21-12-2024 16:45:28 pm
Link: https://bigyan.org.in/ising-model-failure-and-success
বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আবিষ্কারের এমন অনেক কাহিনী নজরে পড়ে, যেখানে দেখা যায় বিজ্ঞানী নিজেই সে সময় তাঁর আবিষ্কারের গুরুত্ব বোঝেননি। তিনি তাঁর গবেষণালব্ধ ফলটিকে নিতান্ত তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন।
পরবর্তী কালে অপর কোনো গবেষক ঠিকই খুঁজে পান সেই বহুমূল্য রত্নকে। তিনি এবং আরও অনেকে মিলে সেটাকে ঘষে-মেজে উজ্জ্বল ও বর্ণময় করে তোলেন তখন। সাধারণত বিজ্ঞান সাধণা বৃথা হয়না।
এই প্রবন্ধ এরকমই এক ‘তুচ্ছ’ গবেষণাকে নিয়ে লেখা। কালক্রমে বোঝা যাবে যার গুরুত্ব। স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্সের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠবে সেই আবিষ্কার। আবিষ্কারের কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কারকের জীবনের নানা আঁক-বাঁকগুলোও গুরুত্ব পেল। তার কারণও রয়েছে। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের আঁচ লেগেছে এই বিজ্ঞানীর জীবনে। এ লেখায় তাঁর জীবনের ঘটনাবহুল অভিজ্ঞতার টুকরো টুকরো কিছু বর্ণনা তাই স্থান পেল।
বিশ শতকের প্রথম দিকে পদার্থের চৌম্বক ধর্ম, বিশেষ করে ফেরোম্যাগনেটিক (ferromagnetic) প্রকৃতির, অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত চুম্বকত্বের, ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। লোহা, নিকেল বা কোবাল্ট-এর মতো কিছু প্রাকৃতিক মৌল এবং এদের কয়েকটা যৌগের ঠিক কী কারণে ফেরোম্যাগনেটিক ধর্ম বা স্বতঃস্ফূর্ত চুম্বকত্ব রয়েছে তা ভাবিয়ে তুলেছিল বিজ্ঞানীদের। ১৯১১ সালে নীলস্ বোর এবং হেন্ডরিকা জোহানা ভান লিউয়েন প্রায় একই সঙ্গে পৃথকভাবে প্রমাণ করলেন যে পদার্থের চৌম্বক ধর্ম কোনোভাবেই সনাতন অর্থাৎ ক্লাসিকাল তত্ত্বের সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। একমাত্র কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যেই পদার্থের এই রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব।
এর বেশ কয়েক বছর পর, ১৯২০-তে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে, জার্মানির হামবুর্গ ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের প্রফেসর উইলহেম লেঞ্জ দাবি করলেন, কঠিন পদার্থের মধ্যে অণু-চুম্বকদের বিন্যাস সম্পর্কে সনাতন যে ধারণা অর্থাৎ ‘অণু-চুম্বকরা যেকোনো অভিমুখে থাকতে পারে’ – আদপে তা সঠিক নয়। তাঁর মতে, কঠিনে অণু-চুম্বকেরা কেবলমাত্র ‘আপ’ এবং ‘ডাউন’ – এই দুই অভিমুখী হতে পারে। অর্থাৎ যে কোনো কোণ নয়, কেবলমাত্র ১৮০ ডিগ্রী কোণেই তাদের ঘূর্ণন সম্ভব, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘টু-স্টেট’ বিন্যাস।
