21-12-2024 17:23:44 pm
Link: https://bigyan.org.in/brief-history-of-time-calculation-part-03
গত অধ্যায়ে আমি পারমাণবিক ঘড়ি নিয়ে বলেছি। একটা পারমাণবিক ঘড়ি যে কতটা নির্ভুল সময় গণনা করতে পারে, তার সাথে পাঠকদের পরিচয় করানো হয়েছে। এরকম নজিরবিহীন সঠিক পরিমাপ সাধারণভাবে ভাবলে হয়তো কল্পনা করাও দুস্কর!
এটা জানার পর অনেকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, আদৌ কেন আমাদের এই ধরণের একটা নির্ভুল ঘড়ির প্রয়োজন? এই বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করার আগে প্রশ্নটা আমার মনেও এসেছিল। অনেকে আবার চট করে এই ধারণা করে বসেন যে এই ধরণের ঘড়ির বাস্তব জীবনে কোনও ব্যবহারই নেই; এটা কেবল গবেষকদের খামখেয়ালিপনা। কিন্তু অনেক আধুনিক প্রযুক্তি ঠিকমতো কাজ করতে হলে নির্ভুল সময় গণনা, তার সম্প্রচার এবং বিভিন্ন যন্ত্রাদির মধ্যে যথাযত সময়ভিত্তিক সমন্বয়সাধন (synchronization) অপরিহার্য। যেমন, এর প্রয়োজন সাধারণ ও কোয়ান্টাম প্রযুক্তিভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থায়, স্যাটেলাইট দ্বারা পরিচালিত নেভিগেশন-এ, স্বয়ংক্রিয় পরিষেবা, ডিজিটাল সংরক্ষণ এবং আর্থিক লেনদেনে, ই-বাণিজ্যে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে বা সাইবার সুরক্ষায়, এছাড়া আরো অনেক ক্ষেত্রে। সুতরাং, কোনও দেশকে যদি এইসব উচ্চমানের প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হয়, তাকে সঠিক সময় পরিমাপের দিকে মন দিতেই হবে। নইলে জাতীয় সুরক্ষা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা বিশ্ব নেতৃত্বের জায়গাতে সে পিছিয়ে পড়বে।
এবার আমি পাঠককে দেখাবো কিভাবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বা স্ট্যান্ডার্ড (standard) অনুযায়ী একটা সময় অঞ্চলের (time zone) গড় স্থানীয় সময়ের হিসেব রাখা হয়। স্থানীয় সময় বলতে এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা দেশের জাতীয় সময়ের কথা বলা হচ্ছে। এই সময়ের হিসেব রাখার দুটি অংশ রয়েছে – স্থানীয় স্ট্যান্ডার্ড সময় (local standard time) নির্ধারণ এবং সেটিকে আন্তর্জাতিক মানের সাথে মিলিয়ে রাখা। এই সময় নির্ধারণ কিন্তু পারমাণবিক ঘড়িগুলির উপরই দাঁড়িয়ে আছে।
একটা সমগ্র দেশের সময়ের হিসেব কিভাবে রাখা হয় (time keeping), সেই আলোচনার আগে পাঠকদের নিচের শব্দগুলির সাথে পরিচিত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যে কোন একক, যেমন সেকেন্ড, তার একটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ড থাকে। এই আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড-এর সাথে যে কোন আঞ্চলিক বা দেশীয় স্ট্যান্ডার্ডকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় সংযুক্ত থাকতে হয়। এটা নিচের ১ নং পিরামিড চিত্র দিয়ে বোঝানো হয়েছে। পিরামিডের বিভিন্ন স্তরগুলো খানিকটা এইরকম:
