21-12-2024 16:39:31 pm
Link: https://bigyan.org.in/dimension-part-two
আগের পর্বে আমরা ‘মাত্রা’-র সংজ্ঞা খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। এমন একটা সংজ্ঞা যেটা আমাদের প্রচলিত মাত্রা-সম্পর্কিত ধারণা থেকেই বেরিয়ে আসবে কিন্তু সেই ধারণার সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকবে না। যেমন, তিনের বেশি মাত্রাকে আমরা সহজেই বর্ণনা করতে পারবো অথচ সেই বর্ণনা এক, দুই কিংবা ত্রিমাত্রিক স্থানের ধর্মগুলো থেকেই উঠে আসবে। এই খোঁজ করতে গিয়ে আমরা সম্মুখীন হলাম লিনিয়ার স্থানের। এমন স্থান, যার কয়েকটা সদস্যের সাহায্যেই গোটা স্থানটা গঠন করা যায় (একটা যোগ আর বাস্তব সংখ্যার সাথে গুণ-এর মাধ্যমে)। যেমন আর বিন্দুদুটোর সাহায্যে একটা কাগজের ওপরের স্থানটাকে গঠন করা যায় এই গাণিতিক প্রক্রিয়াটার মাধ্যমে:
যেখানে আর দুটো বাস্তব সংখ্যা। একটা লিনিয়ার স্থানে ‘মাত্রা’-র সংজ্ঞাটা দাঁড়ালো এইরকম: সর্বনিম্ন যেকটা সদস্যের সাহায্যে গোটা স্থানটা গঠন করা সম্ভব, সেটাই স্থানটার মাত্রা। যেহেতু দুটো বিন্দুর সাহায্যে কাগজের ওপরের স্থানটা গঠন করা সম্ভব, তাই স্থানটা দ্বিমাত্রিক।
কিন্তু এই সংজ্ঞাটা ধরে নেয় যে স্থানটা লিনিয়ার হবে। অর্থাৎ স্থানটাকে পূর্বোক্ত দুটো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কয়েকটা সদস্যের সাহায্যেই গঠন করা সম্ভব হবে। কিন্তু তা যদি না হয়? সেক্ষেত্রে মাত্রার সংজ্ঞা দেওয়া হবে কিকরে? সেই গল্পটাই বলা হচ্ছে আজকের লেখাতে।
এখনো অবধি সবই ভাল, কিন্তু এরকম জিনিস আছে যারা লিনিয়ার স্থান নয়।
যেমন ধরা যাক কাগজের ওপর একটা বৃত্ত আঁকলাম যার ব্যাসার্ধ । বৃত্তের ওপরের বিন্দুগুলোর স্থানাঙ্ক যদি হয় তাহলে তারা এই সমীকরণটা মেনে চলবে:
এই বিন্দুটাকে যদি ০ বাদে যে কোনো একটা বাস্তব সংখ্যা দিয়ে গুণ করি তাহলে:
আর ওই সমীকরণটা মানবে না, তাই “গুণফল”-টা আর বৃত্তটার ওপর থাকবে না। সেটা ব্যাসার্ধের আর একটা বৃত্তের ওপরের বিন্দু হয়ে যাবে। আবার আর যদি ওই বৃত্তের ওপরে দুটো বিন্দু হয় তাহলে:
এই বিন্দুটাও ওই বৃত্তের ওপরের বিন্দু নয় 1।
অর্থাৎ, বৃত্তের ওপরের বিন্দুগুলো আগে বর্ণিত বিন্দু-র যোগ আর গুণ-এর সাহায্যে লিনিয়ার স্থান গঠন করে না। আসলে কাজে লাগার মত এমন কোনো যোগ আর গুণ-এর সংজ্ঞা দেওয়া যাবেনা যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা লিনিয়ার স্থান গঠন করে।
বৃত্তের ওপরের বিন্দুগুলো বিন্দু-র যোগ আর গুণ-এর সাহায্যে লিনিয়ার স্থান গঠন করে না। তাই বৃত্তটা লিনিয়ার স্থান নয়। আগের লিনিয়ার স্থানের মাত্রার যে সংজ্ঞা দেখেছি আমরা, তা এক্ষেত্রে কোন কাজে লাগবে না। অথচ বৃত্তটা দিব্যি একটা সুতোর মত দেখতে জিনিস, সুতোটা যেহেতু একমাত্রিক, বৃত্তটাও তাইই হওয়া উচিৎ। কিন্তু এক্ষেত্রে মাত্রা ব্যাপারটার একটা মানে দেব কিকরে?
