21-12-2024 16:53:40 pm
Link: https://bigyan.org.in/indian-astronomy-scientific-experiment
জ্যোতিষশাস্ত্রের জগতে ভারতের নামডাক খুব। কয়েকটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের গণনা-পদ্ধতি চীন বা পাশ্চাত্য গণনা-পদ্ধতির থেকে একেবারে আলাদা 1। ভারতে ফুল-টাইম আর পার্ট-টাইম মিলিয়ে যতজন জ্যোতিষচর্চা করেন, বাকিসব দেশ জুড়েও হয়তো সেই সংখ্যাটায় পৌঁছনো যাবে না। এমনকি, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ইংরেজি জ্যোতিষশাস্ত্রের ম্যাগাজিনও ভারত থেকেই বেরিয়েছে (The Astrological Magazine, ১৮৯৫ – ২০০৭)। ভারত সরকারের প্রধান অর্থযোগানকারী সংস্থা, ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন (UGC), ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্যোতিষশাস্ত্রে BSc ও MSc কোর্স-এর জন্য সাহায্যপ্রদান করে। আর সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে জ্যোতিষে বিশ্বাস তো একরকম সর্বজনীনই বলা চলে।
ভারতীয় জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষশাস্ত্রের সমালোচক বালাচন্দ্র রাও বলেছেন [তথ্যসূত্র ১, পৃ: ১৪৯]: “মানুষের মধ্যে জ্যোতিষে বিশ্বাস এতটাই গভীর যে ব্যক্তিগত জীবনে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে, সে চাকরির জন্য দরখাস্ত করাই হোক বা অন্য কিছু, তারা জ্যোতিষীদের কাছে কোষ্ঠী নিয়ে হাজির হয়।” বিশেষত, বিয়ের তারিখটা কবে ফেলা হবে এবং দিনটা শুভ কিনা, সেটা জানতে অনেকে জ্যোতিষীদের দ্বারস্থ হয়। যেমন, ১৯৬৩ সালে, এক জ্যোতিষীর পরামর্শে সিকিম-এর যুবরাজের বিয়ে এক বছর পিছিয়ে গেছিলো। আর শুভ দিন হলে তো কথাই নেই, এতোগুলো বিয়ে সেদিন সম্পন্ন হবে যে বিয়ের হলঘর, ক্যাটারিং, ইত্যাদি পাওয়া দায় হয়ে ওঠে।
পশ্চিমী জ্যোতিষীদের সাধারণত শেখানো হয় যে জ্যোতিষবিদ্যা অদৃষ্টের লিখনে বিশ্বাসী নয়, তাই পূর্বলিখিত অদৃষ্টের ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণীর চেষ্টা না করাই ভালো। ভারতীয় জ্যোতিষীরা সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করেন। কোনো ব্যক্তিকে জ্যোতিষী বলে পরিচয় দিতে হলে ভবিষ্যৎদৃষ্টির ক্ষমতা প্রদর্শন করতেই হবে। উদাহরণ স্বরূপ, The Astrological Magazine-এর একসময়ের প্রকাশক ও সম্পাদক বি. ভি. রমন (১৯১২ – ১৯৯৮), “জ্যোতিষবিদ্যার সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন” করতে একটা আলোচনায় লিখেছিলেন যে “১৯৩৯-এ শনিগ্রহের মেষরাশি (Aries)-তে অবস্থান করার অর্থ ছিল যে ইংল্যান্ড-এর জার্মানি আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী।” [তথ্যসূত্র ২, পৃ: ১১৯] (‘অবশ্যম্ভাবী’ কথাটার মধ্যে অদৃষ্টের লিখন লক্ষ্য করুন।) কিন্তু শনি গ্রহ যে ১৯০৯ এবং ১৯৬৮ সালেও মেষরাশিতে ছিল এবং সেই সময়ে যে যথাক্রমে সপ্তম এডওয়ার্ড ও দ্বিতীয় এলিজাবেথ-এর বিদেশযাত্রা ছাড়া তেমন কিছুই ঘটেনি, এই কথাটা বেমালুম চেপে যাওয়া হলো।
ভারতীয় জ্যোতিষীদের মুখে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়েও কিছু অদ্ভুত দাবি শোনা গেছে। যেমন, ১৯৮৪-এর মার্চ মাসে The Astrological Magazine-এ দাবি করা হলো যে ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় ৫০০ বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল [তথ্যসূত্র ১, পৃ: ৩৬]। কিন্তু খোদ জ্যোতিষ-সংক্রান্ত দাবিগুলো আরো বেশি যুক্তিহীনতার পরিচয় দেয়। যেমন, ২০০৩-এর ২৫শে অগস্ট Indian Express সংবাদপত্রে রাজ বলদেব, যিনি নিজেকে “জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, মহাবিশ্বের গণিতবিদ্যা ও অধিবিদ্যাতে একজন পণ্ডিত” বলে দাবি করেন, বললেন যে প্রাচীন হিন্দু জ্যোতিষবিদ্যা “সম্পূর্ণরূপে একটা বৈজ্ঞানিক চর্চা” যেখানে এক সেকেন্ড-এর দশ কোটি কোটিতম ভাগের ফারাকও গণ্য করা হয়। অবিশ্বাসীদের মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে: প্রাচীনকালের সূর্যঘড়ির ছায়া তার মানে এতো সূক্ষ্মভাবে মাপা যেত? যে সে রকমের সূক্ষ্ম নয়, একটা অণুর ব্যাসের দশ কোটিতম ভাগের একভাগ, এতটা সূক্ষ্ম ছিল সেই পরিমাপ। এমনকি রাতের অন্ধকারেও এই ছায়া মাপা যেত। বিশ্বাস করতে একটু অসুবিধে হয় না কি?