এই সময়টা পৃথিবীর আবর্তনের (rotation) ভিত্তিতে নির্ণয় করা হয়। পৃথিবীর উপর ভরের এদিকওদিক হওয়ার ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষে (rotational axis) সামান্য রদবদল হয়, সেইটা মাথায় রেখে একটু সংশোধন করতে হয়। এই সময়টা নির্ণয় করতে যে পদ্ধতি ব্যবহার হয়, তাকে বলে Very Long Base Interferometry বা VLBI। কোয়েসার (quasar) জাতীয় মহাজাগতিক বস্তুর থেকে একরাশ রেডিও টেলিস্কোপ মারফৎ রেডিও সিগন্যাল ধরা হয়, এবং সেই সিগন্যালের ভিত্তিতে অঙ্ক কষে সময়টা বার করা হয়। এককালে যাকে Greenwich Mean Time বা GMT বলতো, UT1 তারই পরবর্তী সংস্করণ।
এইটা নির্ণয় করে পূর্বলিখিত BIPM সংস্থাটা। এর জন্য তারা পৃথিবীজুড়ে আশিটারও বেশী গবেষণাগারে চারশোরও বেশী পারমাণবিক ঘড়ির হিসেব নেয়। যাতে এই সময়টা কোনো একটা ঘড়ির দ্বারা বেশী প্রভাবিত না হয়, প্রত্যেকটি ঘড়ির সময়কে একটা ওজন দিয়ে তাদের গড় নেওয়া হয়। এই সময়টা সম্পূর্ণভাবে পারমাণবিক ঘড়ির প্রক্রিয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এর সাথে পৃথিবীর আবর্তনের কোনো সম্পর্কই নেই।
এই সময়টাও TAI-এর মতো পারমাণবিক ঘড়ির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটা আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত সময়, কিন্তু এতে একটা লিপ সেকেন্ড (leap second) সংশোধন করা হয়। অর্থাৎ, সৌর দিনের সময় আর পারমাণবিক সময়ের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয়। এই লিপ সেকেন্ড সংশোধনটা কখন করা হবে, সেটা ঠিক করে International Earth Rotation and Reference System Service (IERS) নামে একটা সংস্থা, যারা পৃথিবীর ঘূর্ণনের হেরফেরের উপর নজর রাখে। সবার ব্যবহারের জন্য এই UTC সংক্রান্ত তথ্যসমূহ BIPM-এর একটা মাসিক বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন দেশের জাতীয় গবেষণাগার UTC-রই একটা সংস্করণ তাদের নিজস্ব মাপজোখের মাধ্যমে বজায় রাখে। এই সময়টাকে বলে UTC(k), যেখানে k হলো সেই গবেষণাগারটা। ভারতে এই সময়টা হলো UTC(NPLI), যেখানে NPLI-এর অর্থ National Physical Laboratory, India। মোদ্দা কথা, SI সংজ্ঞার দিক থেকে দেখলে, UTC-কেই সবথেকে নির্ভুল হিসেবে ধরা হয় এবং এই সময়টা খুব স্থিরও বটে। UTC(k) ততটা নির্ভুল বা স্থির নাও হতে পারে কারণ সেটা কোনো একটা গবেষণাগারের গুণাগুণের উপর নির্ভর করে।
একটা সর্বসম্মত সংজ্ঞার ভিত্তিতে মাপা সময়ের থেকে আরেকটা সময় কতটা দূরে আছে, সেইটাই দ্বিতীয় সময়টার সঠিকতা। যেমন, UTC-কে আদর্শ ভাবলে UTC – UTC(k) একটা জাতীয় স্তরের সময়ের সঠিকতা।
