09-03-2025 14:39:08 pm
Link: https://bigyan.org.in/grandmother-hypothesis
দিদিমা-ঠাকুমার আদর পেতে কার না ভালো লাগে? বাবা-মায়ের শাসনের হাত থেকে নিরাপদ আশ্রয় ঠাকুমার কোল, দুপুরবেলার গল্প শোনা, লুকিয়ে আচার খাওয়া দিদিমার বিছানা, আমাদের অনেকের শৈশবের স্মৃতি জুড়ে রয়েছে এরকম নানান গভীর ভালোবাসার স্পর্শ। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে দিদিমাকুলের কী ভূমিকা? আমাদের, মানে মানুষদের কেন দিদিমা-ঠাকুমা আছে, বানর বা গোরিলাদের তো নেই? প্রশ্নটা আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু সত্যিই রহস্যময় মানব সমাজের “বৃদ্ধা” গোষ্ঠী। কেন?
এর জন্য বুঝতে হবে বিবর্তনের মূল তত্ত্ব, যার গোড়াপত্তন করেন স্যার চার্লস ডারউইন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে HMS Beagle জাহাজে যাত্রা করেন তিনি এবং তার শেষের দিকে, 1835-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে গালাপাগস দ্বীপপুঞ্জে কাটান পাঁচ সপ্তাহ। এটাই ছিল ডারউইনের জীবনের অন্যতম বিশেষ সময়, এবং এই সময়ের অভিজ্ঞতাই তাঁর Theory of Natural Selection (প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব), এবং বিবর্তন নিয়ে তাঁর সামগ্রিক চিন্তাভাবনার জন্ম দেয়।
ডারউইনের এই প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের কথা অনেকেরই জানা। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, জীবজগতের প্রতিটি পশু – পাখি – উদ্ভিদ – জীবাণুর একমাত্র লক্ষ্য হল প্রজনন, অর্থাৎ নিজের বংশবৃদ্ধি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলে বেঁচে থাকা, এবং পরবর্তী প্রজন্মের মাধ্যমে কিছুটা যেন অমর রয়ে যাওয়া। প্রকৃতির রসদ অফুরান নয়, সুতরাং বেঁচে থাকার লড়াই যথেষ্ট কঠিন, আর এই লড়াইয়ের মূল অংশ হল রসদের জন্য প্রতিযোগিতা — এই প্রতিযোগিতায় জিত তাদের, যারা বেশি উত্তরাধিকারী রেখে যাবে পৃথিবীতে। ডারউইন গ্রেগর মেন্ডেলের কাজের কথা জানলে হয়তো লিখতেন “যে তার জিন যত বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে দিতে পারবে, বিবর্তনের হিসেবে সে তত বেশি সফল হবে”।
জীব জগতের বৈচিত্র সম্পর্কে যত জানা যায়, ততই অবাক হতে হয় আমাদের। ধরা যাক আমাদের খুব চেনা দুটি গাছ — আম আর কলা — বছর বছর ফল দেয় আমগাছ, ডালপালা ছড়িয়ে মহীরুহ হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। অন্যদিকে কলাগাছ ওষধি — আকারে তেমন বড় নয়, একবার ফল ধারণ করেই তার জীবন শেষ হয়ে যায়। বাঙালির অতি প্রিয় ইলিশ — সমুদ্র থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে পড়ে নদীতে, কত দূর থেকে আসে তারা ডিম ছাড়তে। আমাদের লোভের জালে ধরা না পড়লে এই মা-বাবা মাছের মিষ্টি জলে ডিম ছেড়ে ফেরার পথ ধরে, আর তাদের সঙ্গে যায় ডিম ফুটে বেরিয়ে বাড়তে থাকা ছানার দল। মিষ্টি থেকে লোনা জলে ফিরে যেতে