ভারতীয় জ্যোতিষবিদ্যা পাশ্চাত্য জ্যোতিষবিদ্যার থেকে অনেক বেশি জটিল। সবরকম অবস্থার জন্যেই উপযুক্ত বিধি দেওয়া আছে এখানে। যেসব পশ্চিমের লেখকরা ভারতীয় জ্যোতিষবিদ্যা রপ্ত করতে চেয়েছেন তাদের সাধারণত বছর দশেকের বেশি পড়াশোনাতেই কেটে গেছে। এমনই একজন বলেছেন: “ছ’হাজার বছরের বেশি পুরোনো একটা সভ্যতার ক্ষেত্রে এরকমটা হওয়া স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, এমন একটা সমাজ যেখানে বয়োজ্যেষ্ঠরা শুধু জ্যোতিষবিদ্যা ব্যবহারই করেননি, তাকে রীতিমতো জীবনের একটা অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছেন।” [তথ্যসূত্র ৩]2
শুধু যে সকল অবস্থার জন্য বিধি দেওয়া আছে, তাই নয়, সেই বিধির বিধানকে টলাতে তাবিজ, মন্ত্র, রং কিংবা পাথরেরও সরঞ্জাম রয়েছে। যেমন, হলুদ স্যাফায়ারে বৃহস্পতি এবং নীলে শনির প্রভাব মজবুত হয়। আরও আছে যজ্ঞের ঘটা, যেখানে হিন্দু পুরোহিত আগুনে নানানরকমের আহুতি দেন। মজার বিষয় হলো, তখনও কিন্তু ভবিষ্যতটা পূর্বনির্ধারিত অর্থাৎ মানুষের হাতের বাইরেই থাকে, কিন্তু একইসাথে সেই ভবিষ্যৎকে পরিবর্তন করার ক্ষমতাও এসে যায়।
ভারতীয় নাড়ী জ্যোতিষবিদ্যার অনেক রকমফের আছে। কিন্তু তার একটাও যদি কার্যকরী হয়, সেটা একপ্রকার চমৎকারই হবে। নাড়ী জ্যোতিষীদের একটা বিশেষত্ত্ব হলো, তাদের কাছে একগুচ্ছ হরোস্কোপ বা কোষ্ঠী তালপাতার ওপর লেখা থাকে। সেই একগুচ্ছের মধ্যে থেকে মক্কেলের হরোস্কোপটা ঠিক বেরিয়ে আসে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এইভাবে দেওয়া যায়। প্রথমদিন মক্কেলের জন্মতারিখ ইত্যাদি জেনে তাকে বলা হয় কয়েকদিন পর ফিরে আসতে। এতো এতো হরোস্কোপের মধ্যে মক্কেলেরটা খুঁজে পেতে সময় লাগবে তো। কিন্তু চোখের আড়াল হতেই মক্কেলের দেওয়া তথ্য অনুসারে একটা তরতাজা নতুন তালপাতায় লেখা হয় তার হরোস্কোপ। সেটা নারকোলের শাঁস আর আমগাছের ছালের কাইয়ে চুবিয়ে রাখা হয়। উভয়েই থাকে ট্যানিন নামক জৈবরাসায়নিক যার সংস্পর্শে সেই তালপাতা অচিরেই হয়ে যায় প্রাচীনকালের হরোস্কোপ [তথ্যসূত্র ৪]। কয়েকদিন পর মক্কেল এলে তাজ্জব বনে যায়। এতো শতাব্দী পর বেরিয়ে এলো তার হরোস্কোপ!
