21-12-2024 17:06:47 pm
Link: https://bigyan.org.in/genetic-info-in-bacteria-2
আমরা এই লেখার আগের পর্বে কোষের গঠন, কাজ, এবং ক্রমবিকাশের যাবতীয় তথ্য বা এক কথায় জিনগত তথ্যের (Genetic Information) আদান-প্রদান নিয়ে আলোচনা করেছি। সেই আলোচনা থেকে কোষের মধ্যে জিনগত তথ্যের আদানপ্রদান নিয়ে মূলত দুটি নতুন তথ্য পেয়েছি। এক, জিনগত তথ্যের আদান-প্রদান পর্যায়ক্রমে দুটি ধাপে সম্পন্ন হয়, প্রথমে “প্রতিলিপিকরণ” (ট্রান্সক্রিপশন), তারপর “অনুবাদ” (ট্রান্সলেশন)। দুই, ব্যাকটেরিয়া কোষের মধ্যে নিউক্লিয়াসের বাইরের পর্দার অনুপস্থিতিতে এই দুটি ধাপের মধ্যে যোগসূত্র রচিত হয়, যা ইউক্যারিওট কোষে (যেমন, আমাদের কোষে) হয় না। প্রশ্ন হলো এমনটা হলো কেন? জিনগত তথ্যের আদান-প্রদান দুই ধাপে না হয়ে এক ধাপে হলে অসুবিধে কি ছিল? ঠিক একইভাবে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ব্যাকটেরিয়ার ভিতর তথ্যপ্রবাহের দুটি ধাপের মধ্যে এইরকম যোগসূত্র স্থাপিত হওয়ার তাৎপর্য্য কি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে আমরাও কিন্তু ধাপে ধাপে অগ্রসর হবো।
প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার আগেই জানিয়ে রাখি, এইরকম প্রশ্ন মনে জাগলেই বোঝা যাবে আমরা সঠিকভাবে জীববিজ্ঞানের পথ চলতে শুরু করেছি। আমরা এর আগে কোনো একটি বৈশিষ্ট্যর দুই ধরণের কারণ বা ব্যাখ্যার কথা বলেছি: প্রাকৃতিক বা পদার্থবিদ্যাগত কারণ (physical explanation)1, কিংবা রসায়নগত কারণ (chemical explanation)2। কিন্তু জীববিজ্ঞানীরা জীবের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত কোনো তথ্যের শুধুমাত্র physical কিংবা chemical কারণ জেনেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। যেমন, প্রাকৃতিক কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, নিউক্লিয়াসের পর্দাটির অনুপস্থিতির ফলেই ট্রান্সক্রিপশন আর ট্রান্সলেশন পরস্পরের সাথে যুক্ত। কিন্তু একজন জীববিজ্ঞানের পাঠক কিংবা জীববিজ্ঞানীর মন দাবি করে আরো বেশি কিছু।
সেই বেশি কিছুটা ঠিক কিরকম? সেটা হলো ঐ জীবের এতে কি সুবিধে হলো, এই ধরণের প্রশ্ন। এই ধরণের প্রশ্ন আপাতভাবে খুব সাধারণ শোনালেও জীববিজ্ঞানে এর তাৎপর্য্য খুব গভীর। কোনো একটি বৈশিষ্ট্যের জন্য জীবটির কি সুবিধে লাভ হয়, এই প্রশ্নের উত্তরকেই বলা হয় ঐ বৈশিষ্ট্যের বিবর্তন-সম্মত ব্যাখ্যা। আমাদের এই পর্বের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো জিনগত তথ্যের আদান-প্রদানের দুটি বৈশিষ্ট্য। এক, তথ্য আদান-প্রদান দুটি ধাপে সম্পন্ন হয়। দুই, ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে এই দুটি ধাপের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে। এবার এদের বিবর্তন-সম্মত ব্যাখ্যা খোঁজা যাক।
