21-11-2024 08:45:37 am
Link: https://bigyan.org.in/bio-circadian-clock
অমলেশ (বিজ্ঞান): আজকের মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে তুমি তোমার পড়াশোনা এবং গবেষণার দীর্ঘ যাত্রা নিয়ে একটু বলো।
শাওন : আমার ব্যাকগ্রাউন্ড ফিজিক্স-এর। আমি বড় হয়েছি কলকাতায় এবং স্কুলিং ও কলকাতায়। তারপর আমি আন্ডারগ্র্যাড করতে দিল্লি যাই। দিল্লিতে St. Stephens কলেজে আমি ফিজিক্স-এ বিএসসি করি। তারপরে আমি ফিজিক্সেই মাস্টার্স করি IIT কানপুরে।
ফিজিক্স করতে করতেই আমার বায়োলজি-তে ইন্টারেস্ট ডেভেলপ করতে শুরু করলো। আন্ডারগ্র্যাড-এর সময়ই আমি বায়োলজিতে একটা প্রজেক্ট করেছিলাম কলকাতার বোস ইনস্টিটিউটে। সেখানে প্রফেসর ইন্দ্রানী বোস-এর সাথে সিস্টেমস বায়োলজি-তে একটা প্রজেক্ট করেছিলাম। তখন আমি দেখলাম ফিজিক্স -এর নানা রকম তত্ত্ব দিয়ে বায়োলজির অনেক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাচ্ছে। সেই থেকেই আমার বায়োলজিতে ইন্টারেস্ট। এরপর পিএইচডি, পোস্ট ডক-এ আস্তে আস্তে আরো বেশি করে বায়োলজি করতে শুরু করি।
বাহ্! এটা কিন্তু একটা বেশ ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার। (মুচকি হেসে) যতই হোক আমাদের সমাজে ফিজিক্স পড়লে একটা গর্ব বোধ থাকে, অথচ সেখান থেকে তুমি বায়োলজিতে এসে একদম কোর সেল বায়োলজি (core Cell Biology) নিয়ে কাজ করছো, এইটা দারুণ ব্যাপার।
অনেকেই জানেন না যে ফিজিক্স পড়েও বায়োলজি করা যায়। এই ধারণাটা ইন্ডিয়াতে খুব কম। বাইরে-ও ছিল না, কিন্তু এখন অনেক বেড়েছে। ইন্ডিয়াতে আস্তে আস্তে ধারণাটা হচ্ছে। বায়োলজিতে অনেক ইন্টারেষ্টিং প্রশ্ন আছে, যেগুলো তোমার যদি ফিজিক্স, অঙ্ক, কম্পিউটার সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড হয় তাহলে অনেক ভাবে সেখানে contribute করতে পারবে।
বাহ্ ! বেশ ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার। আচ্ছা, তোমার এখনকার গবেষণার অনেক বিষয়ের একটা হলো circadian rhythm। এই circadian rhythm বা যেটাকে আমরা বাংলা করেছি ‘দৈনিক জৈবিক ছন্দ’-এই ব্যাপারটা আসলে কী?
এইটা আমরা সবাই অনুভব করেছি। এই যেমন ধরো প্রত্যেকদিন রাত্তিরে আমাদের ঘুম পায়। এটাতে একটা 24 ঘণ্টার ছন্দ আছে, যাকে আমরা দোলন বা oscillation বলি। এই দোলনের একটা দোলনকাল (time period) আছে। তার মানে, অত ঘণ্টা পর পর একই ব্যাপার ঘটছে। যেমন প্রত্যেক রাত্তিরে, 24 ঘণ্টা অন্তর তোমার ঘুম পায়। এরকম অনেক কিছু আছে। তারপরে তোমার ব্লাড প্রেসার-এর একটা ছন্দ আছে। রাতে ব্লাড প্রেসার কমের দিকে থাকে, সকাল বেলা বেড়ে যায় (একে morning surge বলে), এবং দুপুর-বিকেলের দিকে সবথেকে বেশি থাকে (Circadian Clock-Mediated Regulation of Blood Pressure)।
এই যে রোজ ঘুম পায়, এইটা 24 ঘণ্টা পর পরই কেন, এটা কখনও ভেবে দেখেছো?
ঠিক ! আমরা বেশ কিছু গাছ দেখেছি যার ফুল একটা পার্টিকুলার সময়ই ফোটে, কিছু ফুল আছে যেগুলো রাত্রিবেলা ফোটে।
একদম ! এইটা খুব ভালো একটা পয়েন্ট তুলেছো।
এইটা actually 1750 সাল নাগাদ Carl Linnaeus বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন, উনি বায়োলজি-তে খুব নাম করা। উনি উদ্ভিদ জগতের শ্রেণিবিভাগ এবং তাদের বিজ্ঞানসম্মত নাম-এর প্রচলন নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। উনি flower clock বলে এক ধরনের ঘড়ির কথা ভেবেছিলেন (Linnaeus’s flower clock)।, এইটা অমলেশ তুমি যা বললে ঠিক তাই। এই ঘড়িটাতে কোন ফুল কোন সময়ে ফুটছে সেইটা দিয়ে তুমি সঠিক সময় বলতে পারো।
তাই?