১৯৮৪ সালে, ইউরোপে সতেরো বছর ব্যবসার পর ভারতে কম্পিউটারাইজড হরোস্কোপের চল শুরু হলো। কুড়ি মিনিটের মধ্যে (আজকের দিনে কয়েক সেকেন্ডে) কম্পিউটার সেইসব গণনা করে ফেললো যা এর আগে তিন মাস লেগে যেত। একটা সাধারণ মানের কম্পিউটার হরোস্কোপ পঁচিশ টাকায় এবং আরো বেশি চাইলে পঞ্চাশ টাকায় পাওয়া যায়। দ্বিতীয় ধরণের গণনাটা বড় শহরে এয়ার-কন্ডিশনড ঘরেই হয়ে থাকে। আর ভাগ্যগণনা চাইলে কত বছরের চাই সেই হিসেবে ৫০০ টাকা অব্দি চার্জ করা হতে পারে [তথ্যসূত্র ১, পৃ. ১৪৭]3। অনেক ওয়েবসাইটে অবশ্য বিনামূল্যে হরোস্কোপ পাওয়া যায়। যেমন, এখানে একটা লিস্ট পাবেন।
কম্পিউটারাইজড হরোস্কোপ চালু হওয়ার প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই পশ্চিমের মত ভারতেও জ্যোতিষীরা প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠলো। তারা নালিশ জানালো যে কম্পিউটার-এর না আছে বিচারবুদ্ধি, না অভিজ্ঞতা। শুধু তাই না, মানুষের যে কথা বলার বা নিজের সুখদুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন আছে, তা কম্পিউটার মেটাতে পারে না। এর স্বপক্ষে প্রমাণও পাওয়া গেল। দুই দশক আগে এক শিক্ষিত যুবক কম্পিউটার হরোস্কোপ-এর নির্মম ভাগ্যগণনার শিকার হলো। যখন কম্পিউটার তাকে জানালো যে সে জীবনের সব উদ্যোগেই ব্যর্থ হবে, সে আত্মহননের পথ বেছে নিলো [তথ্যসূত্র ৪, পৃ. ৩০৭]। এসব সত্ত্বেও মনে হয় কম্পিউটার হরোস্কোপ পাকাপাকিভাবেই পসার জমিয়েছে।
১৯৮৯ সালে, আমি এক অতিথিকে নিয়ে পুনেতে আমার সদ্য প্রতিষ্ঠিত জ্যোতির্বিদ্যা কেন্দ্র পরিদর্শন করাচ্ছিলাম। তখন সবে কম্পিউটার বসেছে সেখানে। অতিথিকে বোঝাচ্ছিলাম সেই কম্পিউটারের ক্ষমতা। শেষে তার কোনো প্রশ্ন আছে কিনা, জিজ্ঞেস করলাম। হ্যাঁ, প্রশ্ন তার ছিল ঠিকই, সেটা হলো: “এই কম্পিউটার থেকে হরোস্কোপ বেরোয়?”
ভারতীয় জ্যোতিষবিদ্যার সমর্থকদের মুকুটে সবচেয়ে উজ্জ্বল পালকের সংযোজন হলো ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন (UGC) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জ্যোতিষশাস্ত্রে BSc ও MSc কোর্স পড়ানোর জন্য অর্থযোগানের সিদ্ধান্ত নিল। তাদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো: “বৈদিক জ্যোতিষবিদ্যা চর্চাকে পুনরুজ্জীবিত করা আশু প্রয়োজন…দেশের বাইরেও এই গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানের শাখাকে প্রচার করার সুযোগ করে দিতে হবে।” বৈদিক জ্যোতিষবিদ্যা কথাটা একটু বিভ্রান্তিকর কারণ হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বেদে কোথাও জ্যোতিষবিদ্যার উল্লেখ নেই। সত্যি কথা বলতে কি পন্ডিতরা মোটামুটি একমত যে গ্রহনক্ষত্রনির্ভর জ্যোতিষবিদ্যা ভারতে এসেছিলো গ্রীক সভ্যতার সাথে, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে আলেক্সান্ডার-এর ভারত আক্রমণের সময়।