মানে দিতে পারি এই সুতোর মত দেখতে ব্যাপারটাকে ব্যবহার করেই। অনেক জিনিসই বাঁকা এবং সাধারণভাবে লিনিয়ার স্থান গঠন না করলেও খুব ছোট অংশ দেখলে সেটা বাঁকা হয়না। বরং সেটা হয় চ্যাটালো (flat), অর্থাৎ ইউক্লিডীয় স্থানের ছোট অংশের মতই দেখতে 2। ঠিক যেমন পৃথিবীর উপরের তল, যেখানে আমরা বাস করি, সেটা আসলে বাঁকা। কিন্তু আমরা যতদূর দেখতে পাই খালি চোখে সেটা এতই ছোট্ট একটা অংশ যে সেগুলোকে আমরা দ্বিমাত্রিক সমতলের মতই দেখি। বা বৃত্তের অংশ, যার খুব ছোট্ট অংশ একমাত্রিক সরলরেখার অংশের মত। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর উপরিতলটা দ্বিমাত্রিক আর বৃত্তের অংশটা একমাত্রিক ভাবাই স্বাভাবিক নয় কি? সেই স্বাভাবিক ধারণাটাকেই আমরা আর একটু নিশ্ছিদ্র করব।
তার আগে দেখে নি, এই স্বল্প পরিসরে ইউক্লিডীয় স্থানের ধারণা দিয়ে কিভাবে একটা বৃত্ত বা গোলকের উপরিতলের মাত্রার সংজ্ঞা দেওয়া যায়। খেয়াল করে দেখুন ইউক্লিডীয় স্থানরা সবসময়েই লিনিয়ার স্থান, তাই তাদের লিনিয়ার স্থান হিসেবে মাত্রাও আছে। দ্বিমাত্রিক সমতলের মাত্রা দুই, সরলরেখার এক-এইরকম।
বৃত্ত বা গোলকের ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে খুব ছোট অংশে এরা যে মাত্রার ইউক্লিডীয় স্থানের মতো, সেই ইউক্লিডীয় স্থানের লিনিয়ার স্থান হিসেবে মাত্রা-ই এদের মাত্রা। একটা বৃত্তের ছোট অংশ যেহেতু একটা সরলরেখার মতো আর সরলরেখার মাত্রা যেহেতু এক, বৃত্তের মাত্রা-ও তাই এক (উপরের ছবিটি দেখো)। আবার গোলকের উপরিতলের ছোট্ট অংশ দ্বিমাত্রিক সমতলের মত তাই গোলকের উপরিতলের মাত্রাও দুই। এই সংজ্ঞাটা আমাদের ওই স্বাভাবিক ধারণাটার সাথে মিলছেও। ঠিক এই সংজ্ঞাটাই জ্যামিতিক বা টপোলজিকাল মাত্রা।
বৃত্ত বা গোলক খুব ছোট অংশে যে মাত্রার ইউক্লিডীয় স্থানের মতো, সেই ইউক্লিডীয় স্থানের লিনিয়ার স্থান হিসেবে মাত্রা-ই এদের মাত্রা। ওপরে যা বললাম, সেই ব্যাপারটাকে অঙ্কের ভাষায় একটা নির্দিষ্ট মানে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন টপোলজিকাল স্থানের ধারণা। এই মানে দেওয়াটা দরকারি, কারণ সাধারণ কথ্য ভাষার মানেটা পুরোটা ঠিক নয়। একটু ভাবলেই বুঝবেন যে গোলকের উপরিতলের অংশ, তা সে যতই ছোট করি না কেন, একদম পুরো চ্যাটালো কিন্তু কখনোই হবে না 3। তাই ওই “চ্যাটালো” (flat) , অর্থাৎ “ইউক্লিডীয় স্থানের ছোট অংশের মতই দেখতে” -কথাটার একটা বিশেষ, সুনির্দিষ্ট মানে দিতে হবে।
ধরা যাক বৃত্তের ছোট্ট একটা অংশ। সেটা যে একটা ছোট্ট রেখাংশের মত “দেখতে”, এই কথাটার মানে কি? মানে এই যে কোনো একটাকে আর একটার ওপর বসিয়ে দেওয়া যায়, টেনে বাড়িয়ে, বা গুটিয়ে, বা বেঁকিয়ে, কিন্তু ছিঁড়ে বা কেটে না ফেলে, বা সেলাই না করে বা জুড়ে না দিয়ে। আবার এই কথাটা বৃত্তের একটা ছোট অংশের জন্যেই প্রযোজ্য শুধু। খেয়াল করুন যে গোটা বৃত্তটা এই মানে অনুযায়ী