21-12-2024 15:47:02 pm
Link: https://bigyan.org.in/ig-nobel
“প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকে পড়েছে যে। কি সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি সার রে হতভাগা – পইপই করে বললাম এত জল খাসনে। ভাগ্যিস পাবলিক টয়লেট খানা ছিল!”
নিজের বা সহযাত্রীর সঙ্গে – এই অভিজ্ঞতা হয়নি এমন মানুষ বোধ হয় খুব কম আছেন! এইরকম মহাসংকটের মুহূর্তে মনে হয় যদি আমাদের ব্লাডারটা ইঁদুরের মত পুচকে অথবা হাতির মত বড় হত – কী ভালই না হত। পুচকে ব্লাডার খালি করতে সময় কম লাগত, আর বড় ব্লাডার হলে অনেকক্ষণ মূত্র ধরে রাখা যেত – ‘মধ্যম পন্থা সর্বোত্তম’ কে যে বলে!
তাই কি? আচ্ছা, ভেবে দেখেছেন কি প্রাণীদের মধ্যে ‘মূত্র বিসর্জন’ করতে কার কত সময় লাগে? ভাবছেন, বিজ্ঞানের পত্রিকায় এসব কী লিখছি ? বেশ, তাহলে অন্য প্রশ্নে যাই বরং। মুরগীর লেজের কাছের দিকে একখানা বড় মাপের বোঝা চাপিয়ে দিলে কি তাদের হাঁটা-চলা ডাইনোসরের মত হবে? অথবা, শরীরের কোন জায়গায় মৌমাছি কামড়ালে বেশী জ্বালা করে? ঠোঁটে না মুখে না মাথায় না কি শরীরের যে সব জায়গায় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারছেন না মৌমাছির কামড় খেতে হতে পারে !!
না, মাথা খারাপ হয়ে যায়নি আমাদের। সত্যি সত্যিই বিজ্ঞানীরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করেছেন। আর সেই সব গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ কিছু বিজ্ঞানী পেয়েছেন ইগ নোবেল পুরস্কার। ‘অ্যানালস অফ ইমপ্রোবাবল রিসার্চ’ নামে এক গবেষণা পত্রিকা দেয় এই পুরস্কার। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যান্ডার্স প্রেক্ষাগৃহে প্রতিবছর বিজেতারা পুরস্কার পান – উপস্থিত থাকেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরাও। এই অনুষ্ঠানের কয়েকদিন পরে এম আই টি -তে এক অনুষ্ঠানে বিজয়ীরা তাদের বক্তব্য রাখেন। প্রতি বিজয়ী বা বিজয়ী দল সময় পান পাঁচ মিনিট। একদম ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট। তার বেশী হলেই কিন্তু মহা বিপত্তি। কেমন বিপত্তি? এই লেখার শেষে একটি ভিডিও লিঙ্ক দেওয়া আছে – নিজেরাই দেখে নিন!
এই বছর (২০১৫) পদার্থবিদ্যায় ইগ নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা হলেন প্যাট্রিশিয়া ইয়াং, ডেভিড হু, জোনাথন ফাম, এবং জেরোম চু । এরা সকলেই জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির সাথে যুক্ত। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওনারা দেখিয়েছেন যে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মূত্রত্যাগ করতে মোটামুটি কুড়ি সেকেন্ড সময় লাগে এবং এই সময়টা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আকার ও আয়তনের উপর নির্ভর করে না। এই কুড়ি সেকেন্ড হল গড় সময়, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে এর একটু এদিক ওদিক হতেই পারে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল, চেহারায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকলেও এই সংখ্যাটা সাত থেকে তেত্রিশ (কুড়ি প্লাস মাইনাস তেরো) সেকেন্ডের মধ্যেই থাকে। মানে একটি ইঁদুরের মূত্রত্যাগ করতে যতক্ষণ সময় লাগে, একটি হাতিরও মোটামুটি একই সময় লাগে!
