02-12-2025 18:52:52 pm

print

 
বিজ্ঞান - Bigyan-logo

বিজ্ঞান - Bigyan

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম
An online Bengali Popular Science magazine

https://bigyan.org.in

 

পরীক্ষায় হোঁচট খেলেন হাইসেনবার্গ


%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a6%e0%a7%80%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%a4-%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%be%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a7%80
প্রদীপ্ত পঞ্চাধ্যায়ী

(কাঁথি প্রভাত কুমার কলেজ)

 
03 Dec 2025
 

Link: https://bigyan.org.in/heisenberg-viva-incident

%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b7%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%81%e0%a6%9a%e0%a6%9f-%e0%a6%96%e0%a7%87%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%a8-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%87

পরীক্ষায় ভালো ফল না হলে যারা মুষড়ে পড়ে, হয়তো বেছে নেওয়া কর্মপথটাই ছেড়ে দেয়, তাদের জন্য এই গল্প। পদার্থবিদ গবেষক ভার্নার হাইসেনবার্গ — যার অনিশ্চয়তা নীতি (uncertainty principle) এবং ম্যাট্রিক্স মেকানিক্স (matrix mechanics) নিয়ে গবেষণা কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে (quantum mechanics) অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছিল — পিএইচডি গবেষণার শেষে মৌখিক পরীক্ষায় বিষম ধেড়িয়েছিলেন। এতটাই যে তাঁর গবেষণা নির্দেশককে পিএইচডি কমিটির কাছে সাধাসাধি করতে হয়েছিল তাঁকে ফেল না করাতে!

মাইক্রোস্কোপ দিয়ে একটা ইলেক্ট্রনকে দেখতে চেষ্টা করলে মাইক্রোস্কোপের আলোর ধাক্কায় ইলেক্ট্রন-টা সরে যাবে। আরো ভালো করে সেটাকে দেখতে যদি আরো শক্তিশালী আলো ফেলো, তাহলে ধাক্কাটা আরো জোরালো হবে। হয় তুমি ইলেক্ট্রনটা কোথায় আছে সেটা ভালো করে জানতে পারবে, নয়তো সেটাকে স্থির রাখতে পারবে। যত ভালো করে তার অবস্থানটা জানবে, তত বেশি অনিশ্চয়তা ঢুকবে তার চলনে।

এটাই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার “অনিশ্চয়তা নীতি”-র (uncertainty principle) মোদ্দা কথা। যাঁর নামে এই নীতিটা পরিচিত, সেই ভার্নার হাইসেনবার্গ (Werner Heisenberg) উপরের এই পরীক্ষাটির কথা বলেছিলেন, অনিশ্চয়তা নীতির একটা বাস্তব প্রতিফলন হিসেবে। ওনার নীতিটা সঠিক ছিল, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে, এবং আজও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পাঠ্যবইয়ে শুরুর দিকেই পড়ানো হয়। কিন্তু এই বিশেষ পরীক্ষাটি উনি একটি কাল্পনিক সম্ভাবনা (thought experiment) হিসেবে ফেঁদেছিলেন। 

কারণ একটা মাইক্রোস্কোপ নিয়ে খুব বেশি নাড়াচাড়া করার প্রবৃত্তি হাইসেনবার্গ-এর ছিল না। সেই পিএইচডি-র সময় থেকেই ছিল না। যে কারণে উনি পিএইচডি-র শেষে মৌখিক পরীক্ষায় প্রায় ফেল করতে বসেছিলেন!

হীরের টুকরো ছাত্র

1922 সাল।

জার্মান তরুণ গবেষক ছাত্র ভার্নার হাইসেনবার্গ (Werner Heisenberg) তখন গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পৌঁছানোর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হিলবার্ট-বর্ন শীর্ষক সেমিনারে হাইসেনবার্গের আলোচনা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার উচ্চ মেধা, উল্লেখযোগ্য দক্ষতা, এবং সদালাপী ব্যক্তিত্বের কারণে গটিংগেনে তিনি অল্পদিনেই বিজ্ঞানী মহলে আদৃত হলেন।

অল্পবয়েসী হাইসেনবার্গ (Credit — Emilio Segre visual archives)