একটা জিনিস বারবার মাপলে মানগুলোর মধ্যে যে হেরফের হয়, সেটাই তার স্থিরতা। যেমন, এক মাস ধরে UTC – UTC(k) মাপলে এই পরিমাপের হেরফেরকে তার স্থিরতা বলা হবে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে সঠিকতা এবং স্থিরতা সম্পর্কে আরো বিশদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং পাঠক সেটা ভুলে গিয়ে থাকলে ওই অংশটা আরেকবার পড়ে নিতে পারেন। এখানে একটাই ব্যাপার আরেকবার বলছি। UTC-র সাপেক্ষে একটা সময়ের পরিমাপ কতটা সঠিক, সেটা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার থেকেও বেশী প্রয়োজন পরিমাপটার স্থিরতা। পরিমাপটা কেন UTC-র থেকে একটা সমান দূরত্বে রয়ে যাচ্ছে, সেইটার কারণ জানা থাকলে কারণগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে আনা যায়। পরিমাপের উপর কিছুটা জুড়ে বা বাদ দিয়ে সঠিক মানটা পাওয়া যায়। কিন্তু পরিমাপটা স্থির না হয়ে অনিশ্চিতভাবে ওঠানামা করতে থাকলে কতটা জুড়লে বা বাদ দিলে সঠিক সময় পাওয়া যাবে, সেই হিসেবটা করা যায় না।
একটা দেশের ভিতর সময়ের রেফারেন্স রাখা হয় সেদেশের National Metrology Institute-এ বা অন্য কোনো নির্দিষ্ট জাতীয় গবেষণাগারে। দেশটা এক্ষেত্রে এক বা একাধিক সময় অঞ্চলের সমষ্টি হতে পারে। সেসব গবেষণাগারের নিজস্ব পারমাণবিক ঘড়ি থাকে। সেই ঘড়ির সাহায্যে যে সময়টা রাখা হয়, সেটাকেই আগে UTC(k) নামে বলা হয়েছে। অর্থাৎ সেটা আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড UTC-র একটা জাতীয় সংস্করণ। এই UTC(k)-কে থেকে থেকে আসল UTC-র সাথে মেলানো হয়, যাতে জাতীয় স্তরের সময়টা আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড-এর থেকে খুব দূরে না সরে যায়। এই যে সময়ের পরিমাপ এবং তাকে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড-এর সাথে সংযুক্ত রাখা, এই গোটা ব্যবস্থাটাকে বলে দেশের “প্রধান সময় মাপক” (primary timescale)। যদিও এই সময়টাকে সরকারী সময় (official time) হিসেবে মান্য করা হবে কিনা বা প্রশাসনিক দিক থেকে লাগু করার কোনো দায় থাকবে কিনা, সেটা নির্ভর করে সেই দেশে ওই সংক্রান্ত কোনো আইন পাশ হয়েছে কিনা, তার উপর। প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা না থাকলে হতেই পারে যে দেশের লোকে নানা জায়গায় নানারকম সময় ব্যবহার করছে। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গোলযোগ বাধতে পারে।
কিরকম গোলযোগ, তার কয়েকটা নমুনা দিই। তাহলে পাঠক একটা স্ট্যান্ডার্ড সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পারবেন।
[১] ধরা যাক, রেলওয়ের টিকিট সংরক্ষণ অফিস সকাল আটটায় শুরু হয় এবং প্রচুর চাহিদার কারণে শুরু হবার কয়েক মিনিটের মধ্যে সমস্ত টিকিট শেষ হয়ে যায়। এটা প্রায়শই হয়ে থাকে। যদি যাত্রীদের ঘড়ি রেলওয়ের ঘড়ির তুলনায় কয়েক মিনিট ধীর গতিতে চলে, তাহলে সঠিক সময় না পৌঁছানোর দরুণ ওনাদের হাত থেকে টিকিট ফস্কে যাবে।
[২] জিপিএস ভিত্তিক নেভিগেশন (GPS navigation) নিখুঁত সময় পরিমাপের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এখানে একটা প্রেরক (transmitter), যেমন সেলফোনের টাওয়ার, আলোর গতিতে ডেটা পাঠায় একটা গ্রাহককে (receiver)। এক্ষেত্রে গ্রাহক আপনার সেলফোন হ্যান্ডসেট হতে পারে। আলোর গতি যেহেতু c = ৩ × ১০৮ m/s, যদি প্রেরক আর গ্রাহকের সময়ের ধারার মধ্যে এক সেকেন্ড-ও তফাৎ হয়, তাহলে প্রেরক গ্রাহকের যে অবস্থানটা