21-12-2024 12:09:45 pm
Link: https://bigyan.org.in/neutrino-open-questions-applications
রাজীবুল (bigyan.org.in): আচ্ছা বাসুদা, নিউট্রিনোর বিষয়ে এখন যেসব গবেষণা হচ্ছে, তার মধ্যে থেকে দু-একটা মূল প্রশ্নের উদাহরণ দাও। বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনো-সংক্রান্ত কোন বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছেন?
আচ্ছা। আমি তাহলে তোমাদের নিউট্রিনো নিয়ে গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ দুটো প্রশ্ন নিয়ে বলি।
প্রথমটা হচ্ছে এইরকম — নিউট্রিনোর যে দোলন (oscillation) দেখা যায় তা থেকে জানা যায় নিউট্রিনোর ভর আছে [1]। আমি আগে বলেছিলাম, তিন ধরনের নিউট্রিনো আছে — ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন নিউট্রিনো, টাউ নিউট্রিনো। যেহেতু তিন ধরনের নিউট্রিনো, তাই তিন ধরনের ভর থাকার কথা। যে-কোনো এক ধরনের নিউট্রিনোর পৃথকভাবে কোনো ভর হয় না; এর পেছনে কোয়ান্টাম মেকানিক্স রয়েছে [2]। এখন, এই যে তিনটে ভর, এদের মধ্যে অন্তত দুটো ভর শূন্য নয়, এতদিন পর্যন্ত এটা আমরা জানতে পেরেছি। যে বড় প্রশ্নটা রয়ে গেছে, সেটা হচ্ছে, এই ভরটা কী করে এলো?
যারা পদার্থবিদ্যা নিয়ে একটু চর্চা করেছে তারা জানবে যে অনেক কিছুরই ভর আসে হিগস পদ্ধতিতে [3]। মোটামুটি বছর দশেক আগে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে (LHC) করা পরীক্ষা থেকে জানা যায় যে হিগস কণার সাথে অন্য কণার পারস্পরিক ক্রিয়ার (interaction) ফলে কোনো বস্তুতে ভরের উৎপত্তি হয় [4]।
কিন্তু নিউট্রিনোর ক্ষেত্রে সেটা নাও হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরেকটা কণার কথা বলি যার ভর হিগস পদ্ধতিতে আসে না, সেটা হল প্রোটন। প্রোটনের ভর আসে সবল মিথস্ক্রিয়া (strong interaction) থেকে। এছাড়াও এই বিষয়ে আরো বেশ কিছু খুঁটিনাটি আছে। বৈজ্ঞানিক ভাষায় বললে, নিউট্রিনোটা ডিরাক নিউট্রিনো না মায়োরানা নিউট্রিনো, তার উত্তর এখনো জানা নেই [5]। এইগুলো জানতে বড় বড় গবেষণা চলছে এখনো।
নিউট্রিনোর ভর এবং দোলনের প্রবণতা কিছু মৌলিক প্যারামিটার দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়। সেই প্যারামিটারগুলির পরিমাপ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। এর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার যেটা এখনো একেবারেই জানা যায়নি সেটা হলো নিউট্রিনোর আধান-সমতা লঙ্ঘন (charge-parity violation বা CP violation) হয় কি না।
