21-12-2024 18:33:26 pm
Link: https://bigyan.org.in/neutrino-history-source-detection
রাজিবুল (বিজ্ঞান): আজ আমরা অধ্যাপক বাসুদেব দাশগুপ্তর সাথে নিউট্রিনো পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করবো। নিউট্রিনো কী জিনিস, কোথায় দেখা যায়, এই গবেষণায় কী ধরনের প্রশ্ন রয়েছে বা কী কী বাধা রয়েছে, সেইসব নিয়ে আলোচনা করবো।
নিউট্রিনো জিনিসটা ঠিক কী, তুমি সেই নিয়ে একটু বলো।
বাসুদেব দাশগুপ্ত : আমরা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনের বিষয়ে তো প্রায় সবাই জানি। পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন, এবং তার আশেপাশে ইলেকট্রন ঘুরে বেড়ায়। সেটাকে আমরা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার দ্বারা (quantum mechanically) ব্যাখ্যা করি। কিন্তু ইলেকট্রনের মতোই আর একটা উপপারমাণবিক কণা আছে যার ভর ইলেকট্রন এর সাপেক্ষে কমপক্ষে দশ লক্ষ গুণ কম। এর সঠিক ভরটা জানা নেই। এবং ইলেকট্রনের সাথে আরেকটা তফাৎ হলো, এই কণাগুলোর কোনো আধান নেই। তাই তড়িৎ বা চুম্বকক্ষেত্র দিয়ে এদের প্রভাবিত করা যায় না। এই কণাদেরকেই আমরা নিউট্রিনো বলছি।
আচ্ছা এই যে উপপারমাণবিক কণা বললে…সেই ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করি। পরমাণুর মধ্যে কী থাকে সেটা নিয়ে আমরা ছোটবেলায়, এই ধরো ক্লাস 7-8-এ একটা ধারণা তৈরি করি। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী পরমাণুর মধ্যে একটা নিউক্লিয়াস থাকে। এই নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন আছে, নিউট্রন আছে, আর তার বাইরে ইলেকট্রন ঘুরছে।
কিন্তু আমরা যখন পরমাণু সম্বন্ধে শুনি তখন তো কই নিউট্রিনোর কথা শুনি না। তো, নিউট্রিনো থাকেটা কোথায়?
এটা একটা ভালো প্রশ্ন। অনেকে হয়তো মনে করতে পারে যে নিউট্রিনোটা পরমাণুর মধ্যে বা নিউক্লিয়াসের মধ্যে কোথাও ঢুকে আছে। এই ধারণাটা একদিকে যেমন সঠিক নয়, অন্যদিক থেকে ঠিকও।
নিউট্রিনো তৈরি হয় নিউক্লিয়াসের ভিতরে অবস্থিত কণার বিক্রিয়ায়। ঠিক যেমন একটা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সোডিয়াম আর ক্লোরিন একসাথে সোডিয়াম ক্লোরাইড তৈরি করে, সেভাবেই কণা-পদার্থবিদ্যায়ও (particle physics) অনেকরকম বিক্রিয়া হয়। সেখানে দু-রকম কণা ধাক্কা খায় বা একটা কণার ক্ষয় হয়, আর তৈরি হয় নতুন নতুন কণা। তার একটা উদাহরণের মধ্যে পড়ে বিটা-ক্ষয় (beta decay)। এতে নিউট্রন ক্ষয় হয় এবং একটা প্রোটন, একটা ইলেকট্রন আর একটা নিউট্রিনো বেরোয় (আসলে অ্যানটি-নিউট্রিনো বেরোয়, যেটা নিউট্রিনোর জাতভাই)।
একভাবে ভাবতে গেলে হয়তো লোকে মনে করবে নিউট্রিনোটা নিউট্রনের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। নিউট্রনটা যখন ভাঙলো তখন তার মধ্যে থেকে একটা প্রোটন, একটা ইলেকট্রন, একটা নিউট্রিনো বেরোলো। এটা সঠিক নয়, কারণ বিটা ক্ষয়ের আগে নিউট্রিনো-টার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তবে এটাও ঠিক যে যখন নিউট্রন ক্ষয় হয় তখনই নিউট্রিনো বেরোয়।
এই থেকেও না থাকাটা কি আমরা এভাবে ভাবতে পারি: ধরো কোনো একটা উৎসবে আতশবাজি থেকে লাল-নীল সমস্ত রঙের আলো বেরিয়ে আসছে। সেই আলোটা আতশবাজির মধ্যে নেই কিন্তু বেরিয়ে আসছে এই প্রক্রিয়াতে। পরমাণু থেকে নিউট্রিনোর বের হওয়াটাও কি এভাবে ভাবা যায়? না আরও কিছু মৌলিক ধারণা আছে এখানে?