আপাতভাবে শুনে হাসি পেলেও কাজটি খুবই আগ্রহজনক। মূত্রত্যাগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুব গভীর নয়। বিশেষতঃ, মূত্রনালী বা ইউরেথ্রার ভূমিকা সম্পর্কে আমরা বিশেষ জানি না। এতদিন আমাদের ধারণা ছিল যে মূত্রনালী কেবল মূত্রথলি ও মূত্রদ্বারের সংযোগকারী একটি নালী ছাড়া আর কিছুই নয়। তার যে মূত্রত্যাগের সময় এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। পূর্বোল্লেখিত গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, মূত্রনালীর কাজ হল, মূত্রত্যাগের সময়কে মোটামুটি কুড়ি-একুশ সেকেন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, তাই যে প্রাণী যত বড় হয়, তার মূত্রনালীর আকার ও আয়তনও তত বড় হয়। শুধু তাইই নয়, মূত্রনালী যদি খুব ছোটো আর সরু হয়, তাহলে সান্দ্র্য (viscous) ও ক্যাপিলারি বল মোটামুটি অভিকর্ষ বলের মতই শক্তিশালী হয়। এই কারণে, খুব ছোট প্রাণী, যেমন ইঁদুরের ক্ষেত্রে মূত্র আমাদের মত ধারার (jet) আকারে পড়ে না, বরং ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে।
কিন্তু কেন এমন হয়? প্রায় সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী কেন কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যে মূত্রত্যাগ করে ফেলে? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এমনটা বিবর্তনের (Evolution) কারণে হয়ে থাকে। আমরা যখন প্রস্রাব করি, তখন যদি কেউ পিছন থেকে ধাক্কা মারে তাহলে কিন্তু আমরা সেটা আটকাতে পারি না। বরং, অনেক সময় প্রস্রাব আটকে গিয়ে খুবই শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে অবশ্য পিছন থেকে ধাক্কা মারার মত কেউ নেই, তবে শিকারী প্রাণীরা তো এরকম অবস্থার জন্য সবসময় তক্কে তক্কেই থাকে, তাই মূত্রত্যাগের সময়কে যত কম করা যায় ততই ভালো। তাই সম্ভবত বহু বহু বছরের অভিযোজনের ফলেই আমরা কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যে কম্পিটিশন লাগিয়ে প্রস্রাব সেরে ফেলি।
নোবেলের মতই ইগ নোবেল বিভিন্ন বিষয়ে দেওয়া হয়ে থাকে – যেমন অর্থনীতি। এবারের বিজেতা হলেন থাইল্যান্ডের ব্যাংকক মেট্রোপলিটান পুলিশ। তারা দেখিয়েছেন, ঘুষ বন্ধ করার একটা ভালো উপায় হতে পারে যে সব পুলিশেরা ঘুষ নেওয়ার সুযোগ পেয়েও নেননি তাদের অতিরিক্ত আর্থিক পুরস্কার দেওয়া।
চিলে এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিজ্ঞানী দল জীববিজ্ঞানের ইগ নোবেল পেয়েছেন। তারা দেখিয়েছেন মুরগীর পিছনে একটি ভারী কাঠি ঝুলিয়ে দিলে তারা ডাইনোসরের মত হাঁটতে থাকে। অর্থাৎ হাঁটার সময় মুরগীরা যেমন হাঁটুর উপর ভার ফেলে চলে, এই অতিরিক্ত বোঝার চাপে তা যায় পালটে – ভরকেন্দ্র উরুর কাছে চলে যায়। ডাইনোসররা তাদের বিশাল লেজ নিয়ে ঠিক যে ভাবে হাঁটতো বলে ভাবা হয়ে থাকে।
শরীরবিজ্ঞান (ফিজিওলজি) ও পতঙ্গবিজ্ঞান (এনটমোলজি)-এ পুরস্কৃত হয়েছেন জাস্টিন স্মিট আর মাইকেল স্মিথ। প্রথমজন তৈরী করেছেন বিভিন্ন পতঙ্গের কামড় কত যন্ত্রনা দেয় তার তুলনা করার জন্য একটি স্কেল (‘স্মিট স্টিং পেইন ইন্ডেক্স’)। দ্বিতীয়জন নিজের সারা শরীরে মৌমাছির কামড় খেয়ে দেখেছেন কোথায় কতটা যন্ত্রনা হয়, এবং স্মিট ইন্ডেক্সে তাদের মান কত। তার অভিজ্ঞতায় সবথেকে বেশী কষ্ট হয় নাকের ফুটোয়, উপরের ঠোঁটে আর যৌনাঙ্গে কামড় খেলে!
