21-11-2024 08:38:09 am
Link: https://bigyan.org.in/gravitational-wave-detection-ligo_3
গত সপ্তাহে আমরা আলোচনা করেছিলাম কীভাবে আলোক তরঙ্গের এক বিশেষ ধর্ম – যার নাম ইন্টারফেরেন্স – তাকে কাজে লাগিয়ে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরার বিশাল দুটো যন্ত্র বানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেই যন্ত্রদুটোর নাম লাইগো (LIGO) – একটা রয়েছে আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্বে লুইসিয়ানা রাজ্যের লিভিংস্টনে, আরেকটা সে দেশেরই উত্তর পশ্চিমে ওয়াশিংটন রাজ্যের হানফোর্ডে। বিজ্ঞানীদের আশা যে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এই দুই যন্ত্রের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় এদের মধ্যে কম্পনের সৃষ্টি করবে। এই কম্পনের ফলে যন্ত্রদুটির মধ্যে একটা ফোটোডিটেক্টরে সামান্য ভোল্টেজ উৎপন্ন হবে।। কিন্তু মুশকিল হল এটি অত্যন্ত হাল্কা কম্পন, যা আমাদের কল্পনারও অতীত! মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ফলে যন্ত্রের চার কিলোমিটার লম্বা হাতের দৈর্ঘ্য পালটাবে মাত্র একটা প্রোটন যত বড় তার এক শতাংশের মত! সেই কম্পন শনাক্ত করার লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা এই লাইগোর উপর কাজ করে চলেছেন বহু বছর ধরে।
২০১৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর। লিভিংস্টনে স্থানীয় সময় তখন ভোর পাঁচটা একান্ন। হানফোর্ডের স্থানীয় সময় লিভিংস্টনের থেকে তিন ঘন্টা পিছিয়ে, সেখানে তখন রাত দুটো একান্ন। দুটো লাইগো-ই মুখিয়ে আছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ‘শব্দ’ শোনার জন্য। কখন যে সে তরঙ্গ আসবে তা তো কেউ জানে না, তাই সবসময় সতর্ক হয়ে থাকতে হয়। ফোটোডিটেক্টর, যেখানে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরা পড়বে ভোল্টেজ হয়ে, এতক্ষণ নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে।
হঠাৎ যন্ত্র জেগে উঠল ক্ষণিকের জন্য!
একটা সিগন্যাল ধরা পড়েছে। এবারে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী – সত্যিই কি প্রথমবার দেখা গেল এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ? সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, যার উৎপত্তি মহাবিশ্বের সুদূর এক কোণে, হয়ত বা কয়েক কোটি বছর আগে।
খাতায়-কলমে সোজা লাগছে বটে কিন্তু বাস্তবে অনেক ঝামেলা আছে। এমন নয় যে ফোটোডিটেক্টরের ভোল্টেজ কাঁপতে শুরু করলো মানেই একটা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এসে আঘাত করেছে। আমাদের পৃথিবীর বুকে হামেশাই ছোটখাটো ভূকম্পন হয়ে চলেছে এবং সেগুলো এতই দুর্বল যে আমরা টেরও পাই না। কিন্তু লাইগো তো চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে একটা প্রোটনের ব্যাসের ভগ্নাংশ সমান পরিবর্তন হলেও ধরতে পারে; তাই তাকে এড়িয়ে যাবে কোথায়! এতই তার ক্ষমতা যে শ’য়ে শ’য়ে কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়লেও সেটা ধরা পড়ে যায়। চারিদিকে এতরকম কম্পনের মাঝে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ খুঁজে পাওয়া এক দুরূহ ব্যাপার।
