30-01-2025 17:22:22 pm
Link: https://bigyan.org.in/bacteria-indoors
অমলেশ (বিজ্ঞান): আমরা আগের অংশে জানলাম যে ক্রায়ো-টোমোগ্রাফি পদ্ধতির মাধ্যমে জীবাণুদের ভিতর দেখা যায়। ব্যাকটেরিয়ার উপর যদি এই পদ্ধতিটা ব্যবহার করি, তাহলে কী দেখতে পাবো? তোমার ওয়েবসাইটে একটা 22 সেকেন্ডের ভিডিওতে সেটা কিছুটা দেখা যাচ্ছে:
এখানে আমরা কী দেখছি একটু বলবে?
দেবনাথ: এই ভিডিওটিতে একটা ব্যাকটেরিয়া কোষের গঠনগত বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা ছোটবেলায় পড়েছি ব্যাকটেরিয়া হলো স্রেফ একটা উৎসেচকপূর্ণ ব্যাগ (bag of enzymes)। অর্থাৎ, ব্যাকটেরিয়ার কোষের ভেতরে কিছু উৎসেচক থাকে যেগুলোর মাধ্যমে তার শারীরবৃত্তীয় কাজকর্মগুলো সম্পন্ন হয়। কিন্তু তার থেকে বেশি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে আর কিছু নেই। কয়েক বছর আগে আমি মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বই খুলে দেখতে পাই, এই একই সংজ্ঞাই এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে।
কিন্তু গত 25 থেকে 30 বছরে বিজ্ঞানীরা ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে আরো অনেক জিনিস আবিষ্কার করেছেন। তারা বুঝেছেন ব্যাকটেরিয়া কোষের গঠন অতটাও সহজ সরল নয়। যদি এতটাই সহজ হত তাহলে প্রযুক্তিগতভাবে এত উন্নত একটা সমাজে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ আমরা অতি সহজেই আটকে দিতে পারতাম। কিন্তু বাস্তব তা নয়, প্রতিবছরই কয়েক লক্ষ মানুষ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে মারা যায়। ব্যাকটেরিয়া কোষের গঠন আমাদের একেকটা কোষের মতো নয়, সেটা অনেক বেশি জটিল।
উদাহরণস্বরূপ, আমাদের কোষে একটাই আবরণী পর্দা থাকে। ব্যাকটেরিয়ার সে জায়গায় বাইরে একটা আবরণী পর্দা থাকে, মাঝখানে কোষ প্রাচীর থাকে, এবং ভেতরের দিকে আরো একটা কোষপর্দা থাকে।
এদের এই তিনটে পর্দাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে পেনিসিলিন গোত্রীয় অ্যান্টিবায়োটিক খাই সেগুলির ওই কোষ প্রাচীরের গঠনটাকে নষ্ট করে দেওয়ার কথা। যার ফলে ব্যাকটেরিয়ার কোষটা আর বেঁচে থাকতে পারবে না। কিন্তু অনেক সময়, বিশেষ করে গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে, আমরা হয়তো অ্যান্টিবায়োটিক খেলাম কিন্তু সেটা ওদের কোষ প্রাচীরকে ভেদ করতেই পারল না।
এছাড়াও বহিরাগতদের আটকে দিতে ব্যাকটেরিয়াতে অন্য আরেক ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। ওদের কোষ প্রাচীরে কিছু প্রোটিন কমপ্লেক্স থাকে যাদের ইফ্লাক্স পাম্প (efflux pump) বলে। আমরা অ্যান্টিবায়োটিক খেলে এই পাম্পগুলো সেটাকে কোষের বাইরে বের করে দেয়। সেক্ষেত্রে ওই জাতীয় ব্যাকটেরিয়া ওই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধে সক্ষম হয়ে গেছে (antibiotic resistant)। আমরা যতই অ্যান্টিবায়োটিক খাই, সেগুলো আর তখন কাজ করবে না।
তাই ব্যাকটেরিয়াকে শুধুমাত্র একটা উৎসেচক পূর্ণ ব্যাগ ভেবে সরলীকরণ করলে সেটা মস্ত ভুল হবে।
ব্যাকটেরিয়া কোষেও আমাদের কোষের মতো প্রোটিন তৈরির কারখানা রাইবোজোম (ribosome) থাকে। এর সাহায্যে ওরা অনেক ধরনের প্রোটিন তৈরি করতে পারে। যেমন, এদের মধ্যেও আমাদের শরীরের মতোই প্রচুর সাইটোস্কেলিটাল প্রোটিন (cytoskeletal protein) পাওয়া যায়, যেমন MRAPI, PER-m, FTM-a, FTS-z।