এরপর ডিসেম্বর মাসে তাঁকে গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা আলোচনা সভায় (Physics Colloquium) ডাকা হয়। এই সভা ছিল ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার সর্বোচ্চ আদালত। সেখানে স্থানীয় ও অতিথি বক্তারা তাঁদের সাম্প্রতিক কাজ জমা দিতেন, তারপর সেগুলির চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হতো। সভায় বক্তারা প্রশ্নোত্তর ও তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হতেন। বিজ্ঞানী ম্যাক্স বর্ন (Max Born) [১] এই আলোচনা সভার কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, “বক্তাকে থামানো এবং নির্মমভাবে সমালোচনা করা একটি প্রথা ছিল।”

এই সভায় হাইসেনবার্গ তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রটি পেশ করেন। সেটির মূল আলোচ্য বিষয় ছিল পরমাণুর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী জিম্যান ক্রিয়ার (Anomalous Zeeman Effect) জন্য তৈরি একটি মডেল। একটা চুম্বক ক্ষেত্রের (magnetic field) উপস্থিতিতে পরমাণু থেকে নির্গত আলো কয়েকটা কম্পাঙ্কে (frequency) ভেঙে যায়।

সোডিয়াম পরমাণু থেকে নির্গত আলো (উপরের ছবি) চুম্বকীয় ক্ষেত্রে ভেঙে যায় (নীচের ছবি) (Credit — HyperPhysics)।

কেন সেটা হয় এবং কম্পাঙ্কগুলোর মধ্যে কতটা ফাঁক থাকে, সেটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন উনি তাঁর মডেলে। মডেলটিতে উনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে ইলেক্ট্রনের ভরবেগের (momentum) মান যদি যে কোনো সংখ্যা না হয়ে কিছু বিশেষ বিশেষ সংখ্যা হয় (আসলে পূর্ণসংখ্যার অর্ধেকের গুণিতক বা multiples of half-integers), তাহলে এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। খামোকা কেন ইলেক্ট্রনের ভরবেগ পূর্ণসংখ্যার অর্ধেক হতে যাবে, তার কোনো ভিত্তি না থাকায় এই প্রস্তাবটি সেইসময় ঘোর বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।

কিন্তু গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আলোচনা সভায় দারুণ সুন্দর বক্তব্যে সকলের মন জয় করে নিলেন হাইসেনবার্গ। হাইসেনবার্গের প্রথম সাফল্যের কয়েক দিনের মধ্যেই অধ্যাপক ম্যাক্স বর্ন তাকে প্রস্তাব দিলেন, একসাথে কাজ করার ব্যাপারে। 

সেসময় কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর স্বর্ণযুগ চলছে। একের পর এক গবেষণাপত্র বেরোচ্ছে পরমাণু সংক্রান্ত বিভিন্ন অদ্ভুত সব পরীক্ষার ব্যাখ্যা দিতে। 1923 সালের জুলাই মাসে ম্যাক্স বর্ন একটি পর্যালোচনা নিবন্ধে ঘোষণা করেন, সাধারণ পরমাণু ও অণুর জন্য এখনো অব্দি প্রস্তাবিত সমস্ত কোয়ান্টাম মডেলের ব্যর্থতা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। পদার্থবিদ্যার ধারণাগত গঠনকে গোড়া থেকে ঢেলে সাজাতে হবে। এর কারণ হিসেবে যে গণনাটিকে উনি দেখান, সেটা উনি নিজে হাইসেনবার্গের সাথেই করেছিলেন। সেইসময়ের কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে ওনারা হিলিয়াম পরমাণুর শক্তিস্তরের তফাত কষার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাদের অঙ্কের উত্তর বাস্তবের সাথে মিলছিল না। 1923 সালের মে মাসে জমা দেওয়া এই গণনাটিকে এর আগের সফল বোর-সমারফেল্ড কোয়ান্টাম তত্ত্বের (Bohr-Sommerfeld quantum theory) সমাপ্তির সূচক হিসেবে ধরা হয়।

হাইসেনবার্গের দক্ষতা প্রসঙ্গে বর্ন তাঁর বন্ধু আইনস্টাইনকে জানান, হাইসেনবার্গ বিজ্ঞানী হিসেবে অন্তত বিজ্ঞানী পাউলির মতোই প্রতিভাবান (বিজ্ঞানী পাউলি হাইসেনবার্গ-এরই সমসাময়িক আরেক দক্ষ বিজ্ঞানী ছিলেন — অপবর্জন নীতি, ইলেক্ট্রনের ঘূর্ণন বা স্পিন, নিউট্রিনো ইত্যাদি পাউলির অবদান)। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে হাইসেনবার্গের সাথে আলাপ-আলোচনা করা আরও বেশি মনোরম এবং আনন্দদায়ক। তিনি আরও যোগ করেন হাইসেনবার্গের পিয়ানোবাদন দক্ষতার কথা।