অনবরত ভূকম্পন যাতে গবেষণায় অসুবিধার সৃষ্টি না করে, তাই লাইগো ইন্টারফেরোমিটার-টাকে চারপাশের ভূকম্পন থেকে বিচ্ছিন্ন করার সবরকম পথ অবলম্বন করা হয়েছে। লাইগোর ইন্টারফেরোমিটারের যে দুটো চোঙ্গা-মার্কা হাত, যার শেষে আছে দুটো আয়না, সেগুলোতে একদম আলট্রা-ভ্যাকুয়াম রাখা হয়েছে যা কিনা সাধারণ বায়ুমণ্ডলীয় চাপের এক ট্রিলিয়ন (এক লক্ষ কোটি) ভাগের এক ভাগ, এতে প্রায় বাতাস নেই বললেই চলে। এর ফলে লাভটা হলো, বাতাসের মাধ্যমে যে কম্পনগুলো আসতো, তাদের আটকে দেওয়া হলো। শুধু তাই না, বাতাসের মধ্যে লেসার রশ্মি গেলে সেটা গরম হয়ে যাবে, গরম বাতাসের ছুটন্ত অণু-ও সিগনালটা নষ্ট করে দিতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, আমরা এখানে খুব ক্ষীণ একটা সিগনালের কথা বলছি, যাকে ঘেঁটে দেওয়ার জন্য খুব বেশি কিছু লাগেনা।
লেসারের কথাই যখন উঠলো, সিগনাল ঘেঁটে দেওয়ার ব্যাপারে সে একাই যথেষ্ট। ওই যে রশ্মিটা গিয়ে আয়নাতে ধাক্কা খায়, তার চাপেই আয়না কিছুটা নড়ে যায়। এই ধাক্কাটা কিছুটা সামলানো যায় আয়নাটাকে ভারী বানিয়ে কিম্বা লেসার-এর পাওয়ার বা ক্ষমতা কমিয়ে। কিন্তু এতেই শেষ নয়, কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল নয়েজ বলে একটা ব্যাপার আছে, তার কথাও মাথায় রাখতে হয়। লেসারের আলোটা তো আসলে একগুচ্ছ কণা মিলিয়ে তৈরী [১]। লেসারের শক্তি নির্দিষ্ট করে বেঁধে দিলেও, কতগুলো আলোককণা এসে প্রতিমুহূর্তে ফোটোডিটেক্টরে এসে পড়ছে, সেই সংখ্যাটা একদম স্থির নয়, কখনো একটু বেশি, কখনো একটু কম [২]। এটাই Noise হিসাবে দেখা দেয়, যার ফলে ইন্টারফেরেন্সের আলো আর আঁধারের মধ্যে তফাতটা (interference contrast) আরো কমে যায়। আর এই আলো আঁধারের তফাত করতে পারার উপরেই গোটা পরীক্ষাটা দাঁড়িয়ে আছে!
এই যে এতরকম সমস্যা, সব কটারই কিছু না কিছু সমাধান বার করা হয়েছে। কয়েকটার কথা বললাম, সবের কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। এবার আসল কথায় আসি , এতরকম গোলমালের মাঝে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ চেনা যায় কি করে।
দুটো কৃষ্ণগহ্বর কাছাকাছি এসে একে অপরের চারিধারে ঘুরতে থাকলে যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জন্ম হয়, তার আলাদা একটা বিশেষত্ব আছে। সময়ের সাথে সাথে তার প্রশস্ততা (amplitude) আর কম্পাঙ্ক (frequency) দুটোই বাড়তে থাকে। এর কারণটা বোঝা সহজ। কৃষ্ণগহ্বর দুটো যখন কাছাকাছি আসছে, তাদের কক্ষের ব্যাস কমতে থাকছে ফলে অনেক তাড়াতাড়ি এক একটা পাক সম্পূর্ণ করে ফেলতে পারছে তারা। এর ফলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কম্পাঙ্কও যাচ্ছে বেড়ে। সাথে সাথে তাদের গতিবেগও বাড়তে থাকে, যার ফলে তরঙ্গের প্রশস্ততার বৃদ্ধি হচ্ছে।
এই ধরণের সিগন্যালকে বলা হয় গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ চার্প (gravitational-wave chirp)। আগেই বললাম, এই তরঙ্গ আমাদের ইন্টারফেরোমিটারে এসে পড়লে তার একটা হাত আরেকটার তুলনায় লম্বা হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতি ইন্টারফেয়ারেন্স নকশার জায়গা বদল, আর ফোটোডিটেক্টরের মধ্যে ভোল্টেজ সৃষ্টি। ঠিক আগের অংশে আমরা দেখলাম, ফোটোডিটেক্টরের মধ্যে আরো হাজার একটা কারণে ভোল্টেজ সৃষ্টি হতে পারে। তাহলে আমরা বুঝবো কি করে যে, কোনটা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে?
