21-12-2024 17:08:34 pm
Link: https://bigyan.org.in/mathematicsisfun
বন্ধুরা, টেনিদার গল্পের স্বামী ঘুটঘুটানন্দকে মনে আছে তো? সেই যিনি টেনিদাকে বলেছিলেন, যোগবলে নাকি সাপকে হাঁড়িতে পুষে রাখা যায়! আজ আমরা জানব সত্যিকারের ‘গণিতানন্দ’-এর কথা, যিনি পোষ মানিয়েছিলেন ঠিকই, তবে সাপকে নয়, অঙ্ককে! ‘গণিতানন্দ’-এর কথা বলার আগে একটা ছোট্ট ম্যাজিক দেখাই।
একটা চার অঙ্কের সংখ্যা ভাবো, যার চারটি অঙ্কই সমান নয়। অর্থাৎ ১১১১ কিংবা ২২২২ ইত্যাদি বাছা যাবে না। এই ৪ টি অঙ্ক ছোট থেকে বড়ো করে সাজাও, যে সংখ্যাটা হলো সেটা লেখো। এবার সংখ্যাটা উল্টে দাও, যাতে অঙ্কগুলো বড়ো থেকে ছোট করে সাজানো থাকে। বড়ো সংখ্যাটা থেকে ছোটটা বাদ দাও। উদাহরণ হিসেবে ধরো, তুমি ভাবলে ২৬৩৫, তাহলে তুমি যে বিয়োগ-টা করলে সেটা হলো ৬৫৩২ – ২৩৫৬ = ৩১৭৬।
বিয়োগ করার ফলে একটা নতুন সংখ্যা পেলে। নতুন সংখ্যাটার উপর আবার ওই ধাপগুলো করো। অর্থাৎ সংখ্যাটার অঙ্কগুলো ছোট থেকে বড়ো আর বড়ো থেকে ছোট করে সাজিয়ে দুটো নতুন সংখ্যা বানাও। বড়ো থেকে ছোটটাকে বিয়োগ করো।
এরকম বার সাতেক করো। তুমি প্রথমে কি সংখ্যা ভেবেছিলে জানি না, কিন্তু ওই সাতবার বড়ো-ছোট-বিয়োগ খেলাটার পর যে সংখ্যাটা পেলে, সেটা বলে দিতে পারি:
৬১৭৪
কি, ঠিক ধরেছি তো? ক্রেডিট-টা আমার নয়, এই “ম্যাজিক”-টা এবং আরও অনেক অদ্ভুত সংখ্যা যিনি খুঁজে বার করেছিলেন, তাঁকে এবং তাঁর সংখ্যাগুলোকে নিয়েই এই লেখাটা। দত্তথ্রেয় রামচন্দ্র কাপ্রেকার ওরফে ডি.আর.কাপ্রেকার। পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক, কিন্তু তাঁর শখই ছিল অঙ্ক নিয়ে খেলা করা।
অঙ্কে হাতেখড়ি
১৯০৫ সালের ১৭ই জানুয়ারী তিনি মহারাষ্ট্রের দাহানু শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে মাতৃহারা ছেলেকে বাবা নিজের সর্বস্ব দিয়ে বড় করে তুলেছিলেন। পেশায় কেরানি, অঙ্কশাস্ত্রের বিশদ জ্ঞান হয়তো ছিলনা, কিন্তু তাঁর শখের বিষয় ছিল জ্যোতিষবিদ্যা। ছেলেকেও সেই বিদ্যা শিখিয়েছিলেন তিনি। বাবার হাত ধরে জ্যোতিষবিদ্যার মাধ্যমে ছোট্ট কাপ্রেকারের প্রথম পরিচয় হয় সংখ্যাজগতের সাথে।
