21-12-2024 17:24:38 pm
Link: https://bigyan.org.in/circadian-rhythm-mouse-running-wheel-experiment
এর আগের পর্বে আমরা জেনেছি উদ্ভিদ থেকে প্রাণী সবার দেহের মধ্যে একটা ঘড়ি আছে এবং তার নিজস্ব একটা সত্ত্বা আছে। এই ঘড়িটা বাইরের দিন-রাতের ঘড়ির সাথে যে মিলবে, এমন কোনো কথা নেই। আমাদের দেহের ভিতরের এই ঘড়ির ফলেই আমরা সারা দিনের কর্মকাণ্ডের পর রাতের বেলায় ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু এই ঘড়ির অস্তিত্ব পরীক্ষা করে প্রমাণ করতে বিজ্ঞানীদের অনেক বেগ পেতে হয়েছিল।
অমলেশ (বিজ্ঞান): দেহের ঘড়ির একটা নিজস্ব সত্ত্বা আছে, এটা মানতে 250 বছর লেগে গেল, কেন ?
শাওন: তুমি ভেবে দেখো, দ্য মাইরান (de Mairan) অষ্টাদশ শতকে যে পরীক্ষা করেছিলেন, তা কিন্তু মোটেও সহজ নয়। উনি একটা লজ্জাবতী গাছকে একসপ্তাহ ধরে সম্পূর্ণ অন্ধকারে, মানে একটা আলমারির মধ্যে রেখে, দেখতে চেয়েছিলেন যে গাছের পাতা ঝিমিয়ে যাওয়া অথবা তাজা হয়ে ওঠা বাইরের আলো-অন্ধকারের উপর নির্ভর করে কিনা। সেট-আপ-টা সহজ হলেও, এর মধ্যে অনেক সমস্যা রয়েছে। প্রব্লেমগুলো খুব স্পষ্ট। তুমি যখন গাছটাকে দেখতে যাচ্ছো, তোমাকে আলমারির দরজা খুলতে হচ্ছে; তখন একটু আলো ঢুকছে। অর্থাৎ বাইরের দিনরাতের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা যায়নি।
আবার, দিন রাতের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য হয়; দিনের বেলা একটু বেশি গরম হয়, রাত্রিবেলা একটু ঠান্ডা হয়।
মানে এখানে আমরা তাপমাত্রাকে সমান (constant) রাখতে পারিনি আলমারির মধ্যে ।
ঠিক। এমন হতেই পারে এই 24 ঘণ্টার যে ছন্দ সেটা আলোর নয়, তাপমাত্রার।
আর্দ্রতাও হতে পারে…
একদম ঠিক! In fact, দ্য মাইরান তাঁর যে আর্টিকেলটা লেখেন সেখানে এই কথাগুলোই বলেছিলেন। তিনি এরকম লিখেছিলেন, “আমার মনে হচ্ছে এই ছন্দটা গাছের মধ্যেই রয়েছে, কিন্তু এইটা ঠিক করে দেখাতে পারছি না। তার কারণ আমি অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তাপমাত্রা বা আর্দ্রতার পরিবর্তনের ফলে হয়তো গাছের মধ্যে এই ছন্দটা আসছে।”
আচ্ছা।
কিন্তু তখন বিজ্ঞানীদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। গত 1500 বছর ধরে তাঁরা যে ভাবছেন দিন-রাতের জন্যই গাছের এই ছন্দ হচ্ছে, সেই ধারণাটা আবার ভাবতে হচ্ছে নতুন করে। এমন তো হতেই পারে যে ছন্দটা গাছের মধ্যেই রয়েছে!
সেই 1729 থেকে 250 বছর কেটে গেল শুধু এইটা দেখাতে যে ছন্দটা আসলে গাছের মধ্যে বা আমাদের মধ্যেই রয়েছে।
তার মানে প্রায় 1980 পর্যন্ত!
প্রায়।
1980-তে কী হলো?
শুধু 1980-তেই হয়েছে এরকম নয়। পুরো 250 বছর ধরে বিভিন্ন গবেষণা চলেছে। শুধু একটা ভালো পরীক্ষা বার করতে যার মাধ্যমে দেখানো যায় যে এই ছন্দটা গাছের মধ্যেই রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু পরীক্ষা করলেন। কিছু দল গাছ নিয়ে মহাশূন্যে পর্যন্ত চলে গেলেন!
মহাশূন্যে !!