সব মিলিয়ে, বর্ন হাইসেনবার্গ-কে প্রস্তাব দিলেন যে পিএইচডি শেষ হলে ওঁর কাছে ফিরে আসতে। কিন্তু হাইসেনবার্গ-এর পিএইচডি গবেষণা ছিল মিউনিখে। গটিংগেনে তিনি ছিলেন কিছুদিন অতিথি ছাত্র হিসেবে। মিউনিখে অন্য গল্প অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্যে।

পিএইচডি-র নানা শর্ত 

1923 সালের মে মাসে হাইসেনবার্গ জার্মানীর মিউনিখে ফিরে এলেন গটিংগেন থেকে। তাঁর শেষ সেমিস্টার কিন্তু তখনো বাকি। বড় কাজ বাকি পড়ে আছে, ডক্টরাল থিসিস লিখতে হবে তাঁকে। 

কিন্তু পিএইচডি শেষ হওয়ার আগেই হাইসেনবার্গ বিখ্যাত হয়ে গেছেন। মিউনিখে তাঁর গুরু অধ্যাপক আর্নল্ড সমারফেল্ড (Arnold Sommerfeld) একটু চিন্তিত ছিলেন — তাঁর ছাত্রকে পিএইচডি-র শেষ অব্দি পৌঁছে দেওয়ার চিন্তা। 

বিজ্ঞান জগতে সমারফেল্ড নিজেও তখন সুবিদিত নাম। বিজ্ঞানী নীলস বোরের (Niels Bohr) দেওয়া পরমাণুর মডেলকে উন্নত করে সমারফেল্ড ইলেকট্রনের উপবৃত্তাকার কক্ষপথের প্রস্তাবনা করেন। পরমাণুর থেকে নির্গত আলোর বর্ণালিকে (atomic spectra) বোঝাতে যেখানে যেখানে বোরের মডেল অক্ষম হচ্ছিল, সমারফেল্ড-এর সংশোধিত মডেল সেখানে প্রযোজ্য হয়। এছাড়া কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে ধাতুর (metal) উপর প্রয়োগ করে ধাতুর আচরণ নিয়ে একটা ধাঁধার সমাধানও তিনি দিয়েছিলেন।

আর্নল্ড সমারফেল্ড (Credit — Bain Collection)

হাইসেনবার্গের গবেষণা নির্দেশনা করতে গিয়ে সমারফেল্ড ভেবেছিলেন, গবেষণার বিষয়টা প্রচলিত কিছুর উপর হলে নিরাপদ হবে। তাই তিনি হাইসেনবার্গ-কে পরামর্শ দিলেন প্রবাহীগতিবিজ্ঞান (Fluid dynamics) নিয়ে কাজ করতে। ওনার আশা ছিল, বিষয়টি তখন গবেষণার জগতে চলতি বলে হাইসেনবার্গের ডক্টরেট পাওয়াটাও নির্ঝঞ্ঝাট হবে। 

কিন্তু বাধ সাধলো অন্য জায়গায়। তখন অধ্যাপক ভিলি ভিন (Willy Wien বা Wilhelm Wien) পরীক্ষামূলক ল্যাব কোর্সের দায়িত্বে ছিলেন, চার ঘণ্টার ল্যাব কোর্স চালাতেন। ইনিও একজন সুবিখ্যাত বিজ্ঞানী। এঁর নামে কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ সংক্রান্ত দুটি প্রধান সূত্র — ভিনের সরণ সূত্র ও ভিনের বণ্টন সূত্র (Wien’s displacement law and Wien’s distribution law) — তখন সুবিদিত। ভিন মনে করলেন, অধ্যাপক সমারফেল্ড-এর ছাত্র তত্ত্বে যতই মেধাবী হোক, পদার্থবিদ হিসেবে ওকে অবশ্যই পরীক্ষামূলক কাজে দক্ষ হতে হবে।

ভিলি ভিন (Credit — Goethe Universitat)

ভিন জোর করলেন, হাইসেনবার্গকেও তার চার ঘণ্টার কোর্স নিতেই হবে। তার আগে হাইসেনবার্গকে ভালো করে প্রস্তুত হতে হবে। ভিন ছিলেন বেশ কঠোর। আর এইখানে বাধল গেরো। ভিনের ল্যাবরেটরির কোর্সে হাইসেনবার্গ অনেক লড়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ভালো করতে পারছিলেন না। তাঁর পরীক্ষণমূলক কাজে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না অধ্যাপক ভিন। ল্যাবের কাজকর্মে হাইসেনবার্গ-কে বেশ দুর্বল মনে হচ্ছিল তাঁর।

