21-12-2024 17:45:47 pm
Link: https://bigyan.org.in/firefly-synchronization
সুসংহতভাবে ছন্দবদ্ধ চলন, গমন বা অন্যান্য ক্রিয়াকলাপের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। এরই আরেক নাম হলো সমলয়ন (synchronization) — সম লয় অর্থাৎ সমান তালে অনেকে মিলে কিছু করা।
স্কুলে লেফ্ট-রাইট করা বা সমস্বরে প্রার্থনাসঙ্গীত গাওয়া থেকে শুরু করে অলিম্পিকের সমলয়িত সন্তরণ (synchronized swimming) – অনেক জায়গাতেই পরিবেশনকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায় এই সমলয়ন।
‘বনে একটা শেয়াল ডাকলে সব শেয়াল ডেকে ওঠে’ বা ‘অন্যকে হাই তুলতে দেখলে নিজেরও হাই ওঠে’ জাতীয় সরস জনশ্রুতির মধ্যেও লুকিয়ে আছে সমলয়নের ইঙ্গিত। প্রাণিজগতের মধ্যেও সমলয়নের উদাহরণের অভাব নেই। বর্ষায় ব্যাঙেদের সমস্বরে গ্যাঙোরগ্যাং করা বা কয়েক জায়গায় সন্ধেবেলা ঝোপেঝাড়ে জোনাকিদের সম্মিলিত আলোর ঝলকানি — অনেক কিছুতেই তার দেখা মেলে।
একটু ভাবলে বোঝা যায় যে প্রকৃতিতে বা প্রাণিজগতে সমলয়ন এক আশ্চর্য জিনিস। অলিম্পিক -এর সাঁতারুর দলের সমলয়িত সন্তরণ বা প্রজাতন্ত্র দিবসে সেনাদের কুচকাওয়াজের সমলয়ন তবু মানা যায়। এই দুটোই অনেকদিনের পরিশ্রমসাধ্য অনুশীলনের ফল। কিন্তু তা বলে জোনাকি? তাদের তো মানুষের মতো উন্নত চিন্তাশক্তিও নেই, বা কোনো সেনাপতিও নেই যে বলে দেবে ‘চলো নিয়ম মেনে’। ওদের ব্যাপারখানা তাহলে কী?
এমনিতে জোনাকিরা যে যার নিজেদের মতো মিটমিট করে জ্বলতে থাকে। প্রথমেই লক্ষ্য করার ব্যাপার হলো, ওরা মিটমিট করে জ্বলে, একনাগাড়ে নয়। জোনাকির আলো আসে তাদের দেহে ঘটা বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে। সেই বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন হয় অক্সিজেনের। তাই প্রতিবার আলো দেখানোর পর জোনাকিদের কিছু বিশ্রামের সময়ের (refractory period) দরকার হয়, একনাগাড়ে আলো দেখিয়ে যেতে পারে না। এই বিশ্রাম পর্বই ঠিক করে দেয় প্রতি মিনিটে একটা জোনাকি কতবার মিটমিট করবে, অর্থাৎ তাদের আলোর জ্বলা-নেভার কম্পাঙ্ক (frequency) কত হবে।
সমলয়ন দেখতে হলে এটাই একদম শুরুর শর্ত — একটা লয় থাকতে হবে। অর্থাৎ ঘটনাবলিতে সময়ের সাথে একটা পরিবর্তন হতে হবে (পরিবর্তনে একটা ছন্দ থাকলে অর্থাৎ একই সময় পর একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হলে আরো ভালো)। জোনাকি একনাগাড়ে জ্বললে সমলয়ন দেখা যেত না।
কিন্তু বনের জোনাকিরা নিজেদের নিজেদের মতো এভাবে মিটমিট করলে সেটা সমলয়ন হলো না। তাদের সবার জ্বলা-নেভার কম্পাঙ্ক কাছাকাছি হলেও জ্বলা-নেভার পর্যায় (phase) বিভিন্ন। এ যখন জ্বলতে শুরু করলো, ওর হয়তো বিশ্রামপর্বের শুরু। তাই তারা একসাথে মিটমিট করতে পারে না। সেটা কখন হয়? দেখা গেছে জোনাকিরা অন্যের আলো দেখলে নিজেদের আলোও দেখাতে চায়, অনেকটা সেই শেয়ালের ডাকের গল্পের মতোই। সেভাবেই হয় সমলয়নের সূচনা।
