09-05-2025 00:30:13 am

print

 
বিজ্ঞান - Bigyan-logo

বিজ্ঞান - Bigyan

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম
An online Bengali Popular Science magazine

https://bigyan.org.in

 

দুধলতা প্রজাপতির জন্মকথা


%e0%a6%97%e0%a7%8b%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%9a%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%b0-%e0%a6%ad%e0%a6%9f%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a6%be%e0%a6%9a%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%af
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য

()

 
26 Nov 2021
 

Link: https://bigyan.org.in/danaus-chrysippus-metamorphosis

%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%a7%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%aa%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be

বাংলা মাধ্যমে লিখে বিজ্ঞানকে যাঁরা জনপ্রিয় করেছেন তাঁদের কথা স্মরণ করতে গেলে যে নামটা প্রথমেই মনে আসে, তিনি হলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রচারে তাঁর রচনার অবদান যেমন অনস্বীকার্য ঠিক তেমনি তাঁর লেখাগুলো বহু মানুষের মনের গভীরে পপুলার সায়েন্সের আগ্রহের বীজ ছড়িয়ে দেয়। বাংলায় বিজ্ঞান প্রচারে নামতে গেলে তাঁর লেখাগুলো প্রথমেই পড়া উচিত। দেখা উচিত কতটা সাবলীল ভাষায় কতটা গভীরে বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণের কথা বলা যায়। এই লেখাগুলোর সাথে সকলের পরিচয় করাতে আমরা চেষ্টা করছি তাঁর রচিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলোর একটা বৈদ্যুতিন সংকলন গড়ে তুলতে। শুরুতে তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘বাংলার কীট-পতঙ্গ’থেকে কিছু বাছাই করা প্রবন্ধ আমরা বিজ্ঞান-এর পাতায় নতুন করে প্রকাশ করবো। আজকে রইলো দুধলতা প্রজাপতির জন্মকথা।

রূপকথার ব্যাং যেমন রাজকন্যা সকাশে তার কুৎসিত আবরণটা পরিত্যাগ করে রাজপুত্রের রূপ ধারণ করতো, প্রাণী-জগতে কিন্তু এরূপ সত্যিকার দৃষ্টান্তের অভাব নেই ! আমাদের আশেপাশে অহরহ কত বিচিত্র বর্ণের সুদৃশ্য প্রজাপতিকে উড়ে বেড়াতে দেখতে পাই। তাদের জন্ম ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলেই তার সত্যতা প্রমাণিত হবে। এস্থলে আমাদের দেশীয় লালচে, হলদে রঙের দুধলতা প্রজাপতির জন্ম কথা বলছি।

কলকাতার আশেপাশে বনে-জঙ্গলে বড় গাছ বা বেড়ার গায়ে অযত্ন-বর্ধিত এক প্রকার বন্য লতার প্রাচুর্য দেখতে পাওয়া যায়। এদের পাতাগুলি একটু গোলাকার ধরনের, প্রায় প্রত্যেকটা গাঁট থেকে এক-একটা লম্বা বোঁটার ডগায় এক জোড়া কাঁটাওয়ালা সরু মুখ ফল ধরে। ফলগুলি শুকিয়ে ফেটে যায় এবং ঝাঁটার মত সূক্ষ্ম তন্তু সমন্বিত বীজ বাতাসে  ছড়িয়ে পড়ে,  পাতা বা ডাঁটা ছিড়লে দুধের মত রস ঝরতে থাকে। এই জন্যেই বোধ হয় এগুলিকে দুধ্লতা বলা হয়ে থাকে। একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলেই এই লতার গায়ে অদ্ভুত আকৃতি-বিশিষ্ট এক প্রকার অজস্র শোঁয়াপোকা দেখতে পাওয়া যাবে। এই শোঁয়াপোকাগুলি প্রায় এক ইঞ্চি থেকে দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। গায়ের উপরিভাগে হলদে ও কালো রঙের ডোরাকাটা। দেহের সম্মুখভাগে পিঠের উপর দুই জোড়া এবং পিছনের দিকে এক জোড়া কালো রঙের লম্বা শুঁড় আছে। মুখটা শাদা-কালো ডোরায় চিত্রিত। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এরা রাতদিন এই দুধলতার পাতা ও ডাঁটা কুরে কুরে খাচ্ছে, এক দণ্ডও বিশ্রাম নেই ; লম্বালম্বিভাবে পাতার ধার থেকে আরম্ভ করে নিচের দিকে প্রায় আধ  ইঞ্চি স্থানের অতি সূক্ষ্ম অংশ কেটে খায়। খাবার সময় দেখা যায় যেন মুখটাকে কেবল বারবার উপর থেকে নিচের দিকে নামাচ্ছে।