পদার্থবিজ্ঞানের দুটি প্রধান ধারা, তাত্ত্বিক এবং পরীক্ষামূলক, একে অপরের পরিপূরক হলেও ইতিহাসে এই দুই ধারার বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রায়শই সংঘাত দেখা গেছে। ভিন এবং সমারফেল্ড এই দুই ধারার প্রতিনিধি ছিলেন। ভিন ছিলেন একজন পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি হাতে-কলমে পরীক্ষানিরীক্ষার ওপর জোর দিতেন। তাঁর কাছে গবেষণাগারে হাতে-কলমে দক্ষতা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে কড়াও ছিলেন তিনি। তাত্ত্বিকদের তিনি মনে করতেন উন্নাসিক, বাস্তব জগতের যন্ত্রপাতি সম্পর্কে জ্ঞান কম। অন্যদিকে, সমারফেল্ড ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের একজন প্রধান প্রবক্তা। তাঁর ছাত্র, যেমন হাইসেনবার্গ ও পাউলি, তত্ত্বের দিকেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। 

ল্যাব কোর্সে পরীক্ষার চেয়ে তত্ত্বের ওপর বেশি জোর দেওয়া কিন্তু ভিনের একদমই পছন্দ হয়নি। পাউলির ভাগ্যেও স্নাতক পরীক্ষায় প্রথমবারে ঘটে বিপত্তি; কিন্তু দ্বিতীয়বার ল্যাব কোর্স নিয়ে তিনি ভিনকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হন। তিনি মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করেন এবং সর্বোচ্চ গ্রেড নিয়ে স্নাতক হন। কিন্তু সেই গ্রীষ্মে যখন হাইসেনবার্গ ভিনের ল্যাব কোর্সে ভর্তি হলেন, তখন তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। 

ভিন তাঁকে একটি বেশ কঠিন সমস্যা দিলেন। হাইসেনবার্গ-কে ফ্যাব্রি-পেরো ইন্টারফেরোমিটার (Fabry-Perot interferometer) ব্যবহার করে পারদের ব্যতিক্রমী জিম্যান ক্রিয়ার হাইপারফাইন কাঠামো (Hyperfine Structure) পরিমাপ করতে বলা হয়। ফ্যাব্রি-পেরো ইন্টারফেরোমিটার আলোকতরঙ্গের ব্যবর্তন (diffraction) পর্যবেক্ষণের একটি যন্ত্র আর হাইপারফাইন কাঠামো হলো বর্ণালি রেখার সূক্ষ্ম বিভাজন। সেই সময়ে এই পরিমাপটা করা ছিল একটি অত্যন্ত জটিল এবং দুরূহ কাজ।

পিএইচডি থিসিস জমা

ইতিমধ্যে এসে গেল প্রতীক্ষিত ক্ষণ। হাইসেনবার্গ-কে গবেষণাপত্র জমা দিতে হবে। শেষ অব্দি হাইসেনবার্গ তাঁর ডক্টরেটের থিসিস প্রস্তুত করলেন। তিনি 1923 সালের 10ই জুলাই-এ মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলীর কাছে সেটা জমা দিলেন। 

থিসিসের শিরোনাম ছিল “On the Stability and Turbulence of Liquid Currents”। এটি ছিল 59 পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ গাণিতিক বিশ্লেষণ।

গবেষণার প্রশ্নটি এসেছিল সমারফেল্ডের ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা চুক্তি থেকে। আল্পস পর্বতের পাদদেশ থেকে মিউনিখের মধ্য দিয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হতো সবুজ রঙের আইজার  (Isar) নদী। এই নদীর প্রবাহকে একটি নির্দিষ্ট গতিপথে চালিত করতে হবে, এরকম একটা চুক্তি নিয়েছিল আইজার কোম্পানি বলে একটি সংস্থা। সেই সংস্থার অনুরোধে সমারফেল্ডের ইনস্টিটিউটে প্রথম দিকের কিছু পরীক্ষা হয়েছিল। সেখান থেকেই হাইসেনবার্গ-এর গবেষণা প্রশ্নটির সূত্রপাত।

আইজার নদী (Credit — Fritz Geller-Grimm)

