গেল জগন্নাথদার সঙ্গে পরিচয়। বরাবর বেশ শান্ত স্বভাব আর ব্যক্তিত্বপূর্ণ হাবভাব। আজ কেন জানি না বেশ ক্ষিপ্ত মনে হল। ফোন তুলে বললাম “কি খবর জগন্নাথদা, এতদিন পর ফোন করলে?”
এতদিন ফোন না করার জন্য কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া তো দূরে থাক, জগাদাকে বেশ রাগী শোনালো, “এখানে মানুষ বাস করে? এরা মানুষ? তুই বল শান্তনু।”
“কেন, কি হয়েছে জগাদা? কাদের কথা বলছ?”
“দেশটা নরকে পরিণত হতে চলেছে আর এরা কিনা মোচ্ছব করছে। এতদিন ধরে বলছি যে বিটি রোডের ধারে এই জঞ্জাল এখুনি পরিষ্কার করা দরকার অথচ শুনছেই না কেউ।” জগাদার গলা দিয়ে হতাশা আর রাগ দুটোই ঝরে পড়ছিল।
তক্ষুনি বুঝলাম জগাদা কি বলতে চাইছে। দীপঙ্করের সাথে ক’দিন আগে যখন দেখা হলো তখন ও বলছিল যে জগাদা রীতিমত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছে স্থানীয় পুরপারিষদকে এই বিষয় নিয়ে। দুর্ভাগ্য এই যে তিনি জগাদার কথা বিশেষ কানে তোলেননি। নেহাৎ জগাদাকে লোকজন শ্রদ্ধা করে বলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেন নি। জগাদার কথা শুনে মনে হলো আমাদের সঙ্গে একটু কথা বলে হালকা হতে চাইছে। “আমাদের” বললাম কারণ আমি জানি ও খালি আমাকেই ফোন করবে না, একে একে দীপঙ্কর, বিশ্বজিৎ, চন্দন সবাইকেই বলবে একই কথা। বিকেলবেলা সবাই মিলে চলে গেলাম জগাদার বাড়ি।
সবাই মিলে চা খাচ্ছি, এমন সময় জগাদা আসল কথাটা তুলল।
“বিটি রোডের ওপর দিয়ে তোরা এলি, আশেপাশে তাকাস নি?” জগাদার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি একে একে আমার, দীপুর আর বিশুর ওপর পড়ল। আমরা সবাই মাথা নাড়ালাম।
“সত্যিই কি অবস্থা, এই জঞ্জাল থেকে কি পরিমাণ দূষণ ছড়াচ্ছে তার ঠিক নেই। এর মধ্যে পুরসভা জঞ্জাল পরিষ্কার না করে পুড়িয়ে দিচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া বাতাসে ছড়াচ্ছে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের কণাকার পদার্থ (particulate matter), যা আমাদের ফুসফুসের নানা অসুখের কারণ। এরকম পরিবেশে থাকলে ধূমপান করো আর নাই করো, ক্যান্সার হবেই আমাদের।” এক নিশ্বাসে নির্মম সত্যটা বলে গেল বিশু১।
“তোদের যদি জিগ্যেস করি বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর কোনটা তাহলে কি বলবি?” জগাদা প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল আমাদের দিকে।
“বেইজিঙ নিশ্চয়।” আমি বলে উঠলাম।
“তোর মত অনেকেই হয়ত বলবে বেইজিঙের কথা। বাস্তবে দিল্লি বহু মাপনীতেই বেইজিঙকে পিছনে ফেলে দিয়েছে।২ শুধু যদি বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার পরিমাণ দেখিস তাহলে দিল্লি কমপক্ষে প্রায় ৩ গুণ আগে।” বলতে বলতে জগাদা উঠে পড়ল। নিয়ে এলো ওর একটা ডায়েরি। নানারকম আঁকিবুকি কাটে এখানে। জগাদার কাছে যা শুনলাম তার সবকিছু এখন ঠিক মনে নেই তবে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সংরক্ষণ সূচক ওয়েবসাইট থেকে পেয়ে গেলাম তার অনেকটাই (নিচে ছবি দেওয়া হলো সেখান থেকেই)।৩ দিল্লির বাতাসে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের কণাকার পদার্থ গ্রহণযোগ্য মাত্রার (৪০ – ৭০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার) থেকে প্রায় ৭ গুণ বেশি। এছাড়া নিচের ছবিটা থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার যে দিল্লির বাতাসের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় এবং এখনি ব্যবস্থা না নিলে দিল্লিবাসী ভীষণ অসুস্থ হবেন ভবিষ্যতে। এভাবে চললে দিল্লি হয়ত আর বাসযোগ্য থাকবেও না। সত্যি কথা বলতে এখনই দিল্লি আর বাসযোগ্য নেই, অন্তত শীতকালে তো বটেই।
