05-11-2024 04:05:24 am
Link: https://bigyan.org.in/plasma-from-kitchen-microwave
সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড ইস্টার্ন শোর-এর কিছু গবেষক একটা মাইক্রোওয়েভ-এর মধ্যে পদার্থের প্লাজমা অবস্থাকে ধরাশায়ী করলেন। তাঁরা কিভাবে করলেন এই কাণ্ড?
কঠিন, তরল, গ্যাস — ইস্কুলের পাঠ্যক্রমে পদার্থের এই তিনটে অবস্থার সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। এই তিন অবস্থার নমুনা আমাদের সর্বত্র রয়েছে। যখন যেমন প্রয়োজন, তিনটে অবস্থাকেই ধরাশায়ী করা যায় এবং পরীক্ষায় ফেলা যায়। কিন্তু এর বাইরেও পদার্থের একটা চতুর্থ অবস্থা হয়। সচরাচর তার কথা আমরা শুনি না। কারণ পৃথিবীতে কোনো পদার্থকে স্বাভাবিকভাবে এই অবস্থায় পাওয়া যায়না।
এই অবস্থার নাম প্লাজমা। যেভাবে কঠিন থেকে তরল হয় এবং তরল থেকে গ্যাস, সেই দিকে আরো এগোতে থাকলেই একসময় পদার্থের এই অবস্থা তৈরী হয়। কঠিন বস্তুকে তরল অবস্থাতে নিয়ে যেতে গেলে বাইরে থেকে শক্তি সরবরাহ করতে হয়, সাধারণত তাপ শক্তির মাধ্যমে। গলনাঙ্কে পৌছলে এই শক্তি কঠিন পদার্থের মধ্যে আন্তরাণবিক বন্ধনগুলো পট পট করে ভেঙে দেয়। আর যেহেতু এই যোগান দেওয়া শক্তির পুরোটাই এই বন্ধন ভাঙতে ব্যবহার হয়ে যায়, পুরো অবস্থার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত বস্তুর তাপমাত্রা আর বাড়ে না। অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেলে অণু /পরমাণুগুলো একটু শিথিল হয়ে ঘোরাফেরা করতে পারে। সেই অবস্থাকেই তরল বলি। একইভাবে তরল থেকে গ্যাস অবস্থার পরিবর্তনও শক্তি সরবরাহের ফলেই সম্ভব হয়।
প্লাজমাও ঐভাবেই আসে। যদি আমরা গ্যাসে আরো শক্তি সরবরাহ করে যাই, তাহলে এক সময় অণুপরমাণুর ইলেক্ট্রনগুলো সেই শক্তি নিয়ে নিউক্লিয়াস-এর বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আধান (charge) তৈরী হয়। এই ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আধানগুলো যদি আবার তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের (electromagnetic field) মধ্যে থাকে তাহলে তড়িৎক্ষেত্রের প্রভাবে সেগুলোর ভরবেগ বাড়তে থাকে ও সেগুলো অন্যান্য অণু পরমাণুর উপর আছড়ে পড়ে। সেখান থেকে আরো ইলেক্ট্রন বেরিয়ে আসে। এগুলোকে দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত ইলেক্ট্রন বলে। এই দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত ইলেক্ট্রনগুলোও আবার গতিসঞ্চার করে আছড়ে পড়ে তৃতীয় পর্যায়ভুক্ত ইলেক্ট্রন তৈরী করে। এটাকেই টাউনসেন্ড ধ্বস (Townsend discharge) নামা বলে। এই ধ্বস নামার ফলে হুড় হুড় করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সমস্ত গ্যাস ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আধানের স্যুপে পরিণত হয়। এটাই প্লাজমা। যেহেতু পদার্থের তৃতীয় অবস্থার উপর শক্তি সরবরাহের ফলে এই নতুন অবস্থা তৈরী হয়, যার চরিত্র অন্য তিন অবস্থার থেকে আলাদা, প্লাজমাকে আমরা পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলি।
প্লাজমা তৈরীর হ্যাপা