ঘোষণার ন’মাসের মধ্যে UGC-র পনেরো লক্ষ টাকার অনুদানের প্রার্থী হিসেবে ভারতের ২০০টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫টাকে পাওয়া গেল। তারা জ্যোতিষবিদ্যা বিভাগ খুলতে রাজি। এর মধ্যে কুড়িটাকে সেই অর্থ প্রদানও করা হলো [তথ্যসূত্র ৫, পৃ. ২]। যেসকল ভারতীয়দের দৈনন্দীন জীবন জ্যোতিষীদের গণনার দ্বারা প্রভাবিত, তারা সানন্দে এই সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করলেন। এই দলে কিছু বাঘা বাঘা রাজনৈতিকও আছেন। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু এই ঘোষণাতে ভারতের তামাম শিক্ষকবৃন্দ, বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক মহল, ক্ষোভে ফেটে পড়লো। ১০০-র বেশি বিজ্ঞানী ও ৩০০-র বেশি সমাজবিজ্ঞানী প্রতিবাদে সরকারকে চিঠি লিখলেন। এই বিষয়টা নিয়ে গোটা তিরিশেক চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল ভারতীয় জার্নাল Current Science-এ। বেশিরভাগই এসেছিলো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাগারে নিযুক্ত বৈজ্ঞানিকের কাছ থেকে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক বিজ্ঞানী বললেন যে জ্যোতিষবিদ্যা বিজ্ঞানের নাম ভাঁওতা আর এক-চতুর্থাংশ বললেন যে জ্যোতিষবিদ্যার কার্যকারিতা প্রমাণসাপেক্ষ। এর বিরুদ্ধে বাকিরা যুক্তি দিলো যে বেশিরভাগ ভারতীয় যাতে বিশ্বাস করে, তাকে অর্থসাহায্য করতে দোষ কোথায়? যাইহোক, প্রতিবাদে কোনো ফল হলোনা কারণ ভারতীয় আইন অনুযায়ী বৈদিক জ্যোতিষবিদ্যা বিজ্ঞান হিসেবে গণ্য হয়েছে।
তা সত্ত্বেও ২০০৪-এ বেশ কিছু বিজ্ঞানী UGC-র বৈদিক জ্যোতিষবিদ্যার পৃষ্টপোষণ বন্ধ করতে অন্ধ্র প্রদেশ হাই কোর্ট-এর কাছে আর্জি জানালেন। তাদের যুক্তি ছিল, জ্যোতিষবিদ্যা বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে অপবিজ্ঞান মাত্র (pseudoscience), তাকে মদত দিলে শিক্ষাব্যবস্থায় হিন্দুধর্মকে চাপানো হবে 4 এবং যে বিষয়গুলোকে যথার্থ বিজ্ঞান হিসেবে গণ্য করা, সেইসবে অর্থের টানাটানি পড়বে। কোর্ট কেস ডিসমিস করে দিলো এই অজুহাতে যে তারা UGC-র সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে চায় না, বিশেষ করে সেই সিদ্ধান্ত যখন আইনসম্মত।
২০১১-তে মুম্বাই হাই কোর্ট-এ একটা আপীল-এ জ্যোতিষচর্চাকে ভুয়ো বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে একটা আইনের আওতায় ফেলার চেষ্টা করা হলো। সেই কেস-ও টিকলো না। কোর্ট জানালো যে “এই আইন জ্যোতিষবিদ্যা বা সেই সম্পর্কিত বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জ্যোতিষবিদ্যা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞান এবং ৪০০০ বছর ধরে তার চর্চা চলে এসেছে…” (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ফেব্রুয়ারী ৩, ২০১১)।
বিজ্ঞান হিসেবে পরিচয় দিতে গেলে জ্যোতিষবিদ্যাকে একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এমন কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করতে হবে যেটা যাচাই করা সম্ভব এবং যাচাই করার পর তাকে সত্য প্রমাণিত হতে হবে। এই একটা বিষয়ে জ্যোতিষচর্চার রেকর্ড খুব একটা ভালো নয়। যেমন, একটা বিশেষ ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎনির্ণয় ও পরবর্তীকালে তার সত্যতা বিচার হয়েই থাকে। সেটা হলো ইলেকশন-এর সময়। এক্ষেত্রে জ্যোতিষীদের গণনা হামেশাই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর বিরোধীদের মধ্যে তুমূল লড়াই হয়েছিল। সেই সময় The Astrological Magazine পত্রিকা জুড়ে ছিল শুধু ইলেকশন-সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী। আনকোরা অভিজ্ঞ মিলিয়ে অনেক জ্যোতিষীই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ইন্দিরা গান্ধী হারতে চলেছেন। কিন্তু হলো উল্টো। ইন্দিরা গান্ধী শুধু জিতলেনই না, বিপুল ভোটে জিতলেন।
