08-12-2024 21:19:42 pm
Link: https://bigyan.org.in/hidden-residents-of-tropical-jungle
আমাদের গাড়িটা অল্প জায়গার মধ্যে বাঁক নিল, দিয়ে একটা পাথুরে চড়াই বেয়ে উঠে শেষে থামতে বাধ্য হলো। গাড়ির রাস্তা শেষ হয়ে গেছে। লাফিয়ে নামলাম গাড়ি থেকে, দিয়ে ট্রাঙ্ক বোঝাই মালপত্তরের সামনে জড়ো হলাম সবাই। এবার প্রস্তুতি নিতে হবে বাকি পথটার জন্য। এটা বছরের সেই সময়টা যখন মৌসুমী বায়ু পশ্চিম ঘাট-কে বৃষ্টিতে ধুয়ে দিয়ে মেঘলা আকাশের পটভূমিকায় পাহাড়ের সবুজটাকে আরো উজ্জ্বল, বাতাসটাকে আরো ঝকঝকে করে দেয়।
আমাদের মত যারা মাটিতে কেন্নো জাতীয় আর্থ্রোপড (arthropod) খোঁজে, তাদের এই মরসুমে সতর্ক থাকতে হয়। মশা ঠেকাতে ঢেকেঢুকে চলতে হয়, পথের ধারে ওত পেতে থাকা জোঁকের কথা ভেবে হাঁটু অব্দি মোজা পরতে হয়। জিপিএস চালু করে আমরা মাথায় টর্চ লাগালাম, তারপর দড়ি, রেক, চালনি আর স্যাম্পল ধরার বোয়াম সব একত্র করলাম। পাঁচমেশালি এইসব সরঞ্জাম বগলদাবা করে রওনা হলাম পাহাড়চূড়ার দিকে। সেখান থেকে একটা দুরন্ত ভিউ পাওয়া যায়: নিচে পশ্চিম ঘাট-এর পুষ্পগিরি পাহাড়ের ঢালে বিছিয়ে আছে বেগুনী রঙের কুরীঞ্জি ফুলের চাদর।
পশ্চিম ঘাট-এর পাহাড়গুলো সেই প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে প্রহরীর মতো ভারতবর্ষের ভূমি, জলবায়ু আর জীবজগতের বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। কুড়ি কোটি বছর আগে যখন ভারতবর্ষ গোন্ডওয়ানা স্থলভূমির অংশ ছিল, তখন থেকেই এই প্রহরীর কাজ শুরু। ভারতের পশ্চিম উপকূল বরাবর ১৬০০ কিমি জুড়ে এই পর্বতমালা দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে আছে একাধিক স্তূপপর্বত (massif)। দক্ষিণের দৈত্যাকার পর্বতগুলো থেকে যত উত্তরের অপেক্ষাকৃত কম উঁচু অধিত্যকার দিকে যাওয়া হয়, তত বৃষ্টির মেয়াদ কমতে থাকে। ফলে এখানে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয় যেটা অন্যত্র দেখা যাবে না [১]। আর সেই পরিবেশে জন্ম নেয় বিচিত্র কিছু প্রাণীর গোষ্ঠী।
এই প্রাণের বিবর্তনের পেছনে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও রয়েছে। যেমন, উত্তরের এবং মাঝের পর্বতমালায় সাড়ে ছ’কোটি বছর আগে এক বিপুল অগ্ন্যুৎপাতের কারণে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায় [২]। তারপর ১.১ কোটি বছর আগে হঠাৎ একটা শুকনো ঋতু চালু হওয়াতে আরেক প্রস্থ পরিবর্তন হয় পরিবেশের [৩]। ইতিহাসের খামখেয়ালিপনার সাথে পরিবেশের বৈচিত্র্য মিশে নতুন ধরণের প্রাণের জন্য আদর্শ পরিস্থিতি তৈরী করেছে [৪]। আজকে ভারতবর্ষের জীববৈচিত্র্যের এক-তৃতীয়াংশ এই পশ্চিম ঘাট পর্বতমালাতেই পাওয়া যায়। এটাকে বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্যের একটা হটস্পট হিসেবে গণ্য করা হয় কারণ এখানকার অনেক প্রজাতিই একেবারে স্বতন্ত্র, আর কোথাও তাদের দেখা যায় না।