থানে শহরে মাধ্যমিক স্তরে, তারপরে পুণেতে ফারগুসন কলেজে শিক্ষালাভ করেন তিনি। অঙ্ক কষা ছিল তাঁর কাছে রোমাঞ্চকর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ডুবে থাকতেন অঙ্কের ধাঁধাঁর সমাধানে। সবসময়েই তিনি খুঁজে বার করার চেষ্টা করতেন সমস্যার সমাধানে পৌঁছনোর সহজতম উপায়টা। ১৯২৭ সালে তাঁকে র্যাংলার আর. পি. ম্যাথেমেটিকাল পুরষ্কার দেওয়া হয়। এই পুরষ্কারটা দেওয়া হতো শ্রেষ্ঠ মৌলিক গণিত-সংক্রান্ত গবেষণার জন্য। অর্থাৎ কাপ্রেকার তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন অল্প বয়েসেই। অবশ্য পরবর্তী জীবনে যে এই স্বীকৃতির ধারাটা অক্ষত ছিল, সেরকম বলা যায় না।
মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে তিনি স্নাতক হন। পরবর্তী জীবনে দীর্ঘ ৩২ বছর তিনি নাসিক-এর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এবং সাথে সাথে খুঁজে বার করেন সংখ্যার জগতের কিছু অদ্ভুত সদস্যদের।
কাপ্রেকার’স কনস্ট্যান্ট
উপরে যে ম্যাজিক-টার কথা বললাম, সেটা সংখ্যাতত্ত্বের জগতে কাপ্রেকারের সবথেকে পরিচিত কাজ। ম্যাজিক-টা দেখতে এবার একসাথে অঙ্কটা করা যাক। ধরো, আমি ভাবলাম ২০১৬, গত বছরের সংখ্যাটা।
এই চারটি অঙ্ক ওলটপালট করে সবচেয়ে বড় যে সংখ্যা পেতে পারি, তা হল ৬২১০ আর সবচেয়ে ছোটটি হলো ০১২৬ অর্থাৎ ১২৬।
বিয়োগের ধাপগুলি হলো এইরকম। এই অঙ্কগুলিকে সাজানো আর বড়ো সংখ্যা থেকে ছোটটাকে বিয়োগ করা, একে ‘কাপ্রেকার’স রুটিন’ (Kaprekar’s routine) বলা হয়ে থাকে।
৬২১০ – ০১২৬ = ৬০৮৪
৮৬৪০ – ০৪৬৮ = ৮১৭২
৮৭২১ – ১২৭৮ = ৭৪৪৩
৭৪৪৩ -৩৪৪৭ = ৩৯৯৬
৯৯৬৩ – ৩৬৯৯ = ৬২৬৪
৬৬৪২ – ২৪৬৬ = ৪১৭৬
৭৬৪১- ১৪৬৭ = ৬১৭৪
৭৬৪১- ১৪৬৭ = ৬১৭৪
…
দেখতেই পাচ্ছো, এরপর বিয়োগটা যতবার-ই করো, ওই ৬১৭৪-ই আসবে। ওই সংখ্যাটাকে বলা যায় ওই কাপ্রেকার’স রুটিন-এর ‘কার্নেল’ (kernel) বা কেন্দ্রস্থল। ভেবে দেখো, প্রায় ন’হাজার-টা সংখ্যার মধ্যে যেখান থেকেই শুরু করো না কেন, একই সংখ্যাতে গিয়ে ঠেকবে। সাতবার বিয়োগটা করতে হবে, সেরকম কথা নেই। তাড়াতাড়িও পৌঁছে যেতে পারো কেন্দ্রস্থলে। তবে সাতবারের মধ্যে ঠিক পৌঁছবে।
সংখ্যার ভিড়ে লুকিয়ে থাকা এই একটি সংখ্যাকে টেনে বার করেছিলেন কাপ্রেকার। ৬১৭৪ সংখ্যাটা ‘কাপ্রেকার’স কনস্ট্যান্ট’ (Kaprekar’s constant) নামে পরিচিত। তিন অঙ্কের সংখ্যাতেও এরকম একটা কেন্দ্রস্থল পাওয়া যায়, সেটা হলো ৪৯৫। নিজেই কয়েকটা সংখ্যা নিয়ে অঙ্কটা করে দেখো। ৪৯৫-এ গিয়ে ঠেকবে।