হয় তাদের, কারণ সমুদ্রই তাদের আসল ঠিকানা। মিষ্টি জলের প্রয়োজন শুধু প্রজননের জন্য, আর মানুষের পাতা ফাঁদ সেখানেই অপেক্ষা করে তাদের জন্য। আবার ধরা যাক বাঁশ গাছের কথা — 49 বছরে একবার ফুল ফোটে কিছু প্রজাতির বাঁশে, একসঙ্গে সব গাছে ফুল ভরে যায়। আর এক প্রজাতির বাঁশ গাছে ফুল হয় 99 বছরে একবার। মজার ব্যাপার হল, একবার ফুল ফুটেই মরে যায় বাঁশ গাছ। কেন এমন হয়? কেন এত বৈচিত্র বিভিন্ন উদ্ভিদ বা পশু-পাখির জীবন যাত্রায়? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে।
জীব জগতের মুদ্রা হল শক্তি, বা energy, যা না থাকলে জীবন অচল। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেমন আয়-ব্যয়ের হিসেব রাখার প্রয়োজন রয়েছে, তেমনই জীবজগতে; শুধু আমাদের খাতায় হিসেব রাখা হয় টাকায়, আর জীবজগতের হিসেব energy-তে। একটি প্রাণীর জীবনে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে সময়টা সে পায়, তার একটা অংশ সে কাটায় শক্তি সঞ্চয় করে নিজের শরীরকে গড়ে তুলতে — যাকে বলা যায় তার শৈশব ও কৈশোর কাল (juvenile phase)। এরপর সে হয় প্রাপ্তবয়স্ক বা adult, অর্থাৎ, প্রজননক্ষম। জীবনের এই ধাপে এসে তার শক্তি খরচ হয় প্রজননের কাজে। কতটা সময় ধরে কোনো প্রাণী শক্তি সঞ্চয় করে প্রজননক্ষম হবে, কতটা শক্তি সে ব্যয় করবে প্রজননে আর কতটা নিজের শরীরকে সুস্থ রাখতে, কতটা সময় ও শক্তি সে দেবে এক একটি সন্তানের লালনপালনে, সবকিছুই হিসেব করে চলতে হয়। কে করে এই হিসেব? ইলিশ মাছ কি গুনতে বসে সে কটা ডিম দিল, নাকি আমগাছের নিয়ম আছে কতটা লম্বা হলে তবে তার মুকুল ফুটবে? অবশ্যই না।
এই “হিসেব“ প্রোথিত আছে তাদের জিনেই। কলাগাছ চাইলেই বার বার ফল ধরতে পারে না, ইলিশ মাছ নদীতে বেড়াতে যায় না, বাঁশেরা ইচ্ছে করলেই বছর বছর ফুল ফোটাতে পারে না। বিবর্তনের ধারায় পরিবেশ আর জিনের নানান পরিবর্তনের মাধ্যমে এক একটি প্রাণীর জীবনধারা বর্ণিত হয়েছে বহু বহু যুগ ধরে।
কিন্তু এই সব হিসেবের সঙ্গে দিদিমা বা ঠাকুমা কীভাবে জড়িত? এখানেও আছে সেই জিন-এর হিসেব। ডারউইনের তত্ত্ব বলে যে প্রজনন জীবজগতে যে কোনো প্রাণীর জীবনের মূল উদ্দেশ্য। আমাদের আসে পাশে তাকিয়ে দেখলেই বুঝবো, প্রজনন ক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বেশির ভাগ জীবের আয়ু শেষ হয়ে যায়। বিভিন্ন জীবের জীবন ধারণের বৈচিত্র, এবং তার পিছনে বিবর্তনের যে ইতিহাস, তা নিয়ে গড়ে উঠেছে বিবর্তনবাদের আস্ত একটা প্রশাখা — life history theory। এই life history বা জীবন যাত্রার বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী যে কোনো জীবের জীবনকে ভাগ করা যায় তিনটে মূল ভাগে — প্রজননক্ষম হয়ে ওঠার আগের সময় (pre-reproductive/ juvenile phase), প্রজননের সময় (reproductive phase) আর প্ৰজনন ক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়ার পরের সময় (post-reproductive