অণু-চুম্বকদের বিন্যাসে এই ‘কোয়ান্টাম-রেস্ট্রিকশন’ আরোপ করে লেঞ্জ কঠিন পদার্থের প্যারাম্যাগনেটিক ধর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কুরীর সূত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। কুরীর সূত্রটি হল, প্যারাম্যাগনেটিক পদার্থের চৌম্বক প্রবণতা পরম উষ্ণতার (absolute temperature) ব্যস্তানুপাতিক অর্থাৎ উষ্ণতা বাড়লে চৌম্বকত্ব সরলরৈখিক হারে কমে। লেঞ্জ তাঁর গবেষণাপত্রের শেষাংশে উল্লেখ করলেন – অণু চুম্বকদের এই ‘টু-স্টেট’ বিন্যাস ধরে নিয়ে ফেরোম্যাগনেটিক প্রকৃতি অর্থাৎ কুরী উষ্ণতার নীচে পদার্থের স্বতঃস্ফূর্ত চুম্বকত্বের আণবিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। লেঞ্জ-এর এই দাবি নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ, যদিও এর সপক্ষে কোনও প্রমাণ ছিল না স্বল্প দৈর্ঘ্যের সেই গবেষণাপত্রে।
১৯২২ সাল। হামবুর্গ ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট কোর্সের এক ছাত্র, উইলহেম লেঞ্জ-এর অধীনে গবেষণার জন্য খুবই আগ্রহী। ছাত্রটির নাম আর্নস্ট আইজিং। বাইশ বছরের তরুণ আইজিং-কে প্রফেসর লেঞ্জ-এর পছন্দ হল। তিনি আইজিং-কে তাঁর কাজের অসমাপ্ত অংশটি নিয়ে গবেষণা করতে পরামর্শ দিলেন। টার্গেট হল – স্বতঃস্ফূর্ত চুম্বকত্বের রহস্য উন্মোচন।
আইজিং যেন এমনই একটা কিছুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিজ্ঞানের আঙিনায় পা রাখা মোটেই সহজ হয়নি আইজিং-এর। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে-না-পেরোতেই বাধ্য হতে হয়েছিল মিলিটারি ট্রেনিং-এ যেতে। সেটা ১৯১৮। পড়াশোনা গেল সব বন্ধ হয়ে। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে ছিল অন্যকিছু লেখা। ট্রেনিং শেষে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার ঠিক পূর্ব-মুহূর্তেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতি ঘটল। আইজিং তখন তাঁর অতি প্রিয় দুই বিষয়, গণিত ও পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়তে গেলেন গটিঞ্জেন ইউনিভার্সিটিতে। আর তারপর এই গবেষণার সুযোগ লাভ। আইজিং লুফে নিলেন লেঞ্জ-এর প্রস্তাব।
আইজিং-এর প্রথম কাজ হল, উপযুক্ত একটা গাণিতিক মডেল ধরে নেওয়া যার সাহায্যে অণু-চুম্বকদের একমুখী সজ্জার ব্যাখ্যা মেলে। অতি সরল এক মডেলেই এই ধর্ম প্রকাশ পেল। বিজ্ঞানীরা একটা বিষয় স্পষ্ট বুঝেছিলেন যে, বাইরের কোনো চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাব ছাড়াই ফেরোম্যাগনেটিক দশায় যেহেতু স্বতঃস্ফূর্ত চুম্বকত্ব প্রকাশ পায় তাই পদার্থের মধ্যে পাশাপাশি থাকা অণু-চুম্বকরা নিশ্চয়ই একই দিকে তাক করে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, দুটো অণু-চুম্বক পাশাপাশি কিভাবে একই অভিমুখে থাকতে পারে? চুম্বক সম্পর্কে আমাদের যে বাস্তব অভিজ্ঞতা এ-যে তার উল্টো কথা! কারণ, দুটো দণ্ডচুম্বক নিজেদের মধ্যেকার আকর্ষণ-বিকর্ষণ বলের প্রভাবে সবসময় পরস্পর বিপরীতমুখী হয়, যাতে একটার উত্তর মেরুর পাশে অন্যটার দক্ষিণ মেরু থাকে।
