22-01-2025 07:42:39 am
Link: https://bigyan.org.in/how-modern-science-began
সৌমিত্রদা আপনাকে বিজ্ঞান পত্রিকার তরফ থেকে স্বাগত জানাই। আপনি আপনার মূল্যবান সময়ের কিছুটা যে আমাদের জন্য দিচ্ছেন, তার জন্য আমরা সত্যি কৃতজ্ঞ। প্রথমত, আমাদের জানতে ইচ্ছে করে, আপনি কীভাবে পদার্থবিদ্যায় আকৃষ্ট হলেন?
সৌমিত্র সেনগুপ্ত: তোমাদের সাথে কথা বলতে পারার এই সুযোগটা আমার কাছে অত্যন্ত বড় ব্যাপার, কারণ বর্তমান সময়ে এই ধরনেরআড্ডা দেওয়ার মতো লোক পাওয়া যায় না। তোমরা সবাই মিলে যে প্রচেষ্টাটা করছো সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে খুব সংক্ষিপ্ত একটা আলোচনা করছি, এটার ফলও কিন্তু খুব সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
আমার বিজ্ঞানের পথে আসার একটা কারণ হলো, আমি খুব সাধারণ একটা স্কুলে পড়াশোনা করেছি। সাধারণ স্কুলের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, সেখানে রেজাল্ট নিয়ে লোকেরা প্রতিনিয়ত কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করতো না। ওখানে কিছু মাস্টারমশাই ছিলেন যারা আদর্শ মাষ্টারমশাই বলতে যে ছবিটা চোখের সামনে আসে, ঠিক সেইরকম। তারা যেমন আদর, যত্ন, স্নেহ করতেন, যতটুকু পড়াশোনা বুঝতেন সেটা ভালো করে শেখানোর চেষ্টা করতেন এবং আমাদের একটা অফুরন্ত জায়গা দিতেন নিজেদের চিন্তাকে ডানা মেলে উড়তে দেওয়ার জন্য। এই রকম একটা স্কুলে পড়া আমি খুব জরুরি মনে করি, যেটা বর্তমানে আমরা কিছুটা হারিয়ে ফেলেছি। স্কুলে যাঁরা আমাদের পদার্থবিদ্যা বা অঙ্ক পড়াতেন তাদের অনাবিল প্রচেষ্টা থেকে আমার বিজ্ঞানে কিছুটা আগ্রহ জন্মেছিল।
কিন্তু আমার আগ্রহের একটা বড় পরিবর্তন ঘটেছিল যখন আমার এক কাকু বিদেশ থেকে আনা জর্জ গ্যামোর লেখা ‘Physics: Foundations and Frontiers’ বইটা আমাকে উপহার দেন। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে একটা লাল মোটা বই যার ভেতরে সব কিছু নিয়ে সহজ ভাবে বলা আছে। জর্জ গ্যামো একজন অসাধারণ লেখক ছিলেন। আমার মনে আছে, ওনার ওই বইটা পড়ে আমি খুব মুগ্ধ হয়ে যাই। যে কোনো একটা বিষয়কে এমন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েও যে দেখা যায়, সেটা আমি আগে কখনও অনুভব করিনি। তারপর থেকে ক্রমশ আমি আমার পড়াশোনার বিষয়গুলোকে ওনার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার চেষ্টা করি। উনি যেভাবে দেখতে বলেছেন প্রকৃতিকে, বিজ্ঞানকে, সেটা আমাকে এতটাই প্রভাবিত করে যে আমি আস্তে আস্তে বিজ্ঞানের প্রতি ঝুঁকতে থাকি। একসময় মনে হয়, পদার্থবিদ্যার মতো বিষয় হয় না, এটাই পড়তে হবে।
ওই সময়েই অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাপে পড়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে হয়। চাপটা খুব বেশি না হলেও স্কুলের এবং আশেপাশের একটা প্রভাব অবশ্যই ছিল। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাদবপুরে ভর্তিও হয়ে গেলাম। ভর্তির পরে একজন আমাকে পরামর্শ দিলো, যেহেতু আমি পদার্থবিদ্যা ভালোবাসি আমার ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া উচিত কারণ বিষয় দুটির মধ্যে মিল রয়েছে। ভর্তি হওয়ার পর দেখলাম, পদার্থবিদ্যার সাথে অনেক মিল থাকতে পারে, এবং বিষয়টাও নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ, কিন্তু আমি এটা নিয়ে পড়াশোনা করতে চাই না।