এই CP violation ব্যাপারটা নিয়ে একটু বলি। ধরা যাক, একটা প্রক্রিয়া সময়ের সাথে যেভাবে এগোচ্ছে, আরেকটা প্রক্রিয়া সেইভাবেই পিছিয়ে যাচ্ছে। কোনো ভিডিও-কে শেষের থেকে শুরুর দিকে চালিয়ে দিলে যেমন হয়। সাধারণত কণাবিদ্যায় কোনো প্রক্রিয়াকে যদি সময়ের সাপেক্ষে সামনের দিকে বা পিছনের দিকে দেখা হয় তাহলে দুটোতে কোনো তফাৎ থাকে না। যদি তফাৎ থাকে, তাহলে সেটাকে CP violation বলে। নিউট্রিনোর পারস্পরিক ক্রিয়ায় CP violation আছে কি না সেটা আমরা এখনো জানি না। এটা আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে চাইবো।
আমার ভালো লাগে যে কণাবিদ্যা বা এই সমস্ত মৌলিক বিষয় নিয়ে যারা গবেষণা করো, তোমরা অনেক গভীর প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করো। সেগুলো আদৌ যে প্রশ্ন হতে পারে, সেটা যারা এ বিষয়ে গবেষণা করে না, তাদের কাছে অবাক করার মতো।
যেমন প্রোটনের আর ইলেক্ট্রনের ভর আছে সেটা আমরা জানি। এখন বললে যে নিউট্রিনোরও খুব ছোট হলেও ভর আছে। কিন্তু তোমরা ভাবছো, সেই ভর কোথা এলো। প্রোটনের যে ভর নাও থাকতে পারতো, থাকলে কেন আছে, এবং বিভিন্ন ধরনের কণার জন্য যে ভরের উৎসটা আলাদা, সেটা নিয়েও তোমরা ভাবনা চিন্তা করছো। এটা খুবই অবাক করার মতো। মানুষের প্রকৃতিকে জানার এবং বোঝার কৌতূহল কোন জায়গায় যেতে পারে তা ভেবে সত্যিই ভালো লাগলো।
নিউট্রিনোর ভর ইত্যাদি নিয়ে এক ধরনের গবেষণার কথা বললে। নিউট্রিনোর বিষয়ে আর কী ধরনের গবেষণা হচ্ছে সেটা তুমি বলো।
জ্যোতির্বিদ্যায় কি নিউট্রিনোর ব্যবহার করা যায় — এটা একটা বড় প্রশ্ন। মানে ধরো, আমরা যদি আরো বড় শনাক্তকারী যন্ত্র ব্যবহার করি, তাহলে আরো অনেক বেশি নিউট্রিনো পাওয়া যাবে। সেটা দিয়ে মহাবিশ্বের ছবি তোলা যায় না [6]? এটা একটা বড় প্রশ্ন এখন, এবং লোকে এইটা করার চেষ্টা করছে।
সেটা কীভাবে কাজ করবে, একটু বলি। আইস কিউব বলে যে পরীক্ষাগারটি আন্টার্কটিকায় তৈরি করা হয়েছে তাতে প্রায় 2.5 কিলোমিটার গভীর একটা গর্ত রয়েছে [7]। এই গর্তগুলোর মধ্যে দিয়ে বৈদ্যুতিক তার নামানো হয়েছে। এই তারগুলোর উপরে অনেকটা বৈদ্যুতিক বাল্বের মতো দেখতে ছোট ছোট ফোটন শনাক্তকারী যন্ত্র, যাকে বলে ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব, লাগানো আছে [8]। আন্টার্কটিকার বরফের মধ্যে দিয়ে যখন নিউট্রিনো যাচ্ছে তখন সেটা বরফের মধ্যে কোনো একটা প্রোটনের সাথে ধাক্কা খাবে এবং ফলতো একটা পজিট্রন তৈরি হবে। সেই আধানযুক্ত পজিট্রন কণা যখন ত্বরান্বিত হয়ে ছুটবে, তার থেকে এক ধরনের বিকিরণ হবে। একে চেরেনকভ বিকিরণ বলে [9]। এই বিকিরণটা ওই ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউবে ধরা পড়বে। এটাই এই পরীক্ষাতে নিউট্রন শনাক্তকরণের মূল নীতি।
একটা নিউট্রিনো এলো, ধাক্কা খেয়ে একটা পজিট্রন তৈরি হলো এবং সেটা ছুটে চললো, এই পুরো ঘটনাটিতে গতিপথটা প্রায় একই থাকে। এই গতিপথটাকে উল্টোদিকে অনুসরণ করে আমরা বুঝতে পারবো নিউট্রিনোটা কোনদিক থেকে এসেছিল। তার থেকে নিউট্রিনোটির উৎস সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারবো।