তারপর আবার ১৯৮০-তে একইরকম ভবিষ্যদ্বাণীর পালা চললো। বেশিরভাগ জ্যোতিষীরা আবার বললেন, ইন্দিরা গান্ধী হারতে চলেছেন। কিন্তু তিনি আবার জিতলেন এবং সরকার গড়লেন। ১৯৮০-তেই ইন্ডিয়ান অ্যাস্ট্রোলজার্স ফাউন্ডেশন-এর সংগঠিত একটা সম্মেলনে সেই সংগঠনের সভাপতি ও সচিব দুজনেই বললেন ১৯৮২-তে পাকিস্তানের সাথে আবার একটা যুদ্ধ হতে চলেছে। যুদ্ধটা অবশ্য ভারতই জিতবে। আর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪-র মধ্যে একটা বিশ্বযুদ্ধ হতে চলেছে। এসবই কিছুই হয়নি। এইগুলো এবং এরকম আরো উদাহরণ রাও-এর লেখায় পাওয়া যাবে [তথ্যসূত্র ১, পৃ. ১১৩-১২২]। রাও এটাও লক্ষ্য করতে বললেন যে কোনো জ্যোতিষীই ১৯৮৪-তে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পূর্বাভাস দিতে পারেননি। তাঁর কথায়, “শ্রোতারা যাতে খুশি হবেন, সেই ধরণের ভবিষ্যদ্বাণী করতেই তারা ব্যস্ত” 5।
পাশ্চাত্য জ্যোতিষবিদ্যার সমালোচনা খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধে হয়না। ভারতে ব্যাপারটা উল্টো। কয়েকটা চমৎকার বই রয়েছে, যেমন প্রেমানন্দ ইত্যাদির লেখা [তথ্যসূত্র ৪] এবং রাও-এর লেখা [তথ্যসূত্র ১]। কিন্তু এতে এমন কোনো পরীক্ষার কথা বলা নেই যা ভারতেই সম্পন্ন হয়েছে। এরকম কিছু না করা হলে বিশ্বাসীদের সামনে দাঁড়ানো যাবে না। এমনকি Current Science পত্রিকাতে মনোজ কোমাত-এর যে লেখাটা বেরিয়েছিলো [৬], সেটাও পশ্চিমে করা তথ্যসূত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। যেমন এই ওয়েবসাইট-টা: https://www.astrology-and-science.com/। তাছাড়া ভারতে এখনো বেশিরভাগ পরিবারেই উপার্জন স্বল্প এবং শিক্ষার অভাব প্রকট। তাই ইন্টারনেট-এ থাকা তথ্য কতটা কার্যকরী হবে সেই নিয়ে সন্দেহ আছে।
UGC-র ফান্ডিং-কে ন্যায্য বলা যেত যদি জ্যোতিষবিদ্যা থেকে নতুন কোনো জ্ঞানলাভ হতো। সেরকম কিছুই হয়নি [তথ্যসূত্র ৫, পৃ. ১৩]। এমনও যদি হতো যে জ্যোতিষবিদ্যার পদ্ধতিগুলোকে কন্ট্রোল্ড টেস্ট-এর মাধ্যমে যাচাই করা যেত, তাহলেও চলতো। কিন্তু সেরকম কোনো পরীক্ষাই ভারতে আজ অব্দি হয়নি। অথচ পরীক্ষা করা খুব একটা কঠিন ছিল না কিন্তু। কয়েকটা হ্যাঁ-না প্রশ্নেই হয়ে যেত 6। এরকম পরীক্ষা পশ্চিমে কয়েকশতবার হয়েছে এবং সেখানকার জ্যোতিষবিদ্যার বেশিরভাগ দাবির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি [তথ্যসূত্র ৭]।
এবার একটা কন্ট্রোলড টেস্ট-এর কথা বলি যেটা আমি এবং আমার সহকর্মীরা সদ্য সম্পন্ন করেছি।
আমাদের এক্সপেরিমেন্ট-টা করা হয়েছিল পুনে-তে। পুনে মুম্বই থেকে ১৬০ কি.মি. দূরত্বে স্থিত মহারাষ্ট্রের এক শহর। পুনে-র জনসংখ্যা তখন ৩৫ লক্ষ।
আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিসটিক্স বিভাগের অধ্যাপক সুধাকর কুন্তে, কুসংস্কার দূরীকরণ কমিটি-র নরেন্দ্র দাভোলকার এবং প্রকাশ ঘাটপাড়ে, যিনি নিজেই একসময় জ্যোতিষচর্চা করতেন এবং পরে জ্যোতিষচর্চার সমালোচক হয়ে যান।