যাদবপুরে ক্লাস চলাকালীন প্রেসিডেন্সি-তে Admission test-এর কথা ঘোষণা হলো। বাড়ি থেকে একদম লুকিয়ে চুরিয়ে আমি পরীক্ষাটা দিলাম। যেদিন উত্তীর্ণদের নামের লিস্ট বেরোলো সেখানে দেখলাম আমার নাম। ভয়ে ভয়ে আমার বাবাকে বলেছিলাম এটার ব্যাপারে। তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন আমার এই সিদ্ধান্ততে, হয়তো চিন্তিতও ছিলেন যে এতো ভালো জায়গা ছেড়ে হঠাৎ অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে আমি যাচ্ছি। তবে খুব ভাগ্যবশত আমাকে সমর্থন করেছিলেন। আমার মনে আছে আমি অনড় ছিলাম যে আমি এটা করবই, কারণ জীবন তো একটাই।
প্রেসিডেন্সি কলেজ ছিল আমার জীবনের দ্বিতীয় বড় মোড়। সেখানে আমি কিছু মানুষ পেয়েছিলাম, যাদের প্রভাব আমার ওপর সাংঘাতিকরকম ভাবে পড়েছে।
আমাদের সময়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান ছিলেন প্রফেসর অমল রায়চৌধুরীর মতো খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। এছাড়া অধ্যাপক শ্যামল সেনগুপ্ত, অধ্যাপক হেমেন্দ্রনাথ মুখার্জী, এবং রাসবিহারী চক্রবর্তী-দের মতো অনেকে ছিলেন। এনারা প্রথম আমাদের বললেন, “পদার্থবিদ্যার পেছনে শুধু দৌড়ে চলো। অনুসন্ধানী মাথা নিয়ে শেষ মুহূর্ত অবধি এর পেছনে তাড়া করো।”
পরীক্ষার কথা জিজ্ঞাসা করতে তারা একদম বারণ করতেন। আমার এখনো মনে আছে, অমল রায়চৌধুরী ক্লাসে এসে বলেছিলেন, “আমার ক্লাসে দুটো প্রশ্ন করা বারণ। এক হলো, পরীক্ষার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। এটা আমি জানি না। এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, পরীক্ষায় কী কী প্রশ্ন আসতে পারে? এটাও আমি জানি না। আমার কাছে পরীক্ষা ছাড়া যা জিজ্ঞাসা করবে আমি উত্তর দেবো।” ছোট বয়সটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়। আমার মনে হয়, অধ্যাপকদের এই ধরনের কথাবার্তাই আমার বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির পেছনে সবথেকে সহায়ক ছিল।
তাই আমার মনে হয়, প্রাথমিক ভাবে স্কুলের কিছু শিক্ষক, কিছু ভালো বই এবং পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি কলেজে কাটানো সময়টা আমার জীবনের অভিমুখ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এটার পরে আমি কোনোদিন অন্য কিছু করার কথা ভাবিনি। এখন ভাবলে আর মনে প্রশ্ন থাকে না যে সেদিন কতটা ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
আচ্ছা, এই যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং চিন্তাধারার কথা আপনি বলছেন, অর্থাৎ শুধু জানার ইচ্ছে থেকে একটা প্রশ্নকে ধাওয়া করা বা প্রথাগত চিন্তার বাইরে ভাবা, এর একটা বিরাট অংশ গ্রীক দার্শনিকদের থেকে পাওয়া। ভাবনাটাকে সংক্ষেপে এইভাবে বলা চলে — আমরা কিছু বৈজ্ঞানিক অনুমান করবো এবং সেগুলো প্রমাণ করার জন্য পরীক্ষা করবো। যদি অনুমান আর পরীক্ষার ফলাফল মিলে যায় সেটাকে আমরা একটা বৈজ্ঞানিক নীতি বলব। যদি না মেলে আমরা অন্য কোনো অনুমান করবো, বা অন্য পরীক্ষা করে প্রমাণের চেষ্টা করবো। পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে ধীরে ধীরে এই ভাবে আমরা সত্যের দিকে পৌঁছবো। এই ভাবেই পদার্থবিদ্যা অনেকটা এগিয়েছে। একসময় যেমন টলেমির পৃথিবী-কেন্দ্রিক মহাজগতের চিন্তাটাই প্রচলিত চিন্তা ছিল —