বিবর্তন-সম্মত ব্যাখ্যা নিয়ে দুকথা বলি। যেসমস্ত তত্ত্ব আমাদের জীবন ও জীববিজ্ঞান-এর একেবারে অন্তরস্থলে আমূল পরিবর্তন এনেছে, চার্লস ডারউইন-এর বিবর্তনবাদ (Theory of Evolution) সম্ভবত তাদের মধ্যে প্রধান। জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স-এর কথায়: “জীবন ও জীববিজ্ঞান-এর জ্ঞান অসম্পূর্ণ রয়ে যায়, যতক্ষণ না আমরা তাদের উৎস ও উপস্থিতির কারণ হৃদয়ঙ্গম করি। পৃথিবীতে প্রাণের উৎস ও বিভিন্ন জীবের উপস্থিতির ব্যাখ্যাই হলো বিবর্তন।” এই বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে যে সাধারণভাবে কোনো সুনির্দিষ্ট সুবিধা অর্জন ব্যতীত কোনো বৈশিষ্ট্যই দীর্ঘ সময়্কাল ধরে স্থায়ী হতে পারে না, বিবর্তনধারায় লুপ্ত হয়ে যায়3। তাই বলা যেতে পারে যে তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট সুবিধা পেলে ওই জৈব-বৈশিষ্ট্যটি যেন বহমান সময়ের প্রবাহে আঁকড়ে ধরার খুঁটি পায়। জীবনের আদিযুগ থেকে স্থায়িত্বলাভের এইটাই একমাত্র চাবিকাঠি। একেই আমরা বলছি বিবর্তন-সম্মত কারণ।
সেইজন্যই কোনো জৈব-বৈশিষ্ট্য চোখে পড়লেই জীববিজ্ঞানীদের মনে প্রশ্ন জাগে: বৈশিষ্ট্যটির জন্য জীবটি ঠিক কি সুবিধে অর্জন করেছে?
শুরুতেই একটু হদিশ দিয়ে রাখি, এই প্রশ্নটির উত্তরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে কত দ্রুত কোনো জীব তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে নিজেকে বদলে নেয়। প্রতিটি জীবের চারপাশের পরিবেশে ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে জীবটিকেও খুব দ্রুত নিজেকে পরিবর্তন বা এক কথায় অ্যাডাপ্ট (adapt) করতে হয়। এর জন্য যে সময় লাগে, তাকে বলে প্রতিক্রিয়ার সময় বা রেসপন্স টাইম (response time)। সাধারণত এই রেসপন্স টাইম যত কম হয়, পরিবর্তনশীল পরিবেশে সেই জীবটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি। জিনগত তথ্যের আদান-প্রদান দুই ধাপে হওয়ার ফলে রেসপন্স টাইম কমে অভিযোজন বা অ্যাডাপ্টেশন-এ (adaptation) সাহায্য করে। ঠিক কিভাবে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে কয়েকটা ধাপে আমাদের প্রশ্নটির খোসা ছাড়াতে হবে।
প্রথম ধাপটি হলো, কোষ কিভাবে নিজেকে পরিবর্তিত পরিবেশের উপযোগী করে তোলে? এর জন্য কোষের মূল হাতিয়ার হলো ওই পরিবেশের উপযোগী প্রোটিন তৈরী করা। আগের পর্বে আমরা জেনেছি যে ডিএনএ -তে সঞ্চিত তথ্য অনুযায়ী কোষ কিছু প্রোটিন তৈরি করে যারা কোষের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকে। এই “যাবতীয় কাজকর্ম” বলতে কিন্তু দুধরণের কাজকর্ম বোঝায়। এক হলো, যখন কোষের