হ্যাঁ, আমি সেরকম কিছুই বলার চেষ্টা করলাম। আতশবাজি থেকে আলো কেন বেরোয় সেটা নিয়ে একটু ভাবা যাক। আতশবাজিতে আসলে অনেকরকম মৌল থাকে। সেগুলো গরম হয়ে গেলে তার ইলেকট্রনগুলো একটা উচ্চ শক্তিস্তরে চলে যায়। তারা যখন নিম্ন শক্তিস্তরে নেমে আসে, তখন কিছু ফোটন বা আলো নিঃসরণ করে। সেইটা আমরা রংবেরঙের আলো হিসেবে দেখতে পাই।
অনেকটা সেই ভাবেই ভাবা যেতে পারে, বিভিন্ন ধরনের উপপারমাণবিক কণাগুলো — সে প্রোটন হোক, নিউট্রন হোক কি ইলেকট্রন — এগুলো হচ্ছে একটা কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের (quantum field) উত্তেজিত অবস্থা।
কোয়ান্টাম ক্ষেত্র-তত্ত্ব (quantum field theory) এমন একটা তত্ত্ব যেটা আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কণাকে ব্যাখ্যা করে। এই তত্ত্ব বলে, এমন একটা ক্ষেত্র (field) রয়েছে যেটা নিম্নতম শক্তিস্তরে অবস্থান করে। কোনো ভাবে সেই ক্ষেত্রে নাড়াচাড়া করলে বা উত্তেজিত করলে একটা পুঁচকে ঢেউ (wave packet) তৈরি হয়, আর এই ঢেউটাকে বা শক্তির সেই দশাকে আমরা কণা বলি। বিভিন্ন রকম ঢেউকে বিভিন্ন কণা হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছে।
তো সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে গেলে এই যে নিউট্রনটা, এটা একটা ঢেউ। বিটা ক্ষয় বিক্রিয়ার সময় এটা ভেঙে পড়ে তিনটে ঢেউয়ে — একটা প্রোটন, একটা ইলেকট্রন আর তৃতীয়টি নিউট্রিনো। মোটামুটি এইভাবে ভাবতে পারো।
আচ্ছা এই নিউট্রিনোর কথাপ্রসঙ্গেই আরেকটা প্রশ্ন করি। এই যে নিউট্রন ভেঙ্গে নিউট্রিনো তৈরি হচ্ছে, এটা তো শুনতে খুব মজাদার লাগলো। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এটা জানলো কীভাবে? এখন নাহয় আমরা জানি, কিন্তু অতীতে প্রথম এটা জানা গেল কীভাবে?
আসলে সুদূর অতীতে লোকে মনে করতো নিউট্রন যখন ভাঙছে, তখন দুটো কণাই শুধু বেরোয়, এক প্রোটন, দুই ইলেকট্রন। কারণ এই দুটোরই আধান আছে: প্রোটনের ধনাত্মক, ইলেকট্রনের ঋণাত্মক। সাধারণত এই ধরনের বিক্রিয়া একটা ক্লাউড-চেম্বারে শনাক্ত করা হয়। এই ধরনের চেম্বারে বাষ্প ভরা থাকে, তার মধ্যে দিয়ে যখন কোনো আধানিত (charged) কণা পাড়ি দেয়, তখন একটা চিহ্ন রেখে যায়। সেটা দেখে বোঝা যায় অমুক কণা বেরিয়েছে।
কিন্তু যেমনটা বললাম, নিউট্রিনো একটা আধানহীন কণা। এর কোনো চিহ্ন থাকে না। তাই লোকে মনে করতো নিউট্রন যখন ভাঙছে শুধু প্রোটন আর ইলেকট্রন বেরোচ্ছে।
সেখান থেকেই সমস্যা শুরু হয়। যারা পদার্থবিদ্যায় প্রথম বর্ষ বা দ্বিতীয় বর্ষে পড়েছে তারা জানবে, একটা কণা যখন দুটি কণায় ভাঙছে, এটা একটা টু-বডি ক্ষয়ের (two body decay) উদাহরণ। এই ধরনের ঘটনায় যে দুটো কণা বেরোচ্ছে, তাদের গতিশক্তিগুলো (kinetic energy) যথাযথভাবে আমাদের জানা থাকে। প্রথম যে কণাটা ক্ষয় হচ্ছে, সেটা যদি স্থিতাবস্থা থেকে ক্ষয় হয়, আর যদি সেই ফ্রেমে যাওয়া যায়, তখন বহিরগামী যে ইলেকট্রন কণাটি, তার শক্তি ধ্রুবক (constant) থাকে। একেকটা ক্ষয়ের ঘটনায় একেকটা ইলেকট্রনের গতিশক্তি আলাদা হতে পারে না [1]।
সেজন্য একরঙা (monochromatic) বলা হয় সেটাকে। একটাই শক্তি দেখা যাচ্ছে যেহেতু। কিন্তু পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেল, ইলেকট্রনের শক্তি বিন্যাসটা একরঙা নয়, তাতে বিভিন্ন গতিশক্তির ইলেকট্রন বেরোচ্ছে। কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব যদি দুটো মাত্র কণা ক্ষয় হয়?