তোমাকে একটু আটকাচ্ছি। আমাদের কিন্তু ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে একরকমের বিজ্ঞানচর্চা এর আগেও হতো। প্রথমদিকে যে ধরনেরবিজ্ঞান হতো, সেটা ছিল ঘটনার মধ্যে পারম্পর্য লক্ষ্য করা। যেমন ধরো, আমি লক্ষ্য করছি যে গ্রীষ্মের সময় কালো জামা পরে বের হলে গরম অনেক বেশি লাগে। আমি কারণটা জানি না, জানার চেষ্টাও করছি না। কিন্তু আমি দেখছি সাদা জামা পরলে গরমটা কম লাগছে। আমি কিন্তু তখনো জানি না যে কালো রংটা আলোর সমস্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলোকে শোষণ করে নেয়। সেরকম কোনো তথ্য আমার জানা নেই।
কিন্তু হতে পারে যে এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই একটা প্রাচীন সমাজে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, আমরা গ্রীষ্মকালে কেউ কালো জামা পরবো না। এটাকে কি আমরা বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত বলতে পারি? সিদ্ধান্তটা কিন্তু শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। মানুষ সম্পূর্ণ বন্য অবস্থা থেকে উঠে আসতে গিয়ে অজস্র বার বিজ্ঞান ব্যবহার করেছে। কিন্তু সেটা না বুঝতে পেরে।
আমার মনে হয়, বিজ্ঞানকে আমাদের দু-ভাবে দেখা উচিত। প্রথমটা হলো আধুনিক বিজ্ঞান, যেখানে আমরা কয়েকটা নিয়ম মেনে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করি। কিন্তু এর আগেও মানুষ এক ধরনেরবিজ্ঞান করেছে, তবে তারা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার ভিতরে থেকে সেটা করেছে। এবং আমি বিশ্বাস করি সেটা না করলে পরবর্তীকালে তুমি যাদের কথা বলছো, তাদের কাছে আমরা পৌঁছতে পারতাম না।
তাই যে লোকটি প্রথম লক্ষ্য করলেন সাদা জামা পরলে গরম কম লাগে, আমার মতে তিনিও একজন বৈজ্ঞানিক। এবং বর্তমানেও পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব কমে যায়নি। কিন্তু অ্যারিস্টটল-এর সময় থেকে একটা বিশেষ পদ্ধতি মেনে বিজ্ঞানচর্চা শুরু হয়। এ বিষয়ে আমি তোমার সাথে একমত।
এটা কি বলা যায় যে বিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত আমরা অ্যারিস্টটলের দেওয়া সেই পদ্ধতিগুলোকেই মেনে চলেছি?
নিঃসন্দেহে অ্যারিস্টটলের পদ্ধতিগুলোকে আমরা মেনে চলেছি, কিন্তু পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের কিছু নতুন সংজ্ঞা এর সাথে যুক্ত হয়। যেমন গ্যালিলিও জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি কাকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলবো? এবং আমি মনে করি, আমরা আজও ওনার সংজ্ঞা থেকে সরে আসতে পারিনি। গ্যালিলিওর মতে, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হলো সেটাই যেটাকে ঠিক বা ভুল প্রমাণ করা যায়।
উদাহরণস্বরুপ আমি তোমাকে একটি এক সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের বস্তু দেখালাম এবং বললাম আমার সামনে রাখা টেবিলটির দৈর্ঘ্য 20 সেমি। এই বিবৃতিটিকে আমরা বৈজ্ঞানিক বলতে পারি কারণ আমরা যে কোনো এক সেন্টিমিটার বস্তুকে ব্যবহার করে টেবিলটির দৈর্ঘ্য মেপে সেটা ঠিক বা ভুল প্রমাণ করতে পারবো। কিন্তু তুমি যদি বলো এই ফুলটি খুব সুন্দর, আমি কোনোভাবেই তোমাকে প্রমাণ করতে পারবো না যে ফুলটি সুন্দর নয়।