ভারতীয় জ্যোতিষীরা দাবি করেন যে তাঁরা হরোস্কোপ দেখে পাত্রের মেধা বলে দিতে পারেন। এই সূত্র ধরে একটা পরীক্ষা করা হলো। কুসংস্কার দূরীকরণ কমিটি-র স্বেচ্ছাসেবকরা বিভিন্ন স্কুলে গেলেন এবং শিক্ষকবৃন্দের কাছ থেকে মেধাবী কিশোর ছাত্রছাত্রীদের নামের তালিকা আদায় করলেন। আর গেলেন মানসিক প্রতিবন্ধীদের স্পেশাল স্কুল-এ। সেখান থেকেও নামের তালিকা জোগাড় করা হলো। এই দুই গোষ্ঠীর মেধায় আকাশ পাতাল ফারাক হওয়ার কথা। এবং যারা হরোস্কোপ দেখে মেধা নির্ণয় করতে পারেন, তাদের সেই তফাৎ ধরতে পারার কথা। আমরা দুই গোষ্ঠীতেই ১০০জন ছাত্রছাত্রীকে বেছে নিলাম। তাদের বয়েসের ব্যাপারে নিচে বলা হচ্ছে।
জন্মের খুঁটিনাটি তথ্য এই ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হলো। অনেকসময়ই আমাদের দেশে বার্থ সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না। তাতে অসুবিধে নেই কারণ জ্যোতিষীরাও প্রায়ই অভিভাবকদের মুখের কথাতেই খুশি থাকেন। আমরাও সেই প্রথা মেনেই এগোলাম। জন্মলগ্নের উপর ভিত্তি করে প্রত্যেকজনের হরোস্কোপ বানানো হলো বাজারে চালু কম্পিউটার সফটওয়্যার-এর সাহায্যে। এই হরোস্কোপগুলো অধ্যাপক কুন্তে-র কাছে সুরক্ষিত রইলো। এমন ব্যবস্থা করা হলো যাতে আমরা চারজন পরীক্ষক বা জ্যোতিষীরা কেউই হরোস্কোপের মালিকের পরিচয় জানতে না পারি।
১২ই মে, ২০০৮-এ সাংবাদিকদের ডেকে আমাদের এক্সপেরিমেন্ট-এর কথা জানানো হলো। যেকোনো প্র্যাক্টিসরত জ্যোতিষীই আমাদের এই এক্সপেরিমেন্ট-এ যোগদান করতে পারে। এক্সপেরিমেন্ট-এর পদ্ধতিটাও বিস্তারিত বলা হলো। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে ২০০টা হরোস্কোপের মধ্যে যেকোনো ৪০টা দেওয়া হবে। তাদের বলতে হবে হরোস্কোপের মালিক মেধাবী না প্রতিবন্ধী। আমরা বড় জ্যোতিষ সংস্থাগুলোকেও আহ্বান করলাম। তাদের ২০০-টা হরোস্কোপই দেওয়া হবে এইরকম ঠিক করা হলো। এতে মোটামুটি একটা বড়সংখ্যক স্যাম্পল সাইজ পাওয়া যাবে।
স্থানীয় আঞ্চলিক সব সংবাদপত্রেই আমাদের এক্সপেরিমেন্ট-এর খবর ছাপা হলো। এতে কাজ হলো। কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় দেড়শো টেলিফোন কল পেলাম মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু জ্যোতিষীর কাছ থেকে। তাদের কাছ থেকে নাম, জ্যোতিষচর্চায় অভিজ্ঞতা এবং ভাগ্যগণনার পদ্ধতি জানলাম এবং বললাম একটা সেলফ-স্ট্যাম্পড খাম আমাদের পাঠাতে। ওই খামে আমরা হরোস্কোপ ভরে ওনাদের পাঠিয়ে দেব। এক মাস দেওয়া হলো ভাগ্যগণনার জন্য। শেষ পর্যন্ত একান্নজন জ্যোতিষী হরোস্কোপ চাইলেন এবং তার মধ্যে সাতাশজন নিজেদের গণনাগুলো আমাদের পাঠালেন। এই সাতাশজন অবশ্য মহারাষ্ট্রের নানা জায়গাতে ছিলেন। বাকিরা আমাদের জানাননি কেন তারা যোগদান করলেন না।
পুনে ও মহারাষ্ট্রের বহু জ্যোতিষ সংস্থা আমাদের এক্সপেরিমেন্ট-এ ঘোর আপত্তি জানালো। তাদের মতে, অবিশ্বাসীরা পরীক্ষা করছে, এ পরীক্ষা একতরফা না হয়ে যায় না। কোনো না কোনোভাবে তাদের মতামত এই পরীক্ষাতে ছাপ ফেলবে। আমরা তাদের আশ্বস্ত করলাম যে পরীক্ষকদের মতামতের এখানে কোনো মূল্য নেই। তারা কোনোভাবে এই পরীক্ষাকে প্রভাবিত করতে পারে না। এই ধরণের পরীক্ষাকে ডাবল-ব্লাইন্ড এক্সপেরিমেন্ট বলা হয়, অর্থাৎ পরীক্ষক এবং যার উপর পরীক্ষা হচ্ছে, দু-তরফেরই চোখে পট্টি বাঁধা। কিন্তু তাতে চিঁড়ে ভিজলো না, এবং এই সংস্থাগুলো অনেক চেষ্টা করলেন বাকি জ্যোতিষীদের বিরত করতে। অবশ্য তারা খুব একটা সফল হয়নি, নইলে আমরা কোনো ফলই পেতাম না।
