21-12-2024 17:13:14 pm
Link: https://bigyan.org.in/fundamental-of-mass
বস্তুর ভরের পরিমাপ তার আরো মৌলিক কোনো ধর্ম থেকে পাওয়া যায় কি? আধুনিক কণাপদার্থবিদ্যা কি বলে?
ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যা কিভাবে ভরের উপর নির্ভরশীল
স্কুলের পাঠ্যবইতে ভরের সংজ্ঞাটা যেভাবে দেওয়া হয়, সেটা অনেকের একটু হলেও গড়বড়ে লেগে থাকতে পারে,—আলোচনাটা সেখান থেকেই শুরু করা যাক।
“কোনো বস্তুর মধ্যে যে পরিমাণ পদার্থ থাকে, তাকে ঐ বস্তুর ভর বলে।”
কিন্তু পদার্থকে কিভাবে মাপা যায়? ধরা যাক, আমার স্কুলের এক বন্ধু ডেমোক্রিটাসকে এরকম একটা প্রশ্ন করা হল। বুদ্ধিমান ডেমোক্রিটাসের তো উত্তর রেডি, ‘খুব সোজা। কোনো বস্তু অজস্র অণু দিয়ে তৈরি, একটা অণুর মধ্যে যে পরিমাণ পদার্থ আছে তা মেপে নে। তাকে বস্তুটির মধ্যে যতগুলো অণু আছে তা দিয়ে গুণ করে ফেল। তাহলে বস্তুর ভর =মোট অণুর সংখ্যা ⨉ একটা অণুর ভর।’
ডেমোক্রিটাসের কথা থেকে একটা জিনিস জানা গেলো। ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যায় ভরের ধারণাটা একরকমভাবে আসে ঘনত্ব (এক্ষেত্রে একটা অণুর ভর) আর আয়তন (এক্ষেত্রে কটা অণু), এই যৌথ ধারণা থেকে। অর্থাৎ, ভর = ঘনত্ব X আয়তন।
কিন্তু ভরের এই ধারণাটা ঠিক সম্পূর্ণ নয়। যেমন, নিউটন প্রদত্ত গতিসূত্রে উপনীত হতে গেলে ভরের অত্যন্ত মৌলিক আরো একটা ধর্ম আমাদের অনুমান করতে হয়। তা হল ভরের নিত্যতা,— ভর সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। নিউটনীয় গতিবিদ্যায় এই ধর্মটা এতটাই মৌলিক যে একে নিউটনের শূন্যতম গতিসূত্রের তকমা দেওয়া যায় আর কি! অথচ, ডেমোক্রিটাস-এর থেকে পাওয়া ধারণা থেকে ভর কেন নিত্য (conserved) হবে,সেটা বোঝা যায় না।
এরপর আমরা ভরবেগকে সংজ্ঞায়িত করি ‘বস্তুর গতিজাড্যের পরিমাপ’ হিসেবে,— গাণিতিকভাবে যা লেখা হয় বস্তুর ভর X গতিবেগ হিসেবে। ভরবেগের সংজ্ঞা এবং ভরের নিত্যতা ব্যবহার করে খুব সহজভাবে নিউটনের প্রথম গতিসূত্র থেকে একটি বস্তুকণার ভরবেগ সংরক্ষণ সূত্র এবং দ্বিতীয় গতিসূত্র থেকে বলের ধারণা পাওয়া যায়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, নিউটনীয় গতিবিদ্যায় ভরই মূল ধারনা যাকে কেন্দ্র করে ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যা বেড়ে ওঠে। এই নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা এখানে দেখুন।
নিউটন প্রদত্ত গতিসূত্রে উপনীত হতে গেলে ভরের অত্যন্ত মৌলিক একটা ধর্ম আমাদের অনুমান করতে হয়, তা হল ভরের নিত্যতা।
কিন্তু ভরের উৎস কী? আমরা কি বস্তুর ভরের পরিমাপ তার আরো মৌলিক কোনো ধর্ম থেকে পেতে পারি? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ‘পদার্থে’র অবর্তমানে কি বস্তুর ভর থাকতে পারে? শেষের প্রশ্নটা অনেকের ভাবনায় সেই বিখ্যাত E=mc2 সূত্রটা এনে ফেলতে পারে। এইভাবে ভাবাই ঠিক কিন্তু আমরা একটু ধীরে ধীরে আরো বেশী যুক্তি ও প্রমাণ নিয়ে এগোবো এবং বোঝার চেষ্টা করবো ভরের বেশীর ভাগটাই কিভাবে আসলে শক্তি থেকে আসে। আসলে একটা পরমাণুর বেশীর ভাগ ভরটাই নিউক্লিয়াস থেকে আসে আর নিউক্লিয়াসে থাকে বেশ ভারী দুটো কণা— প্রোটন আর নিউট্রন। এই দুটো কণাই আসলে কয়েদ করা বিপুল পরিমাণ শক্তি, পদার্থ-টদার্থ ওতে নামমাত্র আছে আর কি!
