21-01-2025 09:55:34 am
Link: https://bigyan.org.in/jonaki-aloke
ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ।
আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ॥
তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র, তোমার তাই ব’লে কি কম আনন্দ।
তুমি আপন জীবন পূর্ণ ক’রে আপন আলো জ্বেলেছ॥
তোমার যা আছে তা তোমার আছে, তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে,
তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে তারি আদেশ পেলেছ।
তুমি আঁধার-বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠ, তুমি ছোটো হয়ে নও গো ছোটো,
জগতে যেথায় যত আলো সবায় আপন ক’রে ফেলেছ॥”— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (“জোনাকী” বানান অপরিবর্তিত)
বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে এমনি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম সন্ধ্যেবেলা। অন্ধকার করে এসেছে। ইটের বাঁধানো রাস্তার দুপাশে টিম টিম করে জ্বলছে শ’য়ে শ’য়ে জোনাকি। যেন আকাশের তারারা সবাই মাটিতে নেমে এসেছে। বড় স্নিগ্ধ মায়াময় তাদের আলো। মনে হচ্ছে আমি চলেছি এক স্বপ্নলোকের দিকে। আর ওরা যেন আমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। এত জোনাকি বহুদিন দেখিনি। অন্ধকারের মধ্যে যেন ওরা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। হাঁটু মুড়ে বসলাম জোনাকিদের পাশে। অন্ধকারের ঘন চাদর যেন আরও ঢেকে গেল চারদিকে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ আমার মাথায়, হাতে বসতে শুরু করলো, সম্পূর্ণ উদাসীন আমার অস্তিত্বে।
“জোনাকি, কোথা থেকে পেলে এমন মায়াভরা আলো?” ওদেরই যেন জিগ্যেস করলাম।
“আমাদের মধ্যে কিছু রাসায়নিক বস্তু আছে, যা থেকে এমন আলো বেরোয়, তোমার ভালো লেগেছে?” চমকে উঠলাম। জোনাকি আমার সাথে কথা বলছে নাকি? বিশ্বাস হলো না। আশেপাশে তাকালাম, কেউ তো নেই। কে কথা বলল তাহলে?
“এদিক ওদিক দেখছ কেন? আমরাই তো কথা বলছি তোমার সাথে”, হাতের ওপরে বসা জোনাকি কথা বলে উঠলো। আমি স্বপ্ন দেখছি নিশ্চয়। ভাবলাম যতক্ষণ এই স্বপ্ন চলে ততক্ষণই ভালো।
“তাহলে তোমরাই আমায় বলো কি রাসায়নিক পদার্থ আছে তোমাদের মধ্যে?” গল্প জুড়ে দিলাম ওদের সাথে।
“জোনাকি লুসিফেরিন (firefly luciferin) বলে একরকম যৌগপদার্থ আছে যা লুসিফারেজ (luciferase) বলে এক উৎসেচকের সাহায্যে এটিপি (ATP = adenosine triphosphate) এবং অক্সিজেনের উপস্থিতিতে ডাইঅক্সিটেন (dioxetane) গোত্রের যৌগ তৈরি করে। তারপর স্বতঃস্ফূর্তভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি করে আর তার সঙ্গে তৈরি করে অক্সিলুসিফেরিন (oxyluciferin)। এই অক্সিলুসিফেরিন উত্তেজিত অবস্থায় সবজে-নীল আলো বিকিরণ করে তারপর শান্ত হয়।” জোনাকি এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নিল।
আমি তো অবাক। জিগ্যেস করতেই যাচ্ছিলাম যে ওরা এত জানলো কি করে? এর মধ্যে একটা গাড়ি চলে এলো তার উগ্র হেডলাইট জ্বালিয়ে। জোনাকিরা যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
“কি রে শান্তনু, এখানে কি করছিস? মোল্লা নাসিরুদ্দিনের মত হারানো চাবি খুজছিস নাকি? চল, বাড়ি চল।” দীপঙ্করের বিরক্তিকর গলা ভেসে এলো।
“তোর কাজই হলো সব কিছু পণ্ড করা।” বিরক্তি নিয়েই উঠে বসলাম ওর গাড়িতে। বললাম ওকে এতক্ষণ যা হলো। এর পর যা হলো তা তো আপনারা আন্দাজ করতেই পারেন। আমার মানসিক অবস্থা নিয়ে ব্যঙ্গ চলল কিছুক্ষণ। তবে দীপঙ্কর ছেলেটা ভালো আর একজন রসায়নবিদ হওয়াতে এসব ভালই জানে, তাই আমাকে কিছু ইতিহাসও শুনিয়ে দিল।
“আরে জানিস তো জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিজ্ঞানী, জীববিদ্যার উইলিয়াম ম্যাকেলরয় আর রসায়নের এমিল হোয়াইট দুজনে মিলে জোনাকির আলো (bioluminescence) নিয়ে অনেক কাজ করেছেন বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। ম্যাকেলরয় তো লোকজনকে পাঠাতেন জোনাকি ধরে আনার জন্য। উনি লুসিফারেজের ওপর অনেক কাজ করেছেন। আর এমিল হোয়াইট প্রথম লুসিফেরিনের গঠন আবিষ্কার করেন এবং তাঁর রসায়নাগারে সেই অণুটি তৈরিও করেন।” গাড়ির মধ্যে অন্ধকারেও বেশ বুঝলাম দীপঙ্করের চোখ উৎসাহে জ্বলজ্বল করছে।
কদিন পরে এই নিয়ে একটু পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখলাম ভারতের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ বড়ুয়া ও তাঁর ছাত্র জোনাকির মধ্যে অক্সিজেনের সর্বক্ষণ উপস্থিতি সুনিশ্চিত করে তার আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন। ভেবে দেখো যদি এরকম আলো অনেক বড়মাপে তৈরি করা যায় তাহলে রাস্তার পাশে লাগিয়ে রাখলে আর পথবাতি (street light) দরকার পড়বে না।
পরের দিনেই দেখলাম মার্কিনদেশে ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে কিছু বিজ্ঞানী আলো বিকিরণ করে এমন গাছ বানিয়ে ফেলেছেন আর সেটা তারা নাকি এই বছরের শেষে বিক্রিও করবেন। আমি তো এখনি একখানা চেয়ে রেখেছি।
বিশদে জানতে :
১) https://www.glowingplant.com/
২) https://www.photobiology.info/Lee-Vysotski.html
৩) https://en.wikipedia.org/wiki/Photinus_pyralis
৪) https://www.natureasia.com/en/nindia/article/10.1038/nindia.2010.88
৫) অক্সিলুসিফেরিনের আলো বিকিরণের ব্যাখ্যা Woodward-Hoffmann rules থেকে পাওয়া যায়, কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আরও জানতে পারো এখান থেকে :
https://sites.google.com/site/learnorganicchem/phys-org-topics/woodward-hoffmann-rules
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/jonaki-aloke