প্রশ্নটি ছিল: ঐ নদীর পথে কোন মুহূর্তে তরলের ধারারেখ প্রবাহ (laminar flow) থেকে অশান্ত প্রবাহে (turbulent flow) রূপান্তর ঘটবে, তার গাণিতিক রূপ নির্ধারণ করা। সমারফেল্ডের ছাত্র লুডভিগ হপফ এক দশকেরও বেশি আগে সমস্যাটি পরীক্ষামূলকভাবে খতিয়ে দেখেছিলেন। কিন্তু অশান্ত প্রবাহের নির্দিষ্ট রূপান্তর কখন ঘটবে, তা ভবিষ্যদ্বাণী করার পদ্ধতি তখনো কেউ আবিষ্কার করতে পারেননি। এটি ছিল অত্যন্ত কঠিন গাণিতিক সমস্যা। এতটাই কঠিন যে হাইসেনবার্গ কেবল আনুমানিক সমাধানই (approximate solution) দিতে পেরেছিলেন। 

সমারফেল্ড পরে হাইসেনবার্গ-এর সমাধানের কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, “সে আরও একবার তার অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছে। সে গাণিতিক পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করেছে। তার পদার্থবিদ্যার অন্তর্দৃষ্টি খুবই দুঃসাহসিক। আমি আমার অন্য কোনো শিক্ষার্থীকে গবেষণা প্রশ্ন হিসেবে এত কঠিন বিষয় দিতাম না। তাই আমি এই কাজটিকে ডক্টরেট প্রদান করার উদ্দেশ্যে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছি।” 

তবে সমারফেল্ড-ই পিএইচডি কমিটি-র একমাত্র সদস্য ছিলেন না। বাকিদেরও সম্মতির প্রয়োজন ছিল এই থিসিস-এর কাজ নিয়ে। কিন্তু তাদের তরফ থেকেও কোনো আপত্তি আসেনি। সমসাময়িক কোয়ান্টাম তত্ত্বের চেয়ে সনাতন জলগতিবিদ্যায় (Hydrodynamics) যিনি বেশি স্বচ্ছন্দ, সেই ভিলি ভিন কাজটা নিয়ে কিঞ্চিৎ সন্দেহ প্রকাশ করলেও প্রস্তাবটিকে সমর্থন করলেন। পিএইচডি কমিটি-র বাকি সদস্যরা কোনো দ্বিধা ছাড়াই স্বাক্ষর করলেন এতে। অধ্যাপক ভিনও 1924 সালে এটি তাঁর সম্পাদিত পদার্থবিজ্ঞানের জার্নালে (Annalen der Physik) প্রকাশের জন্য বেছে নিলেন। 

আপত্তি এসেছিল আরো পরে। 1926 সালে গণিতবিদ ফ্রিটজ ন্যোদার এই সমাধান নিয়ে আপত্তি তোলায় এই ফলাফলটি নিয়ে দীর্ঘদিন সন্দেহ থেকে গেছিল এবং প্রায় পঁচিশ বছর পর ফলাফলটি সঠিক বলে নিশ্চিত হয়। 

হাইসেনবার্গ এরপর 1946 সাল পর্যন্ত জলগতিবিদ্যা (Hydrodynamics) নিয়ে আর কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি।

কিন্তু থিসিস-এর কাজটার স্বীকৃতিই যথেষ্ট ছিল না। এরপর পুরো পিএইচডি কমিটি-র সামনে সবশেষ একটা মৌখিক পরীক্ষা বাকি ছিল। সেটায় উত্তীর্ণ হতে পারলে তবেই পিএইচডি দেওয়া হবে।

মৌখিক পরীক্ষায় হেনস্থা 

থিসিসটি গ্রহণের পরে হাইসেনবার্গের মৌখিক পরীক্ষায় বসার অনুমতি মিলল। এই মৌখিক পরীক্ষায় চারটি গ্রেড ছিল: I (summa cum laude বা সর্বোচ্চ সম্মানে), II (magna cum laude বা বিশেষ সম্মানে), III (cum laude বা সম্মানে) এবং IV (পাস)। আর V গ্রেড মানে অকৃতকার্য। 

একটি গ্রেড দেওয়া হতো প্রধান (major) বিষয়ের জন্য, আর দুটি গ্রেড আসত আবশ্যিক দুটি সহায়ক (minor) বিষয়ের জন্য। এছাড়াও সামগ্রিক দক্ষতার ভিত্তিতে একটি চূড়ান্ত গ্রেড দেওয়া হতো, এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