অণু-চুম্বকদের ক্ষেত্রে কিন্তু একেবারে অন্য ঘটনা ঘটে, যার ব্যাখ্যা কেবলমাত্র কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যেই দেওয়া সম্ভব। দুটো সমমুখী অণু-চুম্বকের মধ্যে এক ধরণের আকর্ষণ কাজ করে, বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘এক্সচেঞ্জ-ফিল্ড’ (exchange field) এবং এই তত্ত্বের যিনি প্রস্তাবক, সেই ফরাসি পদার্থবিদ পিয়ের ভাইস-এর নাম অনুসারে একে ‘ভাইস-ফিল্ড’-ও বলা হয়। অণু-চুম্বকদের মধ্যেকার এই আকর্ষণ শক্তি ও তাপশক্তির মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা চলে। কম উষ্ণতায়, তাপশক্তির তুলনায় আকর্ষণ শক্তির প্রভাব যখন বেশি হয়, তখন পদার্থের ফেরোম্যাগনেটিক দশা বজায় থাকে ও স্বতঃস্ফূর্ত চুম্বকত্ব প্রকাশ পায়। উষ্ণতা যত বৃদ্ধি পায় অণু-চুম্বকদের একমুখী সজ্জা ক্রমশ নষ্ট হয় ও একটা বিশেষ উষ্ণতায় (কুরী উষ্ণতা) পদার্থ ফেরোম্যাগনেটিক থেকে প্যারাম্যাগনেটিক দশায় চলে যায়। প্যারাম্যাগনেটিক দশায় অণু-চুম্বকগুলো এলোমেলো হয়ে থাকে, তার ফলে বাইরের চৌম্বক ক্ষেত্রের অনুপস্থিতিতে স্বতঃস্ফূর্ত চুম্বকত্ব আর দেখা যায় না। এবার দেখা যাক আইজিং ঠিক কি করলেন।
প্রাথমিকভাবে প্রবলেমটাকে গাণিতিক দিক থেকে সহজতর করার জন্য অণু-চুম্বকদের একমাত্রিক-সজ্জা, অর্থাৎ ‘ওয়ান-ডাইমেনশানাল চেন’-এই বিশেষ ক্ষেত্র বেছে নিলেন তিনি। পাশাপাশি থাকা দুটো অণুচুম্বকের মধ্যে সক্রিয় ‘ভাইস ফিল্ড’-এর প্রভাবে যে আকর্ষণ শক্তির সৃষ্টি হয় তার এক গাণিতিক রূপ বা মডেল ধরে নিলেন যা অণু চুম্বকদের সমমুখী হতে সাহায্য করবে। এবার অঙ্ক কষার পালা। ‘ইক্যুইলিব্রিয়াম-স্ট্যাটিস্টিকাল-মেকানিক্স’-এর প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণ করলেন আইজিং। অণুচুম্বকদের সম্মিলিত ক্রিয়ায় যে চৌম্বক ধর্ম প্রকাশ পায় তার রাশিমালা, কিংবা আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, ‘ম্যাক্রোস্কোপিক-ম্যাগনেটাইজেসন’-এর সঙ্গে অণুচুম্বকদের চৌম্বক-ভ্রামক, উষ্ণতা, প্রযুক্ত চৌম্বক ক্ষেত্র – এসবের পারস্পরিক গাণিতিক সম্পর্ক বের করে ফেললেন।
সম্পর্ক একটা পাওয়া গেল ঠিকই, কিন্তু এক ঘোরতর সমস্যা দেখা দিল। বাস্তব উষ্ণতায়, বাইরের চৌম্বক ক্ষেত্রের অনুপস্থিতিতে ফেরোম্যাগনেটিক ধর্মের ব্যাখ্যা যে পাওয়া যাচ্ছে না এই গাণিতিক সম্পর্ক থেকে! অর্থাৎ, তাঁর গণিত আভাস দিচ্ছে যে প্রফেসর লেঞ্জ-এর অনুমান সত্য নয় অর্থাৎ, এই সরল গাণিতিক মডেল স্বতঃস্ফূর্ত চুম্বকত্বের ব্যাখ্যা দেয় না!