প্রকৃতপক্ষে এই ধাঁধাটিকেই সমাধান করার জন্য উলফগাং পাওলি (Wolfgang Pauli) নিউট্রিনো কণাটির অস্তিত্ব অনুমান করেন। এই নিয়ে একটি মজার গল্প আছে।
ওনার একটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল, নাচের অনুষ্ঠান। তাতে উনি ওনার বন্ধু বান্ধবদের একটা চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে আসতে পারছেন না, কাজে ব্যস্ত। আর সেই চিঠিতেই এটাও লিখলেন যে ইলেকট্রনের শক্তি বিন্যাসের রহস্যটা সমাধান করতে পেরেছেন। উনি লিখেছিলেন যে রহস্য সমাধানের জন্য একটা তৃতীয় কণার অস্তিত্ব অনুমান করতে বাধ্য হচ্ছেন। তা না হলে শক্তি সংরক্ষণ ও ভরবেগ সংরক্ষণ বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু এরকম একটা কণা অনুমান করতে ওনার কষ্ট হচ্ছে, কারণ এই কণাটি শনাক্ত করা খুবই জটিল। এর ভর খুবই কম হবে, এর কোনো তড়িৎচুম্বকীয় আন্তঃক্রিয়া (electromagnetic interaction) নেই, ফলতো সহজে একে শনাক্ত করা যাবে না।
উনি খুব যত্নসহকারে এই মজার চিঠিটা লেখেন এবং বলেন যে এই অনুমান করা কণাটি যদি সত্যিই থাকে, তাহলে নিউট্রন বা বিটা ক্ষয়ের শক্তি বিন্যাসকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে [1]।
আচ্ছা নিউট্রিনো নামটাও কি পাওলির দেওয়া?
না, ‘নিউট্রিনো’ নামটা আমি যতদূর জানি, এনরিকো ফার্মির (Enrico Fermi) দেওয়া। ইতালীয় ভাষায় কোনো শব্দের শেষে ইনো(-ino) জুড়ে দিলে তার মানে হচ্ছে সেই জিনিসটির একটা ছোট রূপ। এটা একটু আদর করে একটা ছোট জিনিসকে ডাকার একটা উপায়।
নিউট্রন একটা আধানহীন কণা, তার ভর অনেকটা প্রোটন-এর মতো এবং ইলেকট্রনের চেয়ে প্রায় 1400-1500 গুণ বেশি। সেদিক দিয়ে ভাবলে নিউট্রিনোও হচ্ছে আধানহীন একটা কণা, কিন্তু অনেক হালকা। অর্থাৎ ছোট্ট নিউট্রন। সেজন্যই এর নাম দেওয়া হলো নিউট্রিনো।
পুচকি নিউট্রন।
ঠিক, পুচকি নিউট্রন, ঠিক বলেছো।
আচ্ছা, ধন্যবাদ, এটা খুবই মজাদার গল্প। আচ্ছা
এই যে পূর্বাভাসের কথা বললে, এটা মোটামুটি কোন সময়ের? বিংশ শতকের মাঝামাঝি?