হ্যাঁ, মহাশূন্যে। কারণ ওখানে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টান সামান্য, দিন রাতের গল্প নেই, আর্দ্রতার তারতম্য নেই, রকেট-এর মধ্যে সব কিছু নিয়ন্ত্রিত। এইরকম পরীক্ষা সত্যি করা হয়েছে, গবেষণা পত্রও ছেপেছেন বিজ্ঞানীরা।
সব কিছু করেও দেখা গেছে যে এই ছন্দটাকে কিছুতেই বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। ছন্দ ছন্দের মতনই রয়েছে। এইটা একটা দারুণ পরীক্ষা হয়েছিল [1]।
আরিব্বাস!
এইসব নানারকম গবেষণা করে আস্তে আস্তে বিজ্ঞানীরা ভাবতে লাগলেন যে ছন্দটা গাছটার মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু ছন্দটা যে জীবের নিজস্ব একটা সত্ত্বা, এই তত্ত্বটার একটা খুব সুন্দর প্রমাণ দেখানো হয়েছে ইঁদুর নিয়ে পরীক্ষা করে। এই ইঁদুরের গল্পটা একটু বলি, বেশ মজার।
ইঁদুর কিন্তু নিশাচর (nocturnal), রাতের বেলায় দৌড়োদৌড়ি করে। আমরা যেমন দিনের বেলায় জেগে থাকি, চলাফেরা করি, ইঁদুর ঠিক তার উল্টো। ওরা রাতের বেলায় চলাফেরা করে। এইবার, একটা গবেষণাগারে একটা গোল খাঁচার মধ্যে যদি ইঁদুর ছেড়ে দাও, মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইঁদুররা খালি ওই গোল খাঁচার মধ্যে দৌড়োয়। এইটা একটা অদ্ভুত জিনিস।
এইরকম এক্সপেরিমেন্ট আমরাও গবেষণাগারে করি। ইঁদুরকে গোল খাঁচার মধ্যে রেখে যদি আলোটা নিয়ন্ত্রণ করো, 12 ঘণ্টা আলো এবং 12 ঘণ্টা অন্ধকার, একটা চমৎকার জিনিস দেখা যায়। যেই খাঁচার মধ্যে আলো বন্ধ করে দিলে অমনি ইঁদুর দৌড়োতে শুরু করে। এইটা একটা ক্লাসিক এক্সপেরিমেন্ট। এটাকে বলে ইঁদুরের wheel running experiment, মানে একটা গোল চাকার মধ্যে ইঁদুর দৌড়োচ্ছে।
এইবারে ইঁদুরটা কতটা দৌড়োচ্ছে সেইটা মাপতে পারো। খুব সহজেই এইটা করা যায়। খাঁচা বা চাকাটার মধ্যে অনেকগুলো রড থাকে, সেই রড বেয়ে বেয়ে ইঁদুর দৌড়োতে থাকে আর চাকাটা ঘুরতে থাকে।
তার মানে চাকাটা কতটা বা কত পাক ঘুরলো সেইটা হিসেবে করলেই আমরা জানতে পেরে যাবো ইঁদুর কতটা দৌড়েছে।
হ্যাঁ, কতটা দৌড়োলো বা কিরকম স্পিড-এ দৌড়োলো সেইটা মাপা যায়। লক্ষ্য করো, এই মাপার জন্য কিন্তু আলো জ্বালানোর প্রয়োজন নেই।
মূল বক্তব্য হলো একটা চেম্বার বা খাঁচার মধ্যে আলো, বাতাস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে এবং ইঁদুরের বেঁচে থাকার মতন যথেষ্ট জল, খাবার দিয়ে ইঁদুরটার activity মাপছি আমরা। এর ফলে দ্য মাইরান-এর পরীক্ষার মতন বার বার বাক্স খোলা বন্ধ করার ব্যাপার থাকছে না।
মজার ব্যাপার হলো, যেই আলোটা বন্ধ করলে তখন অন্ধকার হয়ে গেল, আর তখনই ইঁদুরটা দৌড়োতে শুরু করলো। আবার যখন আলোটা জ্বালালে 12 ঘণ্টা পরে, তখন ইঁদুর দৌড়োনো বন্ধ করে। লাইট যখন জ্বলছে তখন ইঁদুর ঘুমিয়ে পড়ে। এইটা একটা 24 ঘণ্টার ছন্দ।
এবার প্রশ্ন হলো: এইটা ব্যবহার করে কী এমন পরীক্ষা করা হলো যাতে বোঝা গেল যে ছন্দটা আসলে বাইরের না, ভেতরেই রয়েছে? বিজ্ঞানীরা খুব সুন্দর একটা এক্সপেরিমেন্ট করলেন। ওই ইঁদুরকে নিয়ে পুরো অন্ধকারে ঢুকিয়ে দিলেন। আলো জ্বালনোই হলো না।
মানে ওই ধরনের খাঁচার মধ্যেই ইঁদুর পুরো অন্ধকারে থাকলো?
