তখন মেঘদূত কহিলেন, “তোমার সম্মুখে অন্ত নাই; ইহাতেই কি তুমি অবসন্ন হইয়াছ ? পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখ, এ জগতের আরম্ভও নাই।”
শেষও নাই, আরম্ভও নাই।
মানুষের মন অসীমের ভার বহিতে পারে না। ধূলিকণা হইয়া কিরূপে অসীম ব্রহ্মাণ্ডের কল্পনা মনে ধারণা করিব ?
অণুবীক্ষণে ক্ষুদ্র বিন্দুতে বৃহৎ জগৎ দেখা যায়। বিপর্য্যয় করিয়া দেখিলে জগৎ ক্ষুদ্র বিন্দুতে পরিণত হয় ; অণুবীক্ষণ বিপর্য্যয় করিয়া দেখ। ব্রহ্মাণ্ড ছাড়িয়া ক্ষুদ্র কণিকায় দৃষ্টি আবদ্ধ করো।
আমাদের চক্ষুর সমক্ষে জড়বস্তু মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে কত বিভিন্ন রূপ ধারণ করিতেছে। অগ্নিদাহে মহানগর শূন্যে বিলীন হইয়া যায়। তাহা বলিয়া একবিন্দুও বিনষ্ট হয় না। একই অণু কখন মৃত্তিকাকারে, কখন উদ্ভিদাকারে, কখন মনুষ্যদেহে, পুনরায় কখন অদৃশ্য বায়ুরূপে বর্ত্তমান। কোন বস্তুরই বিনাশ নাই।
শক্তিও অবিনশ্বর। এক মহাশক্তি জগৎ বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে ; প্রতি কণা ইহা দ্বারা অনুপ্রবিষ্ট। এ মুহূর্ত্তে যাহা দেখিতেছি, পরমুহূর্ত্তে ঠিক তাহা আর দেখিব না। বেগবান নদীস্রোত যেরূপ উপলখণ্ডকে বার বার ভাঙিয়া অনবরত তাহাকে নূতন আকার প্রদান করে, এই মহাশক্তিস্রোতও সেইরূপ দৃশ্য জগৎকে মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে ভাঙিতেছে ও গড়িতেছে। সৃষ্টির আরম্ভ হইতে এই স্রোত অপ্রতিহতগতিতে প্রবাহিত হইতেছে। ইহার বিরাম নাই, হ্রাস নাই, বৃদ্ধি নাই। সমুদ্রের এক স্থানে ভাঁটা হইলে অন্য স্থানে জোয়ার হয়। জোয়ার ভাঁটা উভয়ই এক কারণজাত ; সমুদ্রের জলপরিমাণ সমানই রহিয়াছে। এক স্থানে যত হ্রাস হয়, অপর স্থানে সেই পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এইরূপ জোয়ার ভাঁটা– ক্ষয় বৃদ্ধি–তরঙ্গের ন্যায় চতর্দ্দিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।
শক্তির তরঙ্গেও এইরূপ– ক্ষয় বৃদ্ধি, প্রত্যেক বস্তু এই তরঙ্গ দ্বারা সর্ব্বদা আহত হইতেছে– উপলখণ্ড ভাঙ্গিতেছে ও গড়িতেছে। শক্তি-প্রক্ষিপ্ত ঊর্ম্মিমালার দ্বারাই জগৎ জীবন্ত রহিয়াছে।
এখন জড়-জগৎ ছাড়িয়া জীব-জগতে দৃষ্টিপাত করি। বসন্তের স্পর্শে নিদ্রিত পৃথিবী জাগরিত করিয়া, প্রান্তর বন আচ্ছন্ন করিয়া, উদ্ভিদ্-শিশু অন্ধকার হইতে মস্তক তুলিল। দেখিতে দেখিতে হরিৎ প্রান্তর প্রসূনিত। শরৎকাল আসিল, কোথায় সেই বসন্তের জীবনোচ্ছ্বাস ? পুষ্প বৃন্তচ্যুত, জীর্ণ পল্লব ভূপতিত, তরুদেহ মৃত্তিকায় প্রোথিত। জাগরণের পরেই নিদ্রা !
আবার বসন্ত ফিরিয়া আসিল ; শুষ্ক পুষ্পদলে আচ্ছাদিত, বীজে নিহিত, নিদ্রিত বৃক্ষ-শিশু পুনরায় জাগিয়া উঠিল। বৃক্ষ মৃত্যুর আগমনে জীবনবিন্দু বীজে সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছিল। সেই বিন্দু হইতে বৃক্ষ পুনর্জ্জীবন লাভ করিল।
আপনাকে ইমেইল শুধুমাত্র Bigyan.Org.In এর খবরাখবর পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত হবে। আপনার তথ্য আমাদের কাছে সুরক্ষিত।