হ্যাঁ, আমার যতদূর মনে পড়ছে পাওলি এই চিঠিটা লেখেন 1930-র দিকে।
পাওলি লিখেছিলেন, এই কণাটি থাকতে পারে, এটা তিনি অনুমান করছেন। কিন্তু এটা পরীক্ষামূলক ভাবে দেখা ওনার কাছে প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছিল।
তাহলে আমার পরের প্রশ্ন হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা কবে এবং কীভাবে প্রথম দেখলেন যে নিউট্রিনো বলে সত্যিই একটা কণা আছে? তাত্ত্বিকভাবে ছাড়াও বাস্তবে যে এর অস্তিত্ব রয়েছে, এটা কবে জানা গেল?
আসলে শুধু উলফগাং পাওলিই নন, তার পরেও অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীরা একটি গবেষণাপত্র লেখেন, যাতে ওঁরা প্রায় দাবি করেন যে নিউট্রিনো কণাটি কোনো দিনই শনাক্ত করা যাবে না। কারণ অন্য কণার সাথে তার আন্তঃক্রিয়ার (interaction) সম্ভবনা এতই কম যে বহু মাইল জুড়ে সীসার দেওয়াল তৈরি করলে তাতে হয়তো একটামাত্র নিউট্রিনো ধরা পড়বে।
ওঁরা একটা গণনা করে দেখিয়েছিলেন যে নিউট্রিনো কণাটির সাথে সাধারণ কোনো কণার আন্তঃক্রিয়ার সম্ভাবনা খুব কম। একটা প্রোটন আর প্রোটন বা একটা নিউট্রন আর নিউট্রন যখন একে অপরের সাথে আন্তঃক্রিয়া করে, তাদের আন্তঃক্রিয়ার প্রস্থচ্ছেদটা (interaction cross section) হলো । এটা একটা সংখ্যা যেটা দুটো কণার মধ্যে আন্তঃক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনাটা বলে। একটা নিউট্রিনোর ক্ষেত্রে এই প্রস্থচ্ছেদটা । তার মানে, প্রায় ভাগ কম। সেটা এতই কম যে নিউট্রিনোর সাথে অন্য কিছুর দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার প্রায় কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
তবে তার কিছু বছরের মধ্যেই নিউট্রিনো পাওয়া যায়।
সেটা কী করে হলো?
তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা অনেক সময়ই অনেক গণনা করেন যাতে মনে হতে পারে পরীক্ষায় পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য তৎকালীন যা করা গেছে, সেটাই হয়তো দেখছেন তাঁরা। পরবর্তীকালের বিজ্ঞানীরা হয়তো সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে ভাবতে পারেন পরীক্ষাটাকে। আমেরিকান বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক রেইনস (Frederick Reines) এবং ক্লাইড কোয়ান (Clyde Cowan) 1956-এ একটা উপায় বার করেন। তাঁরাখেয়াল করেন যে পারমাণবিক চুল্লিতে (nuclear reactor) হরদম যেসব পারমাণবিক বিক্রিয়া হচ্ছে তাতে নিশ্চই প্রচুর নিউট্রিনো তৈরি হবে। যদি তার খুব কাছে চলে যাওয়া যায়, সেখানে নিউট্রিনোর প্রবাহটা (flux) অনেকটা বেড়ে যাবে। যদি চুল্লির থেকে দূরত্বটা r ভাবো, যত কাছে যাবে, 1/r^2 অনুপাতে নিউট্রিনোর সংখ্যা বেড়ে যাবে।
ওঁরা এটাও ভেবে দেখছিলেন যদি কোনোভাবে একটা শনাক্তকারী যন্ত্রকে চুল্লিতে ফেলে দেওয়া যায়। যদিও সেটা তাঁরা করেননি। একটা শনাক্তকারী যন্ত্র তৈরি করে পারমাণবিক চুল্লির পাশে রেখে দেন।
কীরকম যন্ত্র? আসলে খুবই সোজা। একটা বড় চৌবাচ্চা, তাতে আপাতত ধরে নিই জল আছে। জল অর্থাৎ , মানে, দুটো করে হাইড্রোজেন, একটা করে অক্সিজেন। হাইড্রোজেনটাকে প্রোটন বলে ধরে নেওয়া যায়। চুল্লি থেকে যে নিউট্রিনো বেরোচ্ছে, সেটা আন্তঃক্রিয়া করবে এই প্রোটনগুলোর সাথে। আমরা বিটা ক্ষয়ের বিক্রিয়া এরকম শিখেছিলাম:
এই সমীকরণে নিউট্রিনোটাকে অন্যদিকে পাঠিয়ে দিলে হয় এরকম:
রসায়নে আমরা এই ধরনের অনেক বিক্রিয়ার কথাই পড়েছি। কণা-পদার্থবিদ্যাতেও এরকম একদিক থেকে অন্যদিক করা যায়। ফলত যে বিক্রিয়াটা হয়, তাকে বলে বিপরীত-বিটা-ক্ষয় (inverse beta decay)। এই বিপরীত বিটা-ক্ষয়ের কারণে নিউট্রিনোকে শনাক্ত করা যায়। জলে প্রচুর প্রোটন আছেই বিক্রিয়ার রসদ যোগানোর জন্য।
আসলে ওঁরা যে বস্তুটি ব্যবহার করেছিলেন, সেটা একটা ডিটারজেন্টের মতো বস্তু, তাতে প্রচুর ক্লোরিন থাকে। নিউট্রন প্রোটনে পরিণত হলে, ক্লোরিনটা আর্গন হয়ে যায়।
ওঁরা যখন মাপছেন, আসলে কতটা আর্গন আছে সেটা মাপছেন।
ঠিক, প্রায় তিন-চার মাস ধরে এই পরীক্ষা চলে।
পারমাণবিক চুল্লি থেকে নিউট্রিনো এসে ক্লোরিনকে আর্গন করতো। তারপর ওঁরা চৌবাচ্চার মধ্যে রসায়নের সাহায্যে কটা আর্গন পরমাণু আছে সেটা মাপতেন।
এই একটা করে আর্গন পরমাণু মাপাটা খুবই জটিল ব্যাপার। কিন্তু রসায়নবিদ্যা তখন অনেকটাই উন্নত, তো ওঁরা সেটা করতে পেরেছিলেন।
তাহলে তুমি আগে যেটা বললে, তাতে দাঁড়াচ্ছিল যে একটা নিউট্রিনোর অন্য একটা প্রোটনের সাথে বিক্রিয়া করার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু এই গবেষণায় ওঁরা বুদ্ধিটা দেখিয়েছিলেন ওই পারমাণবিক চুল্লির কাছে গিয়ে যাতে একের বদলে প্রচুর নিউট্রিনো আসতে থাকে এবং বিক্রিয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন সেই আর্গনটা মেপে।
সঠিক।
এখান থেকে যেটা পরের প্রশ্ন উঠে আসে, সেটা হলো: নিউট্রিনোকে পরীক্ষামূলক ভাবে দেখতে গেলে আমায় কোথায় পারমাণবিক চুল্লি আছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে, নাকি সেছাড়াও আরো কোথাও নিউট্রিনো পাওয়া যায়?
হ্যাঁ, নিউট্রিনোর একটা খুব ভালো উৎস হচ্ছে পারমাণবিক চুল্লি। কিন্তু এছাড়াও নিউট্রিনোর বেশ কিছু প্রাকৃতিক উৎস আছে।
তার একটি বিশিষ্ট উদাহরণ হলো সূর্য। সূর্যতে যে পারমাণবিক বিক্রিয়া হচ্ছে, তাতে অনেক নিউট্রিনো তৈরি হয়। সমস্যাটা হচ্ছে, সূর্য অনেক দূরে।
তবে সূর্য থেকে পৃথিবীতে নিউট্রিনোর প্রবাহটা একেবারে কম নয়। এই ধরো আমাদের একটা নখ, প্রায় এক সেমি^2, তার মধ্যে দিয়ে প্রত্যেক সেকেন্ডে প্রায় এক লক্ষ কোটি নিউট্রিনো পেরিয়ে যাচ্ছে, সেটা দিনে হোক বা রাতে হোক। কারণ নিউট্রিনো তো প্রায় আন্তঃক্রিয়া করে না, তাই পৃথিবী ভেদ করে আমাদের শরীর ভেদ করে সবার মাঝখান দিয়ে চলে যাচ্ছে, আমরা বুঝতেও পারছি না। বলা যায় আমরা সারাদিন এই নিউট্রিনোর রশ্মির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, এবং প্রত্যেক সেকেন্ডে শরীরের প্রত্যেক বর্গসেমির মধ্যে দিয়ে সূর্য থেকে এক লক্ষ কোটি নিউট্রিনো চলে যাচ্ছে।
কবিগুরুর গান আছে “আলোকের এই ঝর্ণাধারায়…”। আমরা বলতে পারি আমরা নিউট্রিনোর ঝর্ণাধারার মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছি। দারুণ।
ওই যে নিউট্রিনোর ঝর্ণাধারা, যেটা সূর্য থেকে আসছে, সেটা পৃথিবীতে বসে মাপা সম্ভব? মাপা গেছে?