এক মাস পর, এক জ্যোতিষবিদ্যার আলোচনাসভায়, আমরা বোঝালাম যে জ্যোতিষবিদ্যাকে বিজ্ঞান হিসেবে দাঁড়াতে হলে বেশ কিছু পরীক্ষার মুখোমুখি হতেই হবে। আলোচনাসভার উদ্যোক্তা বললেন যে তিনি দশটা উপায় বলতে পারেন যার সাহায্যে হরোস্কোপ দেখে বলে দেওয়া যাবে ছাত্র মেধাবী না প্রতিবন্ধী। সভায় উপস্থিত জ্যোতিষীদের বললেন আমাদের এক্সপেরিমেন্ট-এ যোগদান করতে।
ভারতে খুব বড় জ্যোতিষীদের নিজস্ব সংস্থা রয়েছে। সেইরকম গোটা বারো সংস্থাকে আমরা লিখলাম ওই দুশোটা হরোস্কোপের ওপর তাদের গণনা করতে। দুটো সংস্থা রাজি হলো এবং শেষ পর্যন্ত একটা সংস্থাই তাদের গণনা পাঠিয়েছিল। অন্য সংস্থাটির কাছে কোনো সাড়া পেলাম না।
মহারাষ্ট্র অ্যাস্ট্রোলজিকাল সোসাইটি যদিও আমাদের পরীক্ষাটিকে বয়কট করতে সরব হয়েছিল, তার সভাপতি আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা করলেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি আমাদের হরোস্কোপ দেখে লিঙ্গ নির্ধারণ করার এবং মেধা নির্ধারণ করার একটা করে পদ্ধতি বললেন। তার দাবি ছিল, ৬০ শতাংশ সাফল্য আছে এই পদ্ধতিগুলোর। আমাদের ২০০-টা হরোস্কোপে সেই পদ্ধতিগুলো লাগিয়ে সাফল্য এলো ৪৭ শতাংশ (লিঙ্গের ক্ষেত্রে) এবং ৫০ শতাংশ (মেধার ক্ষেত্রে)। একটা পয়সা টস করে উত্তর দিলেও এইরকমই সাফল্য আসতো।
যে সাতাশজন জ্যোতিষী উত্তর দিয়েছিলেন, তার মধ্যে সবাই নিজের কথা বিশদে বলেননি। তবে, যা বোঝা গেল, পনেরোজন শখের জন্য জ্যোতিষচর্চা করেন আর আটজনের এটাই পেশা। অভিজ্ঞতার দিক থেকে ন’জনের দশ বছর অব্দি প্র্যাকটিস আছে আর সতেরোজনের দশ বছরের বেশি। গড় অভিজ্ঞতা ছিল চোদ্দ বছর। অতএব বলা যায়, জ্যোতিষবিদ্যা চর্চায় এদের দখল রয়েছে।
যদি সত্যিই জ্যোতিষীরা হরোস্কোপ দেখে মেধা নির্ণয় করতে পারেন, তাহলে চল্লিশে চল্লিশ বা তার কাছাকাছি সঠিক উত্তর হওয়া উচিত। কিন্তু সর্বোচ্চ সঠিক উত্তর ছিল চব্বিশ। একজন জ্যোতিষীই এটা করেছিলেন। তারপরে দুজন জ্যোতিষী বাইশটা সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন। বাকি চব্বিশজনের সঠিক উত্তর কুড়িটা বা তার কম ছিল। একজন পেশাদার জ্যোতিষী তো বললেন, সাঁইত্রিশজন মেধাবী এবং তিনটে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু তার মধ্যে সতেরোটাই ভুল ছিল। যাকগে, সব মিলিয়ে এই সাতাশজন জ্যোতিষীর গড় সঠিক উত্তর হলো ১৭.২৫, অর্থাৎ কুড়ির কম। টস করলেও সম্ভবত এর থেকে বেশি সাফল্য আসতো। এই গড়টার চারিদিকে উত্তরগুলো ছড়িয়ে ছিল ৩.১৬-এর মধ্যে (p-value ০.০৫-এর কম), অর্থাৎ এই গড় সংখ্যাটার মূল্য আছে। এমনও হতে পারতো যে কয়েকজন খুব বেশি সঠিক উত্তর দিলো আর কয়েকজন খুব কম, যেক্ষেত্রে গড় সংখ্যাটা বললে সম্পূর্ণ চিত্রটা পাওয়া যেত না। কিন্তু সেরকম হয়নি।
এই হলো গড়ে চোদ্দ বছরের অভিজ্ঞতার ফল! কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাফল্য এতো কম হলে সেটা কি এতদিন টিকতে পারতো?