অর্থাৎ, কোনো কথা আদৌ বৈজ্ঞানিক কিনা, সেটা কীভাবে বিচার করবো, এইটা গ্যালিলিও এবং সমসাময়িকদের কাছে আমরা পেলাম। ধরো, আমি একটা কিছু বললাম। প্রথমে দেখতে হবে সেটা ভুল প্রমাণ করা সম্ভব কিনা। যদি সেটা হয়, তাহলেই কথাটা বৈজ্ঞানিক। কিন্তু যদি সেটা না হয় তার মানে এই নয় যে কথাটা ভুল। শুধু এটুকুই বলা যায় যে কথাটা বিজ্ঞানের পরিধির মধ্যে পড়েই না। আমার মনে হয় বিজ্ঞানের চলার পথে এই ধাপটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং এই জায়গাটা থেকে আজও আমরা সরে যাইনি।
কিন্তু এই ব্যাপারটাকে দাঁড় করাতে গিয়ে গ্যালিলিও বা টাইকো ব্রাহে — এদেরকে খুব কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। এর কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, ওই সময়ে বিজ্ঞান বা পর্যবেক্ষণকে ব্যবহার করা হতো আগের কিছু বিশ্বাস বা বদ্ধমূল ধারণাকে প্রমাণ করার জন্য। এখন কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম। এখন আমাদের কাছে বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হলো, এই বিশ্ব প্রকৃতিকে বোঝা। আগের কিছু ধারণাকে প্রমাণ করার কোনো দায়বদ্ধতা সেখানে নেই।
গ্যালিলিও বা অন্যান্যদের সংগ্রামের কারণটাই হলো, আগের গ্রীক দার্শনিকরা কিছু বিশেষ ধারণাকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। যখন গ্যালিলিওর মতো বৈজ্ঞানিকরা দেখলেন সেগুলো প্রকৃতিকে ঠিক মতো ব্যাখ্যা করতে পারছে না, তারা নিজেদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে অন্য একটা সম্ভাবনার কথা বললেন। সেগুলো আগের গ্রীকদের বর্ণনার বিরুদ্ধে গেল।
টাইকো ব্রাহে সম্পর্কে আমরা খুব কম আলোচনা করি। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান একটা কথা লিখেছিলেন যেটা আমি কোনোদিন ভুলবো না। তিনি লিখেছিলেন, যখন লোকে তারা বা গ্রহের ঘোরার কথা ভাবতো, তারা মনে করতো কিছু স্বর্গের পরি এদের ঠেলছে। যেহেতু সমস্ত ঘটনাকে তখন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হতো, এরকম ভাবা স্বাভাবিক ছিল। ফাইনম্যান লিখছেন, সেসময় টাইকো ব্রাহের মনে হয়েছিল, দার্শনিক চিন্তায় মগ্ন হয়ে না থেকে একটা পরীক্ষা করে দেখলেই হয়।
আমার মনে হয় এই বাক্যটি তিনি খুব সচেতনভাবেই লিখেছিলেন। সমস্ত দার্শনিক চিন্তার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। যতক্ষণ না সেটাকে পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করা হচ্ছে, সেটা কিন্তু একটা চিন্তা মাত্র, বৈজ্ঞানিক সত্য নয়। পদার্থবিদ্যা কিন্তু মূলত একটা পরীক্ষা-নির্ভর বিজ্ঞান। আমি নিজে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হয়েও এটা বলছি। আমি যদি কোনো তত্ত্বকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ না করতে পারি, সেই তত্ত্বটি যতই ভালো হোক সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অনেক সময় এরকম হয় যে একটা তত্ত্বের মধ্যে কোনো স্ববিরোধিতা নেই, তত্ত্বের একটা অংশের যুক্তি আরেকটা অংশের সাথে মিলছে। কিন্তু সেটা থেকে এটা প্রমাণ হয় না যে সেই তত্ত্বটার সাথে প্রকৃতির কোনো সম্পর্ক আছে।
টাইকো ব্রাহের পরে আসেন কোপারনিকাস, কেপলার এবং অবশেষে গ্যালিলিও, নিউটন। আমার মনে হয়, এরা সেই মানুষ যারা বিশ্বকে দেখাচ্ছিলেন কীভাবে বিজ্ঞানে জানার পরিধিটা বাড়াতে হয়, এবং একটা জিনিসকে বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝার শর্তগুলো কী কী। তারা দেখালেন, যে কোনো জিনিসকে বিজ্ঞানের মধ্যে ঢোকালেই চলবে না। যে প্রশ্নগুলোর ঠিক ভুল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করা যাবে, সেগুলোই বিজ্ঞানের আওতায় পড়বে এবং বৈজ্ঞানিক হিসেবে আমি শুধু সেইগুলো নিয়ে কথা বলবো, বাকিগুলো নিয়ে নয়।
এটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যেটা আমাদের মনে রাখতে হবে। যুগে যুগে আমাদের সমাজের অশুভ শক্তিরা বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার পিছনে অন্য অভিসন্ধি খুঁজে বিজ্ঞানের বিকাশকে নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করে যাতে মানুষ ভুলে যায় যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একমাত্র দায় হলো সত্যের উদ্ঘাটন করা, বিশ্বপ্রকৃতিকে বোঝা। অথচ বিজ্ঞানী হিসেবে আমরা বৈজ্ঞানিক প্রমাণভিত্তিক সত্য ছাড়া আর কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না। সত্য প্রচারের বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আমাদের নেই।
ফিরে যাই ইতিহাসের আলোচনায়। 500 খ্রিস্টপূর্বে পিথাগোরাসের পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্বের চিন্তার প্রচলন হয়। তারপর টলেমি, টাইকো ব্রাহে, কোপারনিকাস, কেপলার, এদের হাত ধরে এই ধারণাটির ক্রমবিকাশ হতে হতে প্রায় ষষ্ঠদশ শতাব্দী এসে পড়ে।
হ্যাঁ, অনেক বছর লেগেছিল।
কোপারনিকাস-এর সময়ে এসে আমরা বিশ্ব বা সৌরমণ্ডল কীভাবে কাজ করছে তার একটা স্পষ্ট নকশা পাই। কোপারনিকাস প্রমাণ করেন উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহেরা সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। একই ভাবে আমাদের ভারতীয় জ্যোতির্বিদরাও খুব স্পষ্ট ভাবে গণনা করতে পারতেন কবে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হবে। অর্থাৎ গ্রহ, নক্ষত্র, তারাদের গতিবিধিগুলো সম্বন্ধে তাদের ধারণা ছিল। আর্যভট্ট বা বরাহমিহিরদের সময়কাল হল 400 থেকে 500 খ্রিস্টাব্দ। এরা গ্রীক দার্শনিকদের প্রায় হাজার বছর আগে এইগুলো নিয়ে কাজ করেছেন। এতো বছর আগে যদি ভারতীয় জ্যোতির্বিদরা সূর্যকেন্দ্রিক কক্ষপথের কথা না জানতেন, তাহলে কি এই গণনাগুলো করা সম্ভব হতো?
হয়তো না। কিন্তু কোপারনিকাস-এর সমসাময়িক জ্ঞান তৎকালীন ভারতীয়দের কাছে ছিল এটা বলার মতো কোনো নথিপত্র আমাদের কাছে নেই। যা নথিপত্র আছে, তার ভিত্তিতেই তো আমাকে বলতে হবে। সেই দিক থেকে বললে এটুকুই বলা যায় যে প্রাচীন ভারতে যারা বহির্বিশ্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন, তারা অনেক কিছু ঠিকভাবে বলেছিলেন। সম্ভবত তাদের কাছে কোনো পদ্ধতি (methodology) ছিল যেখানে পর্যবেক্ষণকে তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু এটাও সত্যি যে তারা বিশাল এক দূরবীন নিয়ে বসে বসে মহাজাগতিক ঘটনা দেখেছিলেন, আমাদের কাছে এমন কোনো প্রমাণ নেই।
তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী ছিলেন, কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তগুলো অনেকটা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল ছিল বলে আমার মনে হয়। তারা ঘটনার আড়ালে যে বৈজ্ঞানিক নিয়মগুলো কাজ করছে, সেগুলো জানতেন এবং সেগুলো মেনে ভবিষ্যৎবাণী করতেন, এই রকম কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। তুমি বলতে পারো, তৎকালীন যুগে কোনো চিন্তাকে লিখে রাখার প্রচলন ছিল না, তাই হয়তো আমরা জানি না। আমি বলবো, তাও কিন্তু শিষ্যদের মুখে মুখে শ্রুতির মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে তাদের জানাটা চলে আসতো। আমরা কোথাও কিন্তু দেখিনি যে বর্তমান সময়ে যেভাবে আমরা গতিসূত্রের (equation of motion) সমাধান করে ভবিষ্যৎ নির্ণয় করি, সেই যুগে বসে তারা সেইরকম কিছু করতেন।
অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল বিজ্ঞানটাও কিন্তু খুব শক্তিশালী। ধরো, অনেকদিন ধরে তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছো। তুমি একটা সময়ের পর চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের পুনরাবৃত্তি দেখতে পারো। এবং বুদ্ধি খাটিয়ে সেখান থেকে ধীরে ধীরে কিছু ফলাফল পেতে পারো। সেই ফলাফলের মধ্যে কিছুটা সঠিক হলেও কতদূর সঠিক সেটা আমরা জানি না, কারণ পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সবটা বুঝতে পারবেন তারা, এটা আশা করা উচিত না।
আমার মনে হয় না এটা বলার মতো খুব মজবুত যুক্তি রয়েছে যে তৎকালীন ভারতবর্ষের মানুষদের কাছে আধুনিক বিজ্ঞান বলতে পরবর্তীকালে যেটা আমরা বুঝেছি, তার ধারণা ছিল। শুধু এটুকু বলতে পারি যে তাদের মধ্যে খুব বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাদের যুক্তিবিচারের ক্ষমতা (deductive power) বেশ জোরালো ছিল (তুমি জানোই, ভারতবর্ষ অঙ্কে সেই সময়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছিল)। কিছু কিছু ঘটনার মধ্যে ওনারা একটা অন্তর্নিহিত নকশা (pattern) দেখতে পেয়েছিলেন। শুধু এই অব্দিই আমি বলতে পারি।
সূর্যঘড়ির প্রচলন তো সেইসময় ভারতবর্ষে ছিল?
হ্যাঁ, সূর্যঘড়ি ছিল। কিন্তু সেটাও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পাওয়া বিজ্ঞান (empirical science)। ধরো, কেউ একজন মাটিতে খুঁটি পুতেছিল এবং সে দেখলো দিনের বিভিন্ন সময়ে খুঁটির ছায়া পাল্টাচ্ছে। আমার মতে, সে কিন্তু এক অর্থে বিজ্ঞানী। সে প্রথম তার সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটা যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্তে এসেছিল।
আধুনিক বিজ্ঞান যেটা করলো, শুধু পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে না এসে এক ধাপ এগিয়ে আমাদের শেখালো সাধারণীকরণ (generalization) করতে। অর্থাৎ আমি এমন একটা সূত্র বা তত্ত্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো যেটা শুধু এই একটা সিস্টেম-এ (system) নয়, একই ধরনের অন্যান্য সিস্টেম-এও কাজ করবে।
আমার বারবার মনে হয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান তৈরির আরেকটা কারণ হলো, মানুষ বিবিধ ঘটনার মধ্যে একটা মিল খোঁজে। তুমি চারিপাশে যদি দেখো, লক্ষ্য করবে যে প্রকৃতি খুবই বৈচিত্র্যময়। নদীর জল বয়ে চলছে, গাছ থেকে পাতা পড়ছে, আমরা হেঁটে চলেছি, এই সমস্ত ঘটনা আলাদা। কোনোটার সাথে কোনোটার মিল নেই। আমার কেন জানি মনে হয়, এই সমস্ত বৈচিত্র্যের মাঝে মানুষ একটা একতা খোঁজার চেষ্টা করে। কেন করে? সেই উত্তর আমি দিতে পারবো না।
বিজ্ঞান কিন্তু মানুষের সেই প্রয়োজনটা কিছুটা পূরণ করে। বিজ্ঞানের সব থেকে বড় সৌন্দর্য হলো, আমরা যে সূত্র দিয়ে সূর্যের গতিপথ গণনা করতে পারি, ঠিক সেটা দিয়েই গাড়ি চলা, গাছের পাতা পড়া এবং নদী চলার পথও গণনা করতে পারি। আপাত অর্থে প্রকৃতির যে এতো বৈচিত্র্য দেখা গেল তার পেছনে একই ধরনের বিজ্ঞান-এর নিয়ম কাজ করে।