চারধারের পরিবেশ (environment) অপরিবর্তিত আছে, তখন কোষের গঠনমূলক কাজ করা যাতে কোষের সুস্থ বৃদ্ধি ও বিভাজন চলতে থাকে। দুই হলো, যখন হঠাৎ কোষের পরিবেশের পরিবর্তন হচ্ছে, তখন পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে এবং খুব দুঃসহ পরিবেশেও কোষকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করা। এই দুই ধরনের কাজ করবার জন্য যে আলাদা রকমের প্রোটিন দরকার, তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন জিন রয়েছে।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে (adaptation) কোষকে আলাদা আলাদা ধরনের জিন থেকে বিভিন্ন ধরণের ও বিভিন্ন পরিমাণের প্রোটিন অণুর সংশ্লেষ করতে হয় এবং তা করতে হয় যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি। এই খাপ খাওনোর সময়কেই ‘টাইম টু এডাপ্ট’ বা ‘রেসপন্স-টাইম’ বলা হয়। রেসপন্স-টাইম যত কম হবে, কোষ বা জীবটি তত তাড়াতাড়ি সেই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।
কোষের পারিপার্শ্বিকের পরিবর্তন হতে পারে মুহূর্তের মধ্যে। ব্যাকটেরিয়া ক্ষুদ্র বলে, সেই পরিবর্তন অনুভব করতেও তাদের সময় লাগে খুবই কম (গড়ে ~১ মিনিট )। এদিকে একটি প্রোটিন অণু তৈরিতে গড়ে সময় লাগে আধ মিনিট। সুতরাং কোনো একটি নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে কোষের যদি একটি জিন থেকে সরাসরি ১০০-টি প্রোটিন অণু তৈরির প্রয়োজন হয়, তাহলে প্রায় ১ ঘন্টা কেটে যাবে কোষটির। তার পরিবর্তে, জিন থেকে আরএনএ এবং সেই আরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরী হওয়া এই দুটি ধাপে হওয়ায় কোষ এই সময়টিকে অনেকটা সংক্ষিপ্ত করে ফেলতে পারে4। ঠিক কিভাবে, আসুন একটু অঙ্ক কষে দেখি।
১০০-টি প্রোটিন তৈরী হতে প্রায় ১ ঘন্টা লেগেছে, সেটা বোঝা গেছে নিশ্চয়। ১০০ x ০.৫ মিনিট হলো ৫০ মিনিট, অর্থাৎ ১ ঘন্টার কাছাকাছি। এবার ধরা যাক, একটি জিন থেকে কিছু আরএনএ (~১০ টি) তৈরী হলো। এতে সময় লাগলো ৫ মিনিট (১০x ০.৫ মিনিট), কারণ একটি আরএনএ তৈরী করতে গড় সময় লাগে ০.৫ মিনিট। এবার সেই ১০-টি আরএনএ থেকে একসাথে ১০-টি করে প্রোটিন তৈরী হলে খুব তাড়াতাড়ি (৫ মিনিটে) ১০০-টি প্রোটিন তৈরী হয়ে যাবে। অর্থাৎ মোট সময় লাগলো ১০ মিনিট। সুতরাং দুই ধাপে সম্পন্ন হওয়ায়, ১ ঘন্টার কাজ ১০ মিনিটে হয়ে গেলো। একেই “এমপ্লিফায়ার এফেক্ট” বলে। এই ভাবে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে দ্রুত খাপ খাওয়াতে কোষ দ্রুত কিছু আরএনএ তৈরী করে নেয়।