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের চিহ্ন যেভাবে শনাক্ত করা হয়, সেটা বেশ চমকপ্রদ। ধরুন, আপনি একটা পার্টিতে গেছেন। চারিদিকে প্রচুর হইহট্টগোল, চেঁচামেচি, মাইকে জোরে গান চলছে। তার মধ্যেই আপনি দিব্যি এক বন্ধুর সাথে আড্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন। বন্ধু বেশ মৃদুভাষী, তবু আপনার শুনতে অসুবিধে হচ্ছে না। এটা ঠিক কেন? কারণ আপনার মস্তিষ্ক তার গলার স্বরের সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত, তাই খুব সহজে সেই স্বরের চড়াই-উতরাই চিনে নিতে পারে। এই চেনা স্মৃতি ব্যবহার করে আপনার মস্তিষ্ক আর সকল শব্দের মধ্যে আপনার বন্ধুর স্বরকে অনায়াসে বেছে নিতে পারে।
একই জিনিষ একটা কম্পিউটারও পারে। তাকে শুধু বলে দিতে হবে কি ধরণের সিগন্যাল সে আশা করছে। এই পদ্ধতিটাকে বলে ম্যাচড ফিল্টারিং (matched-filtering)। কিন্তু জানবো কিভাবে কি ধরণের সিগন্যাল খুজছি? এখানেই আইনস্টাইনের সাধারণ অপেক্ষবাদ কাজে লাগে। দুটো কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতিতে আইনস্টাইনের সমীকরণগুলোর সমাধান করা হয়, তারপর তার থেকে সিগন্যাল-এর ছাঁচ তৈরী করা হয়। ইন্টারফেরোমিটারে যত সিগন্যাল আসে, এই ছাঁচের সাহায্যে দেখা হয় সেটা প্রত্যাশিত মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সিগন্যালের মত দেখতে কিনা।
কিন্তু, আর বাকিসব কারণে যে সিগন্যাল সৃষ্টি হচ্ছে, তারা কি কেউই এই ছাঁচের সাথে মিলতে পারে না? অর্থাৎ, যন্ত্রটাকে কি টুপি পরানো সম্ভব নয়? যাতে ‘টুপি পরার’ সম্ভাবনা নামমাত্র হয়ে যায়, সেই জন্য একইরকম দুটো ইন্টারফেরোমিটার বানানো হয়েছে (একটা ওয়াশিংটন রাজ্যে আর একটা লুইসিয়ানা রাজ্যে) এবং কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে বসানো হয়েছে। দু’জায়গাতেই একই ছাঁচের সিগন্যাল একই সময়ে পেলে, তবেই তাকে ধরা হয়, আরো চুলচেরা বিশ্লেষণের জন্য।
১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫। দুটো ইন্টারফেরোমিটার — একটা হ্যানফোর্ড, ওয়াশিংটন-এ আর একটা লিভিংস্টন, লুইসিয়ানা-তে — দুজনেই একটা সিগন্যাল পেলো, যাতে স্পষ্ট মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ছাপ রয়েছে। সিগনাল দুটোর প্রাপ্তির সময়ের মধ্যে ৭ মিলিসেকেণ্ডের (অর্থাৎ এক সেকেণ্ডের এক হাজার ভাগের সাত ভাগ) তফাৎ। সিগনাল ৩৫ হার্টজ (Hz) থেকে শুরু হলো আর সিকি সেকেণ্ডের মধ্যে তার কম্পাঙ্ক বেড়ে ১৫০ হার্টজে গিয়ে ঠেকলো। এই কম্পাঙ্ক বৃদ্ধির রকমসকম থেকে অনুমান করা যায়, ১৩০ কোটি (১.৩ বিলিয়ন) বছর আগে দুটো অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ থেকে এই তরঙ্গ জন্মেছে। সংঘর্ষের আগে দুজনেই আলোর গতিবেগের অর্ধেক গতিবেগে ছুটছিলো।