গত কয়েক দশকে অনেক গবেষকদল পশ্চিম ঘাট-এ অভিযান চালিয়েছেন। এই অভিযানগুলোর উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের কথা লিপিবদ্ধ করা। অনেক নতুন প্রজাতির খবর পাওয়া গেছে, যেগুলো আগে বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা ছিল। এরকম অভিযানের ফলে আমাদের জানার পরিধিটা বাড়ে। শুধু যে নতুন প্রজাতির খোঁজ করা হয় তাই নয়, তারা কোথায় কীভাবে ছড়িয়ে আছে সেই পরিসংখ্যানও বার করা হয়। এগুলো ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেন বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আছে কিনা কিংবা তাদের ভৌগোলিক বন্টনে কোনো প্যাটার্ন আছে কিনা, সেইটা খুঁজে দেখতে।
কিন্তু অনেক কুচোকাচা জীব, যেগুলো বাস্তুতন্ত্রের (ecosystem) জন্য জরুরি কিন্তু সহজে চোখে পড়ে না, সেগুলো আড়ালেই রয়ে যায়। আর্থ্রোপড-রা সেরকমই এক অবহেলিত গোষ্ঠী। এদের মধ্যে আছে সেন্টিপিড, মিলিপিড, মাকড়শা, স্করপিয়ন এবং অন্যান্য ধরণের পোকামাকড়। এরা মাটির বাস্তুতন্ত্রে পুষ্টির চলাচল অব্যাহত রাখে, কিন্তু এদের সনাক্ত করা মোটেই সহজ কাজ নয়। অথচ এই আর্থ্রোপড-রা পৃথিবীর বুকে কয়েক কোটি বছর ধরে রয়েছে। পশ্চিম ঘাট-এর মতো পরিবেশে কীভাবে মাটি এবং জলবায়ুর পরিবর্তন হয়েছে, সেটা বুঝতে এরা আমাদের সাহায্য করতে পারে।
আড়ালে যখন রয়েছে, এদের বার করতে অনেক প্যাঁচ কষতে হয়। আমাদের মত গবেষকদের জঙ্গলে যাওয়ার অনেক সপ্তাহ আগে থেকে তোড়জোড় শুরু করতে হয়। কোনখানে কি প্রজাতি পাওয়া যাবে, সেটা তাপমাত্রার আর বৃষ্টির উপর অনেকটাই নির্ভর করে। আবার নদী বা উপত্যকাও একেকটা প্রজাতিকে একেকটা অংশে সীমিত রাখে। আমরা তাই প্রথমে পশ্চিম ঘাট-এর মানচিত্র খুলে বসি। বিভিন্ন স্তূপপর্বতগুলোকে খুঁটিয়ে দেখে কয়েকটা জায়গা বাছতে চেষ্টা করি যেখানে পৌঁছনও যাবে এবং নানান প্রজাতির আস্তানাও থাকবে।
পুরো কাজটা কম্পিউটারে হয়। একটা ডিজিটাল মানচিত্রে কয়েকটা উজ্জ্বল বিন্দু দেখে মনে অনেক আশা জাগে। কিন্তু সেসব জায়গাতে সশরীরে পৌঁছনো, সে আরেক কাহিনী। কখনো হতাশা, কখনো শঙ্কা, মাঝেমাঝে অপ্রত্যাশিত আনন্দ। হয়তো দেখা গেল, সোজা রাস্তায় ধস নামার ফলে অনেক ঘুরপথে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। বা হঠাৎ করে নাকে এলো হাতির বিষ্ঠার গন্ধ, ব্যাস, বুক ধুকপুক শুরু! কখনো বা মুষলধারে বিদ্যুৎসহ বৃষ্টি আমাদের ঘরবন্দী করে দিল। আবার এরকমও হতে পারে যে গাড়ি জলকাদায় আটকে যাওয়ার ফলে অনন্তকাল ধরে বসে আছি, হঠাৎ এক বাঘের দেখা, না চাইতেই অবিস্মরণীয় মুহূর্ত!