এদের চেহারা দেখতে ভীষণ হলেও অন্যান্য সাধারণ শোঁয়াপোকার মত এরা বিষাক্ত নয়। অন্যান্য সাধারণ শোঁয়াপোকা মানুষের গায়ে লাগলেই চামড়ার মধ্যে শোঁয়াগুলি গেঁথে যায় এবং সে স্থানে প্রদাহ – এমন কী সময় সময়ে ক্ষতেরও সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই শোঁয়াপোকার গায়ে মোটেই শোঁয়া নেই। এরাই দুধলতা প্রজাপতির বাচ্চা বা কীড়া। এই কীড়া বা শোঁয়াপোকাই কালক্রমে অমন সুন্দর প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত এই দুধলতা প্রজাপতিই যেখানে-সেখানে বেশির ভাগ নজরে পড়ে। দিনের বেলায় উড়ে বেড়াবার সময় এদের যৌন মিলন ঘটে। এই মিলনের কিছুকাল পরেই স্ত্রী প্রজাপতি দুধলতার পাতার গায়ে এখানে-সেখানে একটা একটা ক’রে কতকগুলি ক’রে ডিম পেড়ে চলে যায়। দিন দশ-পনেরো পরে ডিম ফুটে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শোঁয়াপোকা বেরিয়ে আসে। তখন তাদের গায়ের রং থাকে কতকটা ছাইয়ের রঙের মতো। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার কিছুক্ষণ বাদেই খেতে শুরু করে দেয়। কিন্তু তখন পাতার সমস্ত অংশটাই  খেতে পারে না, কেবল সবুজ অংশটুকুই কুরে কুরে খায়। আর একটু বড় হলেই পাতা বা ডাঁটার সমস্ত অংশ কেটে কেটে খেতে আরম্ভ করে। প্রায় দশ-পনেরো  দিন এরূপ খেতে খেতে বড় হয়ে হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে শক্ত একটা ডাঁটা নির্বাচন করে শরীরের পশ্চাদ্ভাগ থেকে এক প্রকার আঠালো পদার্থ বের করে ঐ ডাঁটার গায়ে মাখাতে থাকে। ঘুরে ঘুরে মাখানো মাত্রই ঐ রস জমে সুতার আকার ধারণ করে এবং বোঁটার মত ওই সুতার সঙ্গে শোঁয়াপোকাটার মাথা নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। 

ঝোলবার সময় কেন্নোর মত মাথার দিক ঈষৎ বক্রভাবে থাকে। কয়েক ঘন্টা এরূপ নিস্পন্দভাবে ঝুলে থাকবার পর হঠাৎ দেখা যায় – শোঁয়াপোকাটার শরীর যেন থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। ক্রমশ কাঁপুনি বাড়তে বাড়তে ঝাঁকুনিতে পরিণত হয়। এই সময়ে দেখা যায়, শোঁয়াপোকাটার মাথার দিকে পিঠের উপর খানিকটা স্থান হঠাৎ একটু স্ফীত হয়ে উঠলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই চামড়াটা ফেটে গেল এবং ভিতর থেকে উপরের দিকে সরু এবং নিচের দিকে মোটা  এক অপূর্ব  সবুজাভ পিন্ডাকার পদার্থ বেরিয়ে আসতে লাগলো। তখনও  শরীরের ঝাঁকুনি পূর্বমত চলছে। প্রায় দশ-পনেরো সেকেন্ডের মধ্যেই দেখতে দেখতে উপরের চামড়াটা সম্পূর্ণরূপে গুটিয়ে গিয়ে কালো একটু ঝুলের মত বোঁটার কাছে লেগে রইলো। সবুজ পিন্ডাকার পদার্থটা সেই বোঁটায় ঝুলেই শরীর সংকুচিত করে নানাভাবে মোচড় খেতে লাগলো। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই সবুজ রঙের পিন্ডটার  আকার পরিবর্তিত হয়ে উপরের দিক মোটা ও নিচের দিক সরু হয়ে গেল। উপরের দিকে পাশাপাশিভাবে একটু স্ফীত স্থানের উপর উজ্জল সারি সারি সোনালী রঙের ফোঁটা ফুটে উঠলো। পরে শরীরের নিম্নভাগেও ঐরূপ কয়েকটি সোনালী রঙের ফোঁটা আত্মপ্রকাশ করলে পাঁচ-সাত মিনিটের ভিতরেই এমন একটা অদ্ভুত রূপান্তর ঘটে গেল যে, দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে থাকতে হয়।

এই প্রজাপতির পিউপা বা গুঁটি গাঢ় সবুজ রঙের হয়, তার উপর সুন্দর সোনালী রঙের ফোঁটা দেখা যায়–ঠিক যেন ‘পরীর কানের দুল’।