মাপা গেছে। রেইনস এবং কোয়ানের পরীক্ষার পর পরই, 1960 থেকে সৌর নিউট্রিনো (Solar Neutrino), অর্থাৎ সূর্য থেকে আগত নিউট্রিনো, সেগুলো মাপা শুরু হয়ে গেছে। শুধু সূর্য থেকে নয়, আরো বেশ কিছু উৎস থেকে মাপা গেছে।
আচ্ছা, এই যে মাপা গেছে, সেগুলো কী ধরনের জায়গায় বসে, তার দু -একটা উদাহরণ দাও… সেগুলো আমাদের উপমহাদেশে রয়েছে কি? যেমন ভারতে?
আগে আমি বলে নিই কী কী উৎস থেকে নিউট্রিনো পাওয়া গেছে। একটা তো হচ্ছে সূর্য। তাছাড়া আর একটা হচ্ছে মহাজাগতিক রশ্মি (cosmic ray) বলে একটি বস্তু। সেটার কথা আমরা অনেকেই হয়তো জানবো। এটা মহাকাশ থেকে আসা খুব উচ্চশক্তির আয়নীয় কণা, যা চারিদিক থেকে আমাদের ওপর আছড়ে পড়ছে। আমরা মনে করি যে নক্ষত্রপুঞ্জের একেবারে মাঝখানে যে কৃষ্ণগহ্বরগুলি (black hole) আছে তা যখন বস্তু আকর্ষণ করে, তাদের কণাগুলোর মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়। তাতে কিছু আধানযুক্ত কণা ত্বরান্বিত অবস্থায় বেরোয়। সেগুলোর ক্ষয় হলে নিউট্রিনো বেরোয়।
আরো কিছু জায়গা আছে, যেমন সুপারনোভা বিস্ফোরণ এবং আরো যত মহাকাশ জুড়ে (astrophysical) ঘটনা ঘটছে, তাতে আধানযুক্ত ত্বরান্বিত কণা (accelerating charged particles) তৈরী হয়। সেই আধানযুক্ত কণাগুলি যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন বা নাইট্রোজেনের সাথে ধাক্কা খায় তখন আবার কিছু কণা তৈরি হয়, যেগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হলে (decay) তার থেকে কিছু নিউট্রিনো বের হয়।
এই নিউট্রিনোগুলোকে বলা হয় বায়ুমণ্ডলীয় নিউট্রিনো (atmospheric neutrino)। কারণ এই নিউট্রিনোগুলো বায়ুমণ্ডলীয় কণার ক্ষয় থেকে আসছে। এইটা হচ্ছে নিউট্রিনোর আরেকটা উৎস যেটা আমরা দেখতে পেয়েছি।
আরো কিছু উৎস্যের উদাহরণ রয়েছে। যেমন, পৃথিবীর গর্ভে তো তেজস্ক্রিয়তা আছে, যাকে বলে ভৌগোলিক তেজস্ক্রিয়তা। সেখান থেকে যে নিউট্রিনোগুলো তৈরি হয় সেগুলোকে ভৌগোলিক নিউট্রিনো বলে (geo neutrino)।
এছাড়াও আরো ছোটখাটো কয়েকটা খোঁজ পাওয়া গেছে, যেমন 1987-এ একটা সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয়েছিল আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জের একটু বাইরেই, বৃহৎ ম্যাগালিনিক ক্লাউডে। সেই বিস্ফোরণেও নিউট্রিনো দেখা গেছে।
তাই বলা যায়, মোটামুটি যেখানেই পারমাণবিক বিক্রিয়া হচ্ছে সেখানেই নিউট্রিনো দেখা যেতে পারে।
ভূগর্ভে, মেরু অঞ্চলে, সোনার খনিতে