বনদপ্তরের কর্মীরা আমাদের স্যাম্পলিং-এর জায়গাতে যেতে সাহায্য করেন। সেখানে পৌঁছলে আমাদের কাজ হলো হাঁটাপথের ধারে পাথর কিংবা মরাকাঠ উল্টেপাল্টে আর্থ্রোপড-দের বার করা। এইরকম স্যাঁতস্যাঁতে ঘুপচি অন্ধকারেই তেনারা থাকতে পছন্দ করেন। কোন আর্থ্রোপড-টা কোন প্রজাতির, সেটা বুঝতে ওদের ল্যাবে মাইক্রোসকোপের তলায় ফেলতে হবে, জেনেটিক বিশ্লেষণ করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে আমরা কয়েকটা নমুনা সযত্নে তুলে বোয়ামবন্দী করি। প্রত্যেকটাকেই একটা সংখ্যা দিয়ে লেবেল করা হয় এবং সেটা কোত্থেকে সংগ্রহ করা হলো, সেইসব লিখে রাখা হয়।
সক্রিয়ভাবে খোঁজা ছাড়াও আমরা ছোট ছোট জমির প্লট স্যাম্পল করি। উদ্দেশ্য হলো সেই প্লটে যত আর্থ্রোপড আছে, তার হিসেব নেওয়া। এর জন্য প্রথমে চিরহরিৎ জঙ্গলের এমন একটা জায়গা চিহ্নিত করা হয় যেখানে মানুষের পা পড়েনি। সেখানে টানটান করে একটা দড়ি বেঁধে সেই দড়ির নিচে নিয়মিত বিরতিতে এক মিটার চওড়া একটা করে চৌকো ফ্রেম বসানো হয়। এরপর শুরু হয় আসল পরিশ্রম: যত ঝরে পড়া পাতা সেই ফ্রেমের মধ্যে রয়েছে, সব সংগ্রহ করতে হয়, গোটা সংগ্রহটাকে ওজন করতে হয়, তারপর চালনি দিয়ে ছেঁকে ওর মধ্যে যত আর্থ্রোপড লুকিয়ে আছে, সব বার করতে হয়। এটা করার সময় সজাগ থাকতে হয়, যাতে তারা লাফিয়ে, ছুটে বা ছিটকে পালিয়ে না যায়। প্রয়োজনে তাড়া করে ধরার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। এসবের মধ্যে আমাদের অন্য ধরণের সম্ভাব্য প্রতিবেশীদের কথাও খেয়াল রাখতে হয়। হয়তো ওই পাতার মধ্যে পিট ভাইপারের (hump-nosed pit viper) মতো কিছু লুকিয়ে আছে তার শিকারের অপেক্ষায় [৫]।
ফিল্ডে কাজ চলতে থাকে। সেই কাজের মাঝে নানান দৃশ্য বা শব্দ আমাদের চমকিত করে। হয়তো একটা মালাবার দৈত্যাকার কাঠবেড়ালি (Malabar giant squirrel) ডেকে উঠলো, সেই ডাক প্রতিধ্বনিত হলো, পরমুহূর্তেই ঝপাৎ করে কাঠবেড়ালিটা উপরে কোথাও লাফ দিল। কিম্বা একটা সাদা-পেট ট্রিপাই (white-bellied treepie) পাখি কাছাকাছি কোথাও ডানা ঝাপটালো। বা হয়তো একটা গিরগিটি আকাশের তারার মতো শান্ত হয়ে একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসে আছে। দিনের শেষে স্পেসিমেন লেবেল করে, তথ্য লিপিবদ্ধ করে আমরা দিনটা কেমন গেল সেই চর্চা করি খানিক, সবশেষে পরদিনের জন্য গোছগাছ করি। যদি ভাগ্য ভালো থাকে, আজ রাতে হয়তো পেটে-দাগ ঈগল প্যাঁচার (spot-bellied eagle owl) পরিত্রাহি ডাক শুনতে পাবো। এই ডাক আমাদের মনে করিয়ে দেবে যে জঙ্গলটা পাশেই রয়েছে, অনেক অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে অপেক্ষা করছে, যে অ্যাডভেঞ্চারে আমরাও সামিল হবো।
(এই লেখাটি প্রথম SciTales ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিল। মূল ইংরেজি লেখাটি এখানে দেখতে পাবেন। SciTales হায়দরাবাদ-এর সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি-র নিজস্ব প্রকাশন। লেখাটি বাংলা অনুবাদ করেছেন ‘বিজ্ঞান’-এর স্বেচ্ছাসেবকরা।)
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[১] “দক্ষিণের দৈত্যাকার পর্বতগুলো থেকে যত উত্তরের অপেক্ষাকৃত কম উঁচু অধিত্যকার দিকে যাওয়া হয়, তত বৃষ্টির মেয়াদ কমতে থাকে। ফলে এখানে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয় যেটা অন্যত্র দেখা যাবে না।” – http://216.10.241.130/pdf/
open/PDF_45_2/45210.pdf
[২] “উত্তরের এবং মাঝের পর্বতমালায় সাড়ে ছ’কোটি বছর আগে এক বিপুল অগ্ন্যুৎপাতের কারণে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়” – https://pubmed.ncbi.nlm.
nih.gov/20009273/
[৩] “তারপর ১.১ কোটি বছর আগে হঠাৎ একটা শুকনো ঋতু চালু হওয়াতে আরেক প্রস্থ পরিবর্তন হয় পরিবেশের” – https://agupubs.onlinelibrary.
wiley.com/doi/full/10.1029/
2012GL051305
[৪] “ইতিহাসের খামখেয়ালিপনার সাথে পরিবেশের বৈচিত্র্য মিশে নতুন ধরণের প্রাণের জন্য আদর্শ পরিস্থিতি তৈরী করেছে” – https://onlinelibrary.wiley.
com/doi/epdf/10.1002/ece3.603
[৫] মানুষ ভাইপারদের স্বাভাবিক খাদ্য নয়, কিন্তু ভুল করে পা পড়ে গেলে তখন ছোবল খাওয়ার ভয় থাকে।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/hidden-residents-of-tropical-jungle