তবে এর বাইরে, অর্থাৎ দুই অঙ্কের সংখ্যা, পাঁচ অঙ্কের সংখ্যা, ইত্যাদি ইত্যাদিতে একটাই কেন্দ্রস্থল আছে, এরকম নয়।
অনেকগুলি কেন্দ্রস্থল থাকে এবং কেন্দ্রস্থলে অনেকসময় একাধিক সংখ্যা থাকে। ধরো, পাঁচ অঙ্কের একটা সংখ্যা ভাবলে, দিয়ে কাপ্রেকার-এর রুটিন-টা চালাতে থাকলে। দেখবে একটা জায়গায় গিয়ে এই সংখ্যাগুলোর গোলকধাঁধায় আটকে গেছো:
৫৩৯৫৫→৫৯৯৯৪→৫৩৯৫৫,
বা
৬১৯৭৪→৮২৯৬২→৭৫৯৩৩→৬৩৯৫৪→৬১৯৭৪,
বা
৬২৯৬৪→৭১৯৭৩→৮৩৯৫২→৭৪৯৪৩→৬২৯৬৪।
গণিতের জগতে কাপ্রেকার প্রথম প্রথম পাত্তা পাননি। তাঁর কয়েকটা কাজ তিনি কিছু নিম্নস্তরের গবেষণাপত্রে ছাপাতে পেরেছিলেন। যেমন, এই কাজটা তিনি ছাপিয়েছিলেন Scripta Mathematica জার্নালে ১৯৫৩ সালে। কাজটির নাম দিয়েছিলেন, Problems involving reversal of digits। তবে অনেক কাজই ওনাকে প্রাইভেটে ছাপাতে হয়েছে প্যামফ্লেট আকারে।
শেষে ১৯৭৫ সালে পপুলার ম্যাথমেটিক্স লেখক মার্টিন গার্ডনার কাপ্রেকার-কে আন্তর্জাতিক স্তরে আনেন। উনি ‘সাইন্টিফিক আমেরিকান’ পত্রিকাতে একটি জনপ্রিয় কলাম লিখতেন, ‘ম্যাথেমেটিক্যাল গেমস’ নামে [২]। মার্চ ১৯৭৫-এর কলামে উনি লেখেন কাপ্রেকারের কাজ নিয়ে। অবশেষে গণিত জগতে তাঁর যোগ্য স্বীকৃতি পান কাপ্রেকার। তারপর বহু সংখ্যাতত্ত্ববিদ তার কাজ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন, তাঁর আবিষ্কৃত সংখ্যাগুলোর পিছনে আরো গূঢ় রহস্য আছে কিনা, সেই সন্ধানে মেতেছেন।
সংখ্যায় আনন্দ
কাপ্রেকার আরো অদ্ভূত সব সংখ্যার চরিত্র খুঁজে বার করেন। যেমন এক জাতীয় সংখ্যা রয়েছে, যাদের অঙ্কগুলোকে যোগ করলে সংখ্যাটা সেই যোগফলের দ্বারা বিভাজ্য। হার্ডি-রামানুজন সংখ্যাটাই ধরা যাক [৩]: ১৭২৯।
অঙ্কগুলো যোগ করো: ১ + ৭ + ২ + ৯ = ১৯। দেখা যাবে, ১৭২৯ সংখ্যাটি এই যোগফলটা অর্থাৎ ১৯-এর দ্বারা বিভাজ্য। এরকম সংখ্যার একটা পুরো সিকোয়েন্স পাওয়া যায়। ১ থেকে ৯ অব্দি সংখ্যাগুলো বাদ দিলাম, কারণ তাদের অঙ্কের যোগফল তারা নিজেই। তারপর থেকে সংখ্যাগুলি হলো:
….,১০, ১২, ১৮, ২০, ২১, ২৪, ২৭, ৩০, ৩৬, ৪০, ৪২, ৪৫, ৪৮, ৫০, ….