ওদের হয়তো আমাদের মতো সুগঠিত নিউক্লিয়াস না থাকতে পারে, কিন্তু ওদের নিউক্লিওয়েড বলে এক ধরনের অংশ থাকে। সেখানে কোন জিনটা কখন সক্রিয় হবে, কোন প্রোটিনটা কখন তৈরি হবে, সেগুলো খুব সুন্দর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
অনেক কোষের ওপরের দিকে ফিলামেন্টের মতো একটা জিনিস থাকে, একে ফ্ল্যাজেলা (flagella) বলে। এতে একটা মোটর এবং আরো কিছু প্রোটিন কমপ্লেক্স আছে যার মাধ্যমে একটি ব্যাকটেরিয়া তার ফ্ল্যাজেলাকে খুব দ্রুত নাড়াতে পারে এবং কোন দিকে যাবে সেটা ঠিক করতে পারে। ওদের সাঁতার কাটার মূল অঙ্গই হলো এটা। এটা ছাড়াও আরো প্রচুর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অঙ্গ থাকে যার মাধ্যমে ওরা কোনো তরল মাধ্যমে ঠিক কোনখানে যাবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে (এদের বলে Type IV pili বা T4P)।
অতএব এরকম হয় না যে ব্যাকটেরিয়া এলোমেলো ভাবে চলাফেরা করছে। ওদের একটা ধারণা থাকে কোন দিকে খাবার থাকবে। খাবার কোথায় আছে জানতে ওদের এক ধরনের অঙ্গ থাকে যাদেরকে কেমোরিসেপ্টর অ্যারে (chemoreceptor array) বলা হয়। খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে, এটা প্রোটিনের একটা চেন যেটা বাতাবরণে রাসায়নিক তারতম্য (chemical gradient) থেকে বুঝতে পারে খাবারের উৎস কোন দিকে। একবার কোনো উৎস খুঁজে পেলে ওরা ফ্ল্যাজেলার মাধ্যমে সেদিকে সাঁতরে যেতে পারে। সংক্রমণ করার ক্ষেত্রেও এই ফ্লাজেলার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। সব মিলিয়ে একটি ব্যাকটেরিয়ার গঠন কিন্তু বেশ জটিল।
ব্যাকটেরিয়াতে অনেক রকমের সিক্রেশন সিস্টেম (secretion system) থাকে। এটা অনেকগুলো প্রোটিন দিয়ে তৈরি একটা ইনজেকশনের সুচের মতো। ঠিক একটা ভ্যাকসিন দেওয়ার সময় যেরকম ইনজেকশন সুচ ফুটিয়ে কিছু একটা তোমার শরীরে ঢোকানো হয়, সেরকমই ব্যাকটেরিয়ারও একটা অনুপ্রবেশ করানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
11 রকমের সিক্রেশন সিস্টেম এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয়েছে। প্রথম দশটি সম্পর্কে আমরা খুবই ভালো ভাবে জানি। 11 নম্বর টি এই সদ্য খুঁজে পাওয়া গেছে। এগুলি খুবই জটিল প্রোটিন দিয়ে তৈরি জিনিস। এই সুচগুলোর মাধ্যমে কোনো ব্যাকটেরিয়া তার কোষে তৈরি ক্ষতিকারক পদার্থ (toxin) আমাদের শরীরের মধ্যে ইনজেক্ট করতে পারে। ঠিক ইনজেকশন সুচের মতোই ওদের শরীরে ফিলামেন্ট (filament) থাকে যেগুলো আমাদের কোষের মধ্যে ঢুকে পড়ে ক্ষতিকারক পদার্থগুলোকে চালান করতে পারে। এই টক্সিনগুলোর জন্য আমাদের কোষে প্রচুর পরিবর্তন আসে, আর সেখান থেকে অনেক রকমের রোগব্যাধি হয়।
যেমন Legionella pneumophila বলে একটা ব্যাকটেরিয়া আছে যেটা থেকে লিজেনাস রোগ (Legionnaires’ disease) হয়। এই রোগের উপসর্গ অনেকটা কোভিডের মতো। এরা যাকে বলে টাইপ ফোর সিক্রেশন সিস্টেম (Type IV secretion system) ব্যবহার করে। আবার হেলিওব্যাকটার পাইলোরি (Helicobacter pylori) বলে অন্য আরেক প্রকার ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যারা টাইপ ফোর সিক্রিশন সিস্টেমের মাধ্যমে আমাদের শরীরে একটা প্রোটিন ঢুকিয়ে দেয় আর যার নাম ক্যাগ-এ (CagA)। এর ফলে আমাদের শরীরে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার বা আলসার হয়। ভিব্রিও কলেরী (Vibrio cholerae) টাইপ-টু সিক্রেশন সিস্টেম (Type II secretion system) ব্যবহার করে। প্লেগের জীবাণু এয়ার্সেনিয়া পেস্টিজ (Yersinia pestis) টাইপ-থ্রি সিক্রেশন সিস্টেম (Type III secretion system) ব্যবহার করে। এরকম নানা রকমের সিক্রেশন সিস্টেম রয়েছে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে।