যে সংস্থাটা উত্তর দিতে রাজি হয়েছিল, তাদের জ্যোতিষীরা ২০০-র মধ্যে ১০২টা সঠিক উত্তর দিলেন। এই সঠিক উত্তরগুলোর মধ্যেও ৫১জন মেধাবী এবং বাকি ৫১ প্রতিবন্ধী। আবারো টস করে উত্তর দেওয়ার থেকে সাফল্য খুব বেশি নয়।
দুঃখের বিষয় হলো আমাদের সংখ্যাতাত্ত্বিক অধ্যাপক সুধাকর কুন্তে ২০১১-তে একটা দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। উনি সমস্ত তথ্য এতটাই সুরক্ষিত রেখেছিলেন যে সেসব আমরা উদ্ধার করতে পারলাম না। তাই আর পরীক্ষা করা সম্ভব হলো না। আরও কিছু পরীক্ষা করা যেত, যেমন, জ্যোতিষীরা ভুল করলেও একইরকম ভুল করছিলো কিনা, বা প্রতিবন্ধীদের থেকে মেধাবীদের চিনতে বেশি সফল হয়েছিল কিনা, বা যে তিনটে গণনার পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছিল (নিরায়ণ, সায়ন, কৃষ্ণমূর্তি) তার মধ্যে কোনটা বেশি সফল। আশা করছি একটা না একটা সময়ে সেই তথ্যগুলোর নাগাল পাওয়া যাবে এবং পরীক্ষাগুলো করা সম্ভব হবে।
পাশ্চাত্য জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর যত পরীক্ষার কথা প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র দুটোতে মেধা-নির্ণয়ের পরীক্ষা হয়েছে। ১৯৬১-র পরীক্ষাটিতে সেরিব্রাল পালসি-আক্রান্ত ব্যাক্তিদের মধ্যে দশজন হাই আই. কিউ. ব্যক্তিকে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই দশজনকে চিনতে কুড়িজন জ্যোতিষীর গণনা ৭২ শতাংশ সাফল্য দেখিয়েছিলো [৮]। কিন্তু ১৯৭৫-এ যখন পুনরায় পরীক্ষাটা করা হলো, জ্যোতিষগণনার সাফল্য এর কাছাকাছিও যায়নি। তেইশজন জ্যোতিষী দশজন হাই আই. কিউ. ব্যক্তিকে মানসিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে চিনতে ৫৩ শতাংশ সাফল্য দেখাতে পেরেছিলো। যাইহোক, মাত্র দশটা কেস ধরলে যে স্যাম্পলিং এরর থাকে, তাতে এই ফলাফলের তফাৎটা বোঝা যায়। এই গলদটা পাশ্চাত্য জ্যোতিষবিদ্যার উপর করা অনেক পরীক্ষাতেই রয়েছে [৯] এবং পশ্চিমে যারা বৈদিক জ্যোতিষবিদ্যার চর্চা করেন, তাদের উপর করা পরীক্ষাতেও রয়েছে [তথ্যসূত্র ১০]।
আমাদের পরীক্ষাটা ছিল সাতাশজন জ্যোতিষীকে নিয়ে। তারা চল্লিশটা হরোস্কোপ বিচার করে মেধাবী ছাত্রের থেকে প্রতিবন্ধীদের চিনতে যতটা সাফল্য দেখালেন, স্রেফ একটা সিকি কি আধুলি নিয়ে টস করলেও সেই সাফল্যই আসতো। আমাদের পরীক্ষা থেকে এই সিদ্ধান্তেই আসতে হয় যে জ্যোতিষীদের মেধা-নির্ণয়ের দাবিটা মানা চলে না। পশ্চিমের দেশগুলোতে করা কিছু পরীক্ষা থেকেও এই সিদ্ধান্তটাই আসে।
অতএব, জ্যোতিষবিদ্যাকে আর যাই বলা হোক, বিজ্ঞান বলা চলে না 7।
পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিসটিক্স বিভাগ এবং পুনে-র ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স এই পরীক্ষাটির জন্য সবরকম সাহায্য করেছিল। এই পরীক্ষাটির কথা Current Science পত্রিকাতে বেরিয়েছে: ৯৬ (তথ্যসূত্র ৫), ৬৪১-৬৪৩, ২০০৯। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া-র পার্থ শহরের জেফ্রি ডিন-কে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই। উনিই আমাকে পাশ্চাত্য জ্যোতিষবিদ্যার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করেছিলেন এবং এখানকার জ্যোতিষবিদ্যার সাথে তফাৎটা বুঝিয়েছিলেন।
মূল লেখাটি প্রথমে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল এখানে।
টিকা
তথ্যসূত্র
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/indian-astronomy-scientific-experiment