হ্যাঁ। এইটা আরো অনেকে পরে বানাতে চেষ্টা করেছেন। অনেকটাই কাজ করেছে, যদিও এর অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু মোটামুটি কাজ করে।
ছোটবেলায় একটা ফুল দেখেছিলাম, ন-টা মণি গাছ বলতো, সকাল 9-টার সময় ফুল ফুটতো।
এইটা কেন হয়? এর পেছনেই সার্কাডিয়ান ক্লক-এর মূল ধারণাটা লুকিয়ে রয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছুই দেখি যেগুলোর একটা ছন্দ আছে। যেমন ধরো যখন আমাদের সর্দি লাগে, রাতের দিকেই যেন বেড়ে যায় বা নাক বন্ধ হয়ে যাওয়াটা রাতের দিকেই বাড়ে। আবার দেখা গেছে হার্ট অ্যাট্যাক হওয়াটা ভোরের দিকে বেশি হয়, statistically দেখা গেছে অনেক ক্ষেত্রেই ভোরের দিকে হার্ট অ্যাট্যাক-এর সম্ভাবনা বেশি থাকে। এইটা কেন হয়?
এইগুলোর সাথে তোমার রিসার্চের যোগ আছে?
হ্যাঁ। এইগুলোর সাথে রিসার্চের সরাসরি যোগ আছে।
তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো প্লেনে চড়েছো। জেট ল্যাগ-এর নিশ্চয় একটা আইডিয়া আছে।
মানে একটা দেশ থেকে, যেমন USA থেকে, যখন এ দেশে আসে?
হ্যাঁ। অথবা ধরো ইন্ডিয়া থেকে অন্য দেশে গেলাম। তখন আমাদের শরীরটা খুব খারাপ লাগে। মনে হয় যেন জল তেষ্টা পাচ্ছে, দেহের মধ্যে যেন কষ্ট হচ্ছে। একেই আমরা জেট ল্যাগ বলি। এইটা কেন হয় কখনও ভেবে দেখেছো?
সাধারণ ভাবে আমরা এরকম বুঝি — এখন এখানে দিন কিন্তু ওদেশে তো এখন রাত্রি, ঘুমোনোর সময় —
এটা কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার। এইটা কেন হয়? এই দিন রাতের সঙ্গে আমাদের শরীরের যে এরকম সম্পর্ক, এইটা কেন?
মানে তুমি কি বলতে চাইছো এই যে rhythm, আমাদের দেহ কোনোভাবে দিনরাতের ছন্দটা বুঝতে পারে?
এইটা খুব ভালো প্রশ্ন করেছো। এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, আমাদের দেহের প্রত্যেকটা কোষ (cell) বুঝতে পারে।
কিন্তু এইটার ইতিহাসটা বেশ ইন্টারেষ্টিং। এইটা সম্পর্কে তোমাদের একটু বলি, বেশ মজা লাগবে।
একদম একদম!
আমরা সবাই প্রত্যেক দিনের জীবনে যা অনুভব করি, তার একটা ছন্দ আছে। মানে ধরো, 24 ঘণ্টা অন্তর অন্তর ঘুম পায়, খিদে পায়। শরীর খারাপ হওয়ারও ছন্দ আছে, রাতের দিকে বেশি খারাপ লাগে। এইটা কিন্তু আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন সভ্যতাগুলোও ডকুমেন্ট করেছিল, সেটা ভারতে, চিনে অথবা গ্রীসে হোক। তখন যেটা লোকে ভাবতো, সেটা হলো: এই ছন্দের স্বাভাবিক কারণ হচ্ছে যে বাইরে সকাল থেকে রাত আবার রাত থেকে সকাল হচ্ছে, সূর্য উঠছে অস্ত যাচ্ছে। এইটার একটা 24 ঘণ্টার ছন্দ রয়েছে। দেহের মধ্যেও একটা ছন্দ দেখা যাচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই তারা এই দুটো জিনিসকে একই ঘটনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ভাবলো। এই বাইরের দিন-রাতের oscillation-টাই আমাদের ভেতরের ছন্দটাকেও পরিচালনা করছে। প্রায় দেড় হাজার বছর পর্যন্ত, প্রায় 1700 সাল পর্যন্ত মানুষের এই ধারণা ছিল যে বাইরের ছন্দের জন্যই আমাদের শরীরের ভেতরের ছন্দটা হচ্ছে।
এখনও পর্যন্ত আমিও সেটাই ভেবে এসেছি।
কিন্তু তুমি একটু আগে যে প্রশ্নটা করলে, দেহ বাইরের ছন্দটা কীভাবে বুঝতে পারে বা আদৌ বুঝতে পারে কি না, এই প্রশ্নটা তখনও লোকের মনে আসেনি। দেড় হাজার বছর ধরে লোকে ভাবতো যে বাইরে দিন-রাত হচ্ছে বলে আমাদের দেহে এই 24 ঘণ্টার একটা ছন্দ রয়েছে।
এইবারে, 1729 সাল নাগাদ দ্য মাইরান (de Mairan) নামে এক ফ্রেঞ্চ ফিলোসোফার একটা খুব মজার এক্সপেরিমেন্ট করলেন। এইটার সাথে একটু আগে অমলেশ যে ফুল খোলা বন্ধ হওয়ার কথা বললে, তার একটা সুন্দর সম্পর্ক আছে।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, তোমরা সবাই জানো যে সেই সময় বিজ্ঞানের কোনো শাখা প্রশাখা ছিল না। দার্শনিকরাই (philosopher) বিজ্ঞান করতেন, অঙ্ক করতেন। তখনকার দিনে ন্যাচারাল সায়েন্স বলা হতো।
দ্য মাইরান ভাবলেন এই বাইরের দিন-রাতের ছন্দের জন্যই যদি আমাদের দেহের দৈনিক ছন্দটা বা গাছেদের এই ছন্দটা আসে, তাহলে যদি আমি বাইরের এই ছন্দটাকেই বন্ধ করে দিই…
মানে উনি কি একটা অন্ধকার ঘরে কিছু পরীক্ষা করলেন?