জানবে, সেটা ৩০০০০০ কিলোমিটার ভুল। ফলে সে গ্রাহককে যে নির্দেশ দেবে, তার কোনো মাথামুন্ডু থাকবে না। এই তফাৎটা এক সেকেন্ড থেকে এক মাইক্রোসেকেন্ড নামিয়ে আনলে, রিসিভারের অবস্থান জানায় ৩০০ মিটার মতো ভুল থাকবে। এত কিছু না ভেবে আপনি দিব্যি নিশ্চিন্তে গুগল-ম্যাপের নির্ভরযোগ্য নেভিগেশন ব্যবহার করে চলেছেন। তাহলে ভেবে দেখুন, প্রেরক আর গ্রাহকের মধ্যে কতটা নিখুঁতভাবে সময়ের সমন্বয় সাধন (synchronization) হয়েছে! একইভাবে, সঠিক কক্ষপথে উপগ্রহ স্থাপনের জন্য বা প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সঠিক নিশানায় মিসাইল পাঠাতেও এইরকম নিখুঁত সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন।
[৩] শেয়ার বাজারে অনলাইন নিলামী (online bidding) চলে যখন, এই ব্যবস্থার সাথে যুক্ত সব কম্পিউটারের সময়কে একই ধারায় চলতে হয়। এইসব জায়গায় “প্রথম যে, পাবে সে” (first come first served), এই নীতি চলে। যদি কোনো দেশে সময়ের হিসেব এক সেকেন্ডের একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও পিছিয়ে থাকে, সেখানকার জাতীয় অর্থনীতির সমূহ লোকসান নিশ্চিত। এক্ষেত্রে বলা বাহুল্য শেয়ার বাজারের ঘড়িগুলো জাতীয় সময়ের সাথে নির্ভুলভাবে মেলানো থাকে।
আশা করি, উপরের কয়েকটা সাধারণ উদাহরণ দিয়ে পাঠকদের বোঝাতে পেরেছি সময়ের মিলিয়ে রাখার গুরুত্ব কতটা। বিশেষ করে এমন একটা যুগে যেখানে চারিদিকে অত্যাধুনিক এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ছড়াছড়ি।
এবার বোঝা যাক, বর্তমান যুগে আন্তর্জাতিক মানের সাথে কিভাবে সময় মিলিয়ে রাখা হয়। এই সময় পরিমাপ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে একরাশ পারমাণবিক ঘড়ি এবং আনুষঙ্গিক ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি। এর মধ্যে বিভিন্ন ঘড়ি কিন্তু আলাদা কম্পাঙ্কে চলতে পারে, কারণ হয়তো তারা আলাদা দুটো শক্তিস্তরের মধ্যে স্থানান্তরকে কাজে লাগছে। তাই, সব ঘড়ির মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে তাদের সব্বাইকে কিছু রেফারেন্স কম্পাঙ্কে চালনা করা হয়। সাধারণত ১ পাল্স প্রতি সেকেন্ড (১ pps), ৫ MHz আর ১০ MHz এইগুলো হয় রেফারেন্স কম্পাঙ্ক। নিখুঁতভাবে পারমাণবিক শক্তিস্তরের মধ্যে স্থানান্তরের কম্পাঙ্ক মেপে তাকে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে স্কেল করা হয় যাতে শেষে একটা রেফারেন্স কম্পাঙ্কের সিগন্যাল নির্গত হয়। আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিগুলো এই রেফারেন্স কম্পাঙ্কেই চলে।
অর্থাৎ, সময় রাখার মধ্যে তিনটে ব্যাপার আছে: ১ pps, ৫ MHz আর ১০ MHz -এর স্থির সিগন্যাল তৈরী করা পারমাণবিক ঘড়ির ভিত্তিতে, SI সংজ্ঞা অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে যে সেকেন্ড-এর পরিমাপ হয় তার সাথে মেলানো, আর শেষে এটা ব্যবহার করে দিনের সময় বলা। নিচে চিত্র ২-এ এইটা দেখানো হলো।