মিটমিট করা এক ঝাঁক জোনাকি কখন একসাথে সমলয়িত আলোর ঝলকানি দেখাতে পারে সেই নিয়ে মানুষের কৌতূহল অনেক দিনের। এ নিয়ে অনেক গাণিতিক কাজ আগে থেকে হয়ে থাকলেও জোনাকিদের ওপর উন্নতমানের পরীক্ষামূলক তথ্য পাওয়া গেছে মাত্র বছর দুয়েক আগে [1]। ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বোল্ডার-এর অধ্যাপক ওরিট পেলেগ এবং ওনার সহকর্মীরা মার্কিন যুক্তরাষ্টের টেনেসি (Tennessee) প্রদেশের জঙ্গলে Photinus carolinus বলে এক প্রজাতির জোনাকিদের হাবভাব ভিডিও ক্যামেরায় বন্দি করেছেন।
জোনাকিদের সেই ভিডিও রেকর্ডিং থেকে দেখা যাচ্ছে সন্ধের শুরুতে জোনাকিরা যে যার নিজেদের মতো মিটমিট করছে। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে যখন আরো অনেক জোনাকি ঝাঁক বাঁধছে, তখন ধীরে ধীরে তাদের আলোর পর্যায়গুলোও ক্রমশ সমলয়িত হয়ে যাচ্ছে। এভাবে ছোট ছোট জোনাকিদের মিটমিট করা আলোর বদলে সমগ্র বনব্যাপী এক উজ্জ্বল আলোর ছন্দময় ঝলকানি তৈরি হচ্ছে। কীভাবে তা সম্ভব?
আলো দেখানোর পর বিশ্রামকালে অন্য জোনাকিদের মিটমিট দেখলে একটা জোনাকির নিজেরও আলো দেখানোর প্রবৃত্তি জাগে। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব হয় যখন তাদের বিশ্রামপর্ব শেষ হয়েছে। এভাবে অন্যদের আলো দেখে নিজের বিশ্রামপর্ব শেষ হতেই আলো দেখাতে দেখাতে সব জোনাকিদের আলোর মিটমিট করার পর্যায় যেমন সমলয়িত হয়ে যায়, তেমন তাদের বিশ্রামপর্বগুলোও একইসাথে সমলয়িত হতে থাকে। যতক্ষণ তা না হচ্ছে, ততক্ষণ বিশ্রামরত জোনাকিরা সমলয়নের আসরে যোগ দিতে পারছে না, সমলয়নও সম্পূর্ণ হচ্ছে না। কবিগুরুর ভাষায়—‘পশ্চাতে রেখেছো যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’
সমলয়নের প্রথম শর্ত দেখা যায় জোনাকিদের এই আচরণ থেকেই — এক তালে ঐক্যবদ্ধ হতে গেলে একে অন্যের সঙ্গে কোনো ধরনের আন্তঃক্রিয়া (interaction) প্রয়োজন। জোনাকিদের একে অপরের আলো দেখে নিজে আলো দেখানোর সহজাত ক্ষমতাই এক্ষেত্রে আন্তঃক্রিয়ার উৎস। এই আন্তঃক্রিয়া যখন যে যার নিজেদের মতো মিটমিট করার ইচ্ছের থেকে বেশি জোরালো হয়, তখনই সমলয়ন ঘটে।
এ ব্যাপারে আরো বিশদ জানতে ওরিট পেলেগ-এর দল অন্ধকার তাঁবুতে গুটিকয়েক জোনাকি ছেড়ে বিভিন্ন কম্পাঙ্কে মিটমিট করা কৃত্রিম আলো দেখিয়ে তাদের হাবভাব লক্ষ্য করেছেন। সন্ধেবেলার জঙ্গলে জোনাকিদের ক্যামেরাবন্দি করার অনেক অসুবিধে, তাই এবার নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গবেষণার শুরু। সমলয়নের জন্যে প্রয়োজনীয় আন্তঃক্রিয়া এবং কোন কোন পরিস্থিতিতে সমলয়ন হয় সেসব আরো ভালো করে বোঝাই এই গবেষণার উদ্দেশ্য।
এই গবেষণার উদ্দেশ্যে ওনারা সাধারণ নাগরিকদেরও সাহায্য নিতে চান। যদি আপনার চারিপাশে জোনাকির ঝাঁকের এই ঝলকানি দেখে থাকেন, তাহলে আপনি ওনাদের খবর দিতে পারেন। ওনারা আপনাকে GoPro ক্যামেরা পাঠিয়ে দেবেন জোনাকির এই ঝলকানি রেকর্ড করতে [2]। বিভিন্ন প্রজাতির জোনাকির মধ্যে কী রকম আচরণ দেখা যায়, তা লিপিবদ্ধ করাই ওনাদের উদ্দেশ্য। হয়তো সব প্রজাতির মধ্যে এই সমলয়ন দেখা যায় না। না গেলে কেন যায় না, সেই প্রশ্নও করা যেতে পারে।
