21-12-2024 16:12:31 pm
Link: https://bigyan.org.in/marvin-minsky
যন্ত্রের, বিশেষ করে কম্পিউটারের বোধবুদ্ধি — ইংরেজিতে যাকে বলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (artificial intelligence) — নিয়ে গবেষণার ফলাফল আমরা চারিদিকেই দেখতে পাই। অচেনা শহরে বন্ধুর সাথে দেখা করতে হবে? নো প্রবলেম! পকেটের স্মার্টফোন-এ গুগল ম্যাপ দেখিয়ে দেবে কোন বাস আর কোন ট্রেন ধরলে সবথেকে তাড়াতাড়ি গন্তব্যস্থলে পৌঁছনো যাবে। শোনা যাচ্ছে যে আর কয়েক বছরের মধ্যে গাড়ির চালকের আর দরকার হবে না — গাড়ি নিজেই নিজেকে চালাবে!
কল্পবিজ্ঞান লেখকরা অনেকদিন আগে থেকেই যান্ত্রিক বোধবুদ্ধি নিয়ে গল্প লিখেছেন। যেমন, ছোটবেলায় আমরা অনেকেই প্রফেসর শঙ্কুর যন্ত্রমানবদের কথা পড়েছি। এবিষয়ে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণার শুরু মার্কিন বিজ্ঞানী মার্ভিন মিনস্কির (১৯২৭-২০১৬) গবেষণা দিয়ে। একটা বৈদুতিন যন্ত্র বোধবুদ্ধির পরিচয় কিভাবে দিতে পারে, এই নিয়ে মার্ভিন চিন্তাভাবনা শুরু করেন পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে।
প্রথাগত ভাবে যখন আমরা কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখি, তখন সেই প্রোগ্রামে আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বলে দিই, কোন অবস্থায় কী করতে হবে। কম্পিউটার-চালিত যন্ত্রমানবকে আমি যদি হঠাৎ করে বলি, “আমার বাগানের গাছগুলোতে একটু জল দিয়ে দাও তো”, সে পড়বে অথই জলে। আমাকে নির্দেশগুলো পরপর সাজিয়ে দিতে হবে। অনেকটা এরকম:
এর পরেও, কলে যদি জল না থাকে, বা পাইপ-এ যদি ফুটো থাকে, যন্ত্রমানব কোন ভাবেই বুঝে উঠতে পারবে না কী করা উচিত। কোন যন্ত্র যদি বুদ্ধিসম্পন্ন হয়, তাহলে তার নিজে থেকেই শেখার ক্ষমতা থাকা উচিত — এই ভাবনা থেকে মার্ভিনের যাত্রা শুরু। আমার যন্ত্রমানব যদি বুদ্ধিসম্পন্ন হয়, তাহলে সে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নেবে “গাছে জল দেওয়া” মানে কী, আর দরকার মত ছোটখাটো সমস্যার (কলে জল নেই, ইত্যাদি) সমাধান কী, তা বুঝে নিতে পারবে।
যেকোনো যন্ত্রকে অভিজ্ঞতা থেকে শেখানোর মধ্যে প্রধান একটা প্রযুক্তি হল স্নায়ুজাল, বা নিউরাল নেটওয়ার্ক (neural network)। আমাদের স্নায়ুর মধ্যে কোটি-কোটি নিউরন একে অপরের সঙ্গে কাটাকুটি খেলে (সাইনাপ্স বানিয়ে) একটা ভয়ানক ঘ্যাঁটপাকানো জাল বানিয়ে ফেলেছে। সেইরকম, স্নায়ুজালেও আমরা চেষ্টা করি সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে কৃত্রিম নিউরন আর সাইন্যাপ্স-এর কাটাকুটি জাল বানানোর [১]। এই জাল-এর গঠন বদলাতে থাকে অভিজ্ঞতা (ট্রেনিং) থেকে, আর সেটাই যান্ত্রিক “শেখা” (মেশিন লার্নিং)।
বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম স্নায়ুজাল মার্ভিনের সৃষ্টি। ১৯৫১ সালে, ছাত্রাবস্থায় তিনি তৈরি করেন “SNARC” (Stochastic neural analog reinforcement calculator)। তখনও কম্পিউটারের প্রচলন হয়নি, হবে-হবে অবস্থায়, তাই মার্ভিন তাঁর স্নায়ুজাল তৈরি করেছিলেন বৈদ্যুতিন ভ্যাকুয়াম টিউব আর যান্ত্রিক ক্লাচ ব্যবহার করে। এই স্নায়ুজালের মধ্যে ছিল চল্লিশটা কৃত্রিম স্নায়ু (নিউরন)। প্রত্যেক স্নাুয়ুর ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিকোষ (শর্ট টার্ম মেমরি) হিসাবে মার্ভিন ব্যবহার করেছিলেন একটা ক্যাপাসিটর, আর দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিকোষ (লং টার্ম মেমরি) হিসাবে প্রত্যেকটি স্নায়ুর সঙ্গে জোড়া ছিল একটা পোটেনশিওমিটার, যার নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করত যান্ত্রিক ক্লাচ-টি।