এখানে মনে এই প্রশ্নটি জাগতেই পারে: তাহলে কোষে একই জিনের ১০-টি প্রতিলিপি রাখলেই বা অসুবিধে কি ছিল? প্রতিবার ১০টি করে আরএনএ করার বদলে, একেবারেই প্রতি জিন-পিছু ১০-টি করে প্রোটিন তৈরী করে নেওয়াও যেত। অসুবিধে হলো, কোষকে তাহলে সবসময় ওই ১০-টি জিন বহন করে চলতে হতো। বিবর্তনবাদের ভাষায় বললে বলা যায়, এতে ওই কোষটির ধারাকে বজায় রাখতে জীবটিকে অতিরিক্ত কাজ করতে হতো, যা তার বৃদ্ধির হার কমিয়ে দিতো 5, এবং জীবটি বাকি জীবদের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে বিবর্তন ধারা থেকে হারিয়ে যেত।
এই কারণেই কোনো কোনো জীব প্রতিটি কোষের মধ্যে একই জিনের ৩০-টি প্রতিলিপি বহন করার বদলে প্রতিটি জিন থেকে প্রয়োজন মাফিক আরএনএ তৈরী করে নেয়। আরএনএ খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাই তাদের থেকে প্রোটিন তৈরী করার কাজ শেষ হলে ৫ মিনিটের মধ্যে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। তাই কোষকে অযথা কোনো শক্তিব্যায় করতে হয়না তাদের বহন করার জন্য। এই হিসেবে আরএনএ-কে অনেকটা আমাদের লেখার টেবিলের ‘খুচরো কাগজ’ হিসেবে ভাবা যায়। যাতে চটপট কিছু হিসেব করে আবার বাজে কাগজের বস্তায় ছুড়ে ফেলা যায়।
ইউক্যারিওটদের ক্ষেত্রে (যেমন, আমাদের কোষে) তথ্যপ্রবাহের দুটি ধাপ কোষের মধ্যে আলাদা ভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে ধাপদুটির মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। এতে ব্যাকটেরিয়াদের কি সুবিধে হয়? আমরা আগের পর্বে বলেছি, ১৯৬৪ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে ড: গুন্টার স্টান্ট প্রথমবার প্রস্তাব করেন যে “ট্রান্সক্রিপশন” ও “ট্রান্সলেশন”-এর মধ্যে একটা সম্পর্কের সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রবন্ধে ড: স্টান্ট কিন্তু শুধু জিনগত তথ্যের “ট্রান্সক্রিপশন” আর “ট্রান্সলেশন”-এর পারস্পরিক বন্ধনের সম্ভাবনার কথা প্রস্তাব করেই থেমে থাকেননি। তিনি আরও প্রস্তাব করেন যে ট্রান্সক্রিপশন এবং ট্রান্সলেশন-এর মধ্যে একটি “feedback”-এর সম্ভাবনা রয়েছে। এই “feedback” -ই আমাদের প্রত্যাশিত তাৎপর্য্য। স্টান্ট প্রস্তাব করেন যে “ট্রান্সক্রিপশন” আর “ট্রান্সলেশন”-এর মেলবন্ধনের মাধ্যমে এই দুই ধাপের মধ্যে সমন্বয়সাধন সম্ভব। তথ্যপ্রবাহের এই দুই ধাপ যুগপৎ সম্পাদিত হলে একটি পদ্ধতির গতির সাথে অপরটির মিল বজায় রাখা যাবে6। জানি মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক।
তথ্যপ্রবাহের এই দুই ধাপের মধ্যে সমন্বয়সাধন হলে অতিরিক্ত আরএনএ কিম্বা প্রোটিন তৈরী করে জীবটি অনর্থক শক্তিব্যয় করবে না। ধরা যাক কোনো কারণে কোষের মধ্যে প্রতিলিপিকরণ-এর হার বৃদ্ধি পেল এবং প্রচুর আরএনএ তৈরী হলো। যদি অনুবাদও একই হারে সম্পন্ন হয় তবে সেই আরএনএ-এর অনর্থক অপচয় হবে না, বরং তার থেকে সমানুপাতিক পরিমাণ প্রোটিন তৈরী হবে। এক্ষেত্রে “feedback”-এর উপযোগিতা হচ্ছে এইরকম: যদি কোন কারণে জীব-কোষে স্বাভাবিক এর তুলনায় কম কিম্বা বেশি প্রোটিনের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র অনুবাদের হার পরিবর্তন করলেই চলবে কারণ তার সাথে সমানুপাতিক হারে প্রতিলিপিকরণ-এর হারও হ্রাস-বৃদ্ধি পাবে।