নিউক্লিয়াস নিয়ে দু–চার কথা
প্রোটন এবং নিউট্রনের ভর কীভাবে আসে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হলে প্রথমে পরমাণুর নিউক্লিয়াস সম্বন্ধে এই দুটো পরীক্ষামূলক তথ্য একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক:
ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ অনুমান করেন যে প্রোটন এবং নিউট্রন একই কোয়ান্টাম অবস্থার এপিঠ-ওপিঠ।
এরপর একেবারে চল্লিশ বছর এগিয়ে যাওয়া যাক। এটা বোঝা গেছে যে হাইসেনবার্গের অনুমান মোটামুটিভাবে সঠিক। সাথে সাথে এটাও দেখা গেছে যে প্রোটন ও নিউট্রন মৌলিক বা অবিভাজ্য কণা নয়। ওরা প্রত্যেকে তিনটে আরও মৌলিক কণা দিয়ে তৈরী। তাদের নাম রাখা হয়েছে কোয়ার্ক (quark)। প্রোটন-নিউট্রন প্রায় একইরকম কিন্তু পুরো এক নয় কারণ কোয়ার্কগুলোর আলাদা আলাদা ‘flavor’ হয়। প্রোটন আর নিউট্রন দুটোতেই ‘up’ আর ‘down‘ ফ্লেভারের কোয়ার্ক থাকে, তবে প্রোটনে দুটো up একটা down আর নিউট্রনে একটা up দুটো down (প্রচ্ছদের ছবিটি দেখুন)। up-এর আধান +(২/৩)e আর down-এর -(১/৩)e, ফলে প্রোটনের আধান +e আর নিউট্রন নিস্তড়িৎ (-e = একটা ইলেক্ট্রনের আধান)। আর প্রোটন-নিউট্রনের SU(2) প্রতিসাম্যটা আসলে আসে up আর down-এর SU(2) প্রতিসাম্য থেকে।
নিউক্লিয়নের এত ভর আসে কোত্থেকে
এসব ঠিক থাকলেও সমস্যা অন্য জায়গায়। দুটো সমস্যা, এবং দুটোই বেশ পাগলাটে। প্রথমত, একলা মুক্ত কোয়ার্কের কখনো দেখা পাওয়া যায় না। যদিও এই কোয়ার্কগুলো যে যৌগিক কণাগুলোর মধ্যে আবদ্ধ থাকে তাদের আচরণ থেকে কোয়ার্কগুলোর অস্তিত্বের পরোক্ষ পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, কোয়ান্টাম ক্ষেত্রগতিবিদ্যার (quantum field theory) গণনা থেকে up এবং down কোয়ার্কের যে ভর পাওয়া যায়, নিউক্লিয়নের ভর তার চেয়ে প্রায় একহাজার গুণ বেশী। এদিকে নিউক্লিয়নে কোয়ার্ক আছে মাত্র তিনটে করে। কোয়ার্ক থেকে না এলে নিউক্লিয়নের এতটা পরিমাণ ভর আসে কোথা থেকে? ধাঁধা দুটো বুঝতে আমাদের চেনা তড়িচ্চুম্বকীয় বলের উদাহরণ থেকে শুরু করা যাক। দুটো আধান (charge) একে অন্যের ওপর বল প্রয়োগ করে ফোটন (photon) কণা বিনিময়ের মাধ্যমে। ফোটন হল তড়িচ্চুম্বকীয় বলের বাহক এবং এর ভর (rest mass) না থাকলেও আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী মোমেন্টাম বা ভরবেগ থাকতে পারে। দুটো আধান ফোটন বিনিময় করলে ভরবেগেরও বিনিময় হয়, যেটা তড়িচ্চুম্বকীয় বল হিসেবে প্রতিভাত হয়।
মজার কথা হলো ফোটন নিজে কিন্তু আধানহীন, অর্থাৎ দুটো ফোটন একে অপরের ওপর বল প্রয়োগ করতে পারে না১।
এই ধারণাগুলোর সাধারণীকরণ করলে একটা নিউক্লিয়নের ভেতর কোয়ার্কদের যে বল বেঁধে রাখে তাকেও বোঝা যায়। এই বলের নাম হলো স্ট্রং বল (strong force) বা বর্ণময় বল (color force)। দুটো কোয়ার্কের বর্ণাধান (color charge) থাকে এবং ওদের মধ্যে ভরবেগ বিনিময় হয় গ্লুওন (gluon) কণা বিনিময় দ্বারা, যেটা বর্ণময় বল হিসেবে প্রতিভাত হয়।