“আমাদের মুখে দিল্লির নিন্দামন্দ শুনে যদি কোনো কলকাতাবাসী ভাবেন যে তিনি স্বর্গে আছেন তাহলে মারাত্মক ভুল করবেন। গাড়ির ধোঁয়া থেকে প্রচণ্ড দূষণ তো হচ্ছেই, তার ওপর জগাদা যা নিয়ে এত চেঁচামেচি করলো সেই জঞ্জাল পোড়ানো কলকাতায় বেড়েই চলছে।” বিশু বলে চলল। জগাদাকে দেখলাম বেশ জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বিশুকে সমর্থন করলো। পরে বাড়ি এসে একটু ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম সত্যি কলকাতার অবস্থা কি রকম। এমনিতেই রাস্তায় বেরোলেই বোঝা যায় কলকাতার বাতাস কতটা দূষিত। বিশেষ করে শীতকালে কলকাতার আকাশ সর্বক্ষণের জন্য ধোঁয়াশায় ঢেকেই থাকে। কলকাতাকে অনেক পরিবেশবিদ সবচেয়ে দূষিত বলে ঘোষণা তো করেই দিয়েছেন। দুর্গাপুর, আসানসোল, হাওড়ার মত শিল্পাঞ্চলগুলোর বাতাসের মানও বেশ খারাপ।৪ বিশ্বের বহু শহরের তুলনায় কলকাতার মানুষ ফুসফুসের রোগে ভুগছেও অনেক বেশি।৫
“শুধু এখানকার পুরসভাকে দোষ দিলেও চলবে না, সরকারই বা কি করছে?” জগাদার গলায় ঝাঁঝ।
চন্দন বলে উঠলো, “দিল্লিতে তাও তো কিছুটা গাড়িদূষণ রোধ করার একটা চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু সরকার কবে একটা কড়া আইন বানাবে? ভারত ৪–এর মানদণ্ড৬ মেনে যে গাড়ি চালাবে না তাকেই কড়া শাস্তি পেতে হবে আর যারা মেনে চলবে তাদের পুরস্কার দিতে হবে। এখনো কলকাতায় কত বাস, ট্যাক্সি চলছে মিশকালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে।”
“অথচ এমন তো নয় যে চেষ্টা করলে অবস্থা পাল্টানো যায় না। দিল্লিতে জোড়–বিজোড় গাড়ির নীতি৭ চালু করে ইতিমধ্যেই কিন্তু কিছু ফল পাওয়া যাচ্ছে মনে হচ্ছে।৮” বিশু আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করলো।
আমি একটু সন্দিহান ব্যাপারটায়, তাই বললাম, “সেটা অবশ্য এখনি নিশ্চিত ভাবে বলা মুশকিল কারণ আমাদের দেশের মানুষ গাড়িদূষণ না করতে পারলে অন্য কিছু করে ঠিক আশ মিটিয়ে নেবে। বিক্ষোভ মিছিলে টায়ার পুড়িয়ে যে কি আনন্দ পায়, দেখিস নি? তবে দিল্লিতে মানুষ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে বলেই তো মনে হচ্ছে।৯”
এবার জগাদার ইতিহাস জ্ঞানের আর একটা নিদর্শন পেলাম। “নিক্সনকে যতই লোকজন ঘৃণার চোখে দেখুক না কেন, একটা ভালো কাজ উনি করেছিলেন। আমেরিকার নির্মল বায়ু আইন (clean air act) তিনিই পাশ করান সেই সত্তরের দশকে আর আজ দ্যাখ মার্কিন দেশের শহরগুলোর বাতাস অনেকটাই পরিষ্কার। অথচ একটা সময় আমেরিকার অনেক শহর আজকের দিল্লি বা বেইজিঙের মতই ধোঁয়াশায় ঢাকা থাকত।১০ ভারত সরকার গাড়ির ধোঁয়া থেকে দূষণ রোধ করার জন্য যে মাপকাঠি ঠিক করেছে সেটা কিন্তু যথেষ্ট কঠোর, বস্তুত ইউরোপের মাপকাঠির থেকেই অনুপ্রেরিত। এটাই যদি সঠিকভাবে সরকার প্রয়োগ করে তাহলেই সমস্যা অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব।১১
“আচ্ছা জগাদা, একটা কথা বলো যে পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে দূষণ নিয়ে গবেষণা এবং নীতি প্রণয়ন নিয়ে কাজ হয় সেভাবে ভারতে কি হয় আদৌ?” চন্দন আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জিগ্যেস করলো।