পরীক্ষক কমিটিতে ছিলেন শিক্ষার্থীর দুটি সহায়ক বিষয়ের অধ্যাপকবৃন্দ — হাইসেনবার্গের ক্ষেত্রে গণিতের জন্য পেরন (Perron) এবং জ্যোতির্বিদ্যার জন্য সীলিগার (Seeliger)। প্রধান বিষয়ের অধ্যাপক হিসেবে ছিলেন সমারফেল্ড ও ভিন। বিপত্তির শুরু এখানেই কারণ দু-জনকেই একটি নির্দিষ্ট গ্রেডে একমত হতে হতো।

হাইসেনবার্গের কঠোর মৌখিক পরীক্ষার (examen rigorosum) তারিখ ঠিক হলো। এটি ছিল 1923 সালের 23শে জুলাই, সোমবার বিকেল 5টায়। পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয় তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সেমিনার কক্ষে। 

শুরুতে হাইসেনবার্গকে বেশ আত্মবিশ্বাসী লাগছিল। কিন্তু দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টে গেল। হাইসেনবার্গ সহজেই পেরনের গণিত ও সমারফেল্ডের তত্ত্বের উত্তর দিলেন। তবে সিলিগারের জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রশ্নে তিনি হোঁচট খেলেন। পরীক্ষার সবচেয়ে কঠিন অংশ ছিল প্রায়োগিক পদার্থবিজ্ঞানের অংশটা। ভিনের প্রশ্নের মুখে মুখ থুবড়ে পড়লেন হাইসেনবার্গ।

ফ্যাব্রি-পেরো ইন্টারফেরোমিটারের বিভেদন ক্ষমতা (resolving power) কীভাবে বার করে, সেটা তিনি বলতে পারলেন না। এমনকি ভিন যাঁর উপর ক্লাসে প্রচুর আলোচনা করেছিলেন সেই টেলিস্কোপের বিভেদন ক্ষমতা বার করার পদ্ধতিটাও বলতে পারলেন না। ভেতরে ভেতরে ভিন ক্রমশ বিরক্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিলেন। হঠাৎ রেগে জিজ্ঞেস করলেন, স্টোরেজ ব্যাটারি কীভাবে কাজ করে? কিন্তু হাইসেনবার্গ এবারেও চুপ। 

ভিন গেলেন ভয়ানক রেগে। ভিনের রাগ ছিল কিন্তু বেশ কিছু আগে থেকেই। তখন মুদ্রাস্ফীতির প্রবল দাপটে ভিনের গবেষণাগারে যন্ত্রপাতি কেনা বা সারানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু হাইসেনবার্গ জানতেন না, অথবা জানার প্রয়োজনও মনে করেননি যে, তিনি ইনস্টিটিউটের কর্মশালা ব্যবহার করে পরীক্ষার জন্য কাজের সরঞ্জাম তৈরি করতে পারতেন। পদার্থবিদ্যার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সফল হয়ে আসা এই অত্যধিক আত্মবিশ্বাসী তাত্ত্বিক গবেষণাগারের কাজকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। জিম্যান ক্রিয়া নিয়ে নিজের কাজের সঙ্গে এই যন্ত্রপাতির কাজকর্মের স্পষ্ট সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তিনি সেদিকে মনোযোগ দেননি। নিজের পরীক্ষার জন্য নিছকই সিগার বক্স এবং সিলিং ওয়াক্স দিয়ে কোনোমতে একটি দুর্বল যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। এমন অবহেলা আগে থেকেই ক্ষিপ্ত অধ্যাপককে রাগিয়ে তুলেছিল। তাই তিনি মৌখিক পরীক্ষার সময় ‘অপরাধী’কে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। 

পিএইচডি কমিটি-র মধ্যে এবার অন্তর্দ্বন্দ দেখা দিল। সমারফেল্ড এবং ভিনের মধ্যে তত্ত্ব ও পরীক্ষার গুরুত্ব নিয়ে তর্ক শুরু হলো। সমারফেল্ড সহ অন্যদের পাল্টা যুক্তি ছিল, হাইসেনবার্গ কিন্তু তত্ত্বে অসাধারণ। পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে ওর দুর্বলতাগুলো তাই ক্ষমা করে দেওয়া যায়। কিন্তু ভিন-এর বক্তব্য ছিল, এই ছাত্র অন্য ক্ষেত্রে যতই উজ্জ্বল হোক, একে পাশ করানোর কোনো কারণ নেই।