ফোটনের মতো গ্লুওনও ভরহীন কণা। কিন্তু এই দুটো কণার সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল, গ্লুওনের বর্ণাধান থাকে, ফলত কোয়ার্কের অনুপস্থিতিতেও এরা নিজেদের মধ্যে ক্রিয়া (interact) করতে পারে। এভাবে তারা নতুন গ্লুওনও সৃষ্টি করতে পারে। তাই দুটো কোয়ার্কের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে থাকলে ওদের মধ্যে থাকা গ্লুওনগুলোর ক্রিয়ায়(interaction) আরো আরো গ্লুওন তৈরী হয়। এতে এত বেশি বর্ণময় বল সৃষ্টি হয় যে কোয়ার্কগুলো পুরোপুরি বাঁধা পড়ে যায় এবং একে অপরকে ছেড়ে বেরোতে পারে না। এই কারণেই একলা মুক্ত কোয়ার্কের কখনো দেখা পাওয়া যায় না।
শুধু তাই নয়, একটা নিউক্লিয়নের সাইজ এক ফার্মির (ফেমটোমিটার-এর) কাছাকাছি। এই দূরত্বে কোয়ার্কগুলো থাকলে তাদের মধ্যে এত অজস্র গ্লুওন তৈরী হয় যে গ্লুওনের সমুদ্রে ওই তিনটে কোয়ার্ক যেন ভাসতে থাকে। এই গ্লুওনগুলোও আবার নিউক্লিয়নের কয়েদ থেকে বেরোতে পারে না কারণ একটা নিউক্লিয়নের সমষ্টিগত বর্ণাধান শূন্য এবং সে এরকম অবস্থাতেই থাকতে চায়। যেহেতু গ্লুওনের বর্ণাধান আছে তাই কোনো নিউক্লিয়ন থেকে গ্লুওন বেরোলে নিউক্লিয়নের আর শূন্য বর্ণাধান থাকবে না যেটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত (favorable) নয়। এভাবে একটা প্রোটন বা নিউট্রন নিজের মধ্যে বিপুল পরিমাণ শক্তি ধরে রাখতে পারে, যা E=mc2 সূত্রানুযায়ী এদের ভর হিসেবে প্রতিভাত হয়।
প্রশ্নের শেষ নেই
বেশ সুন্দর ব্যাখ্যা! তবুও আরও কয়েকটা প্রশ্ন থেকেই যায় যাদের উত্তর আমাদের এখনও অজানা। একটা নিউক্লিয়াসের ভেতর নিউক্লিয়নগুলোর নিজেদের মধ্যে যা দূরত্ব, নিউক্লিয়নের ভেতর কোয়ার্কগুলোর দূরত্বও প্রায় ততটাই। তাহলে এই কোয়ার্কগুলো মিলেমিশে নিউক্লিয়াসে একটা কোয়ার্ক-কমিউন্ বানিয়ে ফেলে না কেন? প্রোটন এত স্থায়ী কণা কেন? প্রোটন কি নিজে থেকেই ভেঙে যেতে পারে? আসলে কণা-পদার্থবিদরা মন থেকে চান না যে প্রোটন চিরস্থায়ী একটা কণা হোক। কারণ প্রোটন অস্থায়ী হলে আমরা সেটা ব্যবহার করে আরও বড় একটা ধাঁধার সমাধান করতে পারব। তা হল, এই মহাবিশ্বে বস্তুর (matter) পরিমাণ প্রতিবস্তুর (antimatter) চেয়ে এত বেশী কেন? (এর গল্প বলতে আরেকটা গোটা লেখা লাগবে। তাই আপাতত চেপে যাচ্ছি। ব্যারিয়ন অপ্রতিসাম্য (Baryon asymmetry) গুগল করে দেখতে পারেন।) কোয়ার্ক বা ইলেক্ট্রনের মতো কণার ভর কোথা থেকে আসে তা কিন্তু এখনো বোঝা গেলো না। কণাপদার্থবিদরা সেই প্রশ্ন-ও করেছেন আর তার উত্তর-ও দিয়েছেন। এরা হিগস্ বোসনের সাথে ক্রিয়া করে ভর পেয়ে থাকে, কিন্তু কীভাবে, তার ব্যাখ্যা বেশ গভীর। সে বিষয়ে আমরা পরে কোন সময় আলোচনা করব।
টীকা:
[১] ফোটন-এর প্রকৃতি সম্বন্ধে আমরা একভাবে জানতে পারি। আশেপাশের যেকোনো বস্তুকে আমরা দেখতে পাই তার দুটো প্রধান কারণ: এক, ওই বস্তু থেকে যে ফোটনগুলো আসে তারা নিজেদের মধ্যে ক্রিয়া করে না। দুই, ফোটনগুলো নাইট্রোজেন বা অক্সিজেন পরমাণুর সাথেও ক্রিয়া করে না, কারণ সাধারণ উষ্ণতায় পরমাণু নিস্তড়িৎ। তার মানে কোনো বস্তু থেকে ফোটন প্রতিফলিত হয়ে আমাদের দিকে আসার পথে অন্য কোনোকিছুর সাথে ক্রিয়া করে না।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/fundamental-of-mass