কিন্তু এখনো অব্দি আইস কিউব পরীক্ষাগারে আমরা একটা কি দুটো নিউট্রিনোর উৎস দেখতে পেয়েছি। দেখতে পেয়েছি মানে যথেষ্ট পরিষ্কার দেখতে পেয়েছি, যাতে কিছুটা অন্তত ভরসা করা যায়। তিন সিগমা, চার সিগমা পর্যন্ত দেখা গেছে কিন্তু পাঁচ সিগমা নয়, যেটা আদর্শ বলে মানা হয়। এর কারণ হলো, আইস কিউব অনেকটা বড় পরীক্ষাগার (একেক সাইড এক কিলোমিটার অব্দি বিস্তৃত) কিন্তু যথেষ্ট বড় নয়।
তাই এখন এটাকে আরো বড় করার কথা ভাবা হচ্ছে। আরো গভীর গর্ত করে, আরো বেশি তার লাগিয়ে এবং ফোটোমাল্টিপ্লায়ার টিউবের প্রয়োগ করে এটাকে আরো উন্নত করার চেষ্টা হচ্ছে। পরের পাঁচ দশ বছরে পরীক্ষাগারটিকে প্রায় 10 গুণ বড় করা হবে। তখন আমরা হয়তো অনেক বেশি নিউট্রিনো দেখতে পাবো। এগুলো ব্যবহার করে কোন উৎস থেকে এবং কোন দিক থেকে কত শক্তির নিউট্রিনো আসছে সেগুলো আরো ভালো করে বলতে পারবো। এটা জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটা নতুন শাখা হয়ে যেতে পারে।
তুমি দু-ধরনের গবেষণার কথা বললে: নিউট্রিনোর ভর সংক্রান্ত গবেষণা আর জ্যোতির্বিদ্যায় নিউট্রিনোর প্রয়োগ। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে তুমি যে কাজ করো, সেগুলো কি এই দুটোর কোনো একটার উপরেই? নাকি অন্য কোনো প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা করো?
আমি এই নিউট্রিনো জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে অল্প কাজ করেছি। নিউট্রিনোর ভরের প্রশ্নটা খুবই আকর্ষণীয় হলেও এ নিয়ে খুব বেশি কাজ আমি করিনি।
আমার কাজের মূল দিক হচ্ছে সুপারনোভায় নিউট্রিনোর দোলন (neutrino oscillations)। সহজ করে বলতে গিয়ে হয়তো একটা কথা বাদ পড়ে গেছে। নিউট্রিনোরা একে অপরের সাথে সাধারণত খুবই কম আন্তঃক্রিয়া করলেও সেটা সব ক্ষেত্রে সত্যি নয়। খুব ঘন বস্তু হলে পারস্পরিক ক্রিয়ার প্রবণতা কিন্ত বেড়ে যায়।
যেমন মৃতপ্রায় তারা থেকে যে সুপারনোভা হয়, সেই সুপারনোভার ঘনত্ব অনেক বেশি, সেখানে 1cm3 -এর মধ্যে 1035 টা নিউট্রিনো থাকে। তখন একটা মজার জিনিস হয়।
সুপারনোভার ভিতর একটা নিউট্রিনোর যাত্রাপথে অনেকগুলো নিউট্রিনো বা অ্যান্টিনিউট্রিনোর সাথে দেখা হয়। সেই নিউট্রিনোটারও যেমন দোলন চলছে, যাদের সাথে দেখা হচ্ছে, তাদেরও দোলন চলছে। তখন যদি শুধু একটি নিউট্রিনোর দোলনকে মাপতে চাও, তাহলে বাকি নিউট্রিনোগুলোর দোলনকেও ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে। আবার সেগুলোর দোলন মাপতে হলে এই নিউট্রিনোটার দোলনের কথাও জানতে হবে। তো এটা একটা জটিল অরৈখিক (nonlinear) সমস্যা সৃষ্টি করে। একসাথে 1035 নিউট্রিনোর বিবর্তন মাপতে হবে! এটা কে সম্মিলিত নিউট্রিনো দোলন (collective neutrino oscillation) বলে।