সময় পরিমাপের বিশদে না গিয়ে এইটুকু বলা যায় যে পারমাণবিক ঘড়ি দিয়ে মাপা সময়কে UTC-র সাথে মিলিয়ে রেখে তবেই সেটা হয় UTC(k) বা UTC-র স্থানীয় সংস্করণ। মিলিয়ে রাখার অর্থ হলো, নির্দিষ্ট সময় পরে পরে ঘরের পরিমাপটা UTC-র সাথে তুলনা করা, যেটা একটা ঘড়ির সময়কে আরেক জায়গায় পাঠিয়ে (time transfer links) করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, চিত্র ১-এ যেরকম দেখানো হয়েছে, দেশের মধ্যে মাপা সময়টা আন্তর্জাতিক সময়ের সাথে লাগামবাঁধা থাকে।
দুটো ঘড়ি দু’জায়গায় থাকলে তাদের মধ্যে সময়গুলোকে মেলানোর কয়েকটা উপায় আছে। একটা হলো, দুটো ঘড়িকেই আলাদা আলাদা ভাবে একটা স্ট্যান্ডার্ড ঘড়ি, যেমন GPS ঘড়ির সাথে তুলনা করা। ঘড়িদুটোকে যদি আর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে দুটোর পরিমাপের তফাৎ হবে:
যেখানে UTC(GPS) হলো সেই স্ট্যান্ডার্ড ঘড়ির পরিমাপ। এইভাবে দু’জায়গার সময় পরিমাপের তুলনা করাকে বলে Common View Global Navigation Satellite System (CVGNSS)। এছাড়াও কৃত্রিম উপগ্রহ (satellite) মারফত বা অপটিক্যাল ফাইবার (optical fiber) দিয়ে এক জায়গার সময় আরেক দূরবর্তী জায়গায় পাঠানো যায়। এই পদ্ধতিগুলোর পোশাকি নাম Two Way Satellite Time & Frequency Transfer (TWSTFT) আর Time Transfer Through Optical Fiber (TTTOF)।
যাইহোক, এরকম কোনো একটা উপায়ে একটা অঞ্চলের প্রধান সময় অর্থাৎ UTC(k) সরাসরি BIPM অর্থাৎ সময় পরিমাপের কেন্দ্রস্থলে তুলে দেওয়া হয়। তারা এইভাবে বহু জায়গার পারমাণবিক ঘড়ির সময়গুলোকে একত্র করে তাদের একটা গড় কষে। সোজাসাপ্টা গড় নয়, তারা গড়ের মধ্যে এই হিসেবটাও রাখে কোথাকার ঘড়ি কতটা সঠিক চলছে (সেইমতো প্রতিটি ঘড়িকে একটা ওজন দেওয়া হয় গড়ের মধ্যে)। প্রত্যেক মাসে এই গড় হিসেবটা তারা একটা মাসিক বিজ্ঞপ্তিতে ছাপে। এর ভিত্তিতে সব দেশের NMI-গুলো প্রয়োজমতো সংশোধন করে যাতে তাদের ঘরের সময় UTC(k) আন্তর্জাতিক সময় UTC-র সাথে মেলানো থাকে। এছাড়া প্রত্যেক সপ্তাহে একটা Rapid-UTC ও বার করা হয়। অর্থাৎ এক মাস অব্দি অপেক্ষা করার দরকার পড়ে না UTC(k)-কে UTC-র চৌহদ্দির মধ্যে ধরে রাখতে।
এরপর বাকি রইলো, দেশের সময়টা বাতলানো। তার জন্য সময় অঞ্চল অনুযায়ী UTC(k)-র সাথে কিছুটা সময় জুড়তে বা বাদ দিতে হয়। আমাদের দেশে যেমন, CSIR-NPL প্রথমে UTC(NPLI) নির্ণয় করে, তারপর তার সাথে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা জুড়ে IST অর্থাৎ ভারতীয় স্ট্যান্ডার্ড সময় বাতলায় এবং সেই সময়টা প্রচার করে। প্রচারকালে সময়ের সঠিকতা একটু একটু করে কমতে থাকে, প্রচারমাধ্যমে নানা ত্রুটি ঢুকে যাওয়ার কারণে।
