30-10-2024 12:34:37 pm
Link: https://bigyan.org.in/earwig-birth-cycle
মাছের ঘুম সমন্ধ কয়েকটি তথ্য নির্ধারণের জন্যে রাতের অন্ধকারে একবার কতকগুলি পরীক্ষা চালাতে হয়েছিল। পরীক্ষাগারের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের সম্মুখে রাতের বেলায় একদিন কিছুক্ষণের জন্যে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে কাজ করছিলাম। আলোর ঔজ্জ্বল্যে আকৃষ্ট হয়ে বিচিত্র আকৃতির রকমারি পোকা এসে টেবিলের উপর পড়তে লাগলো। তার মধ্যে অতি ক্ষুদ্র আকৃতির গঙ্গাফড়িঙের মতো কয়েকটি বাদামী রঙের পোকার অপূর্ব অঙ্গভঙ্গি এবং মস্তক-সঞ্চালন লক্ষ করছিলাম। ইতিমধ্যে কয়েক জাতীয় ক্ষুদে জল-পোকাকেও আলোটার চতুর্দিকে লাফালাফি করতে দেখলাম। জল-পোকাগুলি যদিও আমার অপরিচিত নয়, তথাপি তারা যে কেমন করে টেবিলটার উপরে উঠে আসলো, ভেবে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আলোর চতুর্দিকে পোকাগুলির গতিবিধি লক্ষ করছি, এমন সময় সাঁড়াশীর মতো লেজওয়ালা একটা অদ্ভুত আকৃতির পোকা এসে টেবিলের উপর পড়ল! এর শরীরে যে কোনও রকমের ডানার অস্তিত্ব আছে তা বুঝতেই পারা যায় না। কেমন করে পোকাটা টেবিলের উপর এলো ? পোকাটা এত দ্রুতগতিতে ছুটাছুটি করছিল যে, ভাল করে তাকে লক্ষ করতেই পারছিলাম না। দেখতে দেখতে ঐরূপ আরও কয়েকটি পোকা এসে জুটলো। তাদের তড়িৎগতিতে ছুটাছুটি এবং অপূর্ব অঙ্গভঙ্গি দর্শনে কারও কৌতূহল উদ্রিক্ত না হয়ে পারে না। মাঝে মাঝে এরা পরস্পর ঝগড়াঝাঁটি করছিল, আবার কখনও কখনও ছুটে উধাও হচ্ছিল। এরা এমনই চঞ্চল যে এক মুহূতের্র জন্যেও কোন স্থানে একটু স্থিরভাবে থাকতে দেখলাম না। কেউ কেউ দেহের পশ্চাদ্ভাগের সাঁড়াশীটাকে পর্যায়ক্রমে প্রসারিত ও সংকুচিত করে অতি সর্পিল গতিতে যেন নৃত্যর ভঙ্গি প্রদর্শন করছিল।
এই পোকাগুলির সর্বশরীর প্রায় উন্মুক্ত; কিন্তু পিঠের ঠিক উপরিভাগে শক্ত খোলার মতো অতি ক্ষুদ্র দুটি আবরণী আছে। একটাকে ধরে তার পিঠের উপরের শক্ত খোলা দুটি প্রসারিত করে দেখলাম- সেগুলির নীচে প্যারাসুটের মতো ভাঁজ-করা দুটি চমৎকার ডানা আছে। বাইরে থেকে দেখে কিছু বুঝতে পারা না গেলেও এই ডানার সাহায্যই এরা অনেক দুর উড়ে যেতে পারে। এরা কিন্তু ফড়িং বা প্রজাপতির মত যতক্ষণ খুশি আকাশে বিচরণ করতে পারে না । এক স্থান থেকে নিকটবর্তী অন্য কোনও স্থানে যেতে হলে কিয়ৎকালের জন্য ডানা দুটিকে কাঁপিয়ে একটানা খানিকটা অগ্রসর হতে পারে মাত্র। তখন বুঝলাম – ডানায় ভর করেই এরা টেবিলের উপর উপস্থিত হয়েছিল। যাহোক, অনেকক্ষণ ধরে এদের গতিবিধি লক্ষ করবার কালে একসময় দেখলাম – একটা পোকা আলোটার খুব নিকটে এক স্থানে অনেকটা স্থিরভাবে অবস্থান করে যেন ডানার আবরণী দুটিকে অতি দ্রুতবেগে কাঁপাচ্ছে। আনন্দের আতিশয্যেই এরূপ করছে বলেই মনে হলো। পোকাটি থেমে থেমে এরূপ করছিল এবং মাঝে মাঝে এক একবার দ্রুতগতিতে চতুর্দিকে ঘুরে আসছিল। কেন এরূপ করছে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। অবশেষে অপেক্ষাকৃত বড় আর একটা পোকা ওর কাছে এসে ঘুরতে লাগলো। পোকাটা মাঝে মাঝে ডানাও কাঁপাচ্ছিল। খুব নিকটে কান পেতে শুনলাম – অতি অস্পষ্ট একপ্রকার ঝিরঝির শব্দ হচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ লক্ষ করবার পর বুঝতে পারলাম – এইটাই তাদের মিলনের পূর্বরাগ। যাহোক, এতগুলি কীট-পতঙ্গের মধ্যে এই পোকাগুলির অপূর্ব চঞ্চল গতিভঙ্গিতে যেন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কাজেই এদের জীবনযাত্রা -প্রণালীর বিষয় অবগত হবার জন্য আগ্রহান্বিত হওয়া স্বাভাবিক। এই উদ্দেশ্যে কয়েকটি পোকা ধরে বিশেষভাবে নির্মিত কাচপাত্রে আবদ্ধ করে রাখলাম। পরের দিন সুবিধেমতো স্থানে রেখে সেগুলিকে প্রতিপালন করতে লাগলাম। এদের জীবনযাত্রা-প্রণালীর মধ্যে সন্তানবাৎসল্য এবং তাদের প্রতি-পালন ব্যবস্থাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সম্বন্ধে আলোচনা করার পূর্বে এই পোকাগুলির মোটামুটি পরিচয় প্রয়োজন।
এই পোকাগুলি আমাদের দেশে সাধারণত কানকোটারী নাম পরিচিত। কানকোটারীর শরীর অনেকটা লম্বাটে গোছের সরু এবং মৃসণ। দেখতে কতকটা ডানা ও পিছনের মোটা ঠ্যাং -শূন্য উইচিংড়ির মতো। মাথার সম্মুখভাগে ছোট ছোট দুটি শুঁড় আছে। শুঁড় দুটি বিভিন্ন খণ্ডে সংযুক্ত। বুকের পিছনে শরীরের বাকি অংশ অঙ্গুরীর মতো বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত। লেজের প্রান্তভাগে ঠিক সাঁড়াশীর মতো একটি অদ্ভুত যন্ত্র আছে। এই সাঁড়াশীর মতো যন্ত্রটাই এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। পিঠের উপর উভয় দিকে খুব ছোট ছোট দুটি শক্ত খোলার মতো আবরণী আছে। ক্ষুদ্র ডানা দুটি এরই নীচে ভাঁজ করা থাকে। কয়েক জাতীয় কানকোটারীর আবার মোটেই ডানা থাকে না। কানকোটারী সম্মন্ধে সাধারণ লোকের একটা অদ্ভুত ধারণা আছে। এরা নাকি সুবিধে পেলেই মানুষের কানের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং সাঁড়াশীর সাহায্যে কর্ণপটাহ কুরে কুরে খায়। আবার অনেকে বলে, এরা পত্র-পল্লবের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এবং সুবিধামত মানুষের গায়ের উপর পড়ে সাঁড়াশীর দ্বারা ক্ষত উৎপন্ন করে দেয়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এই সকল ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। এগুলিকে অতি নিরীহ প্রাণীই বলা যেতে পারে। এরা কা’কেও কামড়ায় না বা দংশন করে না। নিরীহ প্রাণী হলেও ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেকেই এদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। ডালিয়া , ফ্লকস , কারনেশন এবং অন্যান্য বাহারে ফুলের পাপড়ি এবং বিভিন্ন জাতীয় ফলমূল অনেক সময়ে পোকায় কেটে নষ্ট করে ! বাগানের মালিদের জিজ্ঞেস করলে তারা একবাক্যে বলবে যে এটা কানকোটারীর-ই কাজ। কানকোটারীই ফুলের পাপড়ি কেটে এবং ফুলের গায়ে ছিদ্র করে অনিষ্ট করে থাকে। প্রমাণ স্বরূপ তারা হয়তো দু-একটা ফুল ঝেড়ে তা থেকে দু – একটা কানকোটারী বের করে দেখাবে অথবা কোনো ফলের গায়ে ছিদ্র থেকে দু-একটা কানকোটারী বের করে দেখাতে পারে। কিন্তু এ থেকেই এ কথা প্রমাণ হয়না যে, এরাই ফলের গায়ে ছিদ্র করে থাকে অথবা ফুলের পাপড়ির অনিষ্ট সাধন করে থাকে। এগুলিকে ফলের গায়ের ছিদ্রের মধ্যে অথবা ফুলের পাপড়ির মধ্যে দেখতে পাওয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু সেজন্য এরা সত্য সত্যই কোনোও ফল-ফুলের অনিষ্টসাধন করে না। কানকোটারী রাত্রিচর প্রাণী। দিনের বেলায় এরা গর্তের মধ্যে বা কোনও কিছুর আড়ালে আত্মগোপন করে থাকে এবং রাতের বেলায় আহারান্বেষণে বহির্গত হয়। কাজেই এদের ফুলের পাপড়ির আড়ালে অথবা ফলের গায়ে গর্তের মধ্যে অনেক সময় দেখতে পাওয়া যায়। অন্যান্য পোকারা ফুলের পাপড়ি কেটে বা ফলের গায়ে ছিদ্র করে চলে যায়। সেই সকল ছিদ্রে অথবা কীটদষ্ট ফুলে কানকোটারীরা আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এ থেকেই কানকোটারীর সম্মন্ধে ভ্রান্ত ধারণার উদ্ভব হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে এরা কিন্তু গাছপালার পক্ষে অনিষ্টকারী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ উদরসাৎ করে আমাদের যথেষ্ট উপকারই করে থাকে। এদের পেট চিরে মাইক্রোস্কোপের নীচে পরীক্ষার ফলে দেখা গেছে তাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গাছ-উকুন ও শোঁয়াপোকা, শ্যামাপোকা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুগলি প্রভৃতি নানা জাতীয় প্রাণীর দেহাবশেষ রয়েছে। তাছাড়া এদের পেটের মধ্যে বেশির ভাগই অনিষ্টকারী কীট-পতঙ্গের ডিম পাওয়া যায়। অবশ্য সুযোগ পেলে তারা স্বজাতীয়দের ডিম উদরসাৎ করতেও কিছুমাত্র ইতস্তত করে না। এরা কীট-পতঙ্গভোজী হলেও ফুল-ফল প্রভৃতি উদ্ভিজ পদার্থ যে একেবারে স্পর্শ করে না, তা নয়। যখন গাছ-উকুন বা অন্যান্য অনিষ্টকারী কীট-পতঙ্গ নিঃশেষিত হয়ে যায় তখন খাদ্যাভাবে এরা পাকা ফলের রস, ফুলের পাপড়ি বা কচিপাতা প্রভৃতি খেয়ে উদর পূরণ করে।
আমাদের দেশে ছোট-বড় কয়েক জাতীয় কানকোটারী দেখতে পাওয়া যায়। স্ত্রী এবং পুরুষ উভয়েরই লেজের দিকে সাঁড়াশীর মতো একজোড়া সুতীক্ষ্ণ অস্ত্র থাকে। সাঁড়াশীর আকৃতির পার্থক্য দেখে স্ত্রী-পুরুষ কানকোটারী চিনতে কিছুমাত্র অসুবিধে হয় না। স্ত্রী-কানকোটারীর সাঁড়াশীর মুখ দুটি প্রায় সরলভাবে এবং পরস্পর গাত্রসংলগ্নভাবে অবস্থান করে। কিন্তু পুরুষ পোকাদের সাঁড়াশী দেখতে অবিকল বেড়ী বা বাউলির মতো। পুং-পোকাদের এই বেড়ীর অগ্রভাগ দুটি পরস্পর সংলগ্ন হলেও মধস্থলে গোলাকার ফাঁক থেকে যায়। বিবর্তনের দিক থেকে দেখলে কোন বিশেষ উদ্দ্যেশে দেহের পশ্চাদ্ভাগে এই অদ্ভুত অস্ত্রটির উদ্ভব ঘটেছিল , তা পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় না। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে কদাচিৎ এর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। কাঁকড়া বা চিংড়ির দাঁড়ার মত আহারসংগ্রহে ব্যবহৃত হলেও এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হতো। পূর্বেই বলেছি , পিঠের উপর এদের ডানা মেলবার পর পুনরায় যথাস্থানে ভাঁজে ভাঁজে সন্নিবেশিত করা কষ্টকর ব্যাপার; সাঁড়াশীর সাহায্যেই এরা ডানা গুটিয়ে যথাস্থানে সন্নিবেশিত করতে পারে। কিন্তু এই ধারণা ভিত্তিহীন। কারণ কয়েক জাতীয় কানকোটারীর মোটেই ডানা নেই অথচ প্রত্যেকেরই সাঁড়াশী আছে। তবে পোষবার সময় দেখেছি – যখন ডিম আগলে বসে থাকে, তখন কোনো কিছুর সাহায্যে শরীর স্পর্শ করলে শরীরের পশ্চাদ্ভাগ ঘুড়িয়ে সাঁড়াশীর সাহায্যে তাকে চেপে ধরে।
শীতের সময় অধিকাংশ পোকামাকড়ই কম-বেশী নিশ্চেষ্টভাবে অবস্থান করে। অনেকে আবার সারা শীতকালই ঘুমন্ত অবস্থায় কাটিয়ে দেয়। কানকোটারী শীতের সময় কেবল ঘুমিয়ে কাটালেও অনেকটা নিশ্চলভাবে অবস্থান করে। গ্রীষ্মের প্রারম্ভেই এদের যৌন-মিলন সংগঠিত হয়। যৌন-মিলনের পর এরা কোনও সুবিধাজনক গর্ত বা ইট-কাঠ প্রভৃতির নিচে একবারে ত্রিশ-চল্লিশটি ডিম পাড়ে। কোনও কোনও জাতির কানকোটারীর শীতের সময়ই যৌন-মিলন ঘটে থাকে। কিন্তু তারা ডিম পারে শীতের অবসানে। এদের ডিম পাড়বার ব্যাপারটা অনেকটা রানী মৌমাছির মতো। ডিমগুলি সম্পূর্ণ গোলগাল নয়। বিশেষভাবে লক্ষ করলে ডিমে রামধনুর মত রঙের আভা দেখতে পাওয়া যায়। কীট-পতঙ্গের মধ্যে দেখা যায় – তারা সাধারনত ডিম পেড়েই খালাস। মা তার ডিমের মটেই তদারক করে না। অনেকে ডিম পেড়ে বাচ্চাদের আহারের জন্য প্রচুর খাদ্য সঞ্চিত করে রাখে। অনেকে আবার বাচ্চার আহার্যোপযোগী গাছ-পালা বা প্রাণীদেহে ডিম পেড়ে যায়। যেমন মৌমাছি , পিঁপড়ের বাচ্চারা আগাগোড়া ধাত্রীর সাহায্যে প্রতিপালিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশীয় মৎস্যশিকারী মাকড়সা শতাধিক বাচ্চা পিঠে নিয়ে ইতস্তত ভ্রমণ করে থাকে। কাঁকড়া-বিছারাও বাচ্চাগুলি বড় না হওয়া অব্দি সেগুলিকে পিঠে নিয়ে বেড়ায়। তাছাড়া কতকগুলি প্রাণী বাচ্চাদের কাছে থেকে অনবরত তাদের তদারক করে থাকে। আমাদের দেশে আড় মাছ, শোল মাছ যেমন অনবরত সঙ্গে থেকে তাদের বাচ্চাগুলির রক্ষনাবেক্ষণ করে, কানকোটারীর সন্তান-বাৎসল্যাও তদনুরূপ। ডিম পাড়বার সময় থেকে আরম্ভ করে স্ত্রী-পোকাটা পারতপক্ষে তাদের ছেড়ে কোথাও যায় না। যখন খাদ্যসংগ্রহ করতে বের হয়, তখনও মাঝে মাঝে গর্তে ফিরে ডিমগুলিকে দেখে যায়। কিন্তু নেহাৎ অসুবিধায় না পড়লে এ সময়ে খাদ্য সংগ্রহে বহির্গত হয় না। মাটির মধ্যে সাধারণ গর্তের মতো একটি স্থানে ডিমগুলিকে একত্রিত করে শরীরের সম্মুখভাগ এবং সম্মুখের পায়ের সাহায্যে সেগুলিকে আবৃত করে রাখে। ঐ সময়ে শরীরের পশ্চাদ্ভাগের সাঁড়াশী ও পা দুটিকে উঁচু করে এমনভাবে অবস্থান করে যে, কোনও শত্রুর পক্ষে গর্তে ঢুকে কিছু অনিষ্টসাধন করা অসম্ভব ! তাছাড়া শত্রুকে আঘাত করবার জন্য ডিম পাড়বার পর তারা আর একটি অদ্ভুত উপায় অবলম্বন করে। মুষ্টিযোদ্ধারা লড়াই করবার সময় যেমন চামড়ার ভারী দস্তানা ব্যবহার করে, এরাও সেরূপ পিছনের পা দুটির প্রান্তভাগে কাদা জমিয়ে পুরু দস্তানা তৈরি করে নেয়। কাদা শুকিয়ে পা দুখানি ঠিক শক্ত মুগুরের আকৃতি ধারণ করে। এই অবস্থায় চলবার সময় কানকোটারী তার সম্মুখের পা মাত্র ব্যবহার করে। পিছনের পা দুটি ভারী বস্তুর মত ঘোষড়ে চলতে থাকে। এই সময় ডিম বা কানকোটারীর শরীর স্পর্শ করলেই দেখা যাবে সে তার মুগুরের মতো পায়ের সাহায্যে ঝটকা আঘাত করে শত্রুকে হটিয়ে দিতে চাইছে। কাজেই এরা যে ডিম রক্ষা করবার জন্য পা দুখানিতে এরূপভাবে ইচ্ছামত কাদা মাখিয়ে নেয় সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। সময় সময় কোনও পায়ের কাদার আবরণ ভেঙে গেলে পুনরায় জুড়ে নিতে দেখা যায়। পিপেটের সাহায্যে দুই পায়ের কাদার ডেলার উপর দু-এক ফোঁটা জল নিক্ষেপ করে দেখা গেছে মাটি ভিজে কাদার ডেলা ক্রমশ গলে গেলে পুনরায় দু-একদিনের মধ্যেই পা দুটিকে মুগুরের মতো করে নিয়েছে ! ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার কিছুকাল পরে কানকোটারী পায়ে আর মাটির প্রলেপ রাখে না।
পনেরো-ষোলো দিন পরে কানকটারীর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। এই কয়দিন তার আর অবসর থাকে না। সর্বদাই ডিম তদারক করে। ডিমগুলিকে প্রায়ই একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে সরিয়ে রাখে। একপ্রকার আঠালো পদার্থের সাহায্যে ডিমগুলি গায়ে গায়ে লেগে থাকে। একসঙ্গে সংলগ্ন এরূপ অনেকগুলি ডিমকে কানকোটারী চোয়ালের সাহায্যে প্রথমে স্থানান্তরিত করে। পরে এসে বিক্ষিপ্ত ডিমগুলিকে সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। যখন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে শুরু করে, তখন কানকোটারী অতি ব্যস্ত হয়ে উত্তেজিতভাবে ডিমগুলির মধ্যে কখনও মস্তক প্রবেশ করিয়ে কখনও বা শুঁড় দিয়ে বাচ্চাগুলিকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। প্রায় ঘন্টাখানেক সময়ের মধ্যেই মায়ের চতুর্দিকে সম্পূর্ণ সাদা রঙের কালো চোখ বিশিষ্ট চল্লিশ -পঞ্চাশটি বাচ্চা মাছির মতো কিলবিল করতে থাকে। মা তাদের জন্য নতুন গর্ত করে সেখানে তাদের রাখবার ব্যবস্থা করে। মা যেদিকে তাদের নিয়ে যেতে চায়, তারা যেন কী ইঙ্গিত পেয়ে সে দিকেই যেতে থাকে। মুরগির বাচ্চাগুলিকে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে অনেকেই দেখেছেন। মা যেখানে থাকে, তার আশেপাশে ঘুরেফিরে তারা আহার সংগ্রহ করে; কিন্তু কোনও প্রকার বিপদের সম্ভাবনা দেখলে মুরগী এক প্রকার শব্দ করলেই বাচ্চাগুলি ছুটে এসে মায়ের ডানার নীচে আশ্রয় গ্রহণ করে। বিপদের ভয় কেটে গেলেই মা বাচ্চাগুলে পুনরায় যথেচ্ছ বিচরণ করতে দেয়। কানকোটারী মুরগী অপেক্ষা নিমস্তরের প্রাণী হলেও বাচ্চাগুলিকে রক্ষনাবেক্ষণের ব্যাপারে কোন অংশেই উন্নততর প্রাণী অপেক্ষা হীন বলে মনে হয় না। কোনরূপ বিপদের সম্ভবনা দেখলেই বাচ্চাগুলি ইতস্তত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকলেও কী যেন একটা সংকেত পেয়ে মায়ের চতুর্দিকে একত্রিত হয়ে একেবারে নিশ্চলভাবে অবস্থান করে। এতগুলি বাচ্চা যে কিভাবে এরূপ শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। বোধ হয় বাচ্চাগুলি একে অন্যের শুঁড়ে শুঁড় স্পর্শ করে বিপদের সংকেত জানিয়ে দেয়। বিপদ কেটে গেলে পুনরায় নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যেই ইতস্তত বিচ্ছিন্নভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকে ! পূর্বেই বলেছি, বাচ্চাগুলি বের হবার পর সম্পূর্ণ সাদা থাকে ; কিন্তু ধীরে ধীরে দেহের রং পরিবর্তিত হয়ে গাঢ় বাদামী বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। ডিম থেকে বহির্গত হবার পনের-ষোল দিন পর বাচ্চাগুলি প্রথমবার খোলস পরিবর্তন করে। তখন পুনরায় শ্বেত বর্ণ ধারণ করে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই রং পরিবর্তিত হয়ে বাদামী বা ধূসর বর্ণ ধারণ করে। বাচ্চাগুলি কিন্তু তখনও মায়ের সঙ্গ ছাড়ে না অথবা মা বাচ্চাদের স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয় না। দ্বিতীয় বারের খোলস পরিত্যাগের পরও মা তাদের জন্য আহার সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে।
অনেক সময় দেখা যায়, বাচ্চাগুলির বয়স দু-তিন সপ্তাহ হলে কানকোটারী আবার নতুন করে কতকগুলি ডিম পাড়ে। পূর্বের বাচ্চাগুলিও সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। বাচ্চাগুলির জ্বালাতনে বিব্রত হয়ে মা-কানকোটারী সাধারণত শেষের ডিমগুলিকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে ; কিন্তু বাচ্চাগুলিকে তাড়াবার চেষ্টা করে না। বাচ্চাগুলিও আবার এমনি যে, সুবিধা পেলে তাদের মায়ের এই নতুন ডিমগুলিকে খেয়ে নিঃশেষ করতে কিছুমাত্র ইতস্তত করে না। একই ঋতুতে স্ত্রী-কানকোটারী কিছু দিন পর পর প্রায় তিন-চার বার ডিম পাড়ে, প্রথম বারের অপেক্ষা ডিমের সংখ্যা ক্রমশই কম হতে থাকে। বাচ্চাগুলি চারবার খোলস বদলাবার পর পরিণতবয়স্ক কানকোটারীর আকার ধারণ করে। ফড়িং, প্রজাপতি প্রভৃতি কতকগুলি প্রাণীর বাচ্চারা খোলস বদলাবার সঙ্গে সঙ্গেই আকৃতিতে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রথমে তারা পুত্তলীতে রূপান্তরিত হয়। পুত্তলী অবস্থায় এরা সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয়ভাবে থাকে। আবার পুত্তলী অবস্থা থেকে খোলস বদলে সম্পূর্ণ নতুন রূপ পরিগ্রহ করে বহির্গত হয়। কানকোটারী চারবার খোলস পরিবর্তন করলেও তাদের এরূপ কোনও অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে না। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এদের দেহের আয়তন বেড়ে যায়, কিন্তু উপরের চামড়াটা শক্ত হয়ে যাবার পরে তা আর শরীরের সঙ্গে সমতা রক্ষা করতে পারে না। কাজেই খোলস বদলবার প্রয়োজন হয়। তৃতীয় বার খোলস পরিবর্তন করবার পর পিঠের ডানার আবরণ আত্মপ্রকাশ করে। কানকোটারী সাধারণত এক বছর পর্যন্ত জীবিত থাকে। স্ত্রী-কানকোটারী ক্রমাগত তিন চার বার ডিম পাড়লেও তার যৌন-মিলন একবারই ঘটে থাকে। মৌমাছি ও পিঁপড়ের রানীরা যেমন একবার মিলনের পর অনবরত নিষিক্ত ডিম প্রসব করতে পারে, কানকোটারীও সেরূপ একবার মিলনের পর কয়েকবারই নিষিক্ত ডিম প্রসব করে থাকে। গুবরে পোকা, মৌমাছি প্রভৃতি কীট-পতঙ্গেরা তাদের দেহের ওজনের তুলনায় অনেক গুণ বেশি ভারী জিনিস টেনে নিয়ে যেতে পারে। গুবরে পোকা তার শরীরের ওজনের ১৮২ গুণ ভারী এবং ভ্রমর তিন শত গুণ ভারী জিনিস টানতে পারে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, কানকোটারী তার ওজনের ৫৩০ গুণ ভারী জিনিস টানবার শক্তি রাখে।
Image credit: MelaniMarfeld
(গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা এই প্রবন্ধগুলি প্রকাশ করতে পারার জন্য আমরা তাঁর পুত্রবধূ শুভা ভট্টাচার্য, দৌহিত্রী মালা চক্রবর্ত্তী, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য বিজ্ঞান প্রসার সমিতির সম্পাদক দীপক কুমার দাঁ এবং আকাশবাণী কলকাতার মানস প্রতিম দাস-র কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। মূল গ্রন্থ থেকে লেখাটি টাইপ করেছেন ‘বিজ্ঞান’-এর স্বেচ্ছাসেবক, স্বাগত সান্যাল।)
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা গ্রন্থ ‘বাংলার কীট-পতঙ্গ’ থেকে কিছু বাছাই করা প্রবন্ধ আমরা বিজ্ঞান-এর পাতায় নতুন করে প্রকাশ করছি। এখনো অব্দি প্রকাশিত লেখাগুলো এখানে পাবে। আর এরকম পর্যবেক্ষণে যদি তোমার নিজেরই উৎসাহ থাকে আর তুমিও এরকম অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা দেখে থাকো, তাহলে আমাদের সেই গল্প জানাও। কিভাবে, সেটা বিশদে দেখতে পাবে এখানে।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/earwig-birth-cycle