এভাবেই বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে নানা ক্ষতিকারক পদার্থ ঢুকিয়ে দিতে পারে, যার ফলে প্রচুর ধরনের রোগব্যাধি হয়। একটা ব্যাকটেরিয়াতে এই সিক্রেশন সিস্টেমগুলোর বিভিন্ন কম্বিনেশন রয়েছে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে। কোনো ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে হয়তো টাইপ ওয়ান, টু আর ফাইভ সিক্রেশন সিস্টেম রয়েছে। কোনোটাতে হয়তো থ্রি আর ফোর রয়েছে। এরকম বিভিন্ন কম্বিনেশন থাকতে পারে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে।
সেজন্যই আমরা বলতে পারি যে যত সময় যাচ্ছে এবং যত বেশি গবেষণা হচ্ছে আমরা দেখতে পাচ্ছি ব্যাকটেরিয়ার গঠন অত্যন্ত জটিল। ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগগুলোর মোকাবিলা করার জন্য আমাদেরকে আরো অনেক বেশি গবেষণা করতে হচ্ছে। প্রায় গত 350 কোটি বছর ধরে তারা পৃথিবীতে রয়েছে এবং তাদের অভিযোজন ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। এই ছোট্ট একটা কোষে ওরা যে পরিমাণ জটিল গঠন তৈরি করেছে তা কিন্তু জানতে আমাদের আরো অনেক সময় লাগবে।
একটা ব্যাকটেরিয়ার ত্রিমাত্রিক গঠনের ভিতরে কী কী রয়েছে আমরা ক্রায়ো ইলেকট্রন টোমোগ্রাফির মাধ্যমে ভালোভাবে জানতে পারি। সেগমেন্টেশন বলে একটি পদ্ধতিতে আলাদা আলাদা অংশগুলিকে আমরা বিভিন্ন রঙে রঙিন করে বোঝার সুবিধার জন্য সাজিয়ে নিই।
এগুলোকে বলে পিলাস (pilus)। এগুলো অনেকটা হুকের মতো। ধরো, কোনো একটা জায়গায় ব্যাকটেরিয়া একটা স্তর (biofilm) তৈরি করতে চায়। যেমন, urinary tract-এ ইনফেকশন হলে ব্যাকটেরিয়া ওখানে একটা স্তর তৈরি করে। সেই স্তরটাকে আটকে রাখার জন্য হুকের মতো ওই পিলাসগুলোকে ওরা ব্যবহার করে। অনেক ব্যাকটেরিয়া এভাবে একসাথে জমা হয়ে স্তরটা তৈরি হয়। সেখান থেকে নানারকম ক্ষতিকারক পদার্থ (toxin) ওরা ঢোকাতে থাকে এবং কোনো একটা রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে।
এইভাবেই আমরা বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াকে দেখতে পাই। বোঝার চেষ্টা করি তারা কী কী মলিকিউলার মেশিন (molecular machine) ব্যবহার করছে বা কীভাবে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক পদার্থ শরীরে ঢুকিয়ে রোগ সৃষ্টি করছে। শুধু ব্যাকটেরিয়া নয় আমরা ভাইরাস নিয়েও একই ধরনের জিনিস দেখতে পাই। আমাদের সদ্য চালু হওয়া একটা প্রকল্পে আমরা দেখেছি কীভাবে কোভিড ভাইরাস আমাদের কোষের পর্দার সাথে জোড়া লাগে এবং ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে, এবং তারপর কোষের কী কী ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়।
আমরা সাম্প্রতিককালে যত ভ্যাকসিন দেখছি সে কোভিসিল্ড-ই বলো বা কোভ্যাকসিন, তার পেছনে কিন্তু ক্রায়োইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ কোনো ভ্যাকসিন তৈরি করার আগে আমাদের জানার দরকার পড়ে যেটার জন্য ভ্যাকসিন বানাচ্ছি তার গঠন বৈশিষ্ট্য কীরূপ।
(এই লেখাটি মূল ইন্টারভিউ থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন স্বপ্ননীল জানা।)
লেখাটি অনলাইন পড়তে হলে নিচের কোডটি স্ক্যান করো।
Scan the above code to read the post online.
Link: https://bigyan.org.in/bacteria-indoors