আরো অঙ্ক কষে পাওয়া গেল, কৃষ্ণগহ্বর দুটোর ভর আমাদের সূর্যের ভরের ২৯ আর ৩৬ গুন বেশি। ওই যে সিকি সেকেণ্ডের জন্য তরঙ্গ ধরলাম আমরা, ওই সিকি সেকেণ্ডে তিনটে সূর্যের সমান ভর ধ্বংস হয়ে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শক্তিতে পরিণত হয়েছে (আইনস্টাইন-এর আরেকটি সূত্র E=mc2 মেনে)। এটা যে কতটা শক্তি, সেটা এইভাবে বোঝা যায়: এই শক্তিটাই যদি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ না হয়ে আলো হিসেবে বেরোতো, এর ঔজ্জ্বল্য মোটামুটি গোটা দৃষ্টিগোচর মহাবিশ্বের যাবতীয় তারা আর ছায়াপথের সম্মিলিত ঔজ্জ্বল্যকে ছাপিয়ে যেত, প্রায় ৫০ গুন বেশি। পৃথিবী থেকে প্রায় ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে সংঘর্ষটা ঘটেছে, অথচ আমরা সেটা পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল দেখতে পেতাম।
দুই কৃষ্ণগহ্বর মিলে একটা নতুন কৃষ্ণগহ্বর তৈরী হলো, যেটার ভর ৬২-টা সূর্যের ভরের সমান। যতটা বেগে একটা কৃষ্ণগহ্বরের পক্ষে ঘুরপাক খাওয়া সম্ভব (অঙ্ক কষে একটা সীমা পাওয়া যায়), তার সত্তর শতাংশ বেগে ঘুরছে। শুধু মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম সনাক্তকরণ বলেই নয়, আরো অনেকগুলো কারণে ১৪ই সেপ্টেম্বরের ঘটনাটি ঐতিহাসিক। কয়েকটা বলি:
১. প্রথম একটা কৃষ্ণগহ্বরের সরাসরি পরিচয় পাওয়া গেল, যেখানে চারিদিকের স্থানকালের উপর কৃষ্ণগহ্বরের প্রভাব স্পষ্ট।
২. আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের মাধ্যমে যে ধরনের কৃষ্ণগহ্বরের কথা জানা যায়, বাস্তবেও ঠিক সেই রকমই দেখা গেল। যেহেতু একটা খুব শক্তিশালী মহাকর্ষ ক্ষেত্র এখানে জড়িত, বলা যেতে পারে সাধারণ অপেক্ষবাদের যথার্থতার আরো একটা প্রমাণ পাওয়া গেলো।
৩. দুটো কৃষ্ণগহ্বর যে যুগলবন্দী করে থাকতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল। দুটো নক্ষত্রের যুগলবন্দী (binary star system) ভয়ানক সুপারনোভা বিস্ফোরণে খতম হয়ে গেলে যে দুটো কৃষ্ণগহ্বর জন্মায়, তারা তখনও যুগলবন্দীটা বজায় রাখতে পারে কিনা, সেটা জানা ছিল না।
৪. ঘূর্ণিরত কৃষ্ণগহ্বর দুটো যে এই মহাবিশ্বের জীবতকালে জোড়া লাগতে পারে, তারও প্রমাণ মিললো। যে দুটো নক্ষত্র থেকে এদের জন্ম, সেদুটো খুব কাছে থাকলে, একটা নক্ষত্র যখন রেড জায়ান্ট (red giant) অবস্থা দিয়ে সুপারনোভা বিস্ফোরণের দিকে এগোচ্ছে, সে অন্যটাকে গিলে ফেলতে পারে। তাতে কৃষ্ণগহ্বর হওয়ার আগেই নক্ষত্রদের যুগলবন্দীর সলিলসমাধি হয়ে যাবে। আবার অন্যদিকে, নক্ষত্রদুটো খুব দূরে থাকলে, তাদের কৃষ্ণগহ্বরদুটোও এত দূরে থাকবে যে কখনই তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হবে না। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের যুগলবন্দীও আছে আর তাদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়, এই দুইয়েরই প্রমাণ পাওয়া গেল।
মহাকর্ষ তরঙ্গের সনাক্তকরণের ফলে জ্যোতির্বিদ্যায় একটা নতুন দুয়ার খুলে গেছে। ডেভিড রাইটজে, লাইগো-র কার্যনির্বাহী পরিচালক বলেছেন, এই ঘটনাটি গ্যালিলিও-র টেলিস্কোপ মারফত প্রথম মহাবিশ্ব দেখার মতই গুরুত্বপূর্ণ। এখনো অব্দি মহাবিশ্ব নিয়ে পরীক্ষামূলক গবেষণা মানেই ছিল কোনো এক ধরণের টেলিস্কোপে-ধরা আলো নিয়ে কারবার, তা সে দৃশ্যমান আলোই হোক, কি ইনফ্রারেড, এক্স-রে, বেতার তরঙ্গ বা গামা তরঙ্গ [৩]। এবার আমরা মহাবিশ্বের সেই সব কোণাতেও উঁকি দিতে পারবো যেখান থেকে আলো আসে না।