phase); এই শেষ ভাগটা বার্ধক্য, যার শেষে মৃত্যু। প্রজনন ক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে আয়ু থাকা বৃথা, তাই বিবর্তনের ধারায় বেশির ভাগ প্রাণী বার্ধক্যে দিনযাপন করে খুব কম সময়ের জন্য। কিছু কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে তো পুরুষদের আয়ু শেষ হয়ে যায় সঙ্গমের পরেই। ব্ল্যাক উইডো মাকড়সার কথা আমরা অনেকেই জানি। ব্ল্যাক উইডোর নামকরণ হয়েছে যে কারণে — সঙ্গমের সময় পুরুষটির মাথা খেয়ে নেয় তার সঙ্গিনী, আর তারপরে পুরুষ মাকড়সার পুরো শরীরটাই হয়ে যায় “বিধবা” মাকড়সাটির খাদ্য। খুবই বীভৎস এই দৃশ্য, মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে। কিন্তু জীবজগতে, যেখানে এনার্জি হল মূলধন, সেখানে তার সঙ্গীর sperm (শুক্রাণু) গ্রহণ করে তার শরীরটাকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে পরের প্রজন্মের জন্য এই মূলধনের অসাধারণ সদ্ব্যবহার করছে ব্ল্যাক উইডো, তার সন্তানের লালনে কাজে লাগছে পুরুষটির দেহ; পিতৃত্বের “দায়িত্ব” খুবই দক্ষভাবে পালন করছে সে।
মানুষ সেই অদ্ভুত প্রাণী, যাদের বার্ধক্য অনেকটা দীর্ঘায়িত। অবশ্যই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জোরে আমাদের আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটা গত কয়েক দশকে। “কুড়িতে বুড়ি” বা “চল্লিশ পেরোলেই চালশে” নিয়ে আজ আর কেউ চিন্তিত নয়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের হাত ধরে চলার অনেক আগেই আমরা হয়ে উঠেছি বিবর্তনের নিয়ম বিরুদ্ধ এক প্রজাতি (species)। কেন? কারণ আমাদের দিদিমা-ঠাকুমা। বিবর্তনের সাধারণ নিয়ম মেনে বোঝা সম্ভব, কেন পুরুষেরা দীর্ঘায়ু — তাদের প্রজনন ক্ষমতা থাকে বার্ধক্যেও। আমাদের সামাজিক নিয়ম আর প্রকৃতির নিয়ম তো এক নয়, সুতরাং প্রজনন তত্ত্বে বৃদ্ধের আয়ু নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যে মহিলার সন্তান ধারণের ক্ষমতা ফুরিয়েছে, তার আয়ু কেন দীর্ঘায়িত হবে? প্রকৃতির কোন নিয়মে সে বেঁচে থেকে রসদে ভাগ বসাবে অন্যদের? অথবা, অন্যভাবে ভাবলে, কেন একটা বয়সের পরে মেনোপজ (menopause) হবে মহিলাদের? আগে ভাবা হত যে শুধু মানুষেই হয় মহিলাদের মেনোপজ। এখন অবশ্য আমরা জানি যে এই দলে রয়েছে আরো কিছু প্রজাতি — তারা সবাই তিমি — killer whale, false killer whale, pilot whale, beluga আর narwhal। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আমাদের সবচেয়ে নিকট “আত্মীয়” যারা, অর্থাৎ শিম্পাঞ্জি, বেবুন, বা অন্য কোনো বানর গোত্রের প্রাণীর মধ্যে কিন্তু মেনোপজ দেখা যায় না। অন্য সব স্তন্যপায়ীদের মতো বানর গোষ্ঠীর প্রজনন ব্যবস্থা হল ইস্ট্র্রাস (estrous), এদের ঋতুস্রাব হয় না। মেনোপজ সেখানেই সম্ভব যেখানে menstrual cycle বা ঋতুস্রাব রয়েছে। ফিরে আসি সেই প্রশ্নে, কেন মেনোপজ, মানে, এই ব্যবস্থা থেকে কী লাভ ?