নক্ষত্রের বিবর্তনে এটার অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সুপারনোভাতে যে বিস্ফোরণ হয় তার একটা মূল কারণ হলো নিউট্রিনো যখন ভেতর থেকে বাইরে যায় তারা তাদের শক্তি সুপারনোভায় জমা করে দিয়ে যায়। সেই শক্তিতেই বিস্ফোরণটা হয় [10]।
সুপারনোভা বিস্ফোরণ ভালো করে বোঝার জন্য নিউট্রিনোর শক্তি কীভাবে বাড়ছে কমছে, কত নিউট্রিনো কোন দিকে যাচ্ছে এটা বোঝা খুবই জরুরি। এখনো আমরা এই বিস্ফোরণের আগের অবস্থাটা ভালো করে বুঝি না।
কিন্তু সেটা বুঝতে হলে সুপারনোভার ভিতরে নিউট্রিনোর দোলনের সমস্যাটার সমাধান করতে হবে, যে সমস্যাটা এরকম একটা জটিল অরৈখিক সমীকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়। আমরা এই সমীকরণের কিছু মৌলিক জিনিসপত্র বুঝতে পেরেছি, কিন্তু পুরোপুরি সমাধান করা এখনো সম্ভব হয়নি।
আমার এই ব্যাপারটা খুব বিস্ময়কর লাগে — একটা জিনিসকে বোঝার জন্য আলাদা করে সেটাকে না বুঝে একসাথে অনেক কিছুকে বোঝার প্রয়োজন হয়, এটা প্রকৃতিতে অন্য অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। যেমন পাখিরা যখন আকাশে উড়ে বেড়ায় তখন তারা নিজেদের মধ্যে সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন রকম আকৃতির সৃষ্টি করে। এটা আবার ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে। এই ঘটনাটা বোঝার জন্য আবার গত বছর নোবেল পুরস্কারও দেওয়া হয়েছে জর্জিও প্যারিসিকে। সেই বহু জিনিসের সম্মিলিত আচরণকে বোঝার প্রয়োজনটা মহাজাগতিক স্তরেও তোমরা দেখছো!
একদম ঠিক। এই যে সুপারনোভায় নিউট্রিনোর দোলনের কথা বললাম, তাতে ঠিক এই রকমেরই সমলয়ন (synchronization) দেখা যায়। ঠিক ওই এক ঝাঁক পাখির সমলয়নের মতো।
এই নিউট্রিনো দোলনের সমস্যাটা সমাধান করতে পারলে আরো অনেক কিছু বোঝা যাবে। আমাদের শরীরে যেসব অপেক্ষাকৃত ভারী রাসায়নিক মৌল থাকে, তা ফুসফুসে নেওয়া অক্সিজেনই হোক বা হাড়ের ক্যালসিয়াম হোক বা রক্তের লোহা, এগুলো সবই কিন্তু সুপারনোভায় তৈরি হয়েছে। এগুলো আর কোথাও তৈরি হয় না। সুপারনোভার ভিতর কোন মৌল কতটা তৈরি হবে এটা নিউট্রিনো দিয়ে বোঝা যায়। কারণ তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়াগুলো (radioactive reactions) কতটা নিউট্রিনো মজুত আছে বা নেই, তার উপর নির্ভর করে। সুপারনোভায় নিউট্রিনো দোলন যদি আমরা না বুঝতে পারি, তাহলে একটা নক্ষত্রে একটা মৌল কতটা পরিমাণ তৈরি হয়েছে, সেটা সঠিকভাবে গণনা করতে পারবো না। এটা এই গবেষণা থেকে আরেকটা লাভ।
দারুণ দারুণ। অন্য প্রশ্নে আসি। আমাদের পাঠকদের মধ্যে অনেকে রয়েছে যারা স্কুলে পড়ছে বা সবে কলেজে উঠেছে, হয়তো সবে কোয়ান্টামবিদ্যা শিখছে, তাদের মধ্যে কেউ যদি নিউট্রিনো গবেষণায় আসতে চায় তাদেরকে তুমি কী বলবে? কোন পথে এই গবেষণাতে আসা যায়?
