21-11-2024 08:59:28 am
Link: https://bigyan.org.in/catterpillar-death-march
লেমিংস্ নামক ইঁদুরের মতো এক জাতীয় প্রাণী পাহাড়-পর্বতের আশে-পাশে দলবদ্ধ ভাবে বাস করে। এতো দ্রুতগতিতে এদের বংশবৃদ্ধি ঘটতে থাকে যে, কিছুদিনের মধ্যেই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রীষ্মকালীন প্রখর রোদের তাপে ঘাসপাতা শুকিয়ে গেলে তাদের মধ্যে দারুণ খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তখন হঠাৎ একদিন দেখা যায়, তারা যেন পরামর্শ করে – শীত নেই, রোদ নেই এবং খাদ্যের অভাব নেই – এমন এক অজানা কল্পিত সুখের রাজ্যের অভিমুখে ছুটতে থাকে। পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, শহর-বন্দর অতিক্রম করে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি লেমিংস্ দলে দলে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
শত-সহস্র বাধাবিঘ্ন, প্রাকৃতিক বিপ্লব, নানাবিধ শত্রুর আক্রমণ – কিছুই এদের অগ্রগতি প্রতিরোধ করতে পারে না। জীবন থাকতে এইরূপ অজানা কোনো সুখের রাজ্যে, পৌঁছুতে না পারলেও সম্মুখের দিকে অগ্রসর হতে হতে অবশেষে সমুদ্রে এসে উপস্থিত হয়। সমুদ্রই হোক বা যা কিছুই হোক – কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই, অগ্রসর হতেই হবে। যতক্ষণ সমুদ্রের ঢেউ তাদের অতলে নিমজ্জিত না করে অথবা সামুদ্রিক হিংস্র প্রাণীর কুক্ষিগত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সাঁতরে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অদ্ভুত এদের সংস্কার। এই সংস্কারের দ্বারাই হয়ত প্রকৃতি প্রাণী-জগতের ভারসাম্য রক্ষা করছে।
ক্যারিবু নামক এক জাতীয় হরিণের মধ্যেও এই ধরনের অদ্ভুত সংস্কার দেখা যায় তাদের চারণভূমিতে কোনো প্রাকৃতিক উৎপাত অথবা খাদ্যাভাবের আশঙ্কা দেখা দিলেই হাজার হাজার হরিণ দলবদ্ধ হয়ে কোনো এক কল্পিত নন্দনকাননে উপনীত হবার জন্যে নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত সব রকম বাধাবিঘ্ন অগ্রাহ্য করে অগ্রসর হতে থাকে। কবে যে এদের যাত্রাপথ সমাপ্ত হবে তা জানে না – বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, অভিযান চলতে থাকে – এমনি দৃঢ় একটা সংস্কার।
শ্রেষ্ঠতম প্রাণীদের মধ্যেও অনুরূপ দৃষ্টান্ত বিরল নয়! মানুষ, পশু,পাখি প্রভৃতি প্রাণীদের মধ্যেও যাযাবর বৃত্তি অনেক ক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া যায় এমন কী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিম্নশ্রেনীর কীট-পতঙ্গের মধ্যেও। কিন্তু কাল্পনিক সুখের আশায় (একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী ছাড়া ) লেমিংসের মত মহাযাত্রার এরূপ দৃষ্টান্ত বোধ হয় উন্নত বা অবনত সকল শ্রেণীর প্রাণীর মধ্যে একান্ত বিরল। কিন্তু সম্প্রতি কীট-পতঙ্গ শ্রেণীর এক জাতীয় শোঁয়াপোকার লেমিং-এর মত মৃত্যু অভিযান প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ ঘটেছিল। গ্রীষ্মের প্রারম্ভে আমাদের দেশীয় জবা বা কাঁঠালী চাঁপা প্রভৃতি গাছের পাতার নীচের দিকে ঈষৎ সবুজাভ শাদা রঙের এক জাতীয় শোঁয়াপোকা দেখতে পাওয়া যায়।