“চেষ্টা হয়। তবে কি জানিস তো, পরিচালনার কিছু সীমাবদ্ধতা, আর্থিক বাধা এসব কাটিয়ে খুব ভালো গবেষণা করা হয়ে ওঠে না এদেশে। এর মধ্যে আইআইটিগুলো কিছুটা উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি আইআইটি কানপুরের নেতৃত্বে তৈরি করা হয়েছে ভারতের নিজস্ব বায়ুদূষণ সূচক (National Air Quality Index, NAQI) কিন্তু এখনো বিষয়গুলো নিয়ে তেমন স্বচ্ছতা নেই তাই অনেক প্রশ্নচিহ্ন থেকে যাচ্ছে।১২ চীনে ওদের নিজস্ব সূচক তৈরি হয়েছে বেশ কয়েক বছর হলো।১৩ ওরা যথেষ্ট ভালোভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দিচ্ছে যেটা আমাদেরও করতেই হবে নাহলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা আসবে না। এর জন্যে বেসরকারি উদ্যোগেরও ভীষণ দরকার। এই জায়গায় আমরা একেবারেই যথেষ্ট এগোতে পারছি না। কলকাতাতেই দূষণ পরিমাপের যন্ত্র নেই যথেষ্ট, থাকলেও সেগুলো বিকল হয়ে পড়ে থাকে।১৪ অনেক তথ্যই পাওয়া যায় মার্কিন দূতাবাসের কাছ থেকে।১৫” একনাগাড়ে বলে গেল জগাদা।
আমার এক বন্ধু সম্প্রতি চাকরি পেয়েছে পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিকাল মেটিওরোলজিতে (Indian Institute of Tropical Meteorology, IITM Pune), তাই ওদের কাজ সম্পর্কে একটু জানতাম। সেই সদ্যলব্ধ জ্ঞান বিনামূল্যে বিতরণ করে দিলাম এই সুযোগে।
“তোমরা সফর (SAFAR) বলে কোনো উদ্যোগ শুনেছ কিনা জানি না তবে পুণের আইআইটিএম (IITM) এই ব্যাপারে গবেষণা করছে যার নাম দিয়েছে সফর এবং ওরা পুণে, মুম্বইয়ের আশেপাশে বায়ুদূষণের ওপর নজর রাখছে।১৬”
“সে তো পশ্চিমবঙ্গেও সরকারের এরকম ব্যবস্থা আছে কিন্তু আরও যন্ত্র বসানো খুব জরুরি। শুধু তাই নয়, সাধারণ মানুষকে সর্বক্ষণ জানানোটাও খুব দরকার।১৭” জগাদার কাছে সব খবরই আছে বুঝলাম। তবে জগাদা ছাড়া আর কেউ জানত না সেটা বুঝতে পেরে একটু গর্বিত হলাম মনে মনে।
“কবে কলকাতার আকাশ ঘন নীল দেখব জগাদা? কবে আমরা সবাই পরিবেশ সচেতন হব?” চন্দন নিরাশভাবে প্রশ্ন করলো।
“হবে হয়ত কোনদিন,, আমি দেখে যেতে পারব না বোধহয়।” জগাদার হতাশা ঝরে পড়ল।
কথাটা আমাদের কারোর ভালো লাগলো না, কিন্তু কেউ কিছু বললাম না। হয়ত আমরাও ভাবছি যে আমাদের মৃত্যুর আগেও হবে কিনা।
লেখার উৎস:
[১] কণাকার পদার্থ সম্পর্কে চট করে জেনে নিন: https://youtu.be/nnoGUVBUiGM
[২] https://www.weforum.org/agenda/2015/06/which-is-the-worlds-most-polluted-city/
[৩] ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ: https://epi.yale.edu/country/india
[৫] https://www.theicct.org/sites/default/files/MRay_0.pdf
[৬] https://en.wikipedia.org/wiki/Bharat_Stage_emission_standards
[৭] https://en.wikipedia.org/wiki/Road_space_rationing#New_Delhi
[৮] https://epic.uchicago.edu/news-events/news/yes-delhi-it-worked
[১০] https://epic.uchicago.edu/news-events/news/infographic-cleaner-air-longer-lives
[১১] https://cpcb.nic.in/Vehicular_Exhaust.php
[১২] https://cpcb.nic.in/National_Ambient_Air_Quality_Standards.php
[১৩] চীনা উদ্যোগ যা ভারতের কণাকার পদার্থের হিসেবও রাখছে: https://aqicn.org/map/india/
[১৫] https://kolkata.usconsulate.gov/airqualitydataemb.html
[১৬] https://safar.tropmet.res.in/AQI-47-12-Details
[১৭] https://emis.wbpcb.gov.in/airquality/showprevdata.do
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/pollution