এর ফলস্বরূপ, হাইসেনবার্গকে পদার্থবিজ্ঞানে ‘III’ গ্রেড (সমারফেল্ডের ‘I’ এবং ভিন-এর ‘V’ এর গড়) পেতে হলো। সৌভাগ্যবশত, তিনি তাঁর অন্য দুটি বিষয়ে ভালো ফল করেছিলেন — গণিতে ‘I’ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে ‘II’ পেয়েছিলেন। তবে তাঁকে তাঁর ডক্টরেটের জন্য সামগ্রিকভাবে ‘III’ গ্রেড নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। এটা ছিল সর্বনিম্ন পাশের গ্রেডের চেয়ে একটু উপরে। কিন্তু শেষমেশ পিএইচডি জুটলো হাইসেনবার্গের।

মৌখিক পরীক্ষায় হাইসেনবার্গের এই ব্যর্থতায় সমারফেল্ড হতচকিত, অবাক। হাইসেনবার্গ ছিলেন ততোধিক লজ্জিত। হাইসেনবার্গের মতো ক্লাসের শীর্ষস্থানে থাকা এমন একজন ছাত্রের মনের অবস্থা অনুমান করা কঠিন নয়।

অনুমান করারও প্রয়োজন নেই। সেই সন্ধ্যায় সমারফেল্ড তাঁর বাড়িতে সদ্য পিএইচডি পাওয়া হাইসেনবার্গের জন্য একটি ছোট পার্টির আয়োজন করেন। লজ্জায় হাইসেনবার্গ সেখানে আর হাজির হতে পারেননি। তাঁর ব্যাগ গুছিয়ে আগেই স্টেশনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন এবং মধ্যরাতে গটিংগেনের ট্রেন ধরেন।

পরেরদিন সকালে তিনি সটান উপস্থিত হন ম্যাক্স বর্নের অফিসে। বর্ন ইতিমধ্যেই তাকে আগাম বছরের জন্য শিক্ষণ সহকারী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। হাইসেনবার্গ লজ্জিতভাবে বর্নকে জানান মৌখিক পরীক্ষায় তাঁর দুর্ভাগ্যজনক ফলের কথা। তারপর তিনি ধীরস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার কাছে এখনও কি আমার প্রয়োজন আছে?”

হাইসেনবার্গের উত্তর দিতে না পারা প্রশ্নগুলো একবার দেখে না নেওয়া পর্যন্ত বর্ন কোনো জবাব দেননি। যাচাই করে বর্ন মনে করলেন প্রশ্নগুলো কিছুটা জটিল। সেই কারণে তিনি হাইসেনবার্গের চাকরির প্রস্তাব বহাল রাখলেন।

এখানেই শেষ নয়

হাইসেনবার্গের চিন্তিত পিতা গটিংগেনের পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যার বিখ্যাত বিজ্ঞানী জেমস ফ্র্যাঙ্ককে একটি চিঠি লিখলেন। তিনি ফ্র্যাঙ্ককে অনুরোধ করলেন তাঁর ছেলেকে কিছু পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যা শেখাতে। 

জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী জেমস ফ্রাঙ্ক প্রধানত ফ্রাঙ্ক-হার্টজ পরীক্ষা (Franck-Hertz Experiment)-এর জন্য বিখ্যাত। 1914 সালে সম্পাদিত এই যুগান্তকারী পরীক্ষাটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বিকাশে একটি মৌলিক ভূমিকা রেখেছিল। এই পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে পরমাণুর ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসের চারপাশে যেকোনো শক্তি স্তরে থাকতে পারে না, বরং তারা কেবল কিছু নির্দিষ্ট ও বিচ্ছিন্ন শক্তি স্তরে অবস্থান করে (এটাই নিলস বোরের তত্ত্ব ছিল)। 

এক্ষেত্রে ফ্র্যাঙ্ক তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাইসেনবার্গের সম্পূর্ণ আগ্রহহীনতা কাটাতে পারলেন না এবং শেষমেশ চেষ্টা ছাড়লেন। যদি হাইসেনবার্গ-কে পদার্থবিজ্ঞানে টিকে থাকতে হয়, তা সম্ভব শুধুমাত্র তাত্ত্বিক হিসেবে। বাকিটা ইতিহাস। এরপর হাইসেনবার্গ ম্যাক্স বর্ন-এর সাথে মিলে ম্যাট্রিক্স মেকানিক্স-এর (matrix mechanics) পত্তন করেছিলেন। তারপর 1927 সালে 23শে ফেব্রুয়ারী বিজ্ঞানী পাউলিকে 14 পৃষ্ঠার একটা চিঠিতে সেই অনিশ্চয়তা নীতির কথা লেখেন যার জন্য তাঁর নাম আমরা আজও জানি।