এখনকার দিনে আমাদের আশেপাশে যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (যান্ত্রিক বোধবুদ্ধি) প্রযুক্তি দেখতে পাই, সেগুলো বেশীরভাগই এরকম স্নায়ুজালের আধুনিক সংস্করণ। মার্ভিন কিন্তু শুধু স্নায়ুজালে থেমে থাকেননি। তাঁর পরবর্তী জীবনের কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন, অন্য কোনোভাবে আমরা বোধবুদ্ধির গঠনকে বুঝতে পারি কিনা। মার্ভিন বলতেন, যে কোনো জিনিসকে প্রকৃতপক্ষে বুঝতে গেলে, সেটাকে শুধু একভাবে বুঝলে চলবে না। তাঁর কাজে ও চিন্তাভাবনার মধ্যে দিয়েও সেটা সবসময় প্রকাশ পেয়েছে।
যন্ত্র কিভাবে শিখবে, সেই নিয়ে ভাবতে ভাবতে তিনি কাজ শুরু করেন এম-আই-টি-র আর এক প্রফেসর, সিমোর প্যাপার্ট-এর সঙ্গে। ছোট বাচ্চারা কিভাবে শিখতে পারে, মেতে যান সেই গবেষণায়। সিমোর আর মার্ভিন মিলে তৈরি করেন এক নতুন তত্ত্ব — মনের সমাজ (সোসাইটি অফ মাইন্ড)। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের বোধবুদ্ধির উৎপত্তি হয় অনেক ছোট ছোট বোধবুদ্ধিহীন অংশের আদানপ্রদান থেকে।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, আমি একটা কাঠের টুকরো তুলে সেটাকে অন্য আরেকটা কাঠের টুকরোর উপর রাখতে চাই। খুদে বাচ্চারা তাদের দৈনন্দিন খেলাধুলার মধ্যে এরকম কাজ মাঝেমধ্যেই করে থাকে। কাজটা শুনে যতটা সহজ মনে হয়, মোটেই ততটা সহজ নয়। টুকরোটা সরাতে গেলে আমাকে প্রথমে দেখতে হবে চোখের সাহায্যে। তারপর কাঠের টুকরোটাকে মুঠো করে ধরতে হবে। সেটার জন্য চাই হাত, যাতে কিনা আঙুল লাগানো। তারপর টুকরোটাকে তুলতে হবে আর ঠিক জায়গায় নিয়ে গিয়ে হাল্কা করে ছেড়ে দিতে হবে। এগুলো যখন করছি, আমার আশেপাশের জগৎ সম্বন্ধেও কিছু তথ্য জানা ভালো — যেমন টুকরোটার একদিক যদি ছুঁচোলো হয়, সেই দিকটা রাখার সময় নিচের দিকে থাকলে চলবে না। এই পুরো ব্যাপারটা কিভাবে ঘটে, সেটা বোঝার জন্য ষাটের দশকের শেষের দিকে মার্ভিন বেশ কিছু বছর ধরে একটা যান্ত্রিক হাত এবং চোখ বানানোর গবেষণায় মেতে ছিলেন। এখান থেকেই ‘মনের সমাজ’ তত্ত্বের শুরু।
মার্ভিন বললেন যে, আমরা বোধ আর মন বলতে যা বুঝি, তার উৎপত্তি সহস্রকোটি “এজেন্ট”-দের মাধ্যমে। প্রত্যেকটা এজেন্ট শুধু একটাই কাজ করতে জানে। এই কাজগুলো এতটাই সহজ যে তার জন্য বুদ্ধি, অর্থাৎ আমরা বুদ্ধি বলতে যা বুঝি, সেটা লাগে না। আমি যদি কাঠের টুকরো সরাই, তাহলে সেই সরানোটা “দেখা”, “আঙুল পাকানো”, “হাত তোলা”, “হাত সরানো”, “ছেড়ে দেওয়া”, ইত্যাদি এজেন্টদের সম্মিলিত কেরামতি।
১৯৫৮ সালে মার্ভিন ম্যাসাচুসেট্স ইন্স্টিটিউট অব টেকনোলজি-তে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন, এবং ১৯৫৯ সালে জন ম্যাককার্থি-র সাথে এম-আই-টি-র আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাবরেটরি স্থাপন করেন। এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাবরেটরি বর্তমানে এম-আই-টি-র কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাবরেটরি-র (CSAIL-এর) অন্তর্ভুক্ত। মার্ভিনকে অনেকেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর জনক হিসাবে গণ্য করেন, কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে মার্ভিনের অবদান শুধু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এ থেমে থাকেনি। যান্ত্রিক স্নায়ুকোষ বানাতে হলে সত্যিকারের (অযান্ত্রিক) স্নায়ুকোষ ঘেঁটে দেখা প্রয়োজনীয়, আর তার জন্য দরকার উন্নত অনুবীক্ষণ যন্ত্রের। এই জন্য ১৯৫৭ সালে মার্ভিন এক নতুন ধরণের অনুবীক্ষণ যন্ত্র বানিয়ে ফেললেন — এই ধরণের যন্ত্রকে আমরা আজ কনফোকাল মাইক্রোস্কোপ বলে চিনি।
গানবাজনা নিয়েও গভীরভাবে চিন্তা করেছেন মার্ভিন। বলতেন, “যেমন আমরা খেলনা ব্লক নানাভাবে সাজিয়ে, ফেলে দিয়ে, স্পেস সম্বন্ধে শিখি, সেইভাবে সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে আমরা সময় নিয়ে খেলা করি। একটা সময়ের টুকরোকে তুলে নিয়ে কি আমরা অন্য টুকরোর মধ্যে গুঁজে দিতে পারি? যদি পাশাপাশি রাখি? তাহলে কেমন হয়? এর উত্তর সঙ্গীতচর্চায় মেলে।” [২] গানবাজনা নিয়ে তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনায় থেমে থাকেননি মার্ভিন। মাঝেমাঝেই তাঁকে দেখা যেত মিডিয়া ল্যাবের একতলায় একমনে পিয়ানো বাজিয়ে চলেছেন।
জীবনকালে অনেক উপাধি, অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন মার্ভিন। কম্পিউটার সায়েন্সের সর্বোচ্চ সম্মান, টিউরিং অ্যওয়ার্ড মার্ভিনকে দেওয়া হয় ১৯৬৯ সালে। কিন্তু মার্ভিনের সবচেয়ে গভীর প্রভাব টের পাওয়া যায় তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দিয়ে। মার্ভিনের ছাত্রছাত্রীরা আজকে কম্পিউটার সায়েন্স ও আর্টিফিশিায়াল ইন্টেলিজেন্সের গবেষণায় দিকপাল। নানা ভাবে গবেষণার নানা জায়গায় তাঁরা গভীর ছাপ ফেলেছেন। শুধু তাই নয়, অনেকসময় তাঁরা গবেষণায় থেমে থাকেননি, ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিয়ে গবেষণার ফল পৌঁছে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্ভিনের ছাত্র ড্যানি হিলিস ‘ম্যাসিভলি প্যারালাল কম্পিউটিং’ (massively parallel computing) নিয়ে তাঁর পি-এইচ-ডি গবেষণার ফল অন্যান্য গবেষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্থাপণ করেন “থিঙ্কিং মেশিনস কর্পোরেশন”। এই সংস্থার “কানেকশন মেশিন-৫” সুপারকম্পিউটার ১৯৯৩ সালে বিশ্বের সবথেকে তাগড়াই কম্পিউটারের খেতাব পায়। ড্যানি হিলিস পরে এক জায়গায় বলেছেন, “মার্ভিন আমাকে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন”।
কয়েক মাস আগে, মিডিয়া ল্যাবের তিরিশ বছর পুর্তি উপলক্ষ্যে মার্ভিনকে একটা ভাস্কর্য উপহার দেওয়া হয়। উপহার পেয়ে মার্ভিনের প্রশ্ন, “ওমা, কি সুন্দর জিনিস। এটা কী করে?” [৩] জীবনের শেষ দিন অবধি মার্ভিন এইধরণের প্রায় শিশুসুলভ কৌতুহল আর রসিকতা নিয়ে জগতটাকে বোঝার চেষ্টা করে গেছেন। বোঝার জিনিসটা তাঁর গবেষণার আওতায় পড়ে কি পড়ে না, তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাননি। এর ছোঁয়াচ মার্ভিনের সহকর্মী আর ছাত্রদের মধ্যেও টের পাওয়া যায় — আর এটাই হয়তো মার্ভিনের সব থেকে বড় অবদান।
(প্রচ্ছদের ছবি: উইকিপিডিয়া)
অন্যান্য টুকিটাকি:
[১] নিউরাল নেটওয়ার্ক বা স্নায়ুজাল নিয়ে বিশদভাবে জানতে চাইলে এই ইউটিউব ভিডিওগুলো দেখুন।
[২] সঙ্গীত নিয়ে মার্ভিনের ভাবনাচিন্তা বিশদে জানতে এই লেখাটি পড়ুন।
[৩] নিজের চোখেই দেখুন মার্ভিনের উৎসাহ, এই ভিডিওটিতে।
[৪] সায়মিন্দু দাশগুপ্ত এম.আই.টি. মিডিয়া ল্যাব-এর ছাত্র। মিডিয়া ল্যাব-এ ‘লাইফলং কিন্ডারগার্টেন‘ গবেষক দলটির সদস্য সায়মিন্দু। ‘স্ক্র্যাচ’ নামক শিশুদের উপযোগী একটা প্রোগ্রামিং ভাষা নিয়ে তার গবেষণা। ‘স্ক্র্যাচ’ সম্বন্ধে বিশদে জানতে বিজ্ঞান-এর এই লেখাটি পড়ুন।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/marvin-minsky