21-11-2024 08:44:30 am
Link: https://bigyan.org.in/google-glass
গুগল্ গ্লাস এখন আর কোনো খবর নয়। বাসি হয়ে গেছে ব্যাপারটা। কিন্তু যে উন্মাদনা ছড়িয়েছে এই বৈদ্যুতিন চশমা তাকে তুচ্ছ করা যায় না। ওয়্যারেবল্ অর্থাৎ পরিধানযোগ্য কম্পুটারের জগৎটাকে এক ধাক্কায় সজীব করে দিয়েছে গুগল্।
২০১২ সালের মাঝামাঝি যখন গুগলের অন্যতম প্রতিষ্টাতা সের্গেই ব্রিন ওই চশমার একটা প্রোটোটাইপ চোখে লাগিয়ে সান ফ্রান্সিসকোর এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন তখন রীতিমত হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছিল। মে আর জুন মাসে প্রচারের সামনের সারিতে চলে আসে গুগলের চশমা। টিভি চ্যানেলের সাক্ষাত্কারে চশমার গুণপনা ব্যাখ্যা করেন সের্গেই। চ্যানেলের শো’তে ক্যালিফোর্নিয়ার লেফটেন্যান্ট গভার্নরের চোখেও পরিয়ে দেন একটা চশমা। এর পর গুগল্ আয়োজিত এক উত্সবে স্কাইডাইভার থেকে শুরু করে মাউন্টেন বাইকাররা চশমা পরে বলতে শুরু করেন তাদের অভিজ্ঞতা। যথারীতি আপলোড হয়ে আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে সেই বিবরণী।
এ বছরের শেষে হয়ত অনেক দেশের বাজারেই গুগলের গ্লাস এক্সপ্লোরার এডিশন কিনতে পাওয়া যাবে। দাম যে কত হতে পারে তার আন্দাজ দেওয়া এখনই শক্ত। কিন্তু গুগলের চশমা পরে মানুষ ভিডিও রেকর্ডিং করবে, রাস্তার নকশা বুঝে নেবে, তথ্য ডাউনলোড করবে ইন্টারনেট থেকে, ই-মেল করবে অর্থাৎ ডেস্কটপ বা ল্যাপটপে যা-যা করা যায় তার সবটাই করবে চশমার সাহায্যে। এর জন্য সফটওয়্যার তৈরি হয়ে গেছে। স্ক্রীনের উপর-নীচে চলাচল করার জন্য চশমার পাশে একটা ব্যবস্থা থাকছে। তবে অনেক কাজই হাত দিয়ে করতে হবে না। স্রেফ মুখে কথা বলে কম্যান্ড দেওয়া যাবে চশমা-কম্পিউটারকে। সমস্যা একটা অবশ্য রয়েছে স্ক্রীন নিয়ে। স্ক্রীনটা গোটা চশমা জুড়ে নয়, একটা কোণে মাত্র। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সমস্যার শেষ এখানেই নয়। কল্পবিজ্ঞানের সিনেমায় দেখা ওয়্যারেবল্ কম্পিউটার থেকে গুগল গ্লাস অনেক দূরে।
যে সংস্থার সাহায্য ছাড়া কম্পিউটারের কোনো ব্যবস্থাই কার্যকারী হতে পারে না সেই ইন্টেলের চীফ টেকনোলজি অফিসার জাস্টিন র্যাটনার (Justin Rattner) কিন্তু এখনই গুগলের চশমা নিয়ে হৈ-চৈ করতে রাজি নন। যে চশমা টাইম ম্যাগাজিনের পাতায় কিউরিওসিটি রোভারের পাশে জায়গা করে নিয়েছে তাকে অনেক পথ পেরোতে হবে বলে বক্তব্য তাঁর। গুগল কেন এমন একটা হেডসেট বানাচ্ছে না যেখানে লেন্সের মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার সব দেখা যাবে, বাস্তব জিনিসের উপর ভার্চুয়াল জগতের প্রলেপ পড়বে ! চশমার কাঁচের একটা কোণে ভার্চুয়াল জগৎকে সীমাবদ্ধ রাখা নিয়ে সন্তুষ্ট নন তিনি।
প্রযুক্তির যে বিশেষ ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করে গুগল গ্লাসের মত পণ্য তৈরি করা যাচ্ছে তাকে বলে অগ্মেন্টেড রিয়ালিটি (augmented reality)। নিঃসন্দেহে এই ক্ষেত্র অপার সম্ভাবনাময় কিন্তু সেইসব সম্ভাবনার খুব সামান্য অংশকেই বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। যে তিনটি প্রযুক্তির মহাসম্মেলনের ফলে অগ্মেন্টেড রিয়েলিটি আকার পাচ্ছে সেগুলো হল সেন্সর প্রযুক্তি, দূরযোগাযোগের প্রযুক্তি এবং কম্পুটার প্রযুক্তি। একদিক থেকে দেখতে গেলে এই মহাসম্মেলন তো আমাদের মুঠোফোন বা সেলফোনের মধ্যে ঘটেই গেছে। সেই পুরো ব্যাপারটা একটা চশমার মধ্যে ভরে দিতে গেলে প্রথম যে সমস্যাটা হয় তা হল ওজন। স্মার্ট গ্লাস বা হেডসেটগুলো এখনও বড্ড ভারী বলে মত র্যাটনারের। তাছাড়া ওই যে বললাম, ভার্চুয়াল জগৎটা সামনে থাকবে এবং তার মধ্যে দিয়ে সরাসরি দেখতে পাব চারপাশটাকে, এই প্রযুক্তি এখনও কেউ এনে দিতে পারে নি। কিছুটা এগিয়ে গেছে অবশ্য লুমাস নামে একটা সংস্থা। কিন্তু তাদের উদ্ভাবিত হেডসেট বেশ ভারী।