চুম্বনের শারীরিক সুফল নিয়ে গবেষণার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছেন একাধিক বিজ্ঞানী। তারা দেখিয়েছেন অ্যালার্জী প্রশমনেও রয়েছে চুম্বনের ভূমিকা!
এইসব অদ্ভূত গবেষণাকেই স্বীকৃতি দেয় ইগ নোবেল। শুধু গভীর কাজ করে ইগনোবেল পাওয়া অসম্ভব। ইগনোবেল পেতে গেলে এমন কাজ করতে হবে যেটার ব্যাপারে শুনে প্রথমে হয় হাসি পাবে, নয়তো মনে হবে, “ধুস! এরকম কাজ করার জন্যও লোকেরা টাকা পায়! ” কিন্তু পরে যখন কাজটির ব্যাপারে ভেবে দেখবেন, বুঝবেন কাজটি সত্যিই খুব সুন্দর আর গভীর। আন্দ্রে গাইম, যিনি ২০১০ সালে নোবেল পুরস্কার পান গ্রাফিনের উপর কাজ করার জন্য, তিনিই ২০০০ সালে পদার্থবিদ্যায় ইগনোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন একটি ব্যাঙকে চুম্বকের সাহায্যে হাওয়ায় ভাসানোর জন্য।
২০১৫ সালের ইগ নোবেল বিজেতাদের বক্তৃতা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল ‘বিজ্ঞান’-এর সুমন্ত্র, শাওন, আর রাজীবুল। সেবছরের পুরস্কার প্রাপকদের বক্তব্য শুনতে শুনতে হাসিতে ফেটে পড়ছিলেন দর্শকবৃন্দ। তবে অনুষ্ঠান শেষ হয় একটু দুঃখ মিশ্রিত অনুভূতির সাথে। হুইল চেয়ারে বসে উপস্থিত ছিলেন জাপানী বিজ্ঞানী ইয়োশিরো নাকামাৎস, যিনি ২০০৫ সালে পেয়েছিলেন ইগ নোবেল। আজ তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত, আয়ু হয়তো আর কয়েক মাস। কিন্তু তাও মুখে দুঃখের ছাপ নেই প্রায় চার হাজার আবিষ্কারের পেটেন্ট পাওয়া সাতাশি বছরের এই বিজ্ঞানীর। নিজে লিখে এক মিউজিক কোম্পানীর সাহায্যে রেকর্ড করে ফেলেছেন একটি গান – “Even cancer face very bad”। ওনার সাথে সাথেই গাইল উপস্থিত দর্শকেরা (নিচে অডিও শুনুন)। সেই গানে বারবার ফিরে এল জীবনের জয়গান, “I don’t afraid never give up! ”
অন্যান্য টুকিটাকি :
[১] ইগ নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট বলার সুযোগ পান বক্তারা। তার বেশী হলে তাদের থামানোর জন্য নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেমন এই ভিডিও-তে মিস স্যুইটি পু-র কার্যকলাপ দেখুন। এ বছর অবশ্য মিস পু ছিল না – তার বদলে এক ব্যান্ড ছিল। সময় পেরিয়ে গেলে তাদের বাজনা উপেক্ষা করা বক্তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
[২] ইগ নোবেল বিজয়ীদের তালিকা।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/ig-nobel