নোবেলজয়ী পদার্থবিদ উলফ্গ্যাং পাউলি তখন হামবুর্গ ইউনিভার্সিটির অন্যতম অধ্যাপক। প্রফেসর লেঞ্জ এবং পাউলি এই দুই দিকপাল বিজ্ঞানীর সঙ্গে সমস্যাটা আলোচনা করলেন আইজিং। মডেলটার আশানুরূপ সাফল্য না মেলায় হতাশ হলেন তাঁরা। সকলেই আশা করেছিলেন, এই মডেল-এর সাহায্যে প্যারাম্যাগনেটিক থেকে ফেরোম্যাগনেটিক দশা পরিবর্তন ঘটনার ব্যাখ্যা মিলে যাবে। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন কুরী উষ্ণতায় এই ঘটনা ঘটে। অনেকটা সেই স্ফুটনাঙ্কে পৌঁছে তরলের বাষ্পে পরিণত হওয়ার মতো। আইজিং-এর মডেল কিন্তু কুরী উষ্ণতার বাস্তব কোনো মানে এই ধরণের দশা পরিবর্তন দেখালো না।
আইজিং-এর গবেষণায় এটুকুই জানা গেল যে একমাত্রিক সজ্জার ক্ষেত্রে অণু চুম্বকেরা কেবলমাত্র পরম শূন্য উষ্ণতায় ফেরোম্যাগনেটিক ধর্ম প্রকাশ করে কিন্তু বাস্তব উষ্ণতায় কোনরকম স্বতঃস্ফূর্ত চুম্বকত্ব দেখায় না। এরপর ‘হায়ার-ডাইমেনশান’ ত্রিমাত্রিক দেশে অনুরূপ পদ্ধতিতে সমাধান বের করতে গিয়ে আইজিং বুঝলেন কাজটা প্রায় অসম্ভব। তবুও কিছুটা অনুমানের ওপর ভর করে, আইজিং এক ধাপ এগিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে ত্রিমাত্রিক সজ্জার ক্ষেত্রেও ফলাফল অন্য কিছু হতে পারে না। একমাত্রিক সজ্জার অনুরূপ ফলই হবে। প্রশ্ন হল, আইজিং-এর শেষোক্ত এই সিদ্ধান্তটি কি সঠিক ছিল? এর উত্তর মিলেছিল আরও দু-দশক পরে। একমাত্রিক সজ্জায় এই মডেল-এর সমাধান সহজ হলেও দুই বা তিন মাত্রিক ক্ষেত্রে অঙ্কটা দেখা গেল বেশ কঠিন। ১৯৪৪-এ লার্স অন্সাগার দ্বিমাত্রিক-তলের ক্ষেত্রে (two dimensional) আইজিং মডেলের সমাধান নির্ণয় করতে সক্ষম হলেন। তিনি দেখালেন, বাস্তব উষ্ণতায় (T > 0 K) এই মডেল স্বতঃস্ফূর্ত চুম্বকত্ব প্রকাশ করে। কিন্তু ত্রিমাত্রিক সজ্জার ক্ষেত্রে অন্সাগার-এর সমাধানের অনুরূপ কোনো সমাধান পাওয়া সম্ভব হয়নি। যদিও কম্পিউটার সিমুলেশনের সাহায্যে জানা যায় নিম্ন উষ্ণতায় তিন-মাত্রিক আইজিং মডেলও স্বতঃস্ফূর্ত চুম্বকত্ব দেখায়।
১৯২৪-এ হামবুর্গ ইউনিভার্সিটি থেকে আইজিং যখন গ্র্যাজুয়েট হলেন, তখন এই সরল মডেল-এর কাজটাই তাঁর পি-এইচ-ডি থিসিসের সারবস্তু ছিল। জার্মান গবেষণা পত্রিকা, ‘Zeitschrift für Physik’ -এ (Volume- 31, Page- 253) ১৯২৫ সালে এই বিষয়ে একটা পেপারও প্রকাশিত হল। দেখা গেল গবেষক একজনই – আর্নস্ট আইজিং। গাইড প্রফেসর লেঞ্জ-এর নাম সেখানে নেই। বোঝাই যায়, কাজটার ‘মেরিট’ বা কার্যকারিতা নিয়ে লেঞ্জ এতটুকুও সন্তুষ্ট ছিলেন না। লেঞ্জ-এর বিচারে এই সরল মডেল ছিল ‘গুরুত্বহীন’।
অদূর ভবিষ্যতে লেঞ্জ-আইজিং-এর এই মডেল যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তা কারও পক্ষেই আন্দাজ করা সম্ভব ছিল না। গবেষণা পত্রে লেঞ্জ-এর নাম না থাকায় ‘আইজিং-মডেল’ নামেই এটি পরিচিত হল। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এরকম দ্বিতীয় আর কোনও উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে গাইডের নামে নয়, আবিষ্কার ছাত্রের নামে বিখ্যাত হয়েছে। যদিও পরবর্তী কালে একাজের সাফল্যের পিছনে তাঁর গাইড অধ্যাপকের অবদানের কথাই উল্লেখ করতেন আইজিং।