এই কাহিনীর একটা মজার লেজুড় আছে। যখন হাইসেনবার্গ অনিশ্চয়তা নীতি (uncertainty principle) প্রতিষ্ঠা করেন, তখনও তিনি একটি সমস্যার সম্মুখীন হন। নীতিটি প্রমাণ করতে তিনি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের (microscope) বিভেদন ক্ষমতা (resolving power) ব্যবহার করেছিলেন একটি কাল্পনিক পরীক্ষার ধাঁচে। তিনি এই কাল্পনিক পরীক্ষার কথা ফেব্রুয়ারী মাসের পাউলিকে লেখা চিঠিতে এবং মার্চ মাসে গবেষণাপত্র আকারে লেখেন। কিন্তু এই কাল্পনিক পরীক্ষায় কিছু ত্রুটি খুঁজে পান বিজ্ঞানী নীলস বোর। তিনি এই ব্যাপারটাতে আপত্তি তোলেন যে কাল্পনিক পরীক্ষায় ধরে নেওয়া হয়েছে ইলেক্ট্রনের আগে থেকে একটা অবস্থান এবং ভরবেগ ছিল, এবং আলো পড়লে তার পরিবর্তন হচ্ছে। এরকম ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। বোর-এর এই ভুল ধরিয়ে দেওয়াতে আবার সেটা হাইসেনবার্গের জন্য মানসিক কষ্টের কারণ হয়েছিল। কিন্তু ভুল ধরানো সত্ত্বেও বোর অনিশ্চয়তা নীতিটি সঠিক বলে মেনে নেন।

এই ঘটনা থেকে একটি ইতিবাচক ফলও এসেছিল। হাইসেনবার্গের প্রতিক্রিয়া বিজ্ঞানী বোরকে তাঁর নিজস্ব ধারণা তৈরি করতে উৎসাহিত করল। তিনি বললেন, একটা ইলেক্ট্রন-কে ব্যাখ্যা করতে গেলে সেটাকে কণা এবং তরঙ্গ দুটো হিসেবেই ধরতে হবে। যতক্ষণ না কেউ একটা পরীক্ষা করছে সেই ইলেক্ট্রন-এর উপর, তার দুটো ধর্মই রয়েছে। কোন ধর্মটা কাজে লাগবে পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাখ্যা দিতে সেটা নির্ভর করছে কী পরীক্ষা করা হচ্ছে, তার উপর। অন্যভাবে বললে, যতক্ষণ না একটা ইলেক্ট্রনকে দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটা একটা তরঙ্গের মতো একসাথে অনেক অবস্থায় থাকতে পারে। যেই সেটার উপর আলো ফেলে দেখার চেষ্টা করা হবে, অমনি সেটা টুপ করে কোনো একটা অবস্থাতে ধরা দেবে। এই ব্যাখাটিকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা (Copenhagen interpretation of quantum mechanics) হিসেবে আজও পড়ানো হয়। হাইসেনবার্গ-এর অনিশ্চয়তা নীতিটাই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এই সুপরিচিত কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার ভিত্তি হয়ে ওঠে। 

সেই বছর শরৎকালে (1927) ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত সলভে সম্মেলনে (Solvay conference) হাইসেনবার্গ এবং ম্যাক্স বর্ন ঘোষণা করেন যে কোয়ান্টাম বিপ্লব সম্পূর্ণ হয়েছে। ভাগ্যিস হাইসেনবার্গ তাঁর পিএইচডি পরীক্ষার ব্যর্থতায় দমে যাননি! নইলে আজকের চেনা কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমরা পেতাম কী করে? আবার তাঁর জীবনের এই ঘটনা আমাদের সকলকে মনে করায়, বিজ্ঞানশিক্ষার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরীক্ষাশ্রয়ী পদার্থবিজ্ঞানকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হতো! কিন্তু হালে দেখা যায়, বিজ্ঞানশিক্ষায় পরীক্ষানিরীক্ষার চর্চা তথা শিক্ষার্থীর মূল্যায়নে এর গুরুত্ব কমছে।

প্রচ্ছদের ছবি: Physicsworld 

তথ্যসূত্র:

[1] D. C. Cassidy, Uncertainty: the life and science of Werner Heisenberg, New York: W.H. Freeman, 1992.

[2] The Sad Story of Heisenberg’s Doctoral Oral Exam, APS Archives[3] February 1927: Heisenberg’s Uncertainty Principle, APS Archives

লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।

Scan the above code to read the post online.

Link: https://bigyan.org.in/heisenberg-viva-incident

print

 

© and ® by বিজ্ঞান - Bigyan, 2013-25