এমন দানবিক শক্তি যা অণুর থেকে ইলেক্ট্রনকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়: এতো শক্তির যোগান হয় কোত্থেকে? এক হয় সূর্য এবং অন্যসকল নক্ষত্রের মধ্যে। অত্যধিক তাপমাত্রার ফলে সমস্ত পদার্থই সেখানে প্লাজমা অবস্থায় থাকে। কিন্তু পৃথিবীর ওপর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্লাজমা তৈরী হওয়া একটা বিরল ঘটনা। যেমন, বিদ্যুৎ চমকালে ক্ষণিকের জন্য বাতাসের অণুগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে প্লাজমা অবস্থার সৃষ্টি হয়।
কিন্তু গত একশো বছর ধরে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে পদার্থের এই অবস্থা তৈরী করে আসছেন। কখনো তারা প্লাজমাকে কাজে লাগাচ্ছেন আলোর উৎস হিসেবে (নিওন আলো আদতে প্লাজমা), আবার কখনো প্লাজমা ব্যবহার করে বিভিন্ন বস্তুর উপরিতলের চরিত্র পাল্টে ফেলা হচ্ছে।
যেহেতু প্লাজমা সৃষ্টি করা এবং সামলানো বেশ দুরূহ কাজ, তাই কারখানার যন্ত্রপাতি বা বিশেষ কিছু গবেষণাগারের বাইরে এর প্রচলন হয়নি। এই যখন অবস্থা, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইস্টার্ন শোর) কৌশিক দাস ও তার সহকর্মীরা মাঠে নামলেন। রান্নাঘরের মাইক্রোওয়েভ-এ বানিয়ে ফেললেন পদার্থের প্লাজমা অবস্থা। এই আবিষ্কারের ফলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটা দিগন্ত খুলে গেল বলা যায়। সুলভে প্লাজমা অবস্থার ওপর পরীক্ষা করা এখন অনেকের নাগালের মধ্যে এসে গেল। কি জানি, হয়তো পদার্থের এই অবস্থার অনেক নতুন প্রয়োগ বেরোবে এবার।
সুলভে প্লাজমা
আগেই যেটা বললাম, প্লাজমা তৈরী করতে বিপুল শক্তির তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনের ধ্বস নামাতে হয়। কৌশিক দাস এবং সহকর্মীরা এইটাই একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেনের মধ্যে সম্পন্ন করেছেন। মাইক্রোওয়েভ ছাড়াও প্রয়োজন হয়েছিল একটা সস্তার কাঁচের ফ্লাস্ক যাতে মোটামুটি ভ্যাকুয়াম-এর কাছাকাছি অবস্থা সীল করে ধরে রাখা যায়।
একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন-এ একটা দীর্ঘ তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরী হয়, ১২ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি। এই তরঙ্গের উপস্থিতিতে কোনো দ্বিমেরু অণু (polar molecule) থাকলে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। দ্বিমেরু অণু অর্থে এমন অণু যাতে ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আধান কেন্দ্র আলাদা আলাদা হয়ে দুই ধারে সরে গেছে।
যেমন, জলের অণু। একটা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গে তড়িৎ-ক্ষেত্রের (electric field) দিশা সময়ের সাথে পরিবর্তন হতে থাকে: একটা আধানযুক্ত কণা থাকলে তাকে এই দূরে ঠেলবে তো এই কাছে টানবে। একটা গোটা জলের অণু আধানযুক্ত নয় কিন্তু বিপরীত আধানের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে (অর্থাৎ দ্বিমেরু)। একটা স্থির তড়িৎ-ক্ষেত্রে এই ধরণের দ্বিমেরু অণুরা ক্ষেত্রের দিশার সাথে লম্বালম্বিভাবে নিজেদের সাজায়। কিন্তু সেই দিশাই যখন স্থির নয়, তখন সেই চেষ্টা বৃথা। তড়িৎ-ক্ষেত্রের দিশাকে ধাওয়া করতে গিয়ে জলের অণু অনন্তকাল চড়কিপাক খায়।
বা চড়কিপাক খেত যদি না অন্যান্য জলের অণুর সাথে ঠোকাঠুকি লাগতো। এই ঠোকাঠুকিতে কিছুটা দম হারিয়ে ফেলে তারা। কিন্তু জলের অণুর সংখ্যা কমিয়ে ঠোকাঠুকির সম্ভাবনা নামিয়ে দিলে এক একটা অণুর ঘূর্ণনগতি রাতারাতি বাড়িয়ে দেওয়া যায়। এক সময় ঘূর্ণনশক্তি এতটাই বেড়ে যায় যে অন্য অণুর সাথে ধাক্কা লাগলে সেই অণুর থেকে ইলেক্ট্রন ছিটকে বেরিয়ে আসে। সৃষ্টি হয় প্লাজমা-র।