এই বছরের দ্বিতীয়ার্ধে আরো একটা ইন্টারফেরোমিটার কাজ শুরু করবে, নাম তার ভারগো (Virgo)। এটা চালু হলে একটা বড়সড় সমস্যার সমাধান হবে। মহাকর্ষ তরঙ্গের উৎসটা ঠিক কোথায় অবস্থিত, সেটা নির্ণয় করতে অন্তত তিনটে সনাক্তকারী যন্ত্রের প্রয়োজন। এই তৃতীয়টা মাঠে নামলে আমরা মোটামুটি টেলিস্কোপ যা পারে, মহাকর্ষ তরঙ্গের সাহায্যেও তাই পারবো। আরো পরে, ২০১৮ নাগাদ, জাপানে কাগরা (Kagra) নামে একটা ইন্টারফেরোমিটার চালু হবে। বাড়বে বিশ্বব্যাপী ব্যবহার। ভারতও কাজ শুরু করে দিয়েছে, লাইগো-ইন্ডিয়া আসছে ২০২৩ নাগাদ। ভারতের যন্ত্রটা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে, কারণ তার আগের যন্ত্রগুলো সব কাছাকাছি অক্ষাংশে (latitude)। আকাশের কোন কোণায় তরঙ্গের উৎস রয়েছে, সেটা ঠাওরাতে অন্য কোনো অক্ষাংশে একটা সনাক্তকারী যন্ত্র থাকা জরুরি, তাতে আরো সুক্ষ্মভাবে সেই উৎসের অবস্থান নির্ণয় করা যায়।
তারও পরে, ২০৩৪ নাগাদ, ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সী মহাকাশে একটা যন্ত্র বসাতে চায়, নাম eLISA (ইভলভড লেসার ইন্টারফেরোমিটার স্পেস এন্টেনা)। তিনটে কৃত্রিম উপগ্রহ, তারা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে। তবে তাদের পারস্পরিক দূরত্মটা এক রাখা হবে লেসার-রেঞ্জিঙ্গের মাধ্যমে, যাতে তারা একটা সমবাহু ত্রিভুজ তৈরী করে। ধরা হচ্ছে, eLISA দাঁড়িয়ে গেলে মোটামুটি বেশিরভাগ ছায়াপথের ভিতেরই উঁকিঝুঁকি মারা সম্ভব হবে, তাদের কেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বর থেকে আসা তরঙ্গের মাধ্যমে।
হয়ত সৃষ্টির শুরু অর্থাৎ বিগ ব্যাং-এর সময়কারও চিহ্ন পাওয়া যাবে। এই মুহুর্তে বিগ ব্যাং সম্বন্ধে আমাদের যাবতীয় ধারণা আসে মহাবিশ্বের প্রথম আলো, কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (বা সংক্ষেপে CMBR)-এর থেকে [৪]। তবে সেই আলো নির্গত হয়েছিল বিগ ব্যাং-এর ৪০০,০০০ বছর পরে। বিগ ব্যাং-এর ফলে জাত মহাকর্ষ তরঙ্গ মাত্র ১০-৩৫ সেকেন্ড পরের খবর এনে দিতে পারবে। হয়তো আমরা আরো ভালোভাবে জানতে পারবো কিভাবে সবকিছু শুরু হয়েছিল।
প্রচ্ছদের ছবি: কম্পিউটার সিমুলেসানে কৃষ্ণগহ্বর-এর সংঘর্ষের আগের চিত্র। (উৎস)
উৎসাহী পাঠকদের জন্য:
[১] আলোর কণাধর্মী আচরণ সম্বন্ধে জানতে বিজ্ঞান-এ প্রকাশিত এই লেখাটি পড়ো।
[২] আলোককণার সংখ্যাটার তারতম্য পোয়াসোঁ বিন্যাস (Poisson distribution)-এর সাহায্যে বোঝা যায়।
[৩] কিভাবে আলোর সাহায্যে জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণা করা হয়, সেই নিয়ে জানতে বিজ্ঞান-এ প্রকাশিত এই আলোচনাটি দেখো।
[৪] মহাবিশ্বের প্রথম আলো সম্বন্ধে আরো জানতে বিজ্ঞান-এ প্রকাশিত এই মজার লেখাটি পড়ো।
[৫] লাইগো-র মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্তকরণ নিয়ে আরো জানতে এখানে দেখো: https://www.pbs.org/wgbh/nova/next/physics/advanced-ligo/।
[৬] লাইগো নিয়ে যাবতীয় তথ্যের জন্য লাইগো-র ওয়েবসাইটে দেখো।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/gravitational-wave-detection-ligo_3