এরা মথ জাতীয় এক প্রকার কালো রঙের প্রজাপতির বাচ্চা। পাতার গায়ে প্রজাপতি একসঙ্গে ২০-২৫ টা ডিম পেড়ে রেখে যায়। দশ-বারো দিন পরে ডিম ফুটে ছোট ছোট শোঁয়াপোকা বেরিয়ে এসে একসঙ্গেই অবস্থান করে। এক-একটা গাছে এরূপ পাঁচ-সাতটা বা আরও বেশি বিভিন্ন দল দেখতে পাওয়া যায়। এরা দলবদ্ধ ভাবেই গাছের পাতা খেয়ে নিঃশেষ করে দেয় – কখনো দলছাড়া হয়ে ইতস্তত ছড়িয়ে পরে না। খুব ছোট অবস্থায় যখন এক ডাল থেকে অন্য ডালে যাবার প্রয়োজন হয়, তখন মাকড়সার মত মুখ থেকে সুক্ষ্ম সুতা বের করে ঝুলে পড়ে অন্যত্র যাতায়াত করে – সকলেই একসঙ্গে সুতা ছেড়ে কতকটা জালের মত যাতায়াতের রাস্তা সৃষ্টি করে বলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় না, সহজেই অন্যত্র গিয়ে একসঙ্গে জড়ো হতে পারে।
গাছপালা বিবর্জিত একটা পাথরের বেদীর উপর কোনো কারণে ছোট একটা গাছসহ টব রাখা হয়েছিল। একদিন সকাল বেলায় দেখা গেল – সেই সিমেন্টের মেঝের উপর দিয়ে দূর থেকে প্রায় দশ-বারোটা শাদা রঙের শোঁয়াপোকা পিপড়ের মত সার বেঁধে অগ্রসর হচ্ছে। আশেপাশে গাছপালা নেই – এরা কোথা থেকে এলো ? আর এদিকেই বা অগ্রসর হচ্ছে কেন ? সেগুলিকে লক্ষ করে এরূপ ভাবছি, দেখতে দেখতে তারা এসে টবটার পাশে উপস্থিত হলো। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ার পর লাইন টা যেন কতকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল – কেউ কেউ এদিক-ওদিক একটু ঘুরে, কেউ কেউ বা মাথা উঁচিয়ে কিছু যেন অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলো।
বোধ হয় ওরা টবের উপরের গাছটার গন্ধই পেয়েছিল। কারণ খানিক বাদে দেখা গেল, ওরা আবার পূর্বের মত লাইন করেই টবের গা বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো ; টবের কানার প্রায় দেড় ইঞ্চি নিচে মাটির মধ্যে গাছটি জন্মেছিল। শোঁয়াপোকাগুলি একে একে উপরে উঠেই টবের গোলাকার কানাটার উপর দিয়ে ঘুরতে লাগলো। গোলাকার রাস্তার আর শেষ হয়না। এদিকে পাতার গন্ধেও বুঝতে পেরেছে খাদ্যবস্তু অতি নিকটে ; কারণ এরা গাছের পাতা খেয়েই জীবনধারণ করে। এদিকে রাস্তাও ফুরোয় না। গোলকধাঁধায় পড়ে একই রাস্তায় যে বারবার ঘুরে মরছে সেটা বোঝবার মত বুদ্ধিও এদের নেই। প্রায় সমস্ত কানাটা জুড়েই এরা চলছিল। মাঝে একটু ফাঁকও নেই, যাতে অগ্রগামী পোকা একটু এদিক-ওদিক মাথা ঘুরিয়ে অবস্থা তদারক করতে পারে – কেবল একে অন্যকে অনুসরণ করে চলেছে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, তাতে আবার অনাহার।
একদিন একরাত্রি কেটে গেল, তখনও দেখলাম সেই গতি অব্যাহত রয়েছে। এরূপ অবস্থায় পাঁচ দিন পাঁচ রাত কেটে গেল। পঞ্চম দিন বেলা শেষে অনাহারে ও অতিরিক্ত পরিশ্রমে দলের একটি শোঁয়াপোকা যেন অসাড় ভাবেই লাইন থেকে নিচে পড়ে গেল এবং কিছুক্ষণ বাদেই তার মৃত্যুর লক্ষণ দেখা গেল। ভাবলাম একটা পোকা মরে যাওয়ায় এদের লাইনের মধ্যে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা দেখে এদিক – ওদিক মাথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টবের মাটির উপর দিয়ে গাছটার উপর উঠতে পারবে ; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, একটা শোঁয়াপোকা পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও লাইনের মধ্যে একটুও ফাঁক দেখা গেল না, পূর্বে যেমন ছিল এখনো ঠিক তেমনি একে অপরকে স্পর্শ করে এগিয়ে চলেছে। লক্ষ করে দেখলাম ব্যাপার আর কিছুই নয় মৃত শোঁয়াপোকাটা যখন দলে ছিল তখন ঠিকমত এদের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না, এরা নিজ নিজ শরীর কতকটা সংকুচিত করে চলছিল। ষষ্ঠ দিনে দেখা গেল আরও গোটা তিনেক শোঁয়াপোকা মরে পড়ে আছে তবুও তাদের লাইনের মধ্যে বড় একটা ফাঁক দেখা গেল না, এরা শরীরটাকে অসম্ভব লম্বা করে হেঁটে চলেছে। মনে হলো যেন এক-একটা শোঁয়াপোকা দৈর্ঘ্যে অন্তত দেড় গুণ লম্বা হয়ে গেছে, সপ্তম দিনে আরও কয়েকটা মারা গেল, এবার যেন এদের গতিবেগ ক্রমশই মন্দীভূত হয়ে পরেছিল।