গ্র্যাজুয়েশনের পর আইজিং বার্লিনের এক ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থার পেটেন্ট দপ্তরে কাজ পেলেন। কিন্তু একাজে মন ভরে না। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এক বোর্ডিং স্কুলে শিক্ষকতার কাজ জুটে গেল আইজিং-এর। খুঁজে পেলেন কর্মজীবনের সঠিক ঠিকানা। মন-প্রাণ ঢেলে পড়াতে থাকলেন।
গবেষণার জগত থেকে আইজিং তখন বহু মাইল দূরে। সেখানকার কোনও খবরই আর তাঁর কাছে এসে পৌঁছয় না। তিনি জানতেও পারছেন না যে তাঁর কাজ ‘আইজিং-মডেল’ নামে একাধিক গবেষণা পত্রে জায়গা করে নিচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ এক চর্চার বিষয় হয়ে উঠছে ক্রমে। এসব কিছু তিনি জানতে পারবেন আরও বেশ কয়েক বছর পরে।
জার্মানির উচ্চশিক্ষা-বিভাগের সরকারী পরীক্ষায় সফল হলেন আইজিং। সেটা ১৯৩০। সেই একই বছরে তিনি ঘর বাঁধলেন পুরনো বান্ধবী জোহানা এমার-এর সাথে। এবং বার্লিনের কাছাকাছি এক সরকারী হাইস্কুলে শুরু করলেন শিক্ষকতা। কিন্তু বাধ সাধলো দেশের ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা।
১৯৩৩-এর জানুয়ারী। হিটলার এলেন ক্ষমতায়। রাতারাতি চাকরী খোয়ালেন জার্মানির সমস্ত ইহুদী সরকারী কর্মী। আইজিং ইহুদী হওয়ায় তাঁকে একটা বছর প্রায় বেকার জীবন কাটাতে হল। কাজের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ান আইজিং।
এমন সময় ইহুদী ছাত্রছাত্রীদের এক বোর্ডিং-স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব এসে গেল। ১৯৩৪-এ। বার্লিন শহর থেকে প্রায় চল্লিশ কিমি দূরের এক নির্জন প্রাকৃতিক স্থান – কাপুথ। সারি সারি পাইন গাছের পাহারায় ঘেরা মনোরম সেই কাপুথেই এই বোর্ডিং-স্কুল। আইজিং জানেন এ-এক ‘তীর্থস্থান’। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সামার-হাউস যে এখানেই। আর তার ঠিক পাশেই এই স্কুল।
বছর দুই আগে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আমেরিকা পাড়ি দিয়েছেন আইনস্টাইন। তার আগে তিনি এই সামার-হাউসে কাটিয়ে গেছেন ১৯২৯ থেকে ১৯৩২-এর অধিকাংশ সময়টাই।
আইনস্টাইনের সামার-হাউসের কয়েকটি ঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছে স্কুলের প্রয়োজনে। আবাসিকদের সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে, কারণ জার্মানিতে তখন সরকারী স্কুলগুলো থেকে ইহুদী ছাত্র-ছাত্রীদের বের করে দেওয়া হচ্ছে।
যে বাড়িতে আইজিং-দম্পতির থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানে কোনো স্নানের বাথটাব না থাকায় আইসিং প্রায়শই আইনস্টাইনের স্নানাগার ব্যবহার করতেন। এ-এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা আইজিং-এর জীবনে।
কয়েক বছর শিক্ষকতার পর বোর্ডিং-স্কুলের প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব পেলেন আইজিং। সেটা ১৯৩৭।