অণুর সংখ্যা কমাতে বিজ্ঞানীরা ফ্লাস্ক থেকে হাওয়া বার করতে থাকলেন। যে গ্যাসটা পড়ে থাকে, তা মূলত নাইট্রোজেন আর অক্সিজেন সম্পন্ন হলেও জলের অণু গুটিকয়েক থাকে। এই ফ্লাস্কটা মাইক্রোওয়েভ-এ ঢুকিয়ে চালু করে দেওয়া হলো। যদি সঠিক বায়ুচাপ তৈরী হয়ে থাকে অর্থাৎ অণুর সংখ্যা যদি যথেষ্ট কমে থাকে, তাহলে কাঙ্খিত ঘটনাবলী ঘটবে। মাইক্রোওয়েভ-এর তড়িৎ-ক্ষেত্রে দ্বিমেরু জলের অণু ঘুরতে থাকবে, তার গতিশক্তি কিছুটা নাইট্রোজেন অণুতে পরিচালিত হবে এবং ইলেক্ট্রন-এর ধ্বস নামবে।
এই পদ্ধতিতে তৈরী হওয়া প্লাজমা একটা হালকা নীল আলোর মাধ্যমে তার উপস্থিতি জানান দেয়। সেটা কয়েক সেকেন্ড-এর জন্য। এই নীল আলো নাইট্রোজেন প্লাজমার লক্ষণ। এরপর অক্সিজেন অণু থেকে ইলেক্ট্রন বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। এর ফলে খুব তাড়াতাড়ি নীল আলো বেগুনিতে পরিবর্তিত হয়। বেগুনি আলো অক্সিজেন প্লাজমার চরিত্রগত সাক্ষর বহন করে।
পুরো পদ্ধতিটা নিচের এই ভিডিও থেকে দেখতে পাবে।
ফ্লাস্ক-এ বায়ুচাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করার পর একসময় বিজ্ঞানীরা এই আলো দেখতে পেলেন। বায়ুচাপটা কিন্তু সঠিক হওয়া জরুরি। কারণ খেয়াল করো, কথাচ্ছলে দুটো উল্টো কারণের কথা বলেছি আমরা। বায়ুচাপ অর্থাৎ অণুর সংখ্যা কম হতে হবে যাতে গাদাগাদি না হয়। জলের অণুর যেন গতিবৃদ্ধির জায়গা থাকে, অন্যান্য অণুর সাথে ঠোকাঠুকি যেন তাতে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। আবার এই ঠোকাঠুকির মাধ্যমেই তো ধ্বস নামে। তাই অণুর সংখ্যা এতো কম হলেও চলবে না যে সেই ধ্বস একেবারেই না হয়। বিজ্ঞানীরা লিখেছেন যে এই দুটো অবস্থার মাঝামাঝি বায়ুচাপে প্লাজমা তৈরী সম্ভব।
প্লাজমার ম্যাজিক
এখানেই শেষ নয়। প্লাজমা-র মাধ্যমে যেসব কাণ্ডকারখানা ঘটানো গেছে বিশেষ ল্যাবরেটরিতে, সেটা এই মাইক্রোওয়েভ ওভেন-এ তৈরী প্লাজমাতেও যে করা সম্ভব, সেটা দেখালেন বিজ্ঞানীরা। পলি-ডাইমিথাইলসিলক্সেন বা PDMS নামে একটা পলিমার-এর উপরিতলের চরিত্র পাল্টে ফেলা গেল প্লাজমা-র সাহায্যে।
সাধারণত PDMS জলের বন্ধু (hydrophillic)। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড প্লাজমার ভিতর রাখলেই সে জলকাতর (hydrophobic) হয়ে পড়ে। এই বিশেষ চরিত্রের একটা পরিমাপও রয়েছে। এক ফোঁটা জল পলিমার-এর ওপর ফেললে জলের ফোঁটার সাথে পলিমার-এর উপরিতলের কোণ মাপা যায়। প্লাজমা-র সংস্পর্শে আসার আগে এই কোণের মান ৬৪ ডিগ্রী। আর পরে ১৩৪ ডিগ্রী। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, মাইক্রোওয়েভ প্লাজমার আধানযুক্ত আয়নগুলো পলিমার-এর মধ্যে গেঁথে যায় এবং সাথে সাথে পলিমারের মধ্যে যে জলের কণা আছে তাদেরকে উত্তপ্তও করে। এই দু-এর প্রভাব পলিমারকে জলকাতর বানিয়ে দেয়।
এরকম আরো কয়েকটা ভেলকি দেখানো যায় প্লাজমার সাহায্যে। বিভিন্ন বস্তুর উপরিতলকে আঠালো করে দেওয়া যায়, এমনকি তার বিদ্যুৎপ্রবাহ ক্ষমতার পরিবর্তন করা যায়।
আর এসব করতে এখন লাগবে শুধু রান্নাঘরের মাইক্রোওয়েভ ওভেন। অতএব ইস্কুলের ল্যাবরেটরিতে কিংবা ঘরের মধ্যেও প্লাজমা নিয়ে নাড়াচাড়া করা সম্ভব হবে, এমনই আশা করছেন গবেষকরা।
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/plasma-from-kitchen-microwave