খুব সহজে উত্তর দিতে গেলে বলতে হয়, “ট্রান্সক্রিপশন” ও “ট্রান্সলেশন” পদ্ধতিদুটির গতিবেগ মাপলেই চলবে। স্টান্ট-এর প্রস্তাব অনুযায়ী ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে জিনগত তথ্যের “ট্রান্সক্রিপশন” ও “ট্রান্সলেশন” পদ্ধতিদুটি সমান বেগে চলে।
এক্ষেত্রে একটু পরিস্কার করে বলে নেওয়া উচিত, ট্রান্সক্রিপশন এবং ট্রান্সলেশন-এর হার বা বেগ বলতে আমরা ঠিক কি বোঝাতে চাইছি। আগের পর্বে আমরা জেনেছি যে প্রোটিন, ডিএনএ এবং আরএনএ, এদের প্রত্যেকের গঠনগত একক রয়েছে। প্রোটিনগুলি তৈরী আমিনো অ্যাসিড দিয়ে; আর ডিএনএ এবং আরএনএ তৈরী নিউক্লিক অ্যাসিড দিয়ে। এরা প্রত্যেকেই সেই হিসেবে পলিমার অর্থাৎ ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অণু দিয়ে তৈরী একটি বড় যৌগ। ট্রান্সক্রিপশন ও ট্রান্সলেশনের মূল যন্ত্রগুলির, যথাক্রমে আরএনএ পলিমারেস এবং রাইবোজম-এর কাজ হচ্ছে এই সরল অণুগুলিকে পরপর জুড়ে যৌগগুলি তৈরী করা। তাই ট্রান্সক্রিপশন-এর হার (transcription rate) বলতে বোঝায় আরএনএ পলিমারেস কর্তৃক নিউক্লিক অ্যাসিডগুলিকে একে অপরের সাথে জোড়া দিয়ে আরএনএ পলিমার তৈরী করার হার। তাই ট্রান্সক্রিপশন হার পরিমাপের একক হলো নিউক্লিওটাইড-প্রতি-সেকেন্ড (nt/s)। ঠিক তেমনভাবেই ট্রান্সলেশন প্রক্রিয়াটির হার (translation rate) বলতে বোঝায় রাইবোজম কর্তৃক অ্যামিনো অ্যাসিডদের জুড়ে প্রোটিনের যৌগিক অণু তৈরী করার হারকে, এবং একে মাপা হয় অ্যামিনো-অ্যাসিড -প্রতি-সেকেন্ড-এ (aa/s)।
স্টান্ট-এর প্রস্তাব অনুযায়ী ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে এই দুই প্রক্রিয়ার হার সমানুপাতিক হওয়া উচিত। এই প্রস্তাবের সত্যতা যাচাই করার জন্য প্রয়োজন কোষের মধ্যে এই দুই প্রক্রিয়ার হার নির্ণয় করা। ২০১০ সালে, স্টান্ট-এর প্রস্তাবনার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে, তেমনই একটি পরীক্ষা করে দেখালেন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী এভজেনি নুডলার এবং তার সহকর্মীরা।