১৯৩৮ এর ১০ই নভেম্বর সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল। স্কুল বিল্ডিংটাকে ধ্বংস করে দেওয়া হল। সেসময় ইহুদীদের ওপর যে চরম নির্যাতন নেমে এসেছিল এ-ঘটনা তারই এক খন্ডিত চিত্র মাত্র। আইজিং-কেও ছাড়া হল না। ১৯৩৯-এর, ২৭শে জানুয়ারীর কাক-ভোরে নাৎসি জার্মানির পুলিশবাহিনী তুলে নিয়ে গেল তাঁকে। দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে চলল জেরা-পর্ব। শেষমেশ জন্মভূমি জার্মানি ত্যাগ করার শপথ পাঠ করিয়ে ছাড়া হল আইজিং-কে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আইসিং-এর জীবনকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। প্রায় বারোটা বছর চলল আইজিং-দম্পতির কঠিন জীবন-সংগ্রাম। পরবর্তী কালে, আর্নস্ট আইজিং-এর পুত্র, টমাস আইজিং, তাঁর পিতা-মাতার এই দুর্বিষহ সময়কাল প্রসঙ্গে তাঁর মা এক-কথায় যা বলতেন তা জানিয়েছেন – “12 years on a tightrope” ।
শেষপর্যন্ত, ১৯৪৭-এ পাকাপাকিভাবে দেশ ত্যাগ করে আমেরিকা পৌঁছলেন আইজিং-দম্পতি।
১৯৪৮ সাল। আর্নস্ট আইজিং তখন আমেরিকার ব্র্যাডলি ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স প্রফেসর। বিজ্ঞানের বিভিন্ন জার্নাল ঘেঁটে আইসিং জানতে পারলেন তাঁর নামে পরিচিত হওয়া মডেলের কথা – মডেলটার জনপ্রিয়তার কথা। আইজিং-এর মনে ভেসে উঠল গাইড প্রফেসর লেঞ্জের মুখ। এ কাজের সিংহভাগ কৃতিত্ব যে তাঁরই! দ্বি-মাত্রিক ও ত্রি-মাত্রিক দেশে অর্থাৎ হায়ার ডাইমেনশন-এ প্রফেসর লেঞ্জের অনুমান যে সঠিক ছিল তাও ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত। ফেরম্যাগনেটিক চৌম্বকত্বের ব্যাখ্যা এভাবে তাদের মডেলের মধ্যেই নিহিত ছিল, অথচ তাঁরা সেটা বুঝতেই পারলেন না সে-সময়! এই ভেবে আইজিং বিস্মিত হন।
যাইহোক, আইজিং-কে গবেষণার কাজ বিশেষ আর টানে না। টিচিং-ই তখন তাঁর প্রথম পছন্দের বিষয়। আইসিং-এর ক্লাসে ছাত্রেরা ভিড় করে। করবেনাই-বা কেন? পড়ানোর সময় তিনি যে নানা ছোটখাটো পরীক্ষা হাতে-কলমে করে দেখান। প্রাঞ্জল করে তোলেন পড়ানোর বিষয়-বস্তুকে। আর রয়েছে তাঁর সূক্ষ্ণ রসবোধ, যা তিনি সযত্নে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন তাঁর জীবনে বয়ে যাওয়া প্রবল ঝড়ঝাপটার হাত থেকে। শিক্ষক আইজিং বিশ্বাস করেন কোনো ক্লাসে প্রতি ঘণ্টায় যদি একবারও হাসির রোল না ওঠে তবে সেটা ক্লাসই নয়।
ব্র্যাডলি ইউনিভার্সিটিতেই কর্মজীবনের শেষদিন (১৯৭৬) পর্যন্ত তিনি মগ্ন ছিলেন শিক্ষকতার কাজে। না, আর কোনো গবেষণা পত্র প্রকাশ করেননি তিনি। ১৯৬৯-এর এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল প্রায় ১৬০০০ গবেষণা পত্রে উল্লেখিত কাজ গড়ে উঠেছে আইজিং-মডেলকে ভিত্তি করে। আর এখনকার এই আধুনিক সময়ের গবেষণায়ও আইজিং-মডেল একই রকম প্রাসঙ্গিক। প্রতিবছর কমপক্ষে ৮০০ গবেষণা পত্রে উল্লেখ থাকে এই অতি সরল গাণিতিক মডেল।