আচ্ছা। এই নিউট্রিনোর গবেষণাক্ষেত্র খুবই বৈচিত্র্যময়, অনেক বড়। তাতে যেমন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা করার সুযোগ রয়েছে, জ্যোতির্বিদ্যার সুযোগ রয়েছে, তেমনই যারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিক দিয়ে নিউট্রিনো গবেষণায় ঢুকছে, তাদের জন্যে ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিভাইস ম্যানুফাকচারিং, ডিটেকশন টেকনোলজি, স্ট্যাটিসটিক্স ইত্যাদি নানা শাখার ব্যবহার রয়েছে।
যারা পদার্থবিদ্যার দিক থেকে আসছে তারা কণাবিদ্যা (particle physics), জ্যোতির্বিজ্ঞান (astrophysics), এসব পড়ে নিউট্রিনো গবেষণাতে আসতে পারে। আবার যারা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর দিক থেকে আসে তারা শনাক্তকরণ প্রযুক্তি (detection technology), যন্ত্র বানানো (device manufacturing) এই সমস্ত দিক থেকে ঢুকতে পারে। যারা গণিত বা কম্পিউটার সাইন্স বা পরিসংখ্যানবিদ্যা এসব দিক থেকে আসছে তাদেরও এখানে যোগ দেওয়ার অনেক জায়গা আছে। কারণ কোডিং বা মেশিন লার্নিং-এর প্রচুর ব্যবহার আছে এই ধরনের ক্ষেত্রে। এক কথায় বলা যায়, বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাক্ষেত্র থেকে লোকেরা এখানে যোগদান করতে পারে।
তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কথা বলে একটা সুন্দর প্রসঙ্গ আনলে। বিজ্ঞানের অনেক প্রশ্ন শুনে মনে হতে পারে সেগুলো শুধুমাত্র মানুষের কৌতূহল মেটানোর জন্য। কিন্তু সেই প্রশ্নগুলো নিয়ে পরে যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, তা থেকে এমন কিছু প্রযুক্তি পাওয়া যায় যেগুলো নানাভাবে মানব উপকারে কাজে লাগে। আমরা এরকম উদাহরণ অনেক দেখেছি। এই যে তুমি পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোর কথা বললে, তার কি মানব সমাজে কোনো সরাসরি প্রয়োগ আছে? সেরকম কোনো প্রয়োগের কথা কি তুমি বলতে পারো?