বিজ্ঞানী নুডলার এবং তার সহকর্মীরা একই সাথে কোষের মধ্যে ট্রান্সক্রিপশনের হার এবং ট্রান্সলেশনের হার নির্ণয় করে দেখান। ঠিক কিভাবে তারা ট্রান্সক্রিপশনের হার এবং ট্রান্সলেশনের হার নির্ণয় করেন তার মধ্যে এই লেখাতে ঢুকবো না আমরা7 । শুধু বলে রাখি, এই পরীক্ষায় তারা কোষের অবস্থার বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন করে প্রতিটি অবস্থায় কোষে ট্রান্সক্রিপশন এবং ট্রান্সলেশনের হার পরিমাপ করেন। কখনো এমন অবস্থায় যখন কোষ তার আহার্য্যের প্রাচুর্য্যর (rich growth-medium) মধ্যে আছে, কখনো বা আহার্য্যের অভাবজনিত আপাত-সুপ্ত (stationary phase) অবস্থায় কিংবা এমন সময়ে যখন অ্যান্টিবায়োটিকের (chloramphenicol) দ্বারা কোষের ট্রান্সলেশন-এর বেগ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পরীক্ষায় দেখা যায় যে এক-একটি অবস্থায় কোষের মধ্যেকার ট্রান্সক্রিপশন এবং ট্রান্সলেশন-এর হার অন্য অবস্থার থেকে আলাদা। কিন্তু প্রতিটি অবস্থাতেই ট্রান্সক্রিপশনের হার, অর্থাৎ নিউক্লিওটাইড যোগ করবার হার, ওই অবস্থায় কোষের ট্রান্সলেশনের হার, যা কিনা অ্যামিনো অ্যাসিডদের জুড়ে দেওয়ার হার, তার ঠিক ৩ গুন।
এই ‘৩ গুন’ ব্যাপারটা খুবই তাৎপর্য্যপূর্ণ। পাঠককে একবার মনে করিয়ে দি, একটি এমআরএনএ-র প্রতি তিনটি নিউক্লিওটাইড পিছু, সেই এমআরএনএ থেকে উৎপন্ন প্রোটিন অণুতে একটি করে অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে। সুতরাং একটি এমআরএনএ এবং তার প্রোটিন অণু তৈরী হতে একই সময় লাগতে হলে নিউক্লিওটাইড জোড়ার হারকে অ্যামিনো অ্যাসিড জোড়ার হারের ঠিক ৩ গুন হতে হবে। অর্থাৎ নুডলার ও তার সহকর্মীদের পরীক্ষাটি প্রমাণ করে যে কোষের মধ্যে ট্রান্সক্রিপশনের হার ট্রান্সলেশনের হারের শুধু সমানুপাতিকই নয়, তাদের মধ্যে নিখুঁত সামঞ্জস্য রয়েছে।
ড: গুন্টার স্টান্ট-এর প্রস্তাবনাটির প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে, নুডলার ও তার সহকর্মীরা শুধু ট্রান্সলেশন এবং ট্রান্সক্রিপশনের হারের সামঞ্জস্যটুকু প্রমাণ করেই ক্ষান্ত হলেন না, তারা এই প্রস্তাবনার পিছনে কার্যকর পদ্ধতিটিরও (মেকানিসম) হদিশ দিলেন। ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়াটির মূল কান্ডারি, আরএনএ পলিমারেস, ট্রান্সক্রিপশন চলাকালীন ক্রমাগত হোঁচট খায়, যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয়, ব্যাকট্র্যাকিং। ট্রান্সলেশন-যন্ত্র রাইবোজোম কিন্তু এই হোঁচট খাওয়া থেকে আরএনএ পলিমারেসকে বাঁচায়। ব্যাক্টেরিয়াতে ট্রান্সক্রিপশন ও ট্রান্সলেশনের মধ্যেকার যোগসূত্রের জন্যই এমনটি সম্ভব। এই যোগসূত্রের মাধ্যমে রাইবোজোম-এর টানে যাবতীয় বাধা-বিপত্তি এড়িয়ে আরএনএ পলিমারেস এগিয়ে চলে, এবং ট্রান্সক্রিপশন-ট্রান্সলেশন-এর হারের মধ্যে সমতা বজায় থাকে।
অর্থাৎ দেখা গেলো আমাদের এবারকার পর্বের দুটি প্রশ্নেরই উত্তরের মূলে রয়েছে ‘সময়’; প্রথমটির ক্ষেত্রে পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে এডাপ্ট করার সময় (রেসপন্স টাইম), আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ট্রান্সক্রিপশন-ট্রান্সলেশন সম্পন্ন হওয়ার সময়।