সেই একই খাঁচা রয়েছে, চাকা রয়েছে, তার মধ্যে ইঁদুর রয়েছে, কিন্তু এইবার আর আলোর ব্যাপারই নেই। পুরো জিনিসটা অন্ধকারে প্রায় দু-সপ্তাহ রেখে দিল।
এইবারে, বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, যদি বাইরের আলোর জন্য এই ছন্দটা হয় তাহলে অন্ধকারে এই ছন্দটা, মানে ইঁদুরের দৌড়োনো, বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু দেখা গেল, ঠিক যেমন দ্য মাইরান-এর পরীক্ষাতে গাছটা আলমারির অন্ধকারের মধ্যেও পাতা খুলছিল বন্ধ করছিল, ইঁদুরটাও সেরকম করছে, তার একটা ছন্দ রয়েছে।
কিন্তু এইখানে একটা মজার ব্যাপার হলো।
ধরো, বিকেল 6-টার সময় লাইট বন্ধ করলে। যেই 6-টায় লাইট বন্ধ করলে, ইঁদুর দৌড়োতে শুরু করছিল। এমনিতে দেখা যেত যে প্রত্যেকদিন ঠিক বিকেল 6-টায় ইঁদুর দৌড়োচ্ছে। কিন্তু পুরো অন্ধকারে রেখে দেওয়ার পর মজার ব্যাপার হলো। প্রথম দিন লাইট নেভাতে ইঁদুর 6-টার সময় দৌড়োতে শুরু করলো। পরের দিন কিন্তু বিকেল 5-টায় শুরু করলো।
একটু আগে!
এক ঘণ্টা আগে। তার পরের দিন বিকেল 4-টেয় শুরু করলো। লক্ষ্য করো ছন্দটা কিন্তু রয়েছে।
মানে ছন্দটা 24 ঘণ্টাই রয়েছে?
প্রায় 24 ঘণ্টা! এইটা খুব জরুরি একটা ব্যাপার। যদি 24 ঘণ্টা হতো তাহলে কিন্তু প্রত্যেকদিন ওই 6- টার সময়ই দৌড়োনো শুরু হতো।
তার মানে 24 ঘণ্টার একটু কম হচ্ছে।
যেহেতু 24 ঘণ্টার একটু কম হচ্ছে তাই প্রত্যেকদিন 1 ঘণ্টা করে এগিয়ে যাচ্ছে। এই পরীক্ষাটা করে দেখানো গেল যে ইঁদুরের ছন্দটা 24 ঘণ্টার নয়, 23 ঘণ্টার।
আচ্ছা। এই পরীক্ষাটা থেকেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যাচ্ছে?
হ্যাঁ। দেখো, ইঁদুরটার ছন্দ যদি ঠিক 24 ঘণ্টা হতো, তাহলে প্রত্যেকদিন বিকেল 6-টার সময় দৌড়োতে শুরু করতো, কারণ আজকের বিকেল 6-টা থেকে কালকের বিকেল 6-টা হচ্ছে 24 ঘণ্টা। কিন্তু দেখা গেল আজকের বিকেল 6-টা থেকে পরের দিন বিকেল 5-টায় দৌড়োনো শুরু করছে। তার পরের দিন বিকেল 4-টের সময় দৌড়োনো শুরু করছে। প্রত্যেকদিন 1 ঘণ্টা করে সময়টা এগিয়ে যাচ্ছে। এইটা তখনই হতে পারে যদি ইঁদুরের ছন্দটা 23 ঘণ্টার হয়।
আমাদের গোটা দিনের সময়টা 24 ঘণ্টার। কিন্তু ইঁদুরের 23 ঘণ্টার।
প্রত্যেক প্রাণীর ক্ষেত্রে কি এই সময়টা আলাদা?