কিন্তু, কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে এই মডেলের, যার জন্য তা এত গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্নটা বর্তমান গবেষকদের মনে আসে। তাঁরা উত্তর খোঁজেন। এই মডেলের সারল্যের মধ্যেই কি লুকিয়ে আছে এর জনপ্রিয়তা? এমন অনেক বাস্তব তন্ত্র বা ‘সিস্টেম’ রয়েছে, যাদের অণু বা পরমাণুদের মধ্যেকার আকর্ষণ, এই মডেল অনুসরণ করলে সহজ হয় সমাধান খুঁজে পাওয়া। তন্ত্রের ‘ফিজিক্যাল’ বা ভৌত ধর্মের পাওয়া যায় প্রাথমিক একটা ধারণা।
না, শুধু্মাত্র এটাই নয়, সারল্যের দিকটাকে সরিয়ে রেখেও এই মডেলের আর একটা দিক বিবেচ্য। আইজিং মডেল-এ, অণু-চুম্বক বা ‘স্পিন’-দের কেবলমাত্র সম্ভাব্য দু্টো ‘ওরিয়েন্টেশান’-এর কথাই ধরা হয় – ‘আপ’ এবং ‘ডাউন’। একেবারে বিপরীত-সম্ভাবনার এই ‘দ্বি-রূপ’ বা ‘বাইনারিটি’ এই মডেলের আসল শক্তির জায়গা। আর তাতেই বেড়েছে আইজিং মডেলের প্রয়োগক্ষেত্র ও বৈচিত্র। এর গুরুত্ব শুধুমাত্র আর চুম্বকের মডেলেই সীমাবদ্ধ রইল না। গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ঘটল।
তরল হিলিয়ামের দশা পরিবর্তন অথবা সাধারণ তরলের কঠিন কিংবা বাস্পে পরিণত হওয়ার আণবিক ব্যাখ্যায় আইজিং মডেলকে সফলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি বায়োলজি ক্ষেত্রে, প্রোটিন অণুর ‘ফোল্ডিং-আনফোল্ডিং’-এই দশা পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় অথবা নিউরাল নেটওয়ার্ক গবেষণায় এই মডেল ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। একেবারে ভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন স্যোসাল নেটওয়ার্ক, অথবা কোয়ান্টাম কম্পুটেশান, এসব ক্ষেত্রেও আইজিং মডেল বিশেষভাবে কার্যকরী হচ্ছে। এরকম আরও উদাহরণ রয়েছে।
১৯২৫ সালে জার্মান পত্রিকায় প্রকাশিত সেই গবেষণাপত্রে উল্লেখিত মডেল কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বুঝতে, আমেরিকান পদার্থবিদ লিও ক্যাডানফের মন্তব্যটি স্মরণ করতে হয় – ‘Starting around 1925, a change occurred: With the work of Ising, statistical mechanics began to be used to describe the behavior of many particles at once.‘
এই বিপুল সাফল্যের কথা তাঁর সামনে তুললে সদাহাস্যময় প্রফেসর আইজিং-এর মুখে লজ্জার ভাব দেখা দিত। তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে চাইতেন। সম্ভবত ‘আনকাট’ সেই হীরকখণ্ডকে চিনতে না পারার কুন্ঠা ছিল প্রবীণ মানুষটির মধ্যে।
আর্নস্ট আইজিং-কে কীভাবে দেখা যায়? একজন শিক্ষক? নাকি বিজ্ঞানী?
ইহুদী এই মানুষটি, জন্ম হয়েছিল যাঁর ১৯০০ সালের ১০-ই মে জার্মানির কোলন শহরে, তিনি মারা যান আমেরিকার পেওরিয়ায়, নিজের বাসভবন, ১৯৯৮-এর ১১ই মে।
সহকর্মী এবং বন্ধু-বান্ধবরা মনে করেন আইজিং ছিলেন আসলে একজন অনুভূতিপ্রবণ আদর্শ শিক্ষক, আর বিজ্ঞানী মহলের কাছে আইজিং স্মরণীয় তাঁর তরুণ বয়সে গড়ে তোলা অতি সরল সেই মডেলটির জন্য।
অঙ্কন – সায়ন পন্ডা [1]
তথ্যসূত্র
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/ising-model-failure-and-success