সমলয়নের নিয়মাবলি ভালো ভাবে বুঝতে পারলে অনেক ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ইচ্ছেমতো সমলয়নকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ থাকে। তাতে অনেক লাভ আছে।
দুটো উদাহরণ হলো – আকাশে অনেক ড্রোনের (drone) গতিবিধির সমলয়ন এবং ছোট ছোট রোবটদের সমলয়ন। দুটোর সাহায্যেই দূর থেকে মানুষের নির্দেশ ছাড়া কোনো কিছুর পরিবহণ বা বন্যা-আক্রান্ত এলাকার মত দুর্গম জায়গায় উদ্ধারকাজ চালানোর সম্ভাবনা আছে। এসব কাজ সাধারণত অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষের শৃঙ্খলাবদ্ধ সহযোগিতার মাধ্যমে হয়ে থাকে। দূর থেকে যান্ত্রিকভাবে করতে চাইলে যন্ত্রদের বা যন্ত্রাংশদের মধ্যে সমলয়নের প্রয়োজন।
কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সমলয়ন যে সবসময় ভালো তা কিন্তু নয়। এর উদাহরণ দেখা গেছিল ২০০০ সালে লন্ডনে টেমস নদীর ওপর মিলেনিয়াম ব্রিজ উদ্বোধনের সময়।
দেখা যায় পথচারীরা ব্রিজে উঠতেই ব্রিজটি দুলতে শুরু করেছে। বড় দুর্ঘটনা এড়াতে তড়িঘড়ি তখন ব্রিজটিকে জনসাধারণের জন্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়। গবেষণায় দেখা যায় জোনাকিদের আলোর মতো ব্রিজের ওপরে পথচারীদের পদক্ষেপও সমলয়িত হতে থাকে এবং ব্রিজের ওপরে অনেক মানুষের সেই সমলয়িত পদক্ষেপের কারণে ব্রিজটি দুলতে শুরু করে। এক্ষেত্রে আবার পদক্ষেপের সমলয়নের জন্যে প্রয়োজনীয় আন্তঃক্রিয়াও ঘটে ব্রিজের দোলনের মাধ্যমেই। এভাবে ব্রিজের দোলন এবং তার ওপরে পথচারীদের সমলয়ন একে অপরকে পুষ্ট করতে থাকে।
মিলেনিয়াম ব্রিজের পথচারীদের এই সমলয়নের সাথে জোনাকিদের সমলয়নের একটা মিল হলো যে দুই ক্ষেত্রেই একজন দু-জন পথচারী বা জোনাকি থাকলে তাদের মধ্যে সমলয়ন হয় না। যখন অনেকে একসাথে পথে নামে, তখন তাদের মধ্যে আন্তঃক্রিয়াও অনেক বেড়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। ফলে, তাদের মধ্যে সমলয়নও অনেক সহজ হয়ে যায়।
বিবিধ পরিস্থিতিতে সমলয়ন দেখা গেলেও তাদের সকলের পিছনেই কিছু মূল শর্ত রয়েছে। তাই জোনাকিদের ওপর সহজ পরীক্ষানিরীক্ষা করে যা জানা যায়, তা একদিন ব্রিজ বা ড্রোনের নকশা তৈরিতেও হয়তো কাজে লাগতে পারে। প্রাকৃতিক ঘটনাবলির প্রতি কৌতূহল থেকে উঠে আসা বিজ্ঞান সরাসরি ব্যবহারে লাগছে, তার উদাহরণ খুঁজতে হলে তাই সমলয়নের দিকেই তাকাতে হয়।
সমলয়ন সম্পর্কে আরো বিশদে জানতে হলে নিচের ভিডিওটি দেখুন।
(Cover image credit — BBC America)
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[1] R. Sarfati, J. C. Hayes, and O. Peleg, Self-organization in natural swarms of Photinus carolinus synchronous fireflies. Science Advances, Vol 7, Issue 28, 7 Jul 2021 (link)
[2] Mathew L. Miller, Want To Help Researchers Understand Fireflies?, Nature Conservancy blog (link)
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/firefly-synchronization