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরে পরেই যেন জোর করেই গতিবেগ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। অনুসন্ধান করে দেখলাম প্রায় দেড়শ’ হাত দূরে একটা ছোট্ট চাঁপা গাছ থেকে শুকনো ঘাস-পাতা, কাঁকর -পাথর অতিক্রম করে কল্পিত সুখের আশায় বরাবর সম্মুখের দিকে অগ্রসর হবার সময় এরা দৈবক্রমে এই টবের গাছটার কাছে উপস্থিত হয়েছিল। কারণ চাঁপা গাছটার পাতা সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষিত হয়ে গেছিল এবং আশেপাশে তাদের খাবার উপযুক্ত কোনো গাছও ছিল না। কিন্তু আশেপাশে না চেয়ে এদের অগ্রগতির এই দৃঢ় সংস্কারই এদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তারপর এই শোঁয়াপোকা নিয়ে পরীক্ষা শুরু করি – এরূপ একটা ঘটনা কী দৈবাৎ ঘটলো, না এদের স্বভাবই এরূপ? টবের কানায় কানায় জল ভর্তি করে এই জাতীয় একদল শোঁয়াপোকাসহ একটি জবাগাছ পুঁতে দিলাম। পাতা খেয়ে নিঃশেষ করবার পর এরাও একদিন নতুন খাদ্যপুর্ণ স্থানের উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করলো। গাছটার গা বেয়ে নিচে নেমেই দেখে জল, কিন্তু তাতেও ভ্রুক্ষেপ নেই – একটা শোঁয়াপোকা জলের উপর নেমে শরীর টাকে নানাভাবে ঘুরিয়ে – ফিরিয়ে একটু অগ্রসর হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার পিছনেরটাও জলে নেমে পড়লো, এইরূপে একটার পর একটা ক’রে ক্রমে ক্রমে সবগুলিই জলে নেমে ইতস্তত ভেসে ভেসে কিছুক্ষণের মধ্যেই অপর পাড়ে উঠে টবের কানার চতুর্দিকে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করে দিল। যাবৎ মৃত্যু এসে তাদের না থামাবে তাবৎ অহোরাত্র এই চক্রাকার পরিভ্রমণ চলতেই থাকবে। আরও আশ্চর্যের বিষয়, এরা যখন এক ইঞ্চি থেকে প্রায় দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়, তখনই নতুন স্থানের সন্ধানে এদের এইরূপ অভিযান চালাতে দেখা যায়। পূর্ণ বয়সে এরা তিন ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয় এবং গায়ের রং কালো হয়ে যায়।
Image credit: Detroitius
(গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা এই প্রবন্ধগুলি প্রকাশ করতে পারার জন্য আমরা তাঁর পুত্রবধূ শুভা ভট্টাচার্য, দৌহিত্রী মালা চক্রবর্ত্তী, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য বিজ্ঞান প্রসার সমিতির সম্পাদক দীপক কুমার দাঁ এবং আকাশবাণী কলকাতার মানস প্রতিম দাস-র কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। মূল গ্রন্থ থেকে লেখাটি টাইপ করেছেন ‘বিজ্ঞান’-এর স্বেচ্ছাসেবক, দেবশ্রী রায়।)
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা গ্রন্থ ‘বাংলার কীট-পতঙ্গ’ থেকে কিছু বাছাই করা প্রবন্ধ আমরা বিজ্ঞান-এর পাতায় নতুন করে প্রকাশ করছি। এখনো অব্দি প্রকাশিত লেখাগুলো এখানে পাবে। আর এরকম পর্যবেক্ষণে যদি তোমার নিজেরই উৎসাহ থাকে আর তুমিও এরকম অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা দেখে থাকো, তাহলে আমাদের সেই গল্প জানাও। কিভাবে, সেটা বিশদে দেখতে পাবে এখানে।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/catterpillar-death-march