তারপর সেই অবস্থায় সবুজ রঙের ঠিক ছোটো একটা আঙুর ফলের মত লতার গায়ে ঝুলে থাকে। রং প্রথমে হালকা সবুজ, পরে গাঢ় সবুজ হয়ে যায়। সোনালী ফোঁটাগুলিতে আলো প্রতিফলিত হয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকে। কিন্তু পাতার সবুজ রঙের সঙ্গে এদের গায়ের রঙের এমন অপূর্ব সাদৃশ্য যে, অনেকক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে অন্বেষণ না করলে সহসা কোনো মতেই নজরে পড়ে না। পনেরো থেকে বিশ দিন পর্যন্ত নিশ্চেষ্টভাবে ঠিক কানের দুলের মত ঝুলে থাকে। এগুলিই প্রজাপতির গুঁটি বা পিউপা। বিভিন্ন জাতের প্রজাপতির গুঁটি বিভিন্ন আকার ও রঙের হয়ে থাকে। কতই না তাদের রঙের বাহার, কতই না তাদের কারুকার্য। বর্ণের ঔজ্জ্বল্যে ও গঠন-পারিপাট্যে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। কবির ভাষায় এগুলিকে সত্যিকার ‘পরীর কানের দুল’ বলতেই ইচ্ছে হয়।

দুধলতা প্রজাপতির গুঁটি বা পিউপার রং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গাঢ় সবুজ; কিন্তু মাঝে মাঝে কতকগুলির রং একেবারে সাদা হয়ে থাকে। সোনালী ফোঁটাগুলি কিন্তু উভয়ের একই রকমের।

পনেরো-বিশ দিন পরে গুঁটির রং ক্রমশ পরিবর্তিত হতে থাকে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ফিকে হয়ে যায়। তখন উপরের অবরণটা অনেক স্বচ্ছ হয়ে পড়ে। তখন তার মধ্যে দিয়ে ভিতরের প্রজাপতিটিকে আবছা দেখতে পাওয়া যায় – যেন ডানা মুড়ে রয়েছে। দেখতে দেখতে গুঁটির মধ্যস্থল থেকে নিচের দিকের একাংশ ফেটে যায় এবং তার ভিতর দিয়ে প্রজাপতিটি আস্তে আস্তে মুখ বের করতে থাকে।

দু-এক মিনিটের মধ্যেই ডানা বাইরে আসে, তারপর একেবারে প্রজাপতির সমস্ত শরীর বহির্গত হয়। খোলস ত্যাগ করে বাইরে আসবার সময় তার ডানা অতি ক্ষুদ্র অবস্থায় থাকে। লেজের দিকেও সেইরূপ অস্বাভাবিক ক্ষুদ্র কিন্তু মোটা। বাইরে এসেই ক্ষুদ্রকায়  প্রজাপতিটি তার পরিত্যক্ত খোলস আঁকড়ে বসে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে শরীরের পশ্চাদ্ভাগ ও ডানাগুলি তরতর করে বাড়তে থাকে। এই সময়ে ডানাগুলি থাকে কোমল ও তকতকে। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই স্বাভাবিক প্রজাপতির অবস্থায় পরিণত হয়। বেকায়দায় পড়ে ডানাগুলি একটু এদিক-ওদিক বেঁকে গেলে আর সোজা হবার উপায় থাকে না; স্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত হবার পরেও প্রায় ঘন্টাখানেকের উপর প্রজাপতিটি ডানা মুড়ে  সেই পরিত্যক্ত খোলসটার উপরেই বসে থাকে। তারপর ডানা একবার প্রসারিত করে আবার গুটিয়ে নিয়ে পরখ করে দেখে ঠিক ওড়বার উপযুক্ত হয়েছে কিনা; তার কিছুক্ষণ পরেই উড়ে গিয়ে ফুলের মধু আহরণে প্রবৃত্ত হয়।                                         

(গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা এই প্রবন্ধগুলি প্রকাশ করতে পারার জন্য আমরা তাঁর পুত্রবধূ শুভা ভট্টাচার্য, দৌহিত্রী মালা চক্রবর্ত্তী, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য বিজ্ঞান প্রসার সমিতির সম্পাদক দীপক কুমার দাঁ এবং আকাশবাণী কলকাতার মানস প্রতিম দাস-র কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। মূল গ্রন্থ থেকে লেখাটি টাইপ করেছেন ‘বিজ্ঞান’-এর স্বেচ্ছাসেবক, শারমিন খালেক।)

গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা গ্রন্থ ‘বাংলার কীট-পতঙ্গ’ থেকে কিছু বাছাই করা প্রবন্ধ আমরা বিজ্ঞান-এর পাতায় নতুন করে প্রকাশ করছি। এখনো অব্দি প্রকাশিত লেখাগুলো এখানে পাবে। আর এরকম পর্যবেক্ষণে যদি তোমার নিজেরই উৎসাহ থাকে আর তুমিও এরকম অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা দেখে থাকো, তাহলে আমাদের সেই গল্প জানাও। কিভাবে, সেটা বিশদে দেখতে পাবে এখানে।

লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।

Scan the above code to read the post online.

Link: https://bigyan.org.in/danaus-chrysippus-metamorphosis

print

 

© and ® by বিজ্ঞান - Bigyan, 2013-25