গ্র্যান্ডমাদার হাইপোথিসিস (grandmother hypothesis) এই প্রশ্নের উত্তর। ধরে নেওয়া যাক আদিম মানুষের একটি দল — পুরুষেরা শিকার করে, মহিলারা হয়তো তাদের সাহায্য করে, আবার নানারকম ফল, মূল, দানা জোগাড় করা, শিকার করে আনার পর মাংস, হাড়, চামড়া, সবকিছু আলাদা আলাদা কাজের জন্য গুছিয়ে রাখা, এগুলোও করতে হয় সবাইকে। মায়েদের তার ওপরে রয়েছে বাচ্চা বড় করে তোলার দায়িত্ব। বাচ্চা ছোট হলে মায়েরা তাদের একা রেখে যেতে পারে না, হয় তাদের কোলে-পিঠে করে নিয়ে যেতে হয় কাজে, অথবা গুহায় থাকতে হয় মায়েদের, বাইরে কাজ করার মানুষ কমে যায় দলের। দিদিমারা থাকলে তাদের মেয়ের বাচ্চার দেখাশোনা করে, সেই মায়েরা বাচ্চা রেখে বাইরে যেতে পারে, কাজে লাগতে পারে গোষ্ঠীর। আবার, বাচ্চার দায়িত্ব দিদিমা নিলে পরের সন্তান জন্ম দিতে পারে যুবতী মা, গোষ্ঠী বেড়ে ওঠে তাড়াতাড়ি। দিদিমার সঙ্গে ছোটরা ঘুরে ঘুরে ফল মূল চিনতে শেখে, কুড়িয়ে আনতে শেখে, গোষ্ঠীর সুবিধে হয় তাতে।
কিন্তু দিদিমাদের এতে কী লাভ? এখানেই আসে জিন ও তার রহস্য, যে রহস্যের প্রথম বিশ্লেষণ করেছিলেন বিল হ্যামিলটন (Bill Hamilton), 1964-তে। কিন্ সিলেকশন থিওরি অনুযায়ী, যে কোনো প্রাণী তার আত্মীয়দের বেঁচে থাকায় সাহায্য করতে পারে, কারণ আমাদের আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে আমাদের কিছুটা হলেও জিনগত যোগাযোগ রয়েছে। একজন মানুষের সঙ্গে তার সন্তানের জিনগত মিল থাকার সম্ভাবনা 50%, আবার তার সঙ্গে তার নাতি-নাতনির জিনগত মিলের সম্ভাবনা 25%। সুতরাং, যে দিদিমা তার মেয়ের বাচ্চাদের দেখাশোনা করছে, তার নিজের জিন ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখছে কিছুটা বেশি, নিজের মেয়ের ও তার সন্তানদের মধ্যে দিয়ে। হ্যামিল্টন এর নাম দিয়েছিলেন ইনক্লুসিভ ফিটনেস (inclusive fitness)। এবার, যদি এই দিদিমাসুলভ ব্যবহার জিন নির্ধারিত হতে পারে, তাহলে এই “দিদিমা” জিন তার কিছু সন্তান, তাদের কিছু সন্তানের মধ্যে দিয়ে বিস্তার করতে পারে গোষ্ঠীর মধ্যে। কিন্তু আমাদের আচার আচরণ তো আর সব জিনের ইশারায় চলে না। যদি দিদিমা জিন বলে কিছু না থাকে? এরও উত্তর আছে grandmother hypothesis -এ। যেসব দিদিমারা নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা করবে, তাদের নাতি-নাতনিদের মৃত্যুর হার অন্যদের তুলনায় কম হবে, সেই গোষ্ঠীতে সন্তান জন্মাবে বেশি, একটু বড় হলে তারা ফল মূল জোগাড়ের কাজে লাগবে। সেই গোষ্ঠীর ছোটরা বড় হলে তাদের মধ্যে অনেকেই একইভাবে নিজের নাতি-নাতনির যত্ন নেবে, আর এভাবেই দিদিমারা শুধু সম্পর্কে নয়, ব্যবহারেও আমাদের চেনা দিদিমা-ঠাকুমা হয়ে উঠবে। যেসব মহিলার আয়ু বেশি, তাদের তত বেশি নাতি-নাতনি, আর তাদের প্রজনন ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকাতে তাদের পরিবারের তত বেশি লাভ। মজার ব্যাপার হল, যে পাঁচ প্রজাতির তিমির মেনোপজ হয়, তাদের মধ্যেও দেখা যায় দিদিমা-র আদর।
তাহলে ঠাকুরমার ঝুলি বা দিদিমার হাতের নাড়ু যখন এর পরে মন ভালো করে দেবে, মায়ের বকুনি খেয়ে যখন দিদার পাশের নিশ্চিন্ত আশ্রয় খুঁজে নেবে কেউ, বিবর্তনকে একটা ছোট্ট থ্যাংক ইউ বলতেই হবে, তাই না?
তথ্যসূত্র:
১. The evolution of prolonged life after reproduction. PMID: 25982154
DOI: 10.1016/j.tree.2015.04.011
২. Postreproductive killer whale grandmothers improve the survival of their grandoffspring. https://doi.org/10.1073/pnas.1903844116.
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/grandmother-hypothesis