একটা প্রাথমিক উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করার জন্য প্রচুর ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি, সফটওয়্যার অথবা পরিসংখ্যান পদ্ধতি প্রতি মুহূর্তে তৈরি করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকগুলো শুধুমাত্র এই ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থেকে যায় না, আরও অন্যান্য মানব কল্যাণের ক্ষেত্রেও কাজে লেগে যায়।
যেমন, আইস কিউব পরীক্ষাগারে আমরা শিখছি, অতি নিম্ন তাপমাত্রায় ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ব্যবহার কীভাবে করা যায়। আর সেটা শুধুমাত্র যে এই পরীক্ষাগারে সীমাবদ্ধ তা নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার করা হতে পারে। সাইবেরিয়া বা লাদাখের মতো অঞ্চলে খুব কম তাপমাত্রায় ব্যাটারি বা তড়িৎ প্রবাহ বজায় রাখতে এই ধরনের প্রযুক্তিগুলো আসতে পারে।
আরেকটা সরাসরি প্রয়োগ দেখা যায় পারমাণবিক রিয়াক্টর এবং ক্ষেপনাস্ত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে। আজকাল পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির (renewable energy) উৎস হিসেবে পারমাণবিক বিক্রিয়াকে ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করা হয়। এই বিক্রিয়ার হার নির্ণয় করা বা রিয়াক্টরগুলিকে ঠিকঠাক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না সেইটা খেয়াল রাখা, এসব নিউট্রিনোর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। কোনো দেশ যদি আন্তর্জাতিক নিয়ম ভঙ্গ করে পারমাণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা করে তাও নিউট্রিনো শনাক্তকরণের মাধ্যমে বোঝা যায়।
কিছুদিন আগেই আমি দেখেছিলাম আন্টার্কটিকায় বরফের উপর জেট বিমান নামানো সম্ভবপর হয়েছে। এটাও একটা বড় মাইলস্টোন বিমানচালনা বিদ্যার জগতে।
একদম ঠিক। বিভিন্নভাবে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাগুলোকে কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এই ধরনের পরীক্ষাতে।
যেমন আরেকটা জিনিস জানা গেছে এই আইস কিউব পরীক্ষাগার থেকে — বরফের স্বচ্ছতা কীভাবে মাপা যায়। এর থেকে জলবায়ুর পরিবর্তনও আমরা পরিমাপ করতে পারি। আগ্নেয়গিরির ছাই কিংবা এই ধরনের ভূতাত্ত্বিক বিষয়বস্তুগুলি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় আন্টার্টিকার বরফগুলিকে পর্যবেক্ষণ করেই। আর সেটা সম্ভবপর হয়েছে 10 কিলোমিটার গভীরে আইস কিউব পরীক্ষাগার স্থাপনা করা হয়েছিল বলেই।
এই লেখাটি মূল ভিডিও থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন স্বপ্ননীল জানা। সম্পূর্ণ ইন্টারভিউ-টা এখানে দেখতে পাবেন:
প্রচ্ছদের ছবি: আন্টার্কটিকায় নিউট্রিনো শনাক্ত করার যন্ত্র। Credit — Mark Krasberg, Ice Cube/NSF
উৎসাহী পাঠকদের জন্য:
[1] নিউট্রিনোর দোলন বা neutrino oscillations নিয়ে জানতে আগের পর্বটা দেখো : https://bigyan.org.in/2024/08/neutrino-lost/ ।
[2] নিউট্রিনো-র তিনটে flavor eigenstate — অর্থাৎ ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন নিউট্রিনো আর টাউ নিউট্রিনো — এগুলো নিউট্রিনোর mass eigenstate-এর সাথে এক নয়। তাই কোনো এক ধরনের নিউট্রিনোর ভর আলাদা করে মাপা যায় না। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় আইগেনস্টেট (eigenstate) এক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। উদাহরণ স্বরূপ — আমরা বলবো, কোনো কণা যদি তার ভর আইগেনস্টেট (mass eigenstate)-এ থাকে তাহলে তার ভর মাপলে সবসময় একটা নির্দিষ্ট ভরের মান পাওয়া যায়, ধরা যাক এই ভরের মান m1। অন্যদিকে, কোনো কণা একাধিক ভর আইগেনস্টেটের উপরিপাতন (superposition)-এও থাকতে পারে। যেমন, কোনো কণা যদি m1 আর m2 ভরের আইগেনস্টেটের উপরিপাতনে থাকে, তাহলে তার ভর মাপলে ঠিক m1 পাওয়া যাবে না m2 পাওয়া যাবে, তা আগে থেকে বলা যাবে না। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী কোন ভর পাওয়া যাবে, তার সম্ভাব্যতা (probability) গণনা করা যাবে অবশ্য।
