21-11-2024 08:35:24 am
Link: https://bigyan.org.in/firefly-mechanism-03
বিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে জোনাকির আলোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা যায়? পরিবেশ দূষণের সাথেই বা জোনাকির আলোর কী সম্পর্ক?
আগের পর্বে (জোনাকি আলোকে ২) জোনাকির আলোর রাসায়নিক কারণ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এবার আসি আমার দ্বিতীয় প্রশ্নে। অর্থাৎ, জোনাকির বিবর্তনে এবং বংশ বিস্তারে এই আলোক সংকেতের কোন গ্রহণযোগ্য কারণ আছে কি ?
খুব স্বাভাবিক ভাবেই তোমরা উৎসুক হবে যে এই আলোর সংকেতের উদ্দেশ্যটা ঠিক কি ?
বিবর্তনের উপর কয়েকটি কথা
তোমরা যারা স্কুলে পড়ছো তাদের একটা কথা বলি। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী থিয়ডোসিয়াস ডোবঝান্সকি বলেছিলেন, “বিবর্তন প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে জীববিদ্যায় কোন ব্যাখ্যাই অর্থবহ হয় না” ( “Nothing in Biology Makes Sense Except in the Light of Evolution”)। তাই জীববিজ্ঞানে যখনই কোন জীবের অস্তিত্ব সংক্রান্ত প্রশ্ন মাথায় আসবে তখন বিবর্তন তত্ত্বটি মাথায় রাখবে। বেশ কিছু উত্তর পাবে, আবার কখনো কখনো অতিরিক্ত জটিলতার কারণে অনেক উত্তর পেতে বেশ বেগ পেতে হবে বা যুক্তিযুক্ত উত্তর পাবেই না হয়তো। কথা হচ্ছিল জোনাকি নিয়ে, হঠাৎ এসব খটমট কথা কেন ? ধীরে ধীরে সে প্রসঙ্গে যাবো, তবে তার আগে বরং তোমাদের দিকে কয়েকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই! খুব সাধারণ প্রশ্ন, যার বেশ কিছু উত্তর বিজ্ঞানীরা দিতে পেরেছেন আবার কিছু পারেন নি এখনও পর্যন্ত। যেমন সাদা ফুল কেন রাতে ফোটে ? জোনাকি কেন রাতে আলো দেয় ? ঝিঁঝিঁ কেন শব্দ করে ? ময়ূরের পেখম অত উজ্জ্বল এবং বড় কেন ? কারোর কাছ থেকে না শিখেই মাকড়শা নিজে নিজেই কেমন করে তার জাল বানাতে পারে ? গিরগিটি কেন রং বদলায় ? ইত্যাদি। বেশিরভাগ প্রশ্নেরই উত্তর লুকিয়ে রয়েছে বিবর্তনের পাতায়। তাই জোনাকির আলো প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু বিবর্তনের কয়েকটা উল্লেখযোগ্য কথা বলি।
“বিবর্তন প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে জীববিদ্যায় কোন ব্যাখ্যাই অর্থবহ হয় না” – থিয়ডোসিয়াস ডোবঝান্সকি
বিবর্তনের সময়ের নিরিখে কোন জীবের অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে গেলেই প্রথম যে দিকে নজর দিতে হয় সেটা হল তারা বংশবিস্তারে কতটা সক্ষম। যে কোন প্রজাতির জীব গোষ্ঠীরই বংশবিস্তারের সাফল্যে কোন না কোন উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য থাকে যার ফলে তারা অন্যান্য প্রতিযোগী তুল্য-প্রজাতির জীবের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের জৈবিক অস্তিত্বকে আরো সবল করে তোলে। অনেক ক্ষেত্রেই বিবর্তন তত্ত্ব বোঝার বা ব্যাখ্যার জন্য জনন বিশেষ এক চাবি কাঠি, জননের সাফল্য (অনেক সময় অস্তিত্বের সাফল্য) প্রত্যক্ষও হতে পারে কিংবা পরোক্ষ (টীকা -১)। আরো একটু যদি গভীরে যাই তা হলে দেখবো অনেক প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে জননের (জোর দিয়ে বললে যৌন জনন) আগে মহিলা-পুরুষ নিজেদের মধ্যে কিছু মিলন সংকেতের (mating signal) মাধ্যমে ভাব আদান প্রদান করে, পরস্পর সন্তুষ্ট হলে হয় মিলন, ফল বংশবিস্তার। জীবজগতে এই মিলন সংকেত নানা রকমের এবং বড়ই বৈচিত্র্যময়। মিলন সঙ্গী (বা সঙ্গিনী) পরস্পরকে প্রভাবিত করতে কি রকম সংকেত দেয় তার একটা বড় উদাহরণ ময়ূরীর সামনে পেখম মেলে ময়ূরের নাচ।
জোনাকির আলো – মিলন সংকেত!
এবার আশা রাখি তোমরা জোনাকির আলোর আর একটা কারণ আন্দাজ করে ফেলেছো। হ্যাঁ, জোনাকির এই আলো আসলে মেটিং সিগন্যাল। মহিলা জোনাকিরা ঝোপের নিচে মাটিতে বসে থাকে আর পুরুষ জোনাকিরা উড়তে উড়তে আলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে মহিলাদের সংকেত পাঠায়। মহিলা জোনাকির কোনো পুরুষের সংকেত পছন্দ হলে একই রকম ছন্দ ও তীব্রতার আলো ছেড়ে তাকে মিলনের বার্তা দেয়। জোনাকির আলোর রং, আলোর স্পন্দন, তীব্রতারও অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে। এতো রকমফের থাকা সত্ত্বেও নিজের নিজের প্রজাতিকে চিনে নিতে জোনাকিরা ভুল করে না। এ প্রসঙ্গে বলি শুধু মাত্র পূর্ণাঙ্গ জোনাকিই আলো ছাড়ে তা নয়, তাদের ডিম, লার্ভা থেকেও আলো বের হয়। পতঙ্গভুক খাদকদের মুখে জোনাকির দেহ মোটেই সুস্বাদু নয় তাই ওই আলো সতর্কবার্তার মতোও কাজ করে, ফলে খাদকদের হাত থেকে বেঁচে থাকতে বেশ সুবিধে হয়। বেশ অবাক করা ব্যাপার তাই না ?
মহিলা জোনাকিরা ঝোপের নিচে মাটিতে বসে থাকে আর পুরুষ জোনাকিরা উড়তে উড়তে আলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে মহিলাদের সংকেত পাঠায়।
শহরে জোনাকিরা হারিয়ে গেল কেন?
এবার আমি আমার একটা অভিজ্ঞতা তোমাদের কাছে বলি। আমি কলকাতার মূল শহরে কোন দিন জোনাকি দেখি নি, দেখেছি আমাদের মফঃস্বলের বাড়িতে। স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে দেখলাম শেষ জোনাকি দেখেছি প্রায় বছর পনেরো আগে। আমার কাছে এ এক বহুদিনের রহস্য, জোনাকিরা হারিয়ে গেল কেন? ঠিক কি ধরনের দূষণের জন্য জোনাকিরা তাদের অস্তিত্ব হারাচ্ছে? কীটনাশক, বায়ু দূষণ ছাড়া আর কোনো দূষণের কথা মাথায় আসেই নি। জোনাকি নিয়ে পড়তে গিয়ে জানলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোকদূষণ [১]। এই আধুনিক যুগে আজ সব জায়গাতেই বৈদ্যুতিক আলোতে ভরে গেছে, এতে আমাদের সুবিধে যে হয়েছে সেটা অনস্বীকার্য কিন্তু জোনাকিদের ক্ষেত্রে তা তাদের অস্তিত্ব সংকটে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে বৈদ্যুতিক আলোর তীব্রতার কারণে জোনাকিদের নিজেদের মধ্যে সংকেতের আদান-প্রদান বিঘ্নিত হচ্ছে ফলে সমস্যা ঘটছে প্রজননে এবং বংশবিস্তারে।
সব কিছু ছাড়িয়ে ক্ষণিকের মধ্যে জোনাকি বদলে দিয়েছে কোন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস !
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ” । জোনাকি সাহিত্যে এসেছে বার বার, সে দেশেই হোক বা বিদেশে। জীববিদ্যার গবেষণায় জোনাকির অবদান অনস্বীকার্য [২]। কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে ক্ষণিকের মধ্যে জোনাকি বদলে দিয়েছে কোন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস [৩]! ১৬৩৪ সাল, ব্রিটিশ নৌবাহিনী ভেসে চলেছে কিউবায় ঘাঁটি গাড়বে বলে। তীরে পৌঁছানোর আগে নৌবাহিনী দেখলো কিউবার দিক থেকে ভেসে আসছে প্রবল আলো, অনেকটা ঝলকানির মতো। ব্রিটিশ সৈন্যরা ভাবলো স্প্যানিশ নৌবাহিনী তাদের আগেই কিউবা দখল করে বসেছে, ওই আলো বোধ হয় স্প্যানিশদের সৈন্য শিবির থেকেই আসছে। কিন্তু ইতিহাস বলে ওই সময় কিউবায় কোনো স্প্যানিশ বাহিনী ছিল না। ব্রিটিশরা অধিকসংখ্যক জোনাকির আলোকে ভুল করেছিল স্প্যানিশ অধিকৃত যুদ্ধ শিবিরের আলো ভেবে, তাই তারা আর কিউবার দিকে এগোয় নি [৩]!
টীকা ১ : “জননের সাফল্য (অনেক সময় অস্তিত্বের সাফল্য) প্রতক্ষও হতে পারে কিংবা পরোক্ষ” একটু জটিল বিষয়। বোঝার সুবিধার্থে ‘বিজ্ঞান’-এ পূর্বে প্রকাশিত কয়েকটা লেখা পাঠককে পড়তে অনুরোধ করবো।
লেখাগুলি হ’ল, পেখম রহস্য, ছদ্মবেশী, কাটা গাছে রসের ফোঁটা ।
প্রচ্ছদের ছবির উৎস: http://blog.arkive.org/tag/adaptation/
লেখকের পক্ষ থেকে স্বীকারোক্তি: জোনাকি নিয়ে গবেষণার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই। জোনাকি সম্বন্ধে জানতে গিয়ে আমি বিস্মিত হয়েছি তাই কলম ধরেছি যদি সেই আনন্দ কিঞ্চিৎ ভাগ করে নেওয়া যায়। এ লেখার উৎসাহ পেয়েছি মার্ক জিমারের লেখা গ্লোয়িং জিন্স : অ্য রিভলুশন ইন বায়োটেক্নলজি [৪, ৫] , পদক্ষেপ স্বেচ্ছাসেবীর লেখা জোনাকি আলোকে এবং জি কে ভি কে, ব্যাঙ্গালোরের জ্বলন্ত জোনাকিদের কাছ থেকে, যারা মনের মধ্যে উস্কে দিয়েছে অনেক অনেক প্রশ্ন।
লেখকের পক্ষ থেকে বিশেষ ধন্যবাদ ‘বিজ্ঞান’-এর সম্পাদকদের প্রতি, যারা লেখাটির মূল্যায়ন ও পরিমার্জনে সহযোগিতা করেছেন।
বিশদে জানতে :
[২] Role of Nitric Oxide and Mitochondria in Control of Firefly Flash
[৩] www.firefly.org/
[৪] Glowing Genes: A Revolution In Biotechnology[৫] Review on Glowing Genes: A Revolution in Biotechnology
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/firefly-mechanism-03