এই সংখ্যাগুলোকে উনি ‘হর্ষদ নাম্বার’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। এখানে ‘হর্ষ’ হলো আনন্দ, হয়তো এই সংখ্যাগুলোকে খুঁজে পেয়ে উনি যে আনন্দ পেয়েছিলেন, সেটাকেই বোঝাতে চেয়েছেন। সংখ্যাই ছিল তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান। উনি বলতেন:
একজন মদ্যপ যেমন পান করা থামাতে চায় না, সুরাপানের উন্মত্ত স্থিতিতে পড়ে থাকতে চায়, সংখ্যার ক্ষেত্রে আমারও সেই একই অবস্থা।
এই ‘হর্ষদ নাম্বার’ পরে তুমুল গবেষণার বিষয় হয়েছিল: কিভাবে বিস্তৃত তারা পূর্ণসংখ্যাদের মধ্যে, অন্য ধরণের সংখ্যার সিকোয়েন্স-এর সাথে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরকমই আরেক জাতীয় সংখ্যা তিনি বার করেছিলেন, যাদের ‘সেল্ফ নাম্বার’ বা ‘স্বয়ম্ভূ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সেল্ফ নম্বর-এর সংজ্ঞা বুঝতে হলে আগে দেখতে হবে কারা ‘সেল্ফ নাম্বার’ নয়। যেমন, ২১, ২২, ২৩-এর কথা ধরা যাক।
কিন্তু কিছু সংখ্যার ক্ষেত্রে এইটা করা যায় না। তারাই ‘সেল্ফ নাম্বার’। অর্থাৎ এমন কোনো সংখ্যা পাওয়া যায় না, যাকে তার অঙ্কের যোগফলের সাথে যোগ করলে সেই সংখ্যাটাই ফেরত আসবে।
যেমন, ২১,২২, ২৩, এরা সেল্ফ নম্বর না হলেও ২০ কিন্তু সেল্ফ নম্বর। দেখো তো, এমন কোনো সংখ্যা খুঁজে পাও কিনা যাকে তার অঙ্কগুলোর সাথে যোগ করলে ২০ পাবে? বা এই ‘সেল্ফ নম্বর’ সিকোয়েন্স-এর অন্য যেকোনো কোনো একটা সংখ্যা নিয়ে দেখো (এক অঙ্কের সংখ্যাগুলো দিলাম না):
…, ২০, ৩১, ৪২, ৫৩, ৬৪, ৭৫, ৮৬, ৯৭, ১০৮, ১১০, ১২১, ১৩২, ১৪৩, ১৫৪, ১৬৫, ১৭৬, ১৮৭, ১৯৮, ২০৯, ২১১, ২২২, ২৩৩,…
কাপ্রেকার এই ‘সেল্ফ নাম্বার’-গুলোকে প্রকাশ করার একটা সূত্র দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, সম্ভাব্য ‘সেল্ফ নাম্বার’-টির নিচে যত সংখ্যা আছে, সব কটাকে ধরে ধরে না দেখলেও চলবে। ফর্মুলাটা ব্যবহার করেই পেয়ে যাবে একটা সংখ্যা ‘সেল্ফ-নাম্বার’ কিনা [৪]।
আরও আছে। তবে উৎসাহী হলে নিজেই পড়ে দেখো সেসব।
১৯৮৮ সালে কাপ্রেকারের জীবনাবসান ঘটে। সংখ্যা নিয়ে স্রেফ খেলা করে কি কাণ্ড করা যায়, সেটা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। ‘রিক্রিয়েশনাল ম্যাথমেটিক্স’ অর্থাৎ অবসর-সময়ে গণিতচর্চা, এটা একটা স্বীকৃত ‘হবি’ বা শখ।
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছি যারা এটা অল্পবিস্তর করে থাকি। সেটা করতে করতে যে গণিত গবেষণার জগতে কি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলা যায়, সেটা দেখিয়ে গেছেন কাপ্রেকার।
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[১] লেখার প্রধান সূত্র: https://www-history.mcs.st-andrews.ac.uk/Biographies/Kaprekar.html
[২] ‘ম্যাথেমেটিক্যাল গেমস’ বলে মার্টিন গার্ডনার-এর একটি মাসিক কলাম বার হতো ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ ম্যাগাজিনে। এই কলাম-এর মাধ্যমেই কাপ্রেকার-এর নাম উঠে এসেছিলো গণিত গবেষণার জগতে। সেই কলাম সম্পর্কে কিছু কথা: https://blogs.scientificamerican.com/guest-blog/the-top-10-martin-gardner-scientific-american-articles/
[৩] হার্ডি-রামানুজন সংখ্যা ১৭২৯ হলো সবচেয়ে ছোট সংখ্যা যাকে দুটো সংখ্যার ঘনফলের যোগফল হিসেবে দুভাবে লেখা যায়:
১৭২৯ = ১৩ + ১২৩ = ৯৩ + ১০৩
সংখ্যাটার পিছনে একটা মজার গল্প আছে। উইকিপিডিয়া-তে দেখতে পারো: https://en.wikipedia.org/wiki/1729_(number)
[৪] Kaprekar, D. R. The Mathematics of New Self-Numbers Devaiali (1963): 19 – 20
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/mathematicsisfun