ঠিক তাই। এইটা হতে পারে। এবং এটাই তার প্রমাণ যে আমাদের দেহের মধ্যে যেই ছন্দটা, সেইটা আমাদের দেহের মধ্যেই রয়েছে। বাইরের যে দিন-রাত-এর ছন্দ সেইটার কারণে দেহের এই ছন্দটা তৈরি হচ্ছে, এরকম নয়। সেইটা যদি হতো তাহলে আমাদের দেহে, ইঁদুরের বা গাছের দেহে ছন্দটা 24 ঘণ্টার হতো। কিন্তু তা নয়।
মানুষের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন। সার্কাডিয়ান ক্লক (circadian clock) নিয়ে খুব নাম করা এক বিজ্ঞানী এশফ (Jürgen Aschoff) একটা পরীক্ষা করেছিলেন [2]।
তবে ওনার পরীক্ষাটা তোমরা কেউ করতে যেও না, জেলে পুড়ে দেবে। কিন্তু 1960-এর দশকে বিজ্ঞানী এশফ এবং তাঁর ছাত্র একটা গভীর গুহার মধ্যে ঢুকে যান। সেখানে কোনো আলো নেই কিছু নেই, তার মধ্যে তাঁরা দু-সপ্তাহ থাকেন। সেখানে তাঁরা তাঁদের কার্যকলাপ নথিভুক্ত করেন।
তাদের ছন্দটাও 24 ঘণ্টাই হচ্ছে কিনা সেইটা দেখছিল কি?
হ্যাঁ। 24 ঘণ্টা হচ্ছে নাকি ইঁদুরের মতন এগিয়ে যাচ্ছে, সেইটা দেখছিল তারা। এই পরীক্ষায় দেখা গেছে যে আমাদের, মানে মানুষের ক্ষেত্রে সময়টা একটু পিছিয়ে যায়।
মানে আমাদের ছন্দটা 24 ঘণ্টার থেকে একটু বেশি?
একটু বেশি। এই সময়টা এখন একদম সঠিকভাবে মাপা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে আমাদের ক্ষেত্রে এই ছন্দটা 24 ঘণ্টা 10 মিনিট-এর।
এই জন্যই সকাল বেলা উঠতে দেরি হয় !
এক্কেবারে !
তুমি একটু আগেই প্রশ্ন করেছিলে যে প্রত্যেকটা প্রাণীর ক্ষেত্রে এই ছন্দটার সময় আলাদা হয় কি না। এইটা দেখা গেছে যে প্রত্যেকটা প্রাণীর ক্ষেত্রেই ছন্দটা আলাদা, কারোরই একদম সঠিকভাবে 24 ঘণ্টার নয়। এর থেকে খুব মৌলিক একটা বিষয় সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা তৈরি হয় যে এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত সবার দেহেই একটা ছন্দ রয়েছে যেটা প্রায় 24 ঘণ্টার কাছাকাছি, কিন্তু একদম সঠিক ভাবে 24 ঘণ্টা নয়। এটাকেই বলে Circadian; ল্যাটিন ভাষায় ‘Circa’ কথাটার অর্থ হচ্ছে প্রায় 24 ঘণ্টা (about 24 hours), কিন্তু পুরোপুরি 24 ঘণ্টা নয়।
এইটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যেটা বুঝতে এবং প্রমাণ করতে আমাদের প্রায় 250 বছর লেগে গেছিল।
গাছই হোক বা মানুষ সমস্ত প্রাণীর দেহে আলাদা একটা ছন্দ রয়েছে। কিন্তু এই ছন্দটা আসছে কোথা থেকে? কে ঠিক করে দিচ্ছে সমস্ত প্রাণীদের এই ছন্দ? এইসব প্রশ্নের উত্তর থাকবে পরের পর্বে।
(লেখাটি মূল ভিডিও থেকে বাংলায় লিপিবদ্ধ করেছেন বনানী মণ্ডল।)
প্রচ্ছদের ছবি: শ্রেয়া সুধীর
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি
[1] Sulzman FM, Ellman D, Fuller CA, Moore-Ede MC, Wassmer G. Neurospora circadian rhythms in space: a reexamination of the endogenous-exogenous question. Science. 1984 Jul 13;225:232-4. doi: 10.1126/science.11540800. PMID: 11540800 (link)
[2] What Happens to a Person’s Biological Clock in Isolation?, Encyclopedia Britannica
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/circadian-rhythm-mouse-running-wheel-experiment