[3] কণা পদার্থবিদ্যার সবথেকে পরিচিত মডেল — যাকে “স্ট্যান্ডার্ড মডেল” নাম দেওয়া হয়েছে — সেই মডেল অনুযায়ী ইলেক্ট্রন, কোয়ার্ক জাতীয় মৌলিক কণার ভর আসে হিগ্স ক্ষেত্র নামের একটা ক্ষেত্রের সাথে কণাগুলোর ক্রিয়ার ফলে। সেই গল্প নিয়ে বিশদে জানতে এই লেখাটি পড়তে পারো: https://www.symmetrymagazine.org/article/where-does-mass-come-from ।
[4] কোয়ান্টাম ক্ষেত্রপদার্থবিদ্যা (quantum field theory) বলে, যে-কোনো ক্ষেত্রের উত্তেজিত অবস্থাকে কণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন, তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের (electromagnetic field) কণাটিকে আমরা ফোটন নামে চিনি। ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ যে হিগ্স ক্ষেত্রের কথা বলে, সেই হিগ্স ক্ষেত্রের কণাকে বলে হিগ্স বোসন (Higgs boson)। 2012 সালে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার বা LHC-র পরীক্ষায় এই কণাটি প্রথম দেখা যায়। কণা পদার্থবিজ্ঞানীরা আশ্বস্ত হন যে তাদের সবথেকে জোরদার মডেলটা ভুল নয়।
[5] কণা পদার্থবিদ্যার পরিচিত কণাদের বেশিরভাগই ডিরাক কণা (Dirac particles) — অর্থাৎ, তাদের একটা বিপরীত-কণা (antiparticle) আছে। কিন্তু আরো এক ধরনের কণা হয়, যারা নিজেরাই নিজেদের বিপরীত-কণা। এদের বলে মায়োরানা কণা (Majorana particles)। নিউট্রিনো কোন গোত্রে পড়ে সেটা এখনো সাব্যস্ত করা যায়নি।
[6] নিউট্রিনোর সাহায্যে মহাবিশ্বের এমন সব জায়গার ঘটনা সম্বন্ধে জানা যায় যেখানে আলোর মাধ্যমে জানার উপায় নেই। যেমন সূর্যের একদম ভিতরে। এই নিয়ে বিশদে জানতে আগের পর্বটা দেখতে পারো: https://bigyan.org.in/2024/08/neutrino-lost ।
[7] আন্টার্কটিকার আইসকিউব পরীক্ষাগার নিয়ে জানতে এখানে দেখো: https://en.wikipedia.org/wiki/IceCube_Neutrino_Observatory , অথবা, https://icecube.wisc.edu/
[8] P.M.T. বা ফোটোমাল্টিপ্লায়ার টিউবের মাধ্যমে ক্ষীণ আলোর সিগন্যালকে ধরা সম্ভবপর হয়। বিশদে জানতে এখানে দেখো: https://en.wikipedia.org/wiki/Photomultiplier_tube ।
[9] কোনো আধানযুক্ত কণা একটা মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে খুব জোরে ছুটে গেলে বিশেষ অবস্থায় এক ধরনের বিকিরণ হতে পারে। এই চেরেনকভ বিকিরণ নিয়ে আরো জানতে এখানে দেখো: https://en.wikipedia.org/wiki/Cherenkov_radiation ।
[10] একটি সুপারনোভার কেন্দ্রস্থল (core) মাধ্যাকর্ষণের চাপে ধসে পড়লে নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় শক্তির প্রায় 99% নিউট্রিনো হিসাবে নির্গত হয়। এই নিউট্রিনোগুলি প্রায় 10-20 সেকেন্ডের সময়ের মধ্যে সুপারনোভার কেন্দ্রে তৈরি হয় এবং এত বেশি তৈরি হয় যে তারা এই সুপারনোভাটাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। নিউট্রিনো সৃষ্ট তাপের কারণে সুপারনোভার মধ্যে একটা কাঁপুনির তরঙ্গ (shock wave) সৃষ্টি হয় এবং এটাই শেষমেশ সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটায়।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/neutrino-open-questions-applications