এত অব্দি এসে পাঠকের মনে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে: সবই তো হলো, কিন্তু দিনের সময় একটা পরমাণুর শক্তিস্তর পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে কিভাবে আসে? এই দিনের সময়টাই (day time) আখেরে ব্যবহারকারীর জন্য সবথেকে জরুরি। এর জন্য একটা সংস্থা IERS পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের পরিবর্তনের উপর নজর রাখে, দেখে ঘড়ির ভিত্তিতে মাপা দিনের দৈর্ঘ্য কতটা সরে এলো তথাকথিত UT1-এর থেকে। তফাৎটা এক সেকেন্ড হয়ে গেলে সেটা UTC-র মধ্যে গুঁজে দেওয়া হয়, একেই বলে লিপ সেকেন্ড সমন্বয়সাধন (leap second adjustment)। তাহলে দাঁড়ালো এই যে বিশ্বজুড়ে একরাশ পারমাণবিক ঘড়ির সময়কে একত্রিত করে এবং তাতে IERS-এর থেকে পাওয়া পৃথিবীর ঘূর্ণন-সম্পর্কিত তথ্য ঢুকিয়ে UTC শূন্য দ্রাঘিমাংশের (zero longitude) সঠিক সময়টা দেয়।
বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহসমূহের মাধ্যমে UTC-র সময়টা প্রচার করা হয়। যেমন, USA-র GPS, রাশিয়ার GLONASS, EU-এর Galileo, চীনের BeiDou, জাপানের QZSS এবং ভারতের NAVIC। এই সময়টা UTC-র থেকে একটু তফাতে থাকে, তবে প্রায় কাছাকাছি। যেমন, GPS-এর সময় UTC-র ১৪ ন্যানোসেকেন্ড-এর মধ্যে থাকে। GPS সঠিক সময় দেওয়া শুরু করেছে ১৯৮০-র ৫ই জানুয়ারি থেকে (আসলে ৫/১/১৯৮০ আর ৬/১/১৯৮০-র মাঝামাঝি মধ্যরাত্রি থেকে)। সেই থেকে সপ্তাহ এবং সপ্তাহের মধ্যের সেকেন্ড গোনে এবং সেইটা সম্প্রচার করে। শনি থেকে রবিতে যেতে মধ্যরাত্রিটা নতুন সপ্তাহের শুরু হিসেবে ধরা হয়। সপ্তাহগুলোকে সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।
এই সম্প্রচারিত সময়ের ভিত্তিতে স্থানীয় পারমাণবিক ঘড়িগুলোকে UTC-র সাথে মেলানো (calibrate) যায়। UTC র সাথে GPS এর পাঠানো সময়ের যেটুকু তফাৎ, সেটা একবার পরিমাপে ধরে নিলে পরে সেটা বারবার মাথায় রাখতে হয়না, যেহেতু এই তফাৎটা আর ভবিষ্যতে পাল্টাবে না। একটা সময়কে শুরু ধরে নিয়ে যে সময়ের ধারাকে মাপা হয়, তাকে এপক (epoch) বলে, আর শুরুর সময়টাকে বলে এপক সময় (epoch time)।
তিনভাগে চেষ্টা করলাম সময় গণনার ইতিহাস, পারমাণবিক ঘড়ি আর আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড-এর সাথে সময় মেলানো, এই তিনটে বিষয় বোঝাতে। এছাড়া আরেকটা বিষয়ে পাঠকদের বিশদে জানানোর ইচ্ছে আছে। সেটা হলো, সঠিক সময় গণনার প্রয়োগ। এর আবার দুটো ভাগ হয়, একটা প্রযুক্তিগত প্রয়োগ আর একটা মৌলিক বিজ্ঞানচর্চায় প্রয়োগ। দ্বিতীয়টা আমার নিজের গবেষণার বিষয়। পারমাণবিক ঘড়ি ব্যবহার করে যাতে নিখুঁত কোয়ান্টাম জগতের পরিমাপ করা যায়, সেই উদ্দেশ্যে আমি পুনে-র IUCAA-তে (Inter University Center for Astronomy and Astrophysics) একটা অত্যাধুনিক গবেষণাগার বানাচ্ছি। আশা করছি, আরেক পর্বে সেই গবেষণার বিবরণ দিতে পারব।
[১] “প্রাইমারি টাইম স্কেল তৈরির অনিশ্চয়তা হ্রাস ইউটিসি (এনপিএলআই) থেকে ২.৮ এনএস করে” এ. আগরওয়াল এট আল ,২০১৯ উ আর এস আই এশিয়া -প্যাসিফিক রেডিও সাইন্স কনফারেন্স (এপি-আর এ এস সি), নিউ দিল্লী , ইন্ডিয়া , পিপি – ১ -৩ (২০১৯ ). ডিও আই: ১০ .২৩৯১৯ / উ আর এস আইএপি-আর এ এস সি.২০১৯ .৮৭৩৮৬২৪
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/brief-history-of-time-calculation-part-03