কীভাবে দেখা যেতে পারে? শনাক্তকরণকারী যন্ত্রগুলো কেমন দেখতে বা কোথায় আছে সেটা নিয়ে একটু বলি। নিউট্রিনোর প্রায় সমস্ত শনাক্তকরণকারী যন্ত্রই মূলত এই এক নীতির ওপর কাজ করে: একটা বড় আকারের শনাক্তকারী যন্ত্র হতে হবে কারণ ছোট আকারের যন্ত্রের প্রস্থচ্ছেদ কম, ফলত: নিউট্রিনো শনাক্তকরণের সম্ভাবনা কম। বড় আকারের যন্ত্রে সম্ভাবনা বেশি থাকে এক-দুটো নিউট্রিনো দেখতে পাওয়ার। এই শনাক্তকারী যন্ত্রগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিশিষ্ট উদাহরণের কথা বলি। এক হচ্ছে জাপানে সুপার কামিওকা (Super Kamioka) বলে একটা শনাক্তকরণকারী যন্ত্র আছে। এটাকে সুপার কামিওকাণ্ডে-ও (Super Kamiokande) বলে অনেকে। এটা আসলে একটা বড় জলের ট্যাঙ্ক, পাহাড়ের তলায় অবস্থিত। পাহাড়ের তলায় বসানো হয়েছে যাতে অন্যান্য আধানযুক্ত কণাগুলো আটকে যায়। শুধুমাত্র যে কণাগুলি খুবই কম আন্তঃক্রিয়া করছে সেগুলোই শুধু ঢুকতে পারে। এই কারণেই এ ধরনের শনাক্তকারী যন্ত্রগুলি মূলত ভূগর্ভস্থ পরীক্ষাগারে বা পাহাড়ের তলায় অথবা পাহাড়ের ভেতর সুড়ঙ্গ করে রেখে সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
এটা তো বললাম জাপানের কামিওকার কথা। এছাড়াও আরো কিছু শনাক্তকারী যন্ত্র আছে যেগুলো আমেরিকায় তৈরি করা হয়েছে। একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ শনাক্তকারী যন্ত্র হচ্ছে আন্টার্কটিকার ‘আইস কিউব’ (IceCube)। সেখানে আন্টার্কটিকায় বরফের চাদরের তিন কিলোমিটার নিচে তার ঝুলিয়ে ডিটেক্টর তৈরি করা হয়েছে। 2010 সাল নাগাদ এই ডিটেক্টরটি তৈরি হয়েছে।
আর একটা ডিটেক্টরের কথা আমি শেষে বলতে চাই। নিউট্রিনো শনাক্তকরণের গবেষণায় ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ মুখ। ভারতের কোলার স্বর্ণখনির নাম হয়তো অনেকেই শুনে থাকবে। সেখানে একসময় সোনার খনি ছিল। খনিটা যেহেতু ভূগর্ভের অনেকটাই ভেতরে, তার একটা সুবিধা হচ্ছে অন্যান্য আয়নযুক্ত কণাগুলি, যেমন মিউয়ন বলে আরেকটা কণা, যেগুলো অনেক গভীর পর্যন্ত যেতে পারে, সেগুলোকে পুরোপুরি ভাবে ঢাকা দেওয়া যাচ্ছিলো।
এই কোলার গোল্ডফিল্ডেই প্রথম বায়ুমণ্ডলীয় নিউট্রিনো শনাক্ত করা যায়। একটি ভারত-জাপানীয় যৌথ প্রচেষ্টায় প্রথমবার এই শনাক্তকরণ করা সম্ভব হয়। সমসাময়িকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি পরীক্ষাগারেও এটি শনাক্ত করা হয়।
এটা খুব মজাদার জিনিস বললে, সোনার খনিতে, যেখানে লোকেরা সোনা তুলে আনছে, তুমি বলছো যে সেখানে তাদের সাথে সাথে বিজ্ঞানী রাও চলে গিয়েছিল!
লেখাটি মূল ভিডিও থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন স্বপ্ননীল জানা ও অমৃতা মণ্ডল। সম্পূর্ণ ইন্টারভিউ-টা এখানে দেখতে পাবেন:
প্রচ্ছদের ছবি: IceCube পর্যবেক্ষণাগারে নিউট্রিনো ধরা দিল (IceCube Neutrino Observatory)
অন্যান্য টুকিটাকি: [1] নিউট্রিনো আবিষ্কারের গল্প নিয়ে আরো বিশদে জানতে এই লেখাটি পড়ো: নিউট্রিনো আবিষ্কারের গল্প।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/neutrino-history-source-detection