‘টার্মিনেটর’ ছবিতে যেমনটা দেখেছিলাম আমরা তেমন চশমা আর কত দূরে ? বহু দূরে, বলছেন র্যাটনার। এখন যা পাওয়া যায় তাতে দৃষ্টিক্ষেত্র তিরিশ থেকে চল্লিশ ডিগ্রী মত বিস্তৃত, চোখের সামনে ছোট্ট একটা কাঠের বাক্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাজারে কাটতি হতে গেলে এই দৃষ্টিক্ষেত্রের বিস্তার ষাট থেকে সত্তর ডিগ্রী হতে হবে অন্ততঃপক্ষে। এদিকে কল্পবিজ্ঞান আমাদের লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছে আরও অনেক দূরে। এমন ব্যবস্থা চাই আমরা যা শরীরের সঙ্গে মিশে যাবে, আলাদা করে পরতে হবে না। সেই লক্ষ্যে কিছু কাজ অবশ্য হয়েছে মার্কিন মুলুকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটা গবেষণায় নিউরাল ইন্টারফেস চিপ তৈরি হয়েছে যা বসিয়ে দেওয়া যাবে চামড়ার নীচে। এটা সরাসরি যোগাযোগ রাখবে মস্তিস্কের সঙ্গে, চিপ-টা সরানোর কোনো প্রয়োজনই পরবে না, প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ হবে একটা আবেশ কুন্ডলীর মাধ্যমে যা চামড়ার থেকে মাথা তুলে রাখবে। তবে এগুলোর আকৃতি খুব ছোট, এক ইঞ্চির ভগ্নাংশ মাত্র।
অগ্মেন্টেড রিয়েলিটির যে ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করছি আমরা তা কিন্তু বেশ বিস্তৃত। শুধু কয়েকটা হেডসেট তৈরি করা এর লক্ষ্য নয়। দৃষ্টিশক্তি হারানো মানুষের দৃষ্টি কিছু পরিমাণে ফিরিয়ে দেয়াও এর লক্ষ্য। এই আর্টিফিশিয়াল ভিশনের মূল লক্ষ্য চোখের রেটিনা। সারা পৃথিবীতে এক কোটিরও বেশি মানুষ রেটিনার সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে কম দেখছেন বা দৃষ্টি হারিয়েছেন। তবে দেখা যায় যে রেটিনাটাইটিস পিগমেন্টোসা বা অন্যান্য রেটিনার সমস্যায় রড ও কোন কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেটিনায় থাকা অপটিক নার্ভের ক্ষতি হয় না। সুতরাং মস্তিষ্কে বার্তা প্রেরণের পথটা অটুট থাকে। প্রয়োজন কৃত্রিম রড ও কোন কোষের। এক্ষেত্রে একটা চাঞ্চল্য তৈরি করলেন ডাক্তার মার্ক হুমায়ুন ১৯৮৮ সালে। তিনি দেখালেন দৃষ্টিশক্তি হারানো একজন মানুষের চোখে আলোর অনুভূতি আনা যায় রেটিনার নার্ভ গ্যাংলিয়াকে কৃত্রিমভাবে বৈদ্যুতিক পাল্স (pulse) দিয়ে উত্তেজিত করে। এমন একটা সন্ধানের পর তো আর গবেষণা থেমে থাকতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জির পৃষ্ঠপোষকতায় হুমায়ুন নিজেই পরিচালনা করছেন ‘আর্টিফিশিয়াল রেটিনা প্রজেক্ট’। এদিকে অপ্টোবায়োনিক্স নাম একটা কোম্পানি ‘আর্টিফিশিয়াল সিলিকন রেটিনা’ (ASR ) তৈরি করে ফেলেছিল সেই ২০০৭ সালেই। ASR আসলে দু’মিলিমিটার প্রস্থের একটা চিপ, মানুষের একটা চুল যতটা পুরু তার থেকেও কম পুরু সেটা। সেখানে রয়েছে সাড়ে তিন হাজার আনুবীক্ষণিক সৌর কোষ। বাড়ির ছাদে লাগানো সৌরকোষ যেমন আলোকে বিদ্যুত শক্তিতে রূপান্তরিত করে, এর কাজও তেমনটা। এভাবেই এই সব সৌরকোষ রড ও কোন কোষের ভূমিকা পালন করে। সূক্ষ্ম সার্জারিতে রেটিনায় ASR বসিয়ে দিলে চিন্তা শেষ। কোনো অতিরিক্ত শক্তির যোগান দিতে হবে না। কারণ, চোখে প্রবেশ করে আলো যখন রেটিনার ASR-এ পড়বে তখন তা থেকেই ফোটোইলেকট্রিক পদ্ধতিতে পাওয়া যাবে শক্তি। অযথা তার-ব্যাটারী-কয়েলের দরকার নেই। বাণিজ্যের বেয়াড়া খেলায় অপ্টোবায়োনিক্স কোম্পানি দেউলে হয়ে গিয়েছিলো। তাই বলে ভাবনাটা তুচ্ছ হয়ে যায়নি। বেঁচে থাক অগ্মেন্টেড রিয়েলিটি।
পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী পাঠকদের জন্য
প্রতি মাসের প্রথম এবং তৃতীয় শুক্রবার FM Rainbow 107 MHz প্রচার তরঙ্গে রাত ১০:৩০-১২:০০ শুনুন মানস প্রতিম দাসের উপস্হাপনায় “বিজ্ঞান রসিকের দরবারে“
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/google-glass