হ্যাঁ ! খুব সহজ একটা এক্সপেরিমেন্ট, এবং এর থেকে বোঝা যায় যে সব এক্সপেরিমেন্ট করতেই যে প্রচুর টাকা লাগে তা নয় কিন্তু। খুব সহজ এক্সপেরিমেন্ট করে খুব গভীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় ।
উনি কী করলেন, Mimosa pudica, মানে বাংলায় যেটা লজ্জাবতী গাছ বলা হয়, যার পাতাগুলো রাতের দিকে ঝিমিয়ে যায়, আবার সকাল বেলা তাজা হয়ে ওঠে, সেই লজ্জাবতী গাছ নিয়ে দেরাজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। এইবার উনি দেখলেন এক অদ্ভুত ব্যাপার। সেই যে দৈনিক ছন্দ, সেইটা তখনও চলছে।
মানে গাছটা জানেনা যে সূর্য আছে নাকি নেই, ওর কাছে সবটাই অন্ধকার।
হ্যাঁ। সারাদিন অন্ধকার। এক সপ্তাহ ধরে অন্ধকারে রয়েছে। কিন্তু..
অন্ধকার সত্ত্বেও যখনই বাইরে সূর্য উঠছে তখন…
এইটা তুমি খুউব ভালো প্রশ্ন করেছো। তুমি অনেকটা এগিয়ে গেছো। উনি ঐসময় অতটা carefully এক্সপেরিমেন্ট-টা করতে পারেননি।
কারণ, তুমি ভেবে দেখো একটা আলমারির মধ্যে গাছটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন, সেক্ষেত্রে গাছটাকে দেখতে পাওয়াটা একটু মুশকিল। দেখতে গেলে আলমারিটা খুলতে হচ্ছে। কিন্তু উনি মোটামুটি দেখলেন যে গাছটা ভেতরে থাকলেও ছন্দটা রয়েছে।
তো সেইটা থেকে উনি অদ্ভুত একটা সিদ্ধান্তে এলেন, যেটা আমাদের সেই দেড় হাজার বছরের যে ধারণা সেটাকে পুরো পাল্টে দিলো। সেটা হচ্ছে, এই ছন্দটা গাছটার নিজের মধ্যেই রয়েছে। বাইরে যে সূর্য উঠছে বা অস্ত যাচ্ছে, তার সাথে ঠিক সম্পর্ক নেই।
তার সাথে সম্পর্ক নেই!
নেই। সারাদিন অন্ধকারে থেকেও যখন ছন্দটা রয়েছে….
তার মানে এইটা বাইরের ওই ছন্দের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে না। তার মানে গাছের নিজের একটা ছন্দ আছে।
হ্যাঁ।
এবং ওই বাইরে একটা ছন্দ আছে।
এইটা একটা খুব ভালো জিনিস বলেছো।
যারা ফিজিক্স-এর স্টুডেন্ট, তোমরা হয়তো বুঝতে পারছো আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, একটু coupled-oscillator-এর দিকে আমরা যাচ্ছি। সেইটা এখনই বলছি না, কিন্তু অমলেশ ধরে নিয়েছো ব্যাপারটা।
মানে দুটো আলাদা ছন্দ রয়েছে। এইটা কিন্তু তখনকার ভাবনা অনুযায়ী একটা সাংঘাতিক উদ্ঘাটন।
কিন্তু এইটা সবাই তখন মেনে নিয়েছিল?
তুমি জিজ্ঞেস করছো, এইটা মেনে নিয়েছিল কি না? উত্তর হলো, এইটা মানতে আরো 250 বছর লেগে গেল।
দ্য মাইরান-এর পরীক্ষায় বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এমনও তো হতে পারে যে ছন্দটা আদৌ সূর্যের আলোর ওপর নির্ভরশীলই নয়। ছন্দটা হয়তো দিনের বিভিন্ন সময়ের উত্তাপ এবং আর্দ্রতার দ্বারা পরিচালিত। এইসব নানারকম প্রশ্নের উত্তর থাকবে পরবর্তী পর্বে।
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/bio-circadian-clock