মানুষের এই যে চাওয়াটা, এর পেছনে কিন্তু একটা দার্শনিক সত্ত্বা রয়েছে। আসল প্রকৃতি কিন্তু সেরকম না-ও হতে পারতো। হতেই পারতো প্রকৃতিতে পাতা পড়ার এক ধরনের সূত্র, নদী চলার জন্য আরেক ধরনের সূত্র। কিন্তু সেটা যে নয়, এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা খোঁজ চালিয়ে যাই, পরীক্ষা করি এবং ফলাফল দেখি। আমার মনে হয় এটার পেছনে আমাদের একটা ‘বৃহত্তর পরিকল্পনা’ (grand design) খোঁজার চেষ্টা কাজ করে। কিন্তু এমন একটা পরিকল্পনা যে আদৌ রয়েছে, এই ধারণাটা নিঃসন্দেহে একটা দার্শনিক চিন্তা।
নিঃসন্দেহে।
সেই জন্যেই আমি বলবো, কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের দেশে বা বিদেশেও নানা মানুষ দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নানারকম কাজ করেছেন। কিন্তু সেগুলো থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম দেওয়া, এর পেছনে কিন্তু এরকম একটা দার্শনিক অনুসন্ধিৎসা কাজ করেছে।
তার মানে, দর্শন আর বিজ্ঞান কোথাও গিয়ে মিলে যাচ্ছে?
ভীষণ সত্যি কথা। মিলে তো যাচ্ছে, কোনো সন্দেহই নেই।
ধরো, আমি যদি তোমাকে প্রশ্ন করি — এই যে নিউটনের সূত্র, প্রকৃতি এটাকে কেন মানে, তাহলে এই প্রশ্নের কী উত্তর হবে? কেন, সেই উত্তর কিন্তু আমরা জানি না। আমরা জানি, এটা হয়। এটা আমরা দেখেছি দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকেই। কিন্তু পুরোনো অভিজ্ঞতানির্ভর বিজ্ঞানের ধারার (empiricism) সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের পার্থক্য হলো, এই সূত্রটাকে ওই অভিজ্ঞতার পরিধির বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পৃথিবীতে বসে একটা পর্যবেক্ষণ করে দূরের এক নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝে কী হবে, সেইটা বলা হচ্ছে। এবং পরে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে যে দুটো ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের এই সূত্রটা একই থাকছে।
এই যে সাধারণীকরণ (generalization) করার একটা মানসিকতা, এটা কিন্তু মানুষের মধ্যে ছিল। এরকম একটা ধারণা ছিল যে এতোরকমের যে জিনিস দেখছি, সেগুলো আসলে কিন্তু আলাদা নয়। এর মূলে কিছু অল্পসংখ্যক সার্বজনীন সূত্র রয়েছে।
এটা কিন্তু বস্তুর গঠনেও লক্ষ্য করবে। দেখো, একটা ঘরের মধ্যে এই যে এতো ধরনের বস্তু রয়েছে, যদি ধীরে ধীরে তাদের ভিতরে যাও, সবগুলোই অণু দিয়ে তৈরি। অণুর সংখ্যা কিন্তু অত বেশি নয়। অণুগুলোর ভেতরে ঢুকে দেখো, সমস্ত কিছু পরমাণু দিয়ে তৈরি। পরমাণুর সংখ্যা আরো কম। আরো ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাবে, পরমাণুগুলো কয়েকটা মাত্র মৌলিক কণা দিয়ে তৈরি।
তার মানে দেখো, যত ভিতরে ঢুকছো, বুঝতে পারছো — প্রকৃতির এই সমস্ত বৈচিত্র্য শুধু বাইরে, ভিতরে কিন্তু সবকিছু কয়েকটা মাত্র কণা দিয়ে তৈরি। এখানেও কিন্তু সেই একই ধরনের একত্রীকরণ (unification) কাজ করেছে। মানুষ এটাই খুঁজে বেরিয়েছে চিরকাল, এবং সেই খোঁজার ফলাফল হলো আধুনিক বিজ্ঞান।
(লেখাটি মূল ইন্টারভিউয়ের ভিত্তিতে লিপিবদ্ধ করেছে সৌমেন্দু জানা।)
(প্রচ্ছদের ছবি: শ্রেয়া সুধীর)
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/how-modern-science-began