গল্পটা এখানেই শেষ হলে ভালো ছিল। মধুরেণ সমাপয়েৎ বলে হাঁফ ছাড়া যেত। কিন্তু তার উপায় নেই। কারণ সময় যত এগিয়েছে, উপরে বর্ণিত চিত্রটির পূর্ণতা নিয়ে তত প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আর সেই প্রশ্ন সময় নিয়েই। অনুবাদ, প্রতিলিপিকরণ, এবং অন্যান্য বিভিন্ন জৈবক্রিয়ার যেমন সময়সীমা রয়েছে, ঠিক তেমনই প্রতিটি জৈবক্রিয়ক-এরও জীবনসীমা রয়েছে। জৈবক্রিয়কদের জীবনসীমা নিয়ে সাধারণ কিছু গণিত করলেই তথ্য বিনিময়ের এই ছবিটির দুর্বলতা ধরা পরে।
জৈবক্রিয়াগুলির অন্যতম প্রধান কান্ডারী প্রোটিনদের জীবনসীমা প্রায় ঘন্টাখানেক। এর অর্থ হলো, তৈরী হবার ঘন্টাখানেক পর প্রোটিন অণুগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এমআরএনএ অণুগুলির ক্ষেত্রে তা কিন্তু গড়ে মাত্র ৪-৫ মিনিট8। মজার কথা হলো, এমআরএনএ-এর এই সংক্ষিপ্ত জীবনসীমাও কিন্তু খুব সংক্ষিপ্ত নয়। একটি এমআরএনএ অণু তৈরী হতে গড়ে সময় লাগে মাত্র আধ মিনিট। সুতরাং এমআরএনএ-এর জীবদ্দশার ১০% সময়। জীবদ্দশার বাকি ৯০% সময় এমআরএনএ-টি কাটায় পূর্ণাঙ্গ অবস্থায়। প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে কি জীবদ্দশার বাকি ৯০% সময় এমআরএনএ শুধু শুধু অপচয় করে?
আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে, ড: মিলার ও তার সহকর্মীদের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে mRNA থেকে প্রোটিন সংশ্লেষ সব সময়ই ট্রান্সক্রিপশন চলাকালীন হয়। উপরের আলোচনার হিসেবে সেক্ষেত্রে এমআরএনএ-এর জীবদ্দশার ১০% অংশে “co-transcriptional translation”-এর মাধ্যমে নতুন প্রোটিন সংশ্লেষ হয়। প্রশ্ন হলো জীবদ্দশার বাকি ৯০% পূর্ণাঙ্গ এমআরএনএ-টির কাজ কি? আর যদি ধরেই নেওয়া হয় এমআরএনএ তৈরী করার মূল উদ্দেশ্য প্রোটিন প্রস্তুত করা, তাহলে ৯০% সময় নষ্ট করার কি কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে? ভুল ঠিক কোথায়? ট্রান্সক্রিপশন-ট্রান্সলেশনের যোগসূত্রের এই চিত্রে নাকি তা থেকে তৈরী সিদ্ধান্তে ?
এইসব প্রশ্নেরই উত্তর আমরা খুঁজবো পরের পর্বে। ড: মিলার ও তার সহকর্মীদের মতো ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে কোষ-নির্যাসের ছবি তোলার বদলে একটি সুপার-রেজলিউশন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে জীবন্ত কোষের মধ্যে উঁকি মারলে নতুন কি জানা যায়, আর ঠিক কিভাবে সেই নতুন জ্ঞান আমাদের পুরোনো ধারণার বিবর্তন কিংবা পরিবর্তন ঘটায়, আমরা সেটাই দেখবো।
টীকা:
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/genetic-info-in-bacteria-2