মোটেই রেখাংশ-র মত দেখতে নয়, দুটো জিনিসই সুতোর মত হলেও। কারণ গোটা বৃত্তটাকে রেখাংশর উপর বসাতে গেলে বৃত্তটাকে কাঁচি চালিয়ে কাটতে হবে। আবার রেখাংশটাকে বৃত্ত করতে শুধু গোল করে বাঁকালে হবে না, শেষে দুটো মাথা সেলাই করে জুড়ে দিতে হবে। কাটা বা সেলাই করা কোনটাই চলবে না আমাদের “একরকম দেখতে” -র ভাবনায়, শুধু বাঁকানো বা টেনে লম্বা করা, গুটিয়ে ছোট করে আনা, প্যাঁচ খাওয়ানো ইত্যাদি বাকি সবই চলবে।
কিকরে নিশ্চিত হব কখন একটা কিছুকে এই অর্থে আর একটা কিছুর মত দেখতে? খুব ছোট অংশ মানেই বা কি? একটা বিন্দু নিলে কি চলবে? বা ধরুণ গোলকের উপরে তো আমরা একটা রেখাও আঁকতে পারি, সেটাও গোলকের অংশ, সেইটা নিলে কি চলবে? আমরা যে বললাম গোলকের ছোট অংশ দ্বিমাত্রিক ইউক্লিডীয় তলের মত, কিন্তু গোলকের উপরে আঁকা রেখা ভাবলে সেইটা তো মোটেই তেমন নয়, দিব্যি সুতোর মত দেখতে।
এই সব সমস্যার সমাধান করার জন্যে এর আগে যা যা বললাম সেগুলোর আরও অনেক সুনির্দিষ্ট, নিশ্ছিদ্র মানে চাই।
“একইরকম দেখতে” কথাটার একটা সুনির্দিষ্ট মানে দিতে আমাদের গণিতের টপোলজি নামক শাখাটার মূল কথাটা খানিকটা বুঝে নেওয়া জরুরী। মূল বিষয় থেকে খানিকটা দুরে চলে যেতে হলেও এই ফাঁকে অঙ্কশাস্ত্র নিয়ে কিছু কথা বলে নি।
অনেকসময় আলোচ্যমান বিষয় নিয়ে আমাদের আগে থেকে কিছুটা আবছা ধারণা থাকে। যেমন, একটু আগেই আমরা বোঝার চেষ্টা করছিলাম লিনিয়ার নয় এমন স্থানের মাত্রা কাকে বলে। এরকম স্থানের উদাহরণ হিসেবে একটা বৃত্তকে নিয়েছিলাম। এই নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর আগেই আমাদের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিলো: “বৃত্তটা দিব্যি একটা সুতোর মত দেখতে জিনিস, সুতোটা যেহেতু একমাত্রিক, বৃত্তটাও তাইই হওয়া উচিৎ।” এই সহজাত বোধ (ইংরেজিতে যাকে বলে intuition) থেকেই বোঝার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।
কিন্তু এই বোঝাটা যথেষ্ট নয়। তার কারণ গোটা অঙ্কশাস্ত্রটা দঁড়িয়ে আছে শুধুমাত্র যুক্তিবিচারের (logic) ওপর। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুক্তিবিচার ঠিক হলো কিনা সেটা পরীক্ষানিরীক্ষা (এক্সপেরিমেন্ট) দিয়ে যাচাই করা হয়। অংকে সেরকম কিছু নেই। তাই অংকের যুক্তিবিচার একদম নিখুঁত হতেই হবে, নইলে ভুল সিদ্ধান্তে আসার সমূহ সম্ভাবনা। এবার যুক্তিবিচার নিখুঁত হতে হলে যে ধারণা ও প্রতিপাদ্যগুলোর ওপর যুক্তিপ্রয়োগ করা হচ্ছে তাকেও নিখুঁতভাবে সুনির্দিষ্ট হতে হবে। (একই কারণে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ধারণাগুলো একদম নিখুঁত না হলেও চলে।)
ঠিক এই কারণে আমাদের দৈনন্দিন কথ্য ভাষা অংকের জন্য উপযোগী নয়।
যেমন কথ্য ভাষায় ‘দুটো জিনিস একইরকম দেখতে’ কথাটার কিন্তু আদৌ সুনির্দিষ্ট কোন মানে নেই। তোমরা অনেকেই হয়ত শুনে থাকবে কোন বাচ্চা জন্মাবার সময় কেউ বলছেন বাচ্চাটাকে তার বাবার মত দেখতে, কেউ বলছেন তার মায়ের মত, কেউ হয়ত আবার বলছেন ঠাকুমা কিম্বা দিদিমার মত দেখতে। এক্ষেত্রে একাধিক মত ঠিক হতে পারে। যাঁরা বলছেন বাবার মত দেখতে তাঁরা হয়ত বাচ্চাটার কপাল ও চিবুকে বাবার সাথে মিল পাচ্ছেন, অন্যরা হয়ত চোখ ও ভ্রুর আদলে মায়ের সাথে মিল পাচ্ছেন, আবার কেউ হয়ত কানের লতির গঠনে কিম্বা নাকের আকারে ঠাকুমা বা দিদিমার সাথে মিল পাচ্ছেন। যেহেতু একইরকম দেখতে বলার সময় কিসের কথা বলা হচ্ছে সেটা আদৌ নির্দিষ্ট করা হয়নি, তাই সবাইই আসলে ঠিক।
এই নির্দিষ্ট করে না বলা কিন্তু কারোর বলার সমস্যা নয়। মানুষ এভাবেই কথা বলে। মানুষের কথ্য ভাষার বৈশিষ্ট্যই এই অনির্দিষ্টতা 4। এ ভাষার দুর্বলতাও নয়, বরং ভাষার মূল শক্তি। এই বৈশিষ্ট্য না থাকলে দৈনন্দিন জীবনে ভাষার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা বহুগুণ কঠিন হয়ে পড়ত, হয়ত কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠত।
কিন্তু কথ্য ভাষার এই বৈশিষ্ট্যই অংকের ক্ষেত্রে দুর্বলতা। আমরা যখন মাত্রা-র প্রসঙ্গে “একইরকম দেখতে” আর “খুব ছোট অংশ” কথাগুলো ব্যবহার করেছিলাম, আমাদের মাথায় এই কথাগুলোর (আবছাভাবে হলেও) একটা নির্দিষ্ট ধারণা ছিল। তাই একটা বিন্দু বা সরলরেখাকে একটা গোলকের ছোট অংশ ভাবতে আমাদের আটকাচ্ছিল। কিন্তু কথ্য ভাষার অনির্দিষ্টতার জন্যে আমাদের সাথে সাথেই মনে হচ্ছিলো: ভাবলেই বা ক্ষতি কি? তাই মাত্রা-র একটা গাণিতিক তত্ত্ব খাড়া করতে গেলে এখন আমাদের সেই আবছা ধারণাগুলোকে একটা সুনির্দিষ্ট ভাষায় লিখে ফেলতে হবে।
এই কাজটা অঙ্ক বা সাধারণভাবে বিজ্ঞানে প্রায়শই করতে হয়। কথ্য ভাষা থেকে আলাদাভাবে পরিভাষা তৈরি করে নিতে হয়। কোনো আলোচনায় নামার আগে অঙ্ককে অঙ্কের ভাষা তৈরি করে নিতে হয় 5। বস্তুত অঙ্ক নিজেই এই কাজের জন্যেই বিশেষভাবে তৈরি করে নেওয়া একটা ভাষা বললেও ভুল বলা হয় না। এই ভাবনাই ভাষা পেয়েছে ইতালীয় বিজ্ঞানী (ও গণিতজ্ঞ) গ্যালিলিও গ্যালিলির অমর উক্তিতে “এই ব্রহ্মান্ডকে তার ভাষা না শিখে ওঠা পর্যন্ত পড়া সম্ভব নয়। তা লেখা হয়েছে অঙ্কের ভাষায়, আর ত্রিভুজ, বৃত্ত এবং অন্যান্য জ্যামিতিক আকারগুলো তার অক্ষর, যেগুলোর মাধ্যমে ছাড়া এই ব্রহ্মাণ্ডের একটি শব্দও মানুষের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভবপর নয়।” 6
আমাদের স্কুলজীবনে যেভাবে আমরা অঙ্ক শিখি, তাতে শেষ অনুচ্ছেদটা বেশ গোলমেলে লাগা খুব স্বাভাবিক। বস্তুত স্কুলস্তরের অঙ্ক থেকে আমাদের সবারই কিছুটা এইরকম ধারণা হয় যে অঙ্ক মানে আসলে নানা কিছু ‘করতে পারা’। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ থেকে শুরু করে বীজগাণিতিক সমীকরণ সমাধান করতে পারা থেকে অবকলন-সমাকলন করতে পারা অবধি এই ধারণাটাই বদ্ধমূল হয়। সাদা বাংলায়, অঙ্ক আসলে ‘কষতে’ হয়। অঙ্ক ভয় পাওয়া বা অঙ্ককে খুব নীরস বিষয় মনে হওয়াও মূলত এর থেকেই জন্ম নেয়। একমাত্র স্কুলস্তরের ইউক্লিডীয় দ্বিমাত্রিক জ্যামিতি খানিকটা আলাদা। সেখানে সংজ্ঞা, স্বতঃসিদ্ধ ও উপপাদ্যের রাজত্ব, ‘সমাধান কর’ বা ‘সরল কর’-র জায়গা নেয় ‘প্রমাণ কর’। উচ্চতর গণিতের রাজ্যে প্রবেশ করলে তবেই আস্তে আস্তে গণিতের আসল চেহারাটা আমরা দেখতে পেতে শুরু করি। বোঝা যায় যে অঙ্ক শুধুই কষা তো নয়ই, এমনকি শুধু প্রমাণ করাও নয়। প্রমাণ করার মতই জরুরী বিষয় আসলে সংজ্ঞাগুলো ঠিক করা, বিভিন্ন ধারণার নির্দিষ্ট মানে দেওয়া, ধারণাগুলোকে সুনির্দিষ্ট, সুবিন্যস্ত, সুসংবদ্ধ রূপ দেওয়া — আর প্রমাণ আসলে সেই ধারণাগুলো থেকে অনুসিদ্ধান্তগুলোকে পরপর নিখুঁত যুক্তিশৃঙ্খলে বার করে আনা।
অঙ্ক আমাদের চারপাশের জগতকে বোঝার অস্ত্র ঠিকই। কিন্তু অঙ্ক এই অস্ত্র হতে পেরেছে কারণ সে ক্রমাগত স্পষ্ট করার চেষ্টা করে কিভাবে আমরা চারপাশের জগত সম্পর্কে ভাবি ও বুঝি। নিজেদের আবছা, অস্পষ্ট, অসংলগ্ন ভাবনাগুলোকে স্পষ্টতর ও তীক্ষ্ণতর করে, গুছিয়ে তুলে যুক্তির শৃঙ্খলে পরপর সুন্দরভাবে মালা গাঁথার মত করে সাজিয়ে তুলেই অঙ্কের ইমারত তৈরি হয়। কুমোর যেমন শুরু করেন খড়, বাঁশ, মাটির তাল থেকে, যেগুলোর কোনটার মধ্যেই প্রতিমার আকার কোথাও নেই, কিন্তু সেইগুলো দিয়ে দিয়েই তিল তিল করে আস্তে আস্তে মূর্তিটা বেরিয়ে আসে, সেভাবেই অঙ্কের শুরু সবসময়েই আমাদের স্বাভাবিক ধারণা, ভাবনা থেকে, আর ক্রমশ তার মধ্যে গাণিতিক তত্ত্বের আকার ফুটে উঠতে থাকে। শুধু অঙ্কের এই মূর্তি গড়া কখনো শেষ হয় না, চলতেই থাকে। মাটির তালে প্রতিমার আকার দেখতে পাওয়ার মতই অনেকগুলো এলোমেলো ভাবনা থেকে তাদের মধ্যেকার পারস্পরিক সংযোগের চেহারা দেখতে পেতে কল্পনাশক্তি ও সৃজনীপ্রতিভা দরকার হয়। আবার মজার ব্যাপার হল কল্পনাশক্তি বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি কল্পনার স্বাধীন, লাগামছাড়া উড়ান। কিন্তু অঙ্কে কল্পনাশক্তির আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হলো ভাবনার উড়ানকে সদাসাবধানী যুক্তির শৃঙ্খলে বাঁধতে।
কথায় কথায় আমরা মূল বিষয় থেকে বেশ অনেকটা সরে এসেছি, এইবারে আমরা আবার ফিরে যাব ‘একইরকম দেখতে’ র একটা আঁটোসাঁটো মানে দেওয়ার কাজে। সেই মানেটাই আমরা দেখবো পরের পর্বে। কিন্তু এই সুনির্দিষ্ট মানেটায় পৌঁছনোর জন্যে আমাদের আরও বেশ কিছু ধারণার সাথে পরিচিত হতে হবে, তাই আমরা আস্তে আস্তে ধাপে ধাপে এগোব। প্রথমে আমরা আলোচনা করব এমন কিছু জিনিস যা তোমাদের মনে হতে পারে এর সাথে সম্পর্কবিহীন। কিন্তু দৌড়তে শেখার আগে হাঁটতে শেখা জরুরী, হাঁটারও আগে হামা দেওয়া। তাই মাত্রার ধারণাকে নিশ্ছিদ্র করতে টপোলজি নামক গণিতের শাখাটির সাথে একটু পরিচিত হওয়া যাক।
(চলবে)
প্রচ্ছদের ছবি